অশোকতল। ভাঙা স্তূপ। ভগ্নপ্রায় আসনবেদি

রত্নাবলী। রাজকিংকরীগণ। একদল রক্ষিণী

অশোকতল। ভাঙা স্তূপ। ভগ্নপ্রায় আসনবেদি

রত্নাবলী। রাজকিংকরীগণ। একদল রক্ষিণী

প্রথম কিংকরী।

রাজকুমারী, আমাদর প্রাসাদের কাজে বিলম্ব হচ্ছে।

রত্নাবলী।

আর একটু অপেক্ষা করো। মহারানী লোকেশ্বরী স্বয়ং এসে দেখতে চান। তিনি না এলে নাচ আরম্ভ হতে পারে না।

দ্বিতীয় কিংকরী।

আপনার আদেশে এসেছি। কিন্তু অধর্মের ভয়ে মন ব্যাকুল।

তৃতীয় কিংকরী। এইখানেই প্রভুকে পূজা দিয়েছি, আজ এখানেই নটীর নাচ দেখা। ছি ছি, কেমন করে এ পাপের ক্ষালন হবে?

চতুর্থ কিংকরী। এতবড়ো বীভৎস ব্যাপার এখানে হবে জানতেন না। থাকতে পারব না আমরা, কিছুতে না।

রত্নাবলী।

মন্দভাগিনী তোরা শুনিসনি, বুদ্ধের পূজা এ-রাজ্যে নিষিদ্ধ হয়েছে।

চতুর্থ কিংকরী। রাজাকে অমান্য করা আমাদের সাধ্য নেই। ভগবানের পূজা নাই করলেম কিন্তু তাই বলে তাঁর অপমান করতে পারি নে।

প্রথম কিংকরী।

রাজবাড়ীর নটীর নাচ রাজকন্যা রাজবধূদেরই জন্যে। এ সভায় আমাদের কেন? চলো তোমরা, আমাদের যেখানে স্থান সেখানে যাই।

রত্নাবলী।

(রক্ষিণীদের প্রতি) যেতে দিয়ো না ওদের। এইবার শীঘ্র নটীকে ডেকে নিয়ে এস।

প্রথম কিংকরী।

রাজকুমারী, এ পাপ নটীকে স্পর্শ করবে না। এ পাপ তোমারই।

রত্নাবলী।

তোরা ভাবিস তোদের নতুন ধর্মের নতুন-গড়া পাপকে আমি গ্রাহ্য করি।

দ্বিতীয় কিংকরী।

মানুষের ভক্তিকে অপমান করা এ তো চিরকালের পাপ।

রত্নাবলী।

এই নটীসাধ্বীর হাওয়া তোমাদের সবাইকে লাগল দেখছি। আমাকে পাপের ভয় দেখিয়ো না, আমি শিশু নই।

রক্ষিণী।

(প্রথম কিংকরীর প্রতি) বসুমতী, আমরা শ্রীমতীকে ভক্তি করেছি কিন্তু ভুল করেছি তো। সে তো নাচতে রাজি হল।

রত্নাবলী।

রাজি হবে না? রাজার আদেশকে ভয় করবে না?

রক্ষিণী।

ভয় তো আমরাই করি, কিন্তু--

রত্নাবলী।

নটীর পদ কি তোমাদেরও উপরে?

প্রথম কিংকরী।

আমরা তো ওকে নটী বলে আর ভাবতুম না। আমরা ওর মধ্যে স্বর্গের আলো দেখেছি।

রত্নাবলী।

নটী স্বর্গে গিয়েও নাচে তা জানিস নে!

রক্ষিণী।

শ্রীমতীকে পাছে রাজার আদেশে আঘাত করতে হয় এই ভয় ছিল কিন্তু আজ মনে হচ্ছে রাজার আদেশের অপেক্ষা করবার দরকার নেই।

প্রথম কিংকরী।

ও পাপীয়সীদের কথা থাক্‌। কিন্তু এই পাপদৃশ্যে দুই চোখকে কলঙ্কিত করলে আমাদের গতি হবে কী?

