রাজোদ্যান

রাজোদ্যান

মালতী।

দিদি, শান্তি পাচ্ছিনে।

শ্রীমতী।

কী হয়েছে।

মালতী।

তোমাকে যখন ওরা নাচের সাজ করাতে নিয়ে গেল আমি চুপি চুপি ওই প্রাচীরের কাছে গিয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে দেখলেম। দেখি ভিক্ষুণী উৎপলপর্ণার মৃতদেহ নিয়ে চলেছে আর,--

শ্রীমতী।

থামলে কেন? বলো।

মালতী।

রাগ করবে না দিদি? আমি বড়ো দুর্বল।

শ্রীমতী।

কিছুতেই না।

মালতী।

দেখলেম অন্ত্যেষ্টিমন্ত্র পড়তে পড়তে শবদেহের সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছিলেন।

শ্রীমতী।

কে যাচ্ছিলেন?

মালতী।

দূর থেকে মনে হল যেন তিনি।

শ্রীমতী।

অসম্ভব নেই।

মালতী।

পণ করেছিলেম, মুক্তি যতদিন না পাই তাঁকে দূর থেকেও দেখব না।

শ্রীমতী।

রক্ষা করিস সেই পণ। সমুদ্রের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে থাকলেই তো পার দেখা যায় না। দুরাশায় মনকে প্রশ্রয় দিসনে।

মালতী।

তাঁকে দেখবার আশায় মনকে আকুল করছি মনে ক'রো না। ভয় হচ্ছে ওঁকে তারা মারবে তাই কাছে থাকতে চাই। পণ রাখতে পারছিনে বলে আমাকে অবজ্ঞা ক'রো না দিদি।

শ্রীমতী।

আমি কি তোর ব্যথা বুঝিনে?

মালতী।

তাঁকে বাঁচাতে পারব না কিন্তু মরতে তো পারব। আর পারলুম না দিদি, এবারকার মতো সব ভেঙে গেল। এ-জীবনে হবে না মুক্তি।

শ্রীমতী।

যাঁর কাছে যাচ্ছিস তিনিই তোকে মুক্তি দিতে পারেন। কেননা তিনি মুক্ত। তোর কথা শুনে আজ একটা কথা বুঝতে পারলুম।

মালতী।

কী বুঝলে দিদি?

শ্রীমতী।

এখনো আমার মনের মধ্যে পুরানো ক্ষত চাপা আছে সে আবার ব্যথিয়ে উঠল। বন্ধনকে বাইরে থেকে যতই তাড়া করেছি ততই সে ভিতরে গিয়ে লুকিয়েছে।

মালতী।

রাজবাড়িতে তোমার মতো একলা মানুষ আর কেউ নেই তাই তোমাকে ছেড়ে যেতে বড়ো কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু যেতে হল। যখন সময় পাবে আমার জন্যে ক্ষমার মন্ত্র প'ড়ো।

শ্রীমতী।

বুদ্ধে যো খলিতো দোসো, বুদ্ধো খমতু তং মম।

মালতী।

(প্রণাম করিতে করিতে) "বুদ্ধো খমতু তং মম।' যাবার মুখে একটা গান শুনিয়ে দাও। তোমার ওই মুক্তির গানে আজ একটুও মন দিতে পারব না। একটা পথের গান গাও।

শ্রীমতীর গান

শ্রীমতীর গান

পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে।

পিছিয়ে পড়েছি আমি যাব যে কী করে!

এসেছে নিবিড় নিশি

পথরেখা গেছে মিশি',

সাড়া দাও, সাড়া দাও আঁধারের ঘোরে।

ভয় হয় পাছে ঘুরে ঘুরে

যত আমি যাই তত যাই চলে দূরে।

মনে করি আছ কাছে,

তবু ভয় হয় পাছে

আমি আছি তুমি নাই কালি নিশিভোরে।

মালতী।

শোনো দিদি, আবার গর্জন। দয়া নেই, কারো দয়া নেই। অনন্তকারুণিক বুদ্ধ তো এই পৃথিবীতেই পা দিয়েছেন তবু এখানে নরকের শিখা নিবল না। আর দেরি করতে পারিনে। প্রণাম, দিদি। মুক্তি যখন পাবে আমাকে একবার ডাক দিয়ো, একবার শেষ চেষ্টা করে দেখো।

