শ্রীমতী হরতনী টেক্কার প্রবেশ
হরতনী।
গান
আমি ফুল তুলিতে এলেম বনে,
জানি নে কী ছিল মনে।
এ তো ফুল তোলা নয়, এ তো ফুল তোলা নয়,
বুঝি নে কী মনে হয়,
জল ভরে যায় দু নয়নে॥
রুইতনের সাহেবের প্রবেশ
রুইতন।
এ কী, হরতনী তুমি এখানে? খুঁজতে খুঁজতে বেলা হয়ে গেল যে।
হরতনী।
কেন, কী হয়েছে, কী চাই।
রুইতন।
তোমাকে ডাক পড়েছে রাজসভার গরাবুমণ্ডলে।
হরতনী।
বলো গে, আমি হারিয়ে গেছি।
রুইতন।
হারিয়ে গেছ?
হরতনী।
হাঁ, হারিয়ে গেছি, যাকে খুঁজছ তাকে আর খুঁজে পাবে না, কোনোদিনই।
রুইতন।
এ কী কাণ্ড। এ কী দুঃসাহস। এই বনে এসেছ তুমি? জান না--নিয়ম নেই?
হরতনী।
নিয়ম তো নেই, কিন্তু কার নিয়মে বর্ষাবিহীন তাসের দেশে আজ এমন ঘনঘটা। হঠাৎ সকালে উঠেই দেখি, নীল মেঘ আকাশ জুড়ে। এতদিন তোমাদের দেশের ময়ূর গুনে গুনে পা ফেলত, নাচত সাবধানে, আজ কেন এমন অনিয়মের নাচ নাচল, সমস্ত পেখম ছড়িয়ে দিয়ে।
রুইতন।
কিন্তু, ঘর হতে যার আঙিনা বিদেশ, সেও আজ ফুল তুলতে বেরিয়েছে--এতবড়ো অদ্ভূত কাজ তোমার মাথায় এল কী করে।
হরতনী।
হঠাৎ মনে হল, আমি মালিনী, আর-জন্মে ফুল তুলতেম। আজ পুবে হাওয়ায় সেই জন্মের ফুলবাগানের গন্ধ এল। সেই জন্মের মাধবীবন থেকে ভ্রমর এসেছে মনের মধ্যে।
গান
ঘরেতে ভ্রমর এল গুন্গুনিয়ে।
আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে।
আলোতে কোন্ গগনে মাধবী জাগল বনে,
এল সেই ফুল-জাগানোর খবর নিয়ে।
সারাদিন সেই কথা সে যায় শুনিয়ে।
কেমনে রহি ঘরে, মন যে কেমন করে,
কেমনে কাটে যে দিন দিন গুনিয়ে।
কী মায়া দেয় বুলায়ে, দিল সব কাজ ভুলায়ে,
বেলা যায় গানের সুরে জাল বুনিয়ে॥
রুইতন।
আচ্ছা, গরাবুমণ্ডলের জন্যে বিবিসুন্দরীদের খুঁজে বেড়াচ্ছি, তারাও কি তবে--
হরতনী।
হাঁ, তারাও এইখানেই, নদীর ধারে ধারে, গাছের তলায় তলায়।
রুইতন।
কী করছে।
হরতনী।
সাজ বদল করছে, আমারই মতো। কেমন দেখাচ্ছে। পছন্দ হয়?
রুইতন।
মনে হচ্ছে, পর্দা খুলে গেছে, চাঁদের থেকে মেঘ গেছে সরে, একেবারে নতুন মানুষ।
হরতনী।
তোমাদের ছক্কা পঞ্জা আমাদের শাসাবার জন্যে এসেছিলেন, তাঁদের কী দশা হয়েছে দেখো গে যাও।
রুইতন।
কেন। কী হল।
হরতনী।
খ্যাপার মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছে, এমন-কি গুন্-গুন্ করে গানও করছে।
রুইতন।
গান! ছক্কা-পঞ্জার গান!
