সন্দেহ

মাঠ

সন্দেহ

মাঠ

সবাই বলে ঐ, ঐ, ঐ--তার পরে চেয়ে দেখলেই দেখা যায় শুধু ধুলো আর শুকনো পাতা।

তার রথের ধ্বজাটা মেঘের মধ্যে যেন একবার দেখা দিয়েছিল।

কিন্তু দিক ভুল হয়ে যায়। এই ভাবি পুবে, এই ভাবি পশ্চিমে।

এমনি করে সমস্ত দিন ধুলো আর ছায়ার পিছনে ঘুরে ঘুরেই হয়রান হয়ে গেলুম। বেলা যে গেল রে ভাই, বেলা যে গেল!

সত্যি কথা বলি, যতই বেলা যাচ্ছে ততই মনে ভয় ঢুকছে।

মনে হচ্ছে, ভুল করেছি।

সকালবেলাকার আলো কানে কানে বললে, সাবাস, এগিয়ে চলো--বিকেল বেলাকার আলো তাই নিয়ে ভারি ঠাট্টা করছে।

ঠকলুম বুঝি রে!

দাদার চৌপদীগুলোর উপরে ক্রমে শ্রদ্ধা বাড়ছে।

ভয় হচ্ছে আমরাও চৌপদী লিখতে বসে যাব--বড়ো দেরি নেই।

আর পাড়ার লোক আমাদের ঘিরে বসবে।

আর এমনি তাদের ভয়ানক উপকার হতে থাকবে যে, তারা এক পা নড়বে না।

আমরা রাত্রিবেলাকার পাথরের মতো ঠাণ্ডা হয়ে বসে থাকব।

আর তারা আমাদের চার দিকে কুয়াশার মতো ঘন হয়ে জমবে।

ও ভাই, আমাদের সর্দার এ-সব কথা শুনলে বলবে কী।

ওরে আমার ক্রমে বিশ্বাস হচ্ছে সর্দারই আমাদের ঠকিয়েছে। সে আমাদের মিথ্যে ফাঁকি দিয়ে খাটিয়ে নেয়, নিজে সে কুঁড়ের সর্দার।

ফিরে চল্‌ রে। এবার সর্দারের সঙ্গে লড়ব।

বলব, আমরা চলব না--দুই পা কাঁধের উপর মুড়ে বসব। পা দুটো লক্ষ্মীছাড়া, পথে পথেই ঘুরে মরল।

হাত দুটোকে পিছনের দিকে বেঁধে রাখব।

পিছনের কোনো বালাই নেই রে, যত মুশকিল এই সামনেটাকে নিয়ে।

শরীরে যতগুলো অঙ্গ আছে তার মধ্যে পিঠটাই সত্যি কথা বলে। সে বলে চিত হয়ে পড়্‌, চিত হয়ে পড়্‌।

কাঁচা বয়সে বুকটা বুক ফুলিয়ে চলে কিন্তু পরিণামে সেই পিঠের উপরেই ভর--পড়তেই হয় চিত হয়ে।

গোড়াতেই যদি চিতপাত দিয়ে শুরু করা যেত তা হলে মাঝখানে উৎপাত থাকত না রে।

আমাদের গ্রামের ছায়ার নীচে দিয়ে সেই যে ইরা নদী বয়ে চলেছে তার কথা মনে পড়ছে ভাই।

সেদিন মনে হয়েছিল, সে বলছে, চল্‌, চল্‌, চল্‌--আজ মনে হচ্ছে ভুল শুনেছিলুম, সে বলছে, ছল, ছল, ছল। সংসারটা সবই ছল রে!

সে কথা আমাদের পণ্ডিত গোড়াতেই বলেছিল।

এবারে ফিরে গিয়েই একেবারে সোজা সেই পণ্ডিতের চণ্ডীমণ্ডপে।

পুঁথি ছাড়া আর এক পা চলা নয়।

কী ভুলটাই করেছিলুম। ভেবেছিলুম চলাটাই বাহাদুরি। কিন্তু না-চলাই যে গ্রহ নক্ষত্র জল হাওয়া সমস্তর উলটো। সেটাই তো তেজের কথা হল।

ওরে বীর, কোমর বাঁধ্‌ রে--আমরা চলব না।

ওরে পালোয়ান, তাল ঠুকে বসে পড়্‌, আমরা চলব না।

চলচ্চিত্তং চলদ্বিত্তং--আমাদের চিত্তেও কাজ নেই, বিত্তেও কাজ নেই; আমরা চলব না।

চলজ্জীবনযৌবনং--আমাদের জীবনও থাক্‌, যৌবনও থাক্‌, আমরা চলব না।

যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছি ফিরে চল্‌।

না রে সেখানে ফিরতে হলেও চলতে হবে।

তবে?

তবে আর কী। যেখানে এসে পড়েছি এইখানেই বসে পড়ি।

মনে করি এইখানেই বরাবর বসে আছি।

জন্মাবার ঢের আগে থেকে।

মরার ঢের পরে পর্যন্ত।

ঠিক বলেছিস্, তা হলে মনটা স্থির থাকবে। আর-কোথাও থেকে এসেছি জানলেই আর-কোথাও যাবার জন্যে মন ছটফট করে।

আর-কোথাওটা বড়ো সর্বনেশে দেশ রে!

সেখানে দেশটা সুদ্ধ চলে। তার পথগুলো চলে।

কিন্তু আমরