বাসন্তী, হে ভুবনমোহিনী,

দিকপ্রান্তে, বনপ্রান্তে,

শ্যাম প্রান্তরে, আম্রছায়ে,

সরোবরতীরে, নদীনীরে,

নীল আকাশে, মলয়বাতাসে

ব্যাপিল অনন্ত তব মাধুরী।

নগরে গ্রামে কাননে,

দিনে নিশীথে,

পিকসংগীতে নৃত্যগীতকলনে

বিশ্ব আনন্দিত;

ভবনে ভবনে

বীণাতান রণ-রণ ঝংকৃত।

মধুমদমোদিত হৃদয়ে হৃদয়ে রে

নবপ্রাণ উচ্ছ্বসিল আজি,

বিচলিত চিত উচ্ছলি উন্মাদনা

ঝন-ঝন ঝনিল মঞ্জীরে মঞ্জীরে॥

শুনেছ অলিমালা, ওরা ধিক্কার দিচ্ছে ঐ ও পাড়ার মল্লের দল; তোমাদের চাপল্য তাদের ভালো লাগছে না। শৈবালগুচ্ছবিলম্বী ভারী ভারী সব কালো কালো পাথরগুলোর মতো তমিস্রগহন গাম্ভীর্যে ওরা গুহাদ্বারে ভ্রূকুটি পুঞ্জিত ক'রে বসে আছে। কলহাস্যচঞ্চলা নির্ঝরিণী ওদের নিষেধ লঙ্ঘন করেই বেরিয়ে পড়ুক এই আনন্দময় বিশ্বের আনন্দপ্রবাহ দিকে দিগন্তে বইয়ে দিতে, নাচে গানে কল্লোলে হিল্লোলে; চূর্ণ চূর্ণ সূর্যের আলো উদ্‌বেল তরঙ্গভঙ্গের অঞ্জলিবিক্ষেপে ছড়িয়ে ছড়িয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে। এই আনন্দ-আবেগের অন্তরে অন্তরে যে-অক্ষয় শৌর্যের অনুপ্রেরণা আছে সেটা ও পাড়ার শাস্ত্রবচনের বেড়া এড়িয়ে চলে গেল। ভয় কোরো না তোমরা, যে রসরাজের নিমন্ত্রণে এসেছ তাঁর প্রসন্নতা যেমন আজ নেমেছে আমাদের নিকুঞ্জে ঐ অন্তঃস্মিত গন্ধরাজমুকুলের প্রচ্ছন্ন গন্ধরেণুতে, তেমনি নামুক তোমাদের কণ্ঠে, তোমাদের দেহলতার নিরুদ্ধ-নটনোৎসাহে। সেই যিনি সুরের গুরু, তাঁরই চরণে তোমাদের নৃত্যের নৈবেদ্য আজ নির্ঝরিত করে দাও।

সুরের গুরু, দাও গো সুরের দীক্ষা--

মোরা সুরের কাঙাল, এই আমাদের ভিক্ষা।

মন্দাকিনীর ধারা

উষার শুকতারা,

কনকচাঁপা কানে কানে যে-সুর পেল শিক্ষা।

তোমার সুরে ভরিয়ে নিয়ে চিত্ত

যাব যেথায় বেসুর বাজে নিত্য।

কোলাহলের বেগে

ঘূর্ণি উঠে জেগে,

নিয়ো তুমি আমার বীণার সেইখানেই পরীক্ষা॥

----

তুমি সুন্দর যৌবনঘন,

রসময় তব মূর্তি,

দৈন্যভরণ বৈভব তব

অপচয়পরিপূর্তি।

নৃত্য গীত কাব্য ছন্দ

কলগুঞ্জন বর্ণ গন্ধ

মরণহীন চিরনবীন

তব মহিমাস্ফূর্তি॥

ও দিকে আধুনিক আমলের বারোয়ারির দল বলছে, উৎসবে নতুন কিছু চাই। কোণা-কাটা ত্যাড়াবাঁকা দুম্‌দাম-করা কড়া-ফ্যাশানের আহেলা বেলাতি নতুনকে না হলে তাদের শুকনো মেজাজে জোর পৌঁচচ্ছে না। কিন্তু, যাঁদের রসবেদনা আছে তাঁরা কানে কানে বলে গেলেন, আমরা নতুন চাই নে, আমরা চাই নবীনকে। এঁরা বলেন, মাধবী বছরে বছরে বাঁকা করে খোঁচা মেরে সাজ বদলায় না, অশোক পলাশ একই পুরাতন রঙে নিঃসংকোচে বারে বারে রঙিন। চিরপুরাতনী ধরণী চিরপুরাতন নবীনের দিকে তাকিয়ে বলছে, "লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু তবু হিয়া জুড়ন না গেল!' সেই নিত্যনন্দিত সহজশোভন নবীনের উদ্দেশে তোমাদের আত্মনিবেদনের গান শুরু করে দাও।