হরতনী।
সুরে না হোক, বেসুরে। আমি তখন চুল বাঁধছিলুম। থাকতে পারলুম না, চলে আসতে হল।
রুইতন।
আশ্চর্য করলে। চুল বাঁধা। এ বিদ্যে কে শেখালে।
হরতনী।
কেউ না। ঐ দেখো-না, এবার হঠাৎ শুকনো ঝরনায় নামল বর্ষা। জলের ধারায় ধারায় শুরু হল বেণীবন্ধন। এ বিদ্যা কে শেখাল তাকে। চলো। আমার সঙ্গে, ছক্কা-পঞ্জার গান শুনিয়ে দিই তোমাকে।
[প্রস্থান
[প্রস্থান
বিবিদের প্রবেশ
বিবিদের প্রবেশ
বিবিরা।
নাচ ও গান
অজানা সুর কে দিয়ে যায় কানে কানে,
ভাবনা আমার যায় ভেসে যায় গানে গানে।
বিস্মৃত জন্মের ছায়ালোকে
হারিয়ে-যাওয়া বীণার শোকে
কেঁদে ফিরে পথহারা রাগিণী।
কোন্ বসন্তের মিলনরাতে তারার পানে
ভাবনা আমার যায় ভেসে যায় গানে গানে॥
[প্রস্থান
[প্রস্থান
রুইতন।
দোষ দেব কাকে। আমারই গাইতে ইচ্ছা করছে।
হরতনী।
দেখো, সম্পাদক যেন শুনতে না পায়, স্তম্ভে চড়াবে। সে দেখলুম ঘুরে বেড়াচ্ছে এই বনের খবর নিতে।
রুইতন।
দেখো, হরতনী, ভয় কিন্তু আমার গেছে ঘুচে, কেন কী জানি। একটা কিছু হুকুম করো, তোমার জন্যে দুঃসাধ্য কিছু একটা করতে চাই।
হরতনী।
আর যাই কর গান গেয়ো না, বনে জবা ফুটেছে, তুলে এনে দাও। ফুলের রস দিয়ে রাঙাব পায়ের তলা।
রুইতন।
দেখো, সুন্দরী, আজ সকালে উঠেই বুঝেছি, আমাদের এই তাসজন্মটা স্বপ্ন। সেটা হঠাৎ ভাঙল। আমাদের আর-এক জন্ম বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। তারই বাণী আসছে মুখে, তারই গান শুনছি কানে। ঐ শোনো, ঐ শোনো, আমার সেই যুগের রচিত গান আকাশ থেকে ঐ কে বয়ে আনছে।
গান
তোমার পায়ের তলায় যেন গো রঙ লাগে,
আমার মনের বনের ফুলের রাঙা রাগে।
যেন আমার গানের তানে
তোমায় ভূষণ পরাই কানে,
যেন রক্তমণির হার গেঁথে দিই প্রাণের অনুরাগে॥
হরতনী।
এ গান কোনোদিন তুমিই বেঁধেছিলে, আর আমারই জন্যে? কেমন ক'রে বাঁধলে।
রুইতন।
যেমন করে তুমি বাঁধলে বেণী।
হরতনী।
আচ্ছা, মনে কি আসছে, তোমার গানে আমি নেচেছিলুম কোনো-একটা যুগে।
রুইতন।
মনে আসছে, আসছে। এতদিন ভুলে ছিলুম কী করে তাই ভাবি।
গান
উতল হাওয়া লাগল আমার গানের তরণীতে।
দোলা লাগে, দোলা লাগে
তোমার চঞ্চল ওই নাচের লহরীতে।
যদি কাটে রশি,
যদি হাল পড়ে খসি,
যদি ঢেউ উঠে উচ্ছ্বসি,
সম্মুখেতে মরণ যদি জাগে,
করি নে ভয়, নেবই তারে নেবই তারে জিতে॥
রুইতন।