রত্নাবলী।

এখনো নটীর সাজ শেষ হল না। দেখছ তো তোমাদের নটীসাধ্বীর সাজের আনন্দ কত।

প্রথম কিংকরী।

ওই যে এল! ইস, দেখেছিস ঝলমল করছে।

দ্বিতীয় কিংকরী।

পাপদেহে এক-শ বাতির আলো জ্বালিয়েছে।

শ্রীমতীর প্রবেশ

শ্রীমতীর প্রবেশ

প্রথম কিংকরী।

পাপিষ্ঠা! শ্রীমতী! ভগবানের আসনের সম্মুখে নির্লজ্জ, তুই আজ নাচবি! তোর দুখানা পা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল না এখনো!

শ্রীমতী।

উপায় নেই, আদেশ আছে।

দ্বিতীয় কিংকরী।

নরকে গিয়ে শতলক্ষ বৎসর ধরে জ্বলন্ত অঙ্গারের উপরে তোকে দিনরাত নাচতে হবে এ আমি বলে দিলেম।

তৃতীয় কিংকরী। দেখো একবার। পাতকিনী আপাদমস্তক অলংকার পরেছে। প্রত্যেক অলংকারটি আগুনের বেড়ি হয়ে তোর হাড়ে মাংসে জড়িয়ে থাকবে, তোর নাড়ীতে নাড়ীতে জ্বালার স্রোত বইয়ে দেবে তা জানিস?

মল্লিকার প্রবেশ

মল্লিকার প্রবেশ

মল্লিকা।

(জনান্তিকে, রত্নাবলীকে) রাজ্যে বুদ্ধপূজার যে-নিষেধ প্রচার হয়েছিল সে আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পথে পথে দুন্দুভি বাজিয়ে তাই ঘোষণা চলছে। হয়তো এখনই এখানেও আসবে তাই সংবাদ দিয়ে গেলেম। আরও একটি সংবাদ আছে। আজ মহারাজ অজাতশ্রত্রু স্বয়ং এখানে এসে পূজা করবেন তার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন।

রত্নাবলী।

একবার দৌড়ে যাও তাহলে মল্লিকা--শীঘ্র মহারানী লোকেশ্বরীকে ডেকে নিয়ে এস।

মল্লিকা।

ওই যে তিনি আসছেন।

লোকেশ্বরীর প্রবেশ

লোকেশ্বরীর প্রবেশ

রত্নাবলী।

মহারানী, এই আপনার আসন।

লোকেশ্বরী।

থামো। শ্রীমতীর সঙ্গে নিভৃতে আমার কথা আছে। (শ্রীমতীকে জনান্তিকে ডাকিয়া লইয়া) শ্রীমতী!

শ্রীমতী।

কী মহারানী?

লোকেশ্বরী।

এই লও, তোমার জন্যে এনেছি।

শ্রীমতী।

কী এনেছেন?

লোকেশ্বরী।

অমৃত।

শ্রীমতী।

বুঝতে পারছি নে।

লোকেশ্বরী।

বিষ। খেয়ে মরো, পরিত্রাণ পাবে।

শ্রীমতী।

পরিত্রাণের আর উপায় নেই ভাবছেন?

লোকেশ্বরী।

না। রত্নাবলী আগেই গিয়ে রাজার কাছ থেকে তোমার জন্যে নাচার আদেশ আনিয়েছে। সে আদেশ কিছুতেই ফিরবে না জানি।

রত্নাবলী।

মহারানী, আর সময় নেই, নৃত্য আরম্ভ হ'ক।

লোকেশ্বরী।

এই নে, শীঘ্র খেয়ে ফেল। এখানে মলে স্বর্গ পাবি, এখানে নাচলে যাবি অবীচি নরকে।

শ্রীমতী।

সর্বাগ্রে আদেশ পালন করে নিই।

লোকেশ্বরী।

নাচবি?

শ্রীমতী।

হাঁ, নাচব।

লোকেশ্বরী।

ভয় নেই তোর?

