মায়ের মায়ানৃত্য

মায়ের মায়ানৃত্য

প্রকৃতি।

ওই দেখ্‌ পশ্চিমে মেঘ ঘনালো,

মন্ত্র খাটবে মা, খাটবে--

উড়ে যাবে শুষ্ক সাধনা সন্ন্যাসীর

শুকনো পাতার মতন।

নিববে বাতি, পথ হবে অন্ধকার,

ঝড়ে-বাসা-ভাঙা পাখি

ঘুরে ঘুরে পড়বে এসে মোর দ্বারে।

দুরু দুরু করে মোর বক্ষ,

মনের মাঝে ঝিলিক দিতেছে বিজুলি।

দূরে যেন ফেনিয়ে উঠেছে সমুদ্র--

তল নেই, কূল নেই তার।

মন্ত্র খাটবে মা, খাটবে।

মা।

এইবার আয়নার সামনে নাচ্‌ দেখি তুই,

দেখ্‌ দেখি কী ছায়া পড়ল।

প্রকৃতির নৃত্য

প্রকৃতির নৃত্য

প্রকৃতি।

লজ্জা ছি ছি লজ্জা!

আকাশে তুলে দুই বাহু

অভিশাপ দিচ্ছেন কাকে।

নিজেরে মারছেন বহ্নির বেত্র,

শেল বিঁধছেন যেন আপনার মর্মে।

মা।

ওরে বাছা, এখনি অধীর হলি যদি,

শেষে তোর কী হবে দশা।

প্রকৃতি।

আমি দেখব না, আমি দেখব না,

আমি দেখব না তোর দর্পণ।

বুক ফেটে যায়, যায় গো,

বুক ফেটে যায়।

কী ভয়ংকর দুঃখের ঘূর্ণিঝঞ্ঝা--

মহান বনস্পতি ধুলায় কি লুটাবে,

ভাঙবে কি অভ্রভেদী তার গৌরব।

দেখব না, আমি দেখব না তোর দর্পণ।

না না না।

মা।

থাক্‌ তবে থাক্‌ এই মায়া।

প্রাণপণে ফিরিয়ে আনব মোর মন্ত্র--

নাড়ী যদি ছিঁড়ে যায় যাক,

ফুরায়ে যায় যদি যাক নিশ্বাস।

প্রকৃতি।

সেই ভালো মা, সেই ভালো।

থাক্‌ তোর মন্ত্র, থাক্‌ তোর--

আর কাজ নাই, কাজ নাই ,কাজ নাই।

না না না, পড়্‌ মন্ত্র তুই, পড়্‌ তোর মন্ত্র--

পথ তো আর নেই বাকি!

আসবে সে, আসবে সে, আসবে,

আমার জীবনমৃত্যু-সীমানায় আসবে।

নিবিড় রাত্রে এসে পৌঁছবে পান্থ,

বুকের জ্বালা দিয়ে আমি

জ্বালিয়ে দিব দীপখানি--

সে আসবে।

--

দুঃখ দিয়ে মেটাব দুঃখ তোমার।

স্নান করাব অতল জলে

বিপুল বেদনার।

মোর সংসার দিব যে জ্বালি,

শোধন হবে এ মোহের কালি--

মরণব্যথা দিব তোমার

চরণে উপহার॥

মা।

বাছা, মোর মন্ত্র আর তো বাকি নেই,

প্রাণ মোর এল কণ্ঠে।

প্রকৃতি।

মা গো, এতদিনে মনে হচ্ছে যেন

টলেছে আসন তাঁহার।

ওই আসছে, আসছে, আসছে।

যা বহু দূরে, যা লক্ষ যোজন দূরে,

যা চন্দ্রসূর্য পেরিয়ে,

ওই আসছে, আসছে, আসছে--

কাঁপছে আমার বক্ষ ভূমিকম্পে।

মা।

বল্‌ দেখি বাছা, কী তুই দেখছিস আয়নায়।

প্রকৃতি।

ঘন কালো মেঘ তাঁর পিছনে,

চারি দিকে বিদ্যুৎ চমকে।

অঙ্গ ঘিরে ঘিরে তাঁর

অগ্নির আবেষ্টন,

যেন শিবের ক্রোধানলদীপ্তি।

তোর মন্ত্রবাণী ধরি কালীনাগিনীমূর্তি

গর্জিছে বিষনিশ্বাসে,

কলুষিত করে তাঁর পুণ্যশিখা।

আনন্দের ছায়া-অভিনয়

আনন্দের ছায়া-অভিনয়

মা।

ওরে পাষাণী,

কী নিষ্ঠুর মন তোর,

কী কঠিন প্রাণ,

এখনো তো আছিস বেঁচে।

প্রকৃতি।

ক্ষুধার্ত প্রেম তার নাই দয়া,

তার নাই ভয়, নাই লজ্জা।

নিষ্ঠুর পণ আমার,

আমি মানব না হার, মানব না হার--

বাঁধব তাঁরে মায়াবাঁধনে,

জড়াব আমারি হাসি-কাঁদনে।

ওই দেখ্‌, ওই নদী হয়েছেন পার--

একা চলেছেন ঘন বনের পথে।

যেন কিছু নাই তাঁর চোখের সম্মুখে--

নাই সত্য, নাই মিথ্যা;