দেখো হরতনী, মন ছট্ফটিয়ে উঠেছে যমরাজের সঙ্গে পাল্লা দিতে। আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ছবি, তুমি পরিয়ে দিলে আমার কপালে জয়তিলক, আমি বেরলুম বন্দিনীকে উদ্ধার করতে, বন্ধ দুর্গের দ্বারে বাজালুম আমার ভেরী। কানে আসছে বিদায়কালে যে গান তুমি গেয়েছিলে।
গান
বিজয়মালা এনো আমার লাগি।
দীর্ঘ রাত্রি রইব আমি জাগি।
চরণ যখন পড়বে তোমার মরণকুলে
বুকের মধ্যে উঠবে আমার পরান দুলে,
সব যদি যায় হব তোমার সর্বনাশের ভাগী।
হরতনী।
চলো চলো, বীর, মরণ পণ করে বেরিয়ে পড়ি দুজনে মিলে। দেখতে পাচ্ছি যে, সামনে কী যেন কালো পাথরের ভ্রূকুটি, ভেঙে চুরমার করতে হবে। ভেঙে মাথায় যদি পড়ে পড়ুক। পথ কাটতে হবে পাহাড়ের বুক ফাটিয়ে দিয়ে। কী করতে এসেছি এখানে। ছি ছি, কেন আছি এখানে। একি অর্থহীন দিন, কী প্রাণহীন রাত্রি। কী ব্যর্থতার আবর্তন মুহূর্তে মুহূর্তে।
রুইতন।
সাহস আছে তোমার, সুন্দরী?
হরতনী।
আছে, আছে।
রুইতন।
অজানাকে ভয় করবে না?
হরতনী।
না, করব না।
রুইতন।
পা যাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে, পথ ফুরোতে চাইবে না।
হরতনী।
কোন্ যুগে আমরা চলেছিলুম সেই দুর্গমে। রাত্রে ধরেছি মশাল তোমার সামনে, দিনে বয়েছি জয়ধ্বজা তোমার আগে আগে। আজ আর-একবার উঠে দাঁড়াও, ভাঙতে হবে এখানে এই অলসের বেড়া, এই নির্জীবের গণ্ডি, ঠেলে ফেলতে হবে এই-সব নিরর্থকের আবর্জনা।
রুইতন।
ছিড়ে ফেলো আবরণ, টুকরো টুকরো ক'রে ছিঁড়ে ফেলো। মুক্ত হও, শুদ্ধ হও, পূর্ণ হও।
[প্রস্থান
[প্রস্থান
ছক্কা-পঞ্জার প্রবেশ।
ছক্কা।
ওহে পঞ্জা, কী হলো বলো দেখি।
পঞ্জা।
ভারি লজ্জা হচ্ছে নিজের দিকে তাকিয়ে। মূঢ়, মূঢ়! কী করছিলি এতদিন।
ছক্কা।
এতদিন পরে কেন মনে প্রশ্ন জাগছে, এ-সমস্তর অর্থ কী।
পঞ্জা।
ঐ-যে দহলা পণ্ডিত আসছেন, ওঁকে জিজ্ঞাসা করি।
দহলার প্রবেশ
দহলার প্রবেশ
ছক্কা।
এতকাল যে-সব ওঠাপড়া-শোওয়াবসার কোট্কেনা নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলুম তার অর্থ কী।
দহলা।
চুপ।
ছক্কা-পঞ্জা।
(উভয়ে) করব না চুপ।
দহলা।
ভয় নেই?
ছক্কা-পঞ্জা।
(উভয়ে) নেই ভয়, বলতে হবে অর্থ কী।
দহলা।
অর্থ নেই--নিয়ম।
ছক্কা।
নিয়ম যদি নাই মানি?
দহলা।
অধঃপাতে যাবে।
ছক্কা।
যাব সেই অধঃপাতেই।
দহলা।
কী করতে।
পঞ্জা।
সেখানে যদি অগৌরব থাকে তার সঙ্গে লড়াই করতে।
দহলা।
এ কেমন গোঁয়ারের কথা শান্তিপ্রিয় দেশে!