শ্রীমতী।

না, কিছু না।

লোকেশ্বরী।

তবে তোমাকে কেউ উদ্ধার করতে পারবে না।

শ্রীমতী।

যিনি উদ্ধারকর্তা তিনি ছাড়া।

রত্নাবলী।

মহারানী, আর একমুহূর্ত দেরি চলবে না। বাইরে গোলমাল শুনছ না? হয়তো বিদ্রোহীরা এখনই রাজোদ্যানে ঢুকে পড়বে। নটী, নাচ শুরু হোক।

শ্রীমতীর গান ও নাচ

শ্রীমতীর গান ও নাচ

আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো, নমো হে নমঃ

তোমায় স্মরি, হে নিরুপম,

নৃত্যরসে চিত্ত মম

উছল হয়ে বাজে।

আমার সকল দেহের আকুল রবে

মন্ত্র হারা তোমার স্তবে

ডাহিনে বামে ছন্দ নামে

নব জনমের মাঝে।

তোমার বন্দনা মোর ভঙ্গিতে আজ

সংগীতে বিরাজে।

রত্নাবলী।

এ কী রকম নাচ? এ তো নাচের ভান। আর এই গানের অর্থ কী?

লোকেশ্বরী।

না না, বাধা দিয়ো না।

শ্রীমতী গান ও নাচ

শ্রীমতী গান ও নাচ

এ কী পরম ব্যথায় পরান কাঁপায়

কাঁপন বক্ষে লাগে

শান্তিসাগরে ঢেউ খেলে যায়

সুন্দর তায় জাগে।

আমার সব চেতনা সব বেদনা

রচিল এ যে কী আরাধনা,

তোমার পায়ে মোর সাধনা

মরে না যেন লাজে।

তোমার বন্দনা মোর ভঙ্গিতে আজ

সংগীতে বিরাজে।

রত্নাবলী।

এ কী হচ্ছে? গয়নাগুলো একে একে তালে তালে ওই স্তূপের আবর্জনার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে! ওই গেল কঙ্কণ, ওই গেল কেয়ূর, ওই গেল হার! মহারানী, দেখছেন এ সমস্ত রাজবাড়ির অলংকার-- এ কী অপমান! শ্রীমতী, এ আমার নিজের গায়ের অলংকার। কুড়িয়ে নিয়ে এসে মাথায় ঠেকাও, যাও এখনই।

লোকেশ্বরী।

শান্ত হও, শান্ত হও। ওর দোষ নেই, এমনি করে আভরণ ফেলে দেওয়া, এই নাচের এই তো অঙ্গ। আনন্দে আমারও শরীর দুলে উঠেছে। (গলা হইতে হার খুলিয়া ফেলিয়া) শ্রীমতী, থেমো না, থেমো না।

শ্রীমতীর গান ও নাচ

শ্রীমতীর গান ও নাচ

আমি কানন হতে তুলিনি ফুল,

মেলেনি মোরে ফল।

কলস মম শূন্যসম

ভরিনি তীর্থজল।

আমার তনু তনুতে বাঁধনহারা

হৃদয় ঢালে অধরা-ধরা,

তোমার চরণে হ'ক তা সারা,

পূজার পুণ্য কাজে।

তোমার বন্দনা মোর ভঙ্গিতে আজ

সংগীতে বিরাজে।

রত্নাবলী।

এ কী রকম নাচের বিড়ম্বনা। নটীর বেশ একে একে ফেলে দিলে। দেখছ তো মহারানী, ভিতরে ভিক্ষুণীর পীতবস্ত্র। একেই কি পূজা বলে না? রক্ষিণী, তোমরা দেখছ। মহারাজ কী দণ্ড বিধান করেছেন মনে নেই?