আন্‌ গো তোরা কার কী আছে,

দেবার হাওয়া বইল দিকে দিগন্তরে--

এই সুসময় ফুরায় পাছে।

কু্‌ঞ্জবনের অঞ্জলি-যে ছাপিয়ে পড়ে,

পলাশকানন ধৈর্য হারায় রঙের ঝড়ে,

বেণুর শাখা তালে মাতাল পাতার নাচে।

প্রজাপতি রঙ ভাসালো নীলাম্বরে,

মৌমাছিরা ধ্বনি উড়ায় বাতাস'পরে।

দখিন হাওয়া হেঁকে বেড়ায় "জাগো জাগো',

দোয়েল কোয়েল গানের বিরাম জানো না গো,

রক্তরঙের জাগল প্রলাপ অশোক গাছে॥

আজ বরবর্ণিনী অশোকমঞ্জরী তার চেলাঞ্চল-আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে আকাশে রক্তরঙের কিঙ্কিণীঝংকার বিকীর্ণ করে দিলে; কুঞ্জবনের শিরীষবীথিকায় আজ সৌরভের অপরিমেয় দাক্ষিণ্য। ললিতিকা, আমরাও তো শূন্য হাতে আসি নি। মাধুর্যের অতল সমুদ্রে আজ দানের জোয়ার লেগেছে, আমরাও ঘাটে ঘাটে দানের বোঝাই তরীর রশি খসিয়ে দিয়েছি। যে নাচের তরঙ্গে তারা ভেসে পড়ল সেই নাচের ছন্দটা, কিশোর, দেখিয়ে দাও।

ফাগুন, তোমার হাওয়ায় হাওয়ায়

করেছি-যে দান

আমার আপনহারা প্রাণ,

আমার বাঁধন-ছেঁড়া প্রাণ।

তোমার অশোকে কিংশুকে

অলক্ষ্যে রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে,

তোমার ঝাউয়ের দোলে

মর্মরিয়া ওঠে আমার দুঃখরাতের গান।

পূর্ণিমাসন্ধ্যায়

তোমার রজনীগন্ধায়

রূপসাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়।

তোমার প্রজাপতির পাখা

আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধচোখের রঙিন স্বপন-মাখা--

তোমার চাঁদের আলোয়

মিলায় আমার দুঃখসুখের সকল অবসান॥

ভরে দাও, একেবারে ভরে দাও গো, "প্যালা ভর ভর লায়ী রে'। পূর্ণের উৎসবে দেওয়া আর পাওয়া, একেবারে একই কথা। ঝর্ণার এক প্রান্তে কেবলই পাওয়া অভ্রভেদী শিখরের দিক থেকে, আর-এক প্রান্তে কেবলই দেওয়া অতলস্পর্শ সমুদ্রের দিকপানে। এই ধারার মাঝখানে শেষে বিচ্ছেদ নেই। অন্তহীন পাওয়া আর অন্তহীন দেওয়ার নিরবচ্ছিন্ন আবর্তন এই বিশ্ব। আমাদের গানেও সেই আবৃত্তি, কেননা, গান তো আমরা শুধু কেবল গাই নে, গান-যে আমরা দিই, তাই গান আমরা পাই।

গানের ডালি ভরে দে গো উষার কোলে--

আয় গো তোরা, আয় গো তোরা, আয় গো চলে।

চাঁপার কলি চাঁপার গাছে

সুরের আশায় চেয়ে আছে,

কান পেতেছে নতুন পাতা গাইবি ব'লে।

কমলবরণ গগনমাঝে

কমলচরণ ওই বিরাজে।

ওইখানে তোর সুর ভেসে যাক,

নবীন প্রাণের ওই দেশে যাক,

ওই যেখানে সোনার আলোর দুয়ার খোলে॥

মধুরিমা, দেখো দেখো, চন্দ্রমা তিথির পর তিথি পেরিয়ে আজ তার উৎসবের তরণী পূর্ণিমার ঘাটে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। নন্দনবন থেকে কোমল আলোর শুভ্র সুকুমার পারিজাতস্তবকে তার ডালি ভরে আনল। সেই ডালিখানিকে ঐ কোলে নিয়ে বসে আছে কোন্‌ মাধুরীর মহাশ্বেতা। রাজহংসের ডানার মতো তার লঘু মেঘের শুভ্র বসনাঞ্চল স্রস্ত হয়ে পড়েছে ঐ আকাশে, আর তার বীণার রুপোর তন্তুগুলিতে অলস অঙ্গুলিক্ষেপে থেকে থেকে গুঞ্জরিত হচ্ছে বেহাগের তান।