পঞ্জা।
শান্তিভঙ্গ করব পণ করেছি।
হরতনীর প্রবেশ
হরতনীর প্রবেশ
দহলা।
শুনছ, শ্রীমতী হরতনী? এরা শান্তি ভাঙতে চায় আমাদের এই অতলস্পর্শ প্রশান্তমহাসাগরের ধারে।
হরতনী।
আমাদের শান্তিটা বুড়ো গাছে মতো। পোকা লেগেছে ভিতরে ভিতরে, সেটা নির্জীব, তাকে কেটে ফেলা চাই।
দহলা।
ছি ছি ছি ছি, এমন কথা তোমার মুখে বেরোল! তুমি নারী, রক্ষা করবে শান্তি; আমরা পুরুষ রক্ষা করব কৃষ্টি।
হরতনী।
অনেকদিন তোমরা আমাদের ভুলিয়েছ, পণ্ডিত। আর নয়, তোমাদের শান্তিরসে হিম হয়ে জমে গেছে আমাদের রক্ত, আর ভুলিয়ো না।
দহলা।
সর্বনাশ! কার কাছ থেকে পেলে এ-সব কথা।
হরতনী।
মনে মনে তাকেই তো ডাকছি। আকাশে শুনতে পাচ্ছি তারই গান।
দহলা।
সর্বনাশ। আকশে গান! এবার মজল তাসের দেশ। আর এখানে নয়।
[প্রস্থান
[প্রস্থান
ছক্কা।
সুন্দরী, তুমিই আমাদের পথ দেখাও।
পঞ্জা।
অশান্তিমন্ত্র পেয়েছ তুমি, সেই মন্ত্র দাও আমাদের।
হরতনী।
বিধাতার ধিক্কারের মধ্যে আছি আমরা, মূঢ়তার অপমানে। চলো, বেরিয়ে পড়ি।
ছক্কা।
একটু নড়লেই যে ওরা দোষ ধরে, বলে "অশুচি'।
হরতনী।
দোষ হয় হোক, কিন্তু মরে থাকার মতো অশুচিতা নেই।
[প্রস্থান
[প্রস্থান
ইস্কাবনী ও টেক্কানী ফুল তুলছে
ইস্কাবনী ও টেক্কানী ফুল তুলছে
টেক্কানী।
ঐ-রে, দহলানী এসেছে। আর রক্ষে নেই।
দহলানীর প্রবেশ
দহলানীর প্রবেশ
দহলানী।
লুকোচ্ছ কোথায়। কে গো, চেনা যায় না যে! এ-যে আমাদের টেক্কানী। আর, উনি কে, উনি যে আমাদের ইস্কাবনী। মরে যাই। কী ছিরি করেছ! মানুষ সেজেছ বুঝি? লজ্জা নেই?
টেক্কানী।
সাজি নি, দৈবাৎ সাজ খসে পড়েছে।
দহলানী।
তাসের দেশের বন্ধন আঁট বন্ধন--হাজার বছরের হাজার গিরে দেওয়া খসে পড়ল? কাণ্ডটা ঘটল কী ক'রে।
ইস্কাবনী।
একটা হাওয়া দিয়েছিল।
দহলানী।
ওমা, কী বলো গো। তাসের দেশের হাওয়ায় বাঁধন ছেঁড়ে! আমাদের পবনদেবের নামে এত বড়ো বদনাম। বলি, এ কি মেলেচ্ছ দেশ পেয়েছ, যেখানে একটু হাওয়া দিলেই গাছের শুকনো পাতা খসে উড়ে যায়।
ইস্কাবনী।
স্বচক্ষেই দেখো-না, দিদি, কী বদল ঘটিয়েছেন আমাদের পবনদেব!
দহলানী।
দেখো, ছোটো মুখে বড়ো কথা ভাল নয়। আমাদের সনাতন পবনদেব! তবে কিনা পুঁথিতে লিখছে তাঁর এক মহাবীর পুত্র আছেন, তিনি নাকি লম্বা লম্বা লম্ফ দিয়ে বেড়ান। হয়তো বা তিনিই ভর করেছেন তোমাদের 'পরে।
টেক্কানী।
কেবল আমাদের খোঁটা দিচ্ছ কেন। এখনো চোখে বুঝি পড়ে নি? তিনি যে লম্ফ লাগিয়েছেন তাসের দেশময়। তাসিনীদের বুকে আগুন লাগিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ইস্কাবনী।
সাগরপারের মানুষরা বলছে, তিনিই নাকি ওদের পূর্বপুরুষ।
দহলানী।
হতে পারে--ওরা লাফ-মারা-বংশেরই সন্তান।
টেক্কানী।
আচ্ছা, সত্যি কথা বলো দিদি--ভিতরে ভিতরে তোমারও মন চঞ্চল হয়েছে? না, চুপ ক'রে থাকলে চলবে না।
দহলানী।
কাউকে ব'লে দিবি নে তো?
টেক্কানী।
তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, কাউকে বলব না।
দহলানী।
কাল ভোর রাত্তিরের ঘুমে স্বপ্ন দেখলুম, হঠাৎ মানুষ হয়ে গেছি, নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছি ঠিক ওদেরই মতো। জেগে উঠে লজ্জায় মরি আর কি। কিন্তু--
টেক্কানী।
কিন্তু কী।
দহলানী।
সে কথা থাক্ গে।
ইস্কাবনী।
বুঝেছি, বুঝেছি, দিনের বেলাকার বাঁধা পাখি খোলা পেয়েছিল স্বপ্নে।
দহলানী।
চুপ চুপ চুপ, নহলাপণ্ডিত শুনলে স্বপ্নেরও প্রায়শ্চিত্ত লাগিয়ে দেবে। ওটা পাপ যে। কিন্তু, স্বপ্নে কী ফুর্তি।
টেক্কানী।
যা বলিস, ভাই, তাসের দেশে সাগরপারের হাওয়া দিয়েছে খুব জোরে। কিছু যেন ধরে রাখতে পারছি নে, সব দিচ্ছে উড়িয়ে।
দহলানী।
তা হোক, এখনো কিন্তু কিছু উড়ল, কিছু রইল বাকি। মাথার ঘোমটা যদি বা খসল, পায়ের বাঁক-মল তো সোজা করতে পারল না।
ইস্কাবনী।
সত্যি বলেছিস, মনটা সমুদ্রের এপারে ওপারে দোলাদুলি করছে। ঐ দেখ্-না, চিঁড়েতনীর মানুষ হবার অসহ্য শখ, পারে না, তাই মানুষের মুখোশ পরেছে--সেটা তাসমহলেরই কারখানাঘরে তৈরি। কী অদ্ভুত দেখতে হয়েছে।
দহলানী।
আমাদের কাকে কী রকম দেখতে হয়েছে নিজেরা বুঝতেই পারি নে। গাছের আড়াল থেকে কাল শুনলুম, সদাগরের পুত্তুর বলছিল, এরা যে মানুষের সঙ সাজছে।
টেক্কানী।
ওমা, কী লজ্জা। রাজপুত্তুর কী বললেন।
দহলানী।
তিনি রেগে উঠে বললেন, সে তো ভালোই--সাজের ভিতর দিয়ে রুচি দেখা দিল। তিনি বললেন, এ দেখে হেসো না, হাসতে চাও তো যাও তাদের কাছে মানুষের মধ্যে যারা তাসের সঙ সেজে বেড়ায়।
ইস্কাবনী।
ওমা, তাও কি ঘটে নাক। মানুষ হয়ে তাসের নকল! আচ্ছা, কী করে তারা।
দহলানী।
রাজপুত্তুর বলছিলেন, তারা রঙের কাঠি বুলোয় ঠোঁটে, কালো বাতি দিয়ে আঁকে ভুরু, আরো কত কী, আমাদের রঙ-করা তাসেদেরই মতো। সব চেয়ে মজার কথা, ওরা খুরওয়ালা চামড়া লাগায় পায়ের তলায়।
টেক্কানী।
কেন।
দহলানী।
পদোন্নতি ঘটে, মাটিতে পা পড়ে না। এ-সমস্তই তাসের ঢঙ। এঁকে দেওয়া, সাজিয়ে দেওয়া কায়দা।
ইস্কাবনী।
এ তো দেখি পবনদেবের উলটোপালটা খেলা--তাসীরা হতে চায় রঙ খসিয়ে মানুষ, মানুষ চায় রঙ মেখে তাসী হতে। আমি কিন্তু, ভাই, ঠিক করেছি, মানুষের মন্তর নেব রাজপুত্তুরের কাছে।
টেক্কানী।
আমিও।
দহলানী।
আমারও ইচ্ছে করে, কিন্তু ভয়ও করে। শুনেছি মানুষের দুঃখ ঢের, তাসের কোনো বালাই নেই।
ইস্কাবনী।
দুঃখের কথা বলছিস, ভাই? দুঃখ যে এখনি শুরু করেছে তার নৃত্য বুকের মধ্যে।
টেক্কানী।
কিন্তু, সেই দুঃখের নেশা ছাড়তে চাই নে। থেকে থেকে চোখ জলে ভেসে যায়, কেন যে ভেবেই পাই নে।
গান
কেন নয়ন আপনি ভেসে যায়,
মন কেন এমন করে--
যেন সহসা কী কথা মনে পড়ে,
মনে পড়ে না গো, তবু মনে পড়ে।
যেন কাহার বচন দিয়েছে বেদন,
যেন কে চলে গিয়েছে অনাদরে--
বাজে তারি অযতন প্রাণের 'পরে।
যেন সহসা কী কথা মনে পড়ে,
মনে পড়ে না গো, তবু মনে পড়ে॥
ইস্কাবনী।
পালাও পালাও, সম্পাদক আসছে। কাগজে যদি রটে যায় তা হলে মুখ দেখাতে পারব না।
দহলানী।
ঐ-যে দলবল সবাই আসছে। বুড়োনিমতলায় আজ সভা বসবে। এখানে আর নয়।
[প্রস্থান
[প্রস্থান
রাজাসাহেব প্রভৃতির প্রবেশ
রাজাসাহেব প্রভৃতির প্রবেশ
রাজা।
এ জায়গাটা কেমন ঠেকছে। ওটা কিসের গন্ধ।
পঞ্জা।
কদম্বের।
রাজা।
কদম্ব! অদ্ভুত নাম। ওটা কী পাখি ডাকছে।
পঞ্জা।
শুনেছি, ওকে বলে ঘুঘু।
রাজা।
ঘুঘু! তাসের ভাষায় ওকে একটা ভদ্র নাম দাও, বলো বিন্তি।--আজ তো কাজ করা দায় হয়েছে। আজ আকাশে কথা শোনা যাচ্ছে, বাতাসে সুর উঠেছে। অনেক কষ্টে মনকে শান্ত রেখেছি। রানীবিবিকে তো ঘরে রাখা শক্ত হল, নেচে বেড়াচ্ছে ভূতে-পাওয়ার মতো। সভ্যগণ, তোমাদের আজ চেনা যায় না--সভার সাজ নেই, অত্যন্ত অসভ্যের মতো।
সকলে।
দোষ নেই। ঢিলে হয়ে গেল আমাদের সাজ, আপনি পড়ল খসে--সেগুলো রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে আছে।
রাজা।
সম্পাদক, তোমারও যেন গাম্ভীর্যহানি হয়েছে বলে বোধ হচ্ছে।
গোলাম।
সকাল থেকে আছি বনে, পলাতকাদের নাম সংগ্রহ করার জন্যে। এখানকার হাওয়া লেগেছে। সম্পাদকীয় স্তম্ভ ভরাতে গিয়ে দেখি, লেখনী দিয়ে ছন্দ ঝরছে। শুনেছি, আধুনিক ডাক্তার এইরকম নিঃসারণকেই বলে ইন্ফুলুয়েঞ্জা।
রাজা।
কী রকম, একটা নমুনা দেখি।
গোলাম।
যে দেশে বায়ু না মানে
বাধ্যতামূলক বিধি,
সে দেশে দহলা তত্ত্বনিধি
কেমনে করিবে রক্ষা কৃষ্টি--
সে দেশে নিশ্চিত অনাসৃষ্টি॥
রাজা।
থাক্, আর প্রয়োজন নেই। এটা চতুর্থবর্গের পাঠ্য পুস্তকে চালিয়ে দিয়ো। তাসবংশীয় শিশুরা কণ্ঠস্থ করুক।
ছক্কা।
রাজাসাহেব, তোমার চতুর্থবর্গের শিশুবিভাগের ছাত্র নই আমরা। আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে, আমাদের বয়স হয়েছে। ও ছন্দ মনে লাগছে না।
পঞ্জা।
ওগো বিদেশী, সমুদ্রের ওপারের ছন্দ আমাদের কানে দিতে পার?