রক্ষিণী।

শ্রীমতী তো পূজার মন্ত্র পড়েনি।

শ্রীমতী।

(জানু পাতিয়া) বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি--

রক্ষিণী।

(শ্রীমতীর মুখে হাত দিয়া) থাম্‌ থাম্‌ দুঃসাহসিকা, এখনো থাম্‌।

রত্নাবলী।

রাজার আদেশ পালন করো।

শ্রীমতী।

বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি

ধম্মং সরণং গচ্ছামি--

কিংকরীগণ।

সর্বনাশ করিসনে শ্রীমতী, থাম্‌ থাম্‌।

রক্ষিণী।

যাসনে মরণের মুখে উন্মত্তা।

দ্বিতীয় রক্ষিণী।

আমি করজোড়ে মিনতি করছি আমাদের উপর দয়া করে ক্ষান্ত হ।

কিংকরীগণ।

চক্ষে দেখতে পারব না, দেখতে পারব না, পালাই আমরা।

[পলায়ন

[পলায়ন

রত্নাবলী।

রাজার আদেশ পালন করো।

শ্রীমতী।

বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি

ধম্মং সরণং গচ্ছামি

সংঘং সরণং গচ্ছামি।

লোকেশ্বরী।

(জানু পাতিয়া সঙ্গে সঙ্গে)

বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি

ধম্মং সরণং গচ্ছামি

সংঘং সরণং গচ্ছামি।

রক্ষিণী শ্রীমতীকে অস্ত্রাঘাত করিতেই সে আসনের উপর পড়িয়া গেল। "ক্ষমা করো

ক্ষমা করো', বলিতে বলিতে রক্ষিণীরা একে একে শ্রীমতীর পায়ের ধুলা লইল।

রক্ষিণী শ্রীমতীকে অস্ত্রাঘাত করিতেই সে আসনের উপর পড়িয়া গেল। "ক্ষমা করো

ক্ষমা করো', বলিতে বলিতে রক্ষিণীরা একে একে শ্রীমতীর পায়ের ধুলা লইল।

লোকেশ্বরী।

(শ্রীমতীর মাথা কোলে লইয়া) নটী, তোর এই ভিক্ষুণীর বস্ত্র আমাকে দিয়ে গেলি। (বসনের একপ্রান্ত মাথায় ঠেকাইয়া) এ আমার।

[ রত্নাবলী ধূলিতে বসিয়া পড়িল

[ রত্নাবলী ধূলিতে বসিয়া পড়িল

মল্লিকা।

কী ভাবছ?

রত্নাবলী।

(বস্ত্রাঞ্চলে মুখ আচ্ছন্ন করিয়া) এইবার আমার ভয় হচ্ছে।

প্রতিহারিণীর প্রবেশ

প্রতিহারিণীর প্রবেশ

প্রতিহারিণী।

মহারাজ অজাতশত্রু ভগবানের পূজা নিয়ে কননদ্বারে অপেক্ষা করছেন দেবীদের সম্মতি চান।

মল্লিকা।

চলো, আমি মহারাজকে দেবীদের সম্মতি জানিয়ে আসিগে।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

লোকেশ্বরী।

বলো তোমরা সবাই,

বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি।

রত্নাবলী ব্যতীত সকলে।

বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি।

লোকেশ্বরী।

ধম্মং সরণং গচ্ছামি।

রত্নাবলী ব্যতীত সকলে।

ধম্মং সরণং গচ্ছামি।

লোকেশ্বরী।

সংঘং সরণং গচ্ছামি।

রত্নাবলী ব্যতীত সকলে।

সংঘং সরণং গচ্ছামি।

নত্থি মে সরণং অঞ ঞং বুদ্ধো মে সরণং বরং

এতেন সচ্চবজ্জেন হোতু মে জয়মঙ্গলং।

মল্লিকার প্রবেশ

মল্লিকার প্রবেশ

মল্লিকা।

মহারাজ এলেন না, ফিরে গেলেন।

লোকেশ্বরী।

কেন?

মল্লিকা।

সংবাদ শুনে তিনি ভয়ে কম্পিত হয়ে উঠলেন।

লোকেশ্বরী।

কাকে তাঁর ভয়?

মল্লিকা।

ওই হতপ্রাণ নটীকে।

লোকেশ্বরী।

চলো পালঙ্ক নিয়ে আসি। এর দেহকে সকলে বহন করে নিয়ে যেতে হবে।

[ রত্নাবলী ছাড়া সকলের প্রস্থান

[ রত্নাবলী ছাড়া সকলের প্রস্থান

রত্নাবলী।

(শ্রীমতীর পাদস্পর্শ করিয়া প্রণাম। জানু পাতিয়া বসিয়া)

বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি

ধম্মং সরণং গচ্ছামি

সংঘং সরণং গচ্ছামি।
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6