নিবিড় অমা-তিমির হতে

বাহির হল জোয়ারস্রোতে

শুক্লরাতে চাঁদের তরণী।

ভরিল ভরা অরূপ ফুলে,

সাজালো ডালা অমরাকূলে

আলোর মালা চামেলিবরণী

শুক্লরাতে চাঁদের তরণী।

তিথির পরে তিথির ঘাটে

আসিছে তরী দোলের নাটে,

নীরবে হাসে স্বপনে ধরণী।

উৎসবের পসরা নিয়ে

পূর্ণিমার কূলেতে কি এ

ভিড়িল শেষে তন্দ্রাহরণী

শুক্লরাতে চাঁদের তরণী॥

দোল লেগেছে এবার। পাওয়া আর না-পাওয়ার মাঝখানে এই দোল। এক প্রান্তে মিলন আর-এক প্রান্তে বিরহ, এই দুই প্রান্ত স্পর্শ করে করে দুলছে বিশ্বের হৃদয়। পরিপূর্ণ আর অপূর্ণের মাঝখানে এই দোলন। আলোতে ছায়াতে ঠেকতে ঠেকতে রূপ জাগছে জীবন থেকে মরণে, বাহির থেকে অন্তরে। এই ছন্দটি বাঁচিয়ে যে চলতে চায় সে তো যাওয়া-আসার দ্বার খোলা রেখে দেয়। কিন্তু, ঔ-যে হিসাবি মানুষটা দ্বারে শিকল দিয়ে আঁক পাড়ছে তার শিকল-নাড়া দাও তোমরা। ঘরের লোককে অন্তত আজ একদিনের মতো ঘরছাড়া করো।

ওরে গৃহবাসী, তোরা খোল্‌ দ্বার খোল্‌,

লাগল-যে দোল।

স্থলে জলে বনতলে

লাগল-যে দোল।

খোল্‌ দ্বার খোল্‌।

রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে,

রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে,

নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।

খোল্‌ দ্বার খোল্‌।

বেনুবন মর্মরে দখিনবাতাসে,

প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে--

মউমাছি ফিরে যাচি ফুলের দখিনা,

পাখায় বাজায় তার ভিখারীর বীণা,

মাধবীবিতানে বায়ু গন্ধে বিভোল।

খোল্‌ দ্বার খোল্‌॥

----

আমি সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়,

আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে-জন ভাসায়।

যে-জন দেয় না দেখা, যায় যে দেখে,

ভালোবাসে আড়াল থেকে,

আমার মন মজেছে সেই গভীরের

গোপন ভালোবাসায়॥

সর্বনাশের ব্রত যাদের তাদের ভয় ভাঙিয়ে দাও। কারো কারো যে দ্বিধা গোচে না। ঔ দেখো-না পাতার আড়ালে মাধবী। ঐ অবগুণ্ঠিতাদের সাহস দাও। শুনছ না বকুলগুলো ঝরতে ঝরতে বলছে "যা হয় তা হোক গে', আমের মুকুল বলে উঠছে "কিছু হাতে রাখব না'। যারা কৃপণতা করবে তাদের সময় বয়ে যাবে।