রাজপুত্র।
পারি, তবে শোনো।
গানগগনে গগনে যায় হাঁকি
বিদ্যুৎবাণী বজ্রবাহিনী বৈশাখী,
স্পর্ধাবেগের ছন্দ জাগায়
বনস্পতির শাখাতে।
শূন্যমদের নেশায় মাতাল ধায় পাখি,
অচিন পথের ছন্দ উড়ায়
মুক্ত বেগের পাখাতে।
অন্তরতল মন্থন করে ছন্দে
সাদার কালোর দ্বন্দ্বে,
নানা ভালো নানা মন্দে,
নানা সোজা নানা বাঁকাতে।
ছন্দ নাচিল হোমবহ্নির তরঙ্গে,
মুক্তিরণের যোদ্ধৃবীরের ভ্রূভঙ্গে,
ছন্দ ছুটিল প্রলয়পথের
রুদ্ররথের চাকাতে॥
রাজা।
কিছু বুঝলে তোমরা?
তাসের দল।
কিছুই না।
রাজা।
তবে?
তাসের দল।
মন মেতে উঠল।
রাজা।
সেটা তো ভালো নয়। আমাদের সনাতন শাস্ত্রের ছন্দ একটা শোনো--
শান্ত যেই জন
যম তারে ঠেলে ঠেলে
নেড়েচেড়ে যায় ফেলে;
বলে, "মোর নাহি প্রয়োজন।"
শোনো বিদেশী।
রাজপুত্র।
আদেশ করো।
রাজা।
তোমরা যে তাসদ্বীপময় অস্থির হয়ে বেড়াচ্ছ--জলে দিচ্ছ ডুব, চড়ছ পাহাড়ের মাথায়, কুড়ুল হাতে বনে কাটছ পথ--এ-সব কেন।
রাজপুত্র।
রাজাসাহেব, তোমরা যে কেবলই উঠছ বসছ, পাশ ফিরছ, পিঠ ফেরাচ্ছ, গড়াচ্ছ মাটিতে, সেই বা কেন।
রাজা।
সে আমাদের নিয়ম।
রাজপুত্র।
এ আমাদের ইচ্ছে।
রাজা।
ইচ্ছে? কী সর্বনাশ! এই তাসের দেশে ইচ্ছে! বন্ধুগণ, তোমরা সবাই কী বল।
ছক্কা-পঞ্জা।
আমরা ওর কাছে ইচ্ছেমন্ত্র নিয়েছি।
রাজা।
কী মন্ত্র!