নাই ভালো, নাই মন্দ।

মাকে নাড়া দিয়ে

দুর্বল হোস নে হোস নে,

এইবার পড়্‌ তোর শেষনাগমন্ত্র--

নাগপাশ-বন্ধনমন্ত্র।

মা।

জাগে নি এখনো জাগে নি

রসাতলবাসিনী নাগিনী।

বাজ্‌ বাজ্‌ বাজ্‌ বাঁশি, বাজ্‌ রে

মহাভীমপাতালী রাগিণী,

জেগে ওঠ্‌ মায়াকালী নাগিনী--

ওরে মোর মন্ত্রে কান দে--

টান দে, টান দে, টান দে, টান দে।

বিষগর্জনে ওকে ডাক দে--

পাক দে, পাক দে, পাক দে,পাক দে।

গহ্বর হতে তুই বার হ,

সপ্তসমুদ্র পার হ।

বেঁধে তারে আন্‌ রে--

টান্‌ রে, টান্‌ রে, টান্‌ রে, টান্‌ রে।

নাগিনী জাগল, জাগল, জাগল--

পাক দিতে ওই লাগল, লাগল, লাগল--

মায়াটান ওই টানল, টানল, টানল।

বেঁধে আনল, বেঁধে আনল, বেঁধে আনল॥

এইবার নৃত্যে করো আহ্বান--

ধর্‌ তোরা গান।

আয় তোরা যোগ দিবি আয়

যোগিনীর দল।

আয় তোরা আয়,

আয় তোরা আয়,

আয় তোরা আয়।

সকলে।

ঘুমের ঘন গহন হতে যেমন আসে স্বপ্ন,

তেমনি উঠে এসো এসো।

শমীশাখার বক্ষ হতে যেমন জ্বলে অগ্নি,

তেমনি তুমি, এসো এসো।

ঈশানকোণে কালো মেঘের নিষেধ বিদারি

যেমন আসে সহসা বিদ্যুৎ,

তেমনি তুমি চমক হানি এসো হৃদয়তলে,

এসো তুমি, এসো তুমি এসো এসো।

আঁধার যবে পাঠায় ডাক মৌন ইশারায়,

যেমন আসে কালপুরুষ সন্ধ্যাকাশে

তেমনি তুমি এসো, তুমি এসো এসো।

সুদূর হিমগিরির শিখরে

মন্ত্র যবে প্রেরণ করে তাপস বৈশাখ,

প্রখর তাপে কঠিন ঘন তুষার গলায়ে

বন্যাধারা যেমন নেমে আসে--

তেমনি তুমি এসো, তুমি এসো এসো॥

মা।

আর দেরি করিস নে, দেখ্‌ দর্পণ--

আমার শক্তি হল যে ক্ষয়।

প্রকৃতি।

না, দেখব না আমি দেখব না,

আমি শুনব--

মনের মধ্যে আমি শুনব,

ধ্যানের মধ্যে আমি শুনব,

তাঁর চরণধ্বনি।

ওই দেখ্‌ এল ঝড়, এল ঝড়,

তাঁর আগমনীর ওই ঝড়--

পৃথিবী কাঁপছে থরো থরো থরো থরো,

গুরু গুরু করে মোর বক্ষ।

মা।

তোর অভিশাপ নিয়ে আসে

হতভাগিনী।

প্রকৃতি।

অভিশাপ নয় নয়,

অভিশাপ নয় নয়--

আনছে আমার জন্মান্তর,

মরণের সিংহদ্বার ওই খুলছে।

ভাঙল দ্বার,

ভাঙল প্রাচীর,

ভাঙল এ জন্মের মিথ্যা।

ওগো আমার সর্বনাশ,

ওগো আমার সর্বস্ব,

তুমি এসেছ

আমার অপমানের চূড়ায়।

মোর অন্ধকারের ঊর্ধ্বে রাখো

তব চরণ জ্যোতির্ময়।

মা।

ও নিষ্ঠুর মেয়ে,

আর যে সহে না, সহে না, সহে না।

প্রকৃতি।

ওমা, ওমা, ওমা,

ফিরিয়ে নে তোর মন্ত্র

এখনি এখনি এখনি।

ও রাক্ষুসী, কী করলি তুই,

কী করলি তুই--

মরলি নে কেন পাপীয়সী।

কোথা আমার সেই দীপ্ত সমুজ্জ্বল

শুভ্র সুনির্মল

সুদূর স্বর্গের আলো।

আহা কী ম্লান, কী ক্লান্ত--

আত্মপরাভব কী গভীর।

যাক যাক যাক,

সব যাক, সব যাক--

অপমান করিস নে বীরের,

জয় হোক তাঁর,

জয় হোক।

আনন্দের প্রবেশ

প্রভু, এসেছ উদ্ধারিতে আমায়,

দিলে তার এত মূল্য,

নিলে তার এত দুঃখ।

ক্ষমা করো, ক্ষমা করো--

মাটিতে টেনেছি তোমারে,

এনেছি নীচে,

ধূলি হতে তুলি নাও আমায়

তব পুণ্যলোকে।

ক্ষমা করো।

জয় হোক তোমার জয় হোক।

আনন্দ।

কল্যাণ হোক তব, কল্যাণী।

সকলে বুদ্ধকে প্রণাম

সকলে বুদ্ধকে প্রণাম

সকলে।

বুদ্ধো সুসুদ্ধো করুণামহাণ্ণবো,

যোচ্চন্ত সুদ্ধব্বর ঞানলোচনো

লোকস্‌স পাপুপকিলেসঘাতকো

বন্দামি বুদ্ধং অহমাদরেণ তং॥