হে মাধবী, দ্বিধা কেন--আসিবে কি ফিরিবে কি--

আঙিনাতে বাহিরিতে মন কেন গেল ঠেকি।

বাতাসে লুকায়ে থেকে

কে-যে তোরে গেছে ডেকে,

পাতায় পাতায় তোরে পত্র সে-যে গেছে লেখি।

কখন্‌ দখিন হতে কে দিল দুয়ার ঠেলি,

চমকি উঠিল জাগি চামেলি নয়ন মেলি।

বকুল পেয়েছে ছাড়া,

করবী দিয়েছে সাড়া,

শিরীষ শিহরি উঠে দূর হতে কারে দেখি॥

----

তুমি কোন্‌ ভাঙনের পথে এলে, সুপ্ত রাতে,

আমার ভাঙল যা তাই ধন্য হল চরণপাতে।

নন্দিনী, ঐ দেখে নাও শিশুর লীলা, ঐ-যে কচি কিশলয়--

শ্যামল কোমল চিকন রূপের নবীন শোভা--দেখে যা--

কল-উতরোল চঞ্চলদোল ওই-যে বোবা।

শিশু হয়ে এসেছে চিরনবীন, কিশলয়ে তার ছেলেখেলা জমাবার জন্যে। দোসর হয়ে তার সঙ্গে যোগ দিল ঐ সূর্যের আলো, সেও সাজল শিশু, সারাবেলা সে কেবল ঝিকিমিক করছে। সেই তো তার কলপ্রলাপ। ওদের নাচে নাচে মুখরিত হয়ে উঠল প্রাণগীতিকার প্রথম ধুয়োটি।

ওরা অকারণে চঞ্চল।

ডালে ডালে দোলে বায়ুহিল্লোলে

নবপল্লবদল।

ছড়ায়ে ছড়ায়ে ঝিকিমিকি আলো

দিকে দিকে ওরা কী খেলা খেলালো--

মর্মরতানে প্রাণে ওরা আনে

কৈশোরকোলাহল।

ওরা কান পেতে শোনে গগনে গগনে

নীরবের কানাকানি,

নীলিমার কোন্‌ বাণী।

ওরা প্রাণঝরনার উচ্ছল ধার

ঝরিয়া ঝরিয়া বহে অনিবার,

চিরতাপসিনী ধরণীর ওরা

শ্যামশিখা হোমানল॥

দীর্ঘ শূন্য পথটাকে এতদিন ঠেকেছিল বড়ো কঠিন, বড়ো নিষ্ঠুর। আজ তাকে প্রণাম। পথিককে সে তো অবশেষে এনে পৌঁছিয়ে দিলে। কিন্তু, ভুলব কেমন করে যে, যে পথ কাছে নিয়ে আসে সেই পথই দূরে নিয়ে যায়--তাই মনে হয়, ঘরের মধ্যে নিশ্চল হয়ে মিলন স্থায়ী হয় না, পথে বেরিয়ে পড়লে তবেই পথিকের সঙ্গে বিচ্ছেদ এড়ানো যায়। তাই আজ পথকেই প্রণাম।

মোর পথিকেরে বুঝি এনেছ এবার

করুণ রঙিন পথ।

এসেছে এসেছে অঙ্গনে, মোর

দুয়ারে লেগেছে রথ।

সে-যে সাগরপারের বাণী

মোর পরানে দিয়েছে আনি,

তার আঁখির তারায় যেন গান গায়

অরণ্য পর্বত।

দুঃখসুখের এপারে ওপারে

দোলায় আমার মন,

কেন অকারণ অশ্রুসলিলে

ভরে যায় দু'নয়ন।

ওগো নিদারুণ পথ, জানি,

জানি, পুন নিয়ে যাবে টানি

তারে, চিরদিন মোর যে দিল ভরিয়া

যাবে সে স্বপনবৎ

----

বাতাসের চলার পথে যে মুকুল পড়ে ঝরে,

তা নিয়ে তোমার লাগি রেখেছি ডালি ভরে।

টুকরো টুকরো সুখদুঃখের মালা গাঁথব--সাতনরী হার পরাব তোমাকে মাধুর্যের মুক্তোগুলি চুনে নিয়ে। ফাগুনের ভরা সাজির উদ্‌বৃত্ত থেকে তুলে নেব বনের মর্মর, বাণীর সূত্রে গেঁথে বেঁধে দেব তোমার মণিবন্ধে। হয়তো আবার আর-বসন্তেও সেই আমার দেওয়া ভূষণ প'রেই তুমি আসবে। আমি থাকব না, কিন্তু কী জানি আমার দানের ভূষণ হয়তো থাকবে তোমার দক্ষিণ হাতে।

ফাগুনের নবীন আনন্দে

গানখানি গাঁথিলাম ছন্দে।

দিল তারে বনবীথি

কোকিলের কলগীতি,

ভরি দিল বকুলের গন্ধে।

মাধবীর মধুময় মন্ত্র

রঙে রঙে রাঙালো দিগন্ত।

বাণী মম নিল তুলি

পলাশের কলিগুলি,

বেঁধে দিল তব মণিবন্ধে॥
1 | 2 | 3