ছক্কা-পঞ্জা।
গান
ইচ্ছে।
সেই তো ভাঙছে, সেই তো গড়ছে,
সেই তো দিচ্ছে নিচ্ছে।
সেই তো আঘাত করছে তালায়,
সেই তো বাঁধন ছিঁড়ে পালায়,
বাঁধন পরতে সেই তো আবার ফিরছে॥
রাজা।
যাও, যাও, এখান থেকে চলে যাও, শীঘ্র চলে যাও। হরতনী, কানে পৌঁছল না কথাটা? চিঁড়েতনী, দেখছ ওর ব্যবহারটা? হঠাৎ এমন হল কেন।
হরতনী।
ইচ্ছে।
অন্য টেক্কারা।
ইচ্ছে।
রাজা।
ও কী রানীবিবি, তাড়াতাড়ি উঠে পড়লে যে।
রানী।
আর বসে থাকতে পারছি নে।
রাজা।
রানীবিব, সন্দেহ হচ্ছে, তোমার মন বিচলিত হয়েছে।
রানী।
সন্দেহ নেই, বিচলিত হয়েছে।
রাজা।
জান? চাঞ্চল্য তাসের দেশে সব চেয়ে বড়ো অপরাধ।
রানী।
জানি, আর এও জানি, এই অপরাধটাই সব চেয়ে বড়ো সম্ভোগের জিনিস।
রাজা।
শাস্তির জিনিসকে তুমি বললে ভোগের জিনিস, তাসের দেশের ভাষাও ভুলে গেছ?
রানী।
আমাদের তাসের দেশের ভাষায় শিকলকে বলে অলংকার, এ ভাষা ভোলবার সময় এসেছে।
রুইতন।
হাঁ বিবিরানী, এদের ভাষায় জেলখানাকে বলে শ্বশুরবাড়ি।
রাজা।
চুপ।
হরতনী।
এরা হেঁয়ালীকে বলে শাস্তর।
রাজা।
চুপ।
হরতনী।
বোবাকে বলে সাধু।
রাজা।
চুপ।
হরতনী।
বোকাকে বলে পণ্ডিত।
রাজা।
চুপ।
পঞ্জা।
এরা মরাকে বলে বাঁচা।
রাজা।
চুপ।
রানী।
আর, স্বর্গকে বলে অপরাধ। বলো তোমরা, জয় ইচ্ছের জয়।
সকলে।
জয় ইচ্ছের জয়।
রাজা।
রানীবিবি, তোমার বনবাস!
রানী।
বাঁচি তা হলে।
রাজা।
নির্বাসন!--ও কী, চললে যে! কোথায় চললে।
রানী।
নির্বাসনে।
রাজা।
আমাকে ফেলে রেখে যাবে?
রানী।
ফেলে রেখে যাব কেন।
রাজা।
তবে?
রানী।
সঙ্গে নিয়ে যাব তোমাকে।
রাজা।
কোথায়।
রানী।
নির্বাসনে।
রাজা।
আর এরা, আমার প্রজারা?
সকলে।
যাব নির্বাসনে।
রাজা।
দহলাপণ্ডিত কী মনে করছ।
দহলা।
নির্বাসনটা ভালোই মনে করছি।
রাজা।
আর, তোমার পুঁথিগুলো?
দহলা।
ভাসিয়ে দেব জলে।
রাজা।
বাধ্যতামূলক আইন?
দহলা।
আর চলবে না।
সকলে।
চলবে না, চলবে না।
রানী।
কোথায় গেল সেই মানুষরা।
রাজপুত্র।
এই-যে আছি আমরা।
রানী।
মানুষ হতে পারব আমরা?
রাজপুত্র।
পারবে, নিশ্চয় পারবে।
রাজা।
ওগো বিদেশী, আমিও কি পারব।
রাজপুত্র।
সন্দেহ করি। কিন্তু, রানী আছেন তোমার সহায়। জয় রানীর।
সকলের গান
সকলের গান
বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও,
বাঁধ ভেঙে দাও।
বন্দী প্রাণমন হোক উধাও।
শুকনো গাঙে আসুক
জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক;
ভাঙনের জয়গান গাও।
জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক,
যাক ভেসে যাক, যাক ভেসে যাক।
আমরা শুনেছি ওই
মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ
কোন্ নূতনেরি ডাক।
ভয় করি না অজানারে,
রুদ্ধ তাহারি দ্বারে
দুর্দাড় বেগে ধাও॥
১৪। ১। ৩৯ শান্তিনিকেতন