শ্রীমতী।

চল্‌, তোকে প্রাচীরদ্বার পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়ে আসিগে।

[ উভয়ের প্রস্থান

[ উভয়ের প্রস্থান

রত্নাবলী ও মল্লিকার প্রবেশ

রত্নাবলী ও মল্লিকার প্রবেশ

রত্নাবলী।

দেবদত্তের শিষ্যেরা ভিক্ষুণীকে মেরেছে। তা নিয়ে এত ভাবনা কিসের? ও তো ছিল সেই ক্ষেত্রপালের মেয়ে।

মল্লিকা।

কিন্তু আজ যে ও ভিক্ষুণী।

রত্নাবলী।

মন্ত্র পড়ে কি রক্ত বদল হয়?

মল্লিকা।

আজকাল তো দেখছি মন্ত্রের বদল রক্তের বদলের চেয়ে ঢের বড়ো।

রত্নাবলী।

রেখে দে ও-সব কথা। প্রজারা উত্তেজিত হয়েছে বলে রাজার ভাবনা! এ আমি সইতে পারিনে। তোমার ভিক্ষুধর্ম রাজধর্মকে নষ্ট করছে।

মল্লিকা।

উত্তেজনার আরও একটু কারণ আছে। মহারাজ বিম্বিসার পূজার জন্য যাত্রা করে বেরিয়েছেন কিন্তু এখনো পৌঁছননি, প্রজারা সন্দেহ করছে।

রত্নাবলী।

কানাকানি চলছে আমিও শুনেছি। ব্যাপারটা ভালো নয় তা মানি। কিন্তু কর্মফলের মূর্তি হাতে হাতে দেখা গেল।

মল্লিকা।

কী কর্মফল দেখলে?

রত্নাবলী।

মহারাজ বিম্বিসার পিতার বৈদিক ধর্মকে বিনাশ করেছেন। সে কি পিতৃহত্যার চেয়ে বেশি নয়? ব্রাহ্মণরা তো তখন থেকেই বলছে, যে যজ্ঞের আগুন উনি নিবিয়েছেন সেই ক্ষুধিত আগুন একদিন ওঁকে খাবে।

মল্লিকা।

চুপ চুপ, আস্তে। জান তো, অভিশাপের ভয়ে উনি কী রকম অবসন্ন হয়ে পড়েছেন।

রত্নাবলী।

কার অভিশাপ?

মল্লিকা।

বুদ্ধের। মনে মনে মহারাজ ওঁকে ভারি ভয় করেন।

রত্নাবলী।

বুদ্ধ তো কাউকে অভিশাপ দেন না। অভিশাপ দিতে জানে দেবদত্ত।

মল্লিকা।

তাই তার এত মান। দয়ালু দেবতাকে মানুষ মুখের কথায় ফাঁকি দেয়, হিংসালু দেবতাকে দেয় দামি অর্ঘ্য।

রত্নাবলী।

যে-দেবতা হিংসা করতে জানে না, তাকে উপবাসী থাকতে হয়, নখদন্তহীন বৃদ্ধ সিংহের মতো।

মল্লিকা।

যাই হ'ক এই বলে যাচ্ছি, আজ সন্ধ্যাবেলায় ওই অশোকচৈত্যে পুজো হবেই।

রত্নাবলী।

তা হয় হোক, কিন্তু নাচ তার আগেই হবে এও আমি বলে দিচ্ছি।

[ মল্লিকার প্রস্থান

[ মল্লিকার প্রস্থান

বাসবীর প্রবেশ

বাসবীর প্রবেশ

বাসবী।

প্রস্তুত হয়ে এলেম।

রত্নাবলী।

কিসের জন্যে?

বাসবী।

শোধ তুলব বলে। অনেক লজ্জা দিয়েছে ওই নটী।

রত্নাবলী।

উপদেশ দিয়ে?

বাসবী।

না, ভক্তি করিয়ে।

রত্নাবলী।

তাই ছুরি হাতে এসেছ?

বাসবী।

সেজন্যে না। রাষ্ট্রবিপ্লবের আশঙ্কা ঘটেছে। বিপদে পড়ি তো নিরস্ত্র মরব না।

রত্নাবলী।

নটীর উপর শোধ তুলবে কী দিয়ে?

বাসবী।

(হার দেখাইয়া) এই হার দিয়ে।

রত্নাবলী।

তোমার হীরের হার!

বাসবী।

বহুমূল্য অবমাননা, রাজকুলের উপযুক্ত। ও নাচবে ওর গায়ে পুরস্কার ছুঁড়ে ফেলে দেব।

রত্নাবলী।

ও যদি তিরস্কার ক'রে ফিলে দেয় তোমার গায়ে। যদি না নেয়।

বাসবী।

(ছুরি দেখাইয়া) তখন এই আছে।

রত্নাবলী।

শীঘ্র ডেকে আনো মহারানী লোকেশ্বরীকে, তিনি খুব আমোদ পাবেন।

বাসবী।

আসবার সময় খুঁজেছিলেম তাঁকে। শুনলেম ঘরে দ্বার দিয়ে আছেন। একি রাষ্ট্রবিপ্লবের ভয়ে না স্বামীর 'পরে অভিমানে? বোঝা গেল না।

রত্নাবলী।

কিন্তু আজ হবে নটীর নতিনাট্য, তাতে মহারানীর উপস্থিত থাকা চাই।

বাসবী।

নটীর নতিনাট্য! নামটি বেশ বানিয়েছ।

মল্লিকার প্রবেশ

মল্লিকার প্রবেশ

মল্লিকা।

যা মনে করেছিলেম তাই ঘটেছে। রাজ্যে যেখানে যত বুদ্ধের শিষ্য আছে মহারাজ অজাতশত্রু সবাইকে ডাকতে দূত পাঠিয়েছেন। এমনি করে গ্রহপূজা চলছেই, কখনো বা শনিগ্রহ কখনো বা রবিগ্রহ।

রত্নাবলী।

ভালোই হয়েছে। বুদ্ধের সব-কটি শিষ্যকেই দেবদত্তের শিষ্যদের হাতে একসঙ্গে সমর্পণ করে দিন। তাতে সময়-সংক্ষেপ হবে।

মল্লিকা।

সেজন্যে নয়। ওরা রাজার হয়ে অহোরাত্র পাপমোচন মন্ত্র পড়তে আসছে। মহারাজ একেবারে অভিভূত হয়ে পড়েছেন।

বাসবী।

কেন এই দুর্বলতা?

মল্লিকা।

লোকে কি বলছে শোননি বুঝি? দেবদত্তের শিষ্যদের মহারাজ এখন আর নিজেই সামলাতে পারছেন না।

বাসবী।

তাতে কী হয়েছে?

মল্লিকা।

কী আশ্চর্য। এখনো জনশ্রুতি তোমার কানে পৌঁছয় নি! সবাই অনুমান করছে, পথের মধ্যে ওরা বিম্বিসার মহারাজকে হত্যা করেছে।

বাসবী।

সর্বনাশ। এ কখনো সত্য হতেই পারে না।

মল্লিকা।

কিন্তু এটা সত্য যে, মহারাজকে যেন আগুনের জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে। তিনি কোন্‌ একটা অনুশোচনায় ছটফট করে বেড়াচ্ছেন।

বাসবী।

হায়, হায়, এ কী সংবাদ।

রত্নাবলী।

লোকেশ্বরী মহারানী কি শুনেছেন?

মল্লিকা।

অপ্রিয় সংবাদ তাঁকে যে শোনাবে তাকে তিনি দুখানা করে ফেলবেন। কেউ সাহস পাচ্ছে না।

বাসবী।

সর্বনাশ হল। এতবড়ো পাপের আঘাত থেকে রাজবাড়ির কেউ বাঁচবে না। ধর্মকে নিয়ে যা খুশি করতে গেলে কি সহ্য হয়।

রত্নাবলী।

ওই রে! বাসবী আবার দেখছি নটীর চেলা হবার দিকে ঝুঁকছে। ভয়ের তাড়া খেলেই ধর্মের মূঢ়তার পিছনে মানুষ লুকোতে চেষ্টা করে।

বাসবী।

কখনো না। আমি কিছু ভয় করিনে। ভদ্রাকে এই খবরটা দিয়ে আসিগে।

রত্নাবলী।

মিথ্যা ছুতো করে পালিয়ো না। ভয় তুমি পেয়েছ। তোমাদের এই অবসাদ দেখলে আমার বড়ো লজ্জা করে। এ কেবল নীচসংসর্গের ফল।

বাসবী।

অন্যায় বলছ তুমি, আমি কিছুই ভয় করিনে।

রত্নাবলী।

আচ্ছা তাহলে অশোকবনে নাচ দেখতে চলো।

বাসবী।

কেন যাব না। তুমি ভাবছ আমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছ?

রত্নাবলী।

আর দেরি নয়, মল্লিকা, শ্রীমতীকে এখনই ডাকো, সাজ হ'ক বা না হ'ক। রাজকন্যারা যদি না আসতে চায় রাজকিংকরীদের সবাইকে চাই। নইলে কৌতুক অসম্পূর্ণ থাকবে।

বাসবী।

ওই যে শ্রীমতী আসছে। দেখো, দেখো, যেন চলছে স্বপ্নে। যেন মধ্যাহ্নের দীপ্ত মরীচিকা, ওর মধ্যে ও যেন একটুও নেই।

ধীরে ধীরে শ্রীমতীর প্রবেশ ও গান

ধীরে ধীরে শ্রীমতীর প্রবেশ ও গান

হে মহাজীবন, হে মহামরণ,

লইনু শরণ, লইনু শরণ।

আঁধার প্রদীপে জ্বালাও শিখা,

পরাও, পরাও জ্যোতির টিকা,

করো হে আমার লজ্জা হরণ।

রত্নাবলী।

এইদিকে পথ। আমাদের কথা কি কানে পৌঁছচ্ছে না? এই-যে এইদিকে।

শ্রীমতী।

পরশরতন তোমারি চরণ,

লইনু শরণ লইনু শরণ,

যা-কিছু মলিন, যা-কিছু কালো

যা-কিছু বিরূপ হোক তা ভালো,

ঘুচাও ঘুচাও সব আবরণ।

রত্নাবলী।

বাসবী, দাঁড়িয়ে রইলে কেন? চলো।

বাসবী।

না, আমি যাব না।

রত্নাবলী।

কেন যাবে না?

বাসবী।

তবে সত্য কথা বলি। আমি পারব না।

রত্নাবলী।

ভয় করছে?

বাসবী।

হাঁ, ভয় করছে।

রত্নাবলী।

ভয় করতে লজ্জা করছে না?

বাসবী।

একটুমাত্রও না। শ্রীমতী, সেই ক্ষমার মন্ত্রটা।

শ্রীমতী।

উত্তমঙ্গেন বন্দেহং পাদপংসু-বরুত্তমং

বুদ্ধে যো খলিতো দোসো বুদ্ধো খমতু তং মম।

বাসবী।

বুদ্ধো খমতু তং মম, বুদ্ধো খমতু তং মম,

বুদ্ধো খমতু তং মম।

শ্রীমতীর গান

শ্রীমতীর গান

হার মানালে, ভাঙিলে অভিমান।

ক্ষীণ হাতে জ্বালা

ম্লান দীপের থালা

হল খান খান।

এবার তবে জ্বালো

আপন তারার আলো,

রঙিন ছায়ার এই গোধূলি হ'ক অবসান।

এস পারের সাথি।

বইল পথের হাওয়া, নিবল ঘরের বাতি।

আজি বিজন বাটে,

অন্ধকারের ঘাটে

সব হারানো নাটে

এনেছি এই গান।

[ সকলের প্রস্থান

[ সকলের প্রস্থান

ভিক্ষুদের প্রবেশ ও গান

ভিক্ষুদের প্রবেশ ও গান

সকল কলুষ তামস হর,

জয় হ'ক তব জয়,

অমৃতবারি সিঞ্চন কর

নিখিল ভুবনময়।

মহাশান্তি মহাক্ষেম

মহাপুণ্য মহাপ্রেম।

জ্ঞানসূর্য-উদয়ভাতি

ধ্বংস করুক তিমির-রাতি।

দুঃসহ দুঃস্বপ্ন ঘাতি'

অপগত কর ভয়।

মহাশান্তি মহাক্ষেম

মহাপুণ্য মহাপ্রেম॥

মোহমলিন অতিদুর্দিন

শঙ্কিত চিত পান্থ,

জটিলগহন পথসংকট-

সংশয় উদ্‌ভ্রান্ত।

করুণাময়, মাগি শরণ--

দুর্গতিভয় করহ হরণ,

দাও দুঃখবন্ধতরণ

মুক্তির পরিচয়।

মহাশান্তি মহাক্ষেম

মহাপুণ্য মহাপ্রেম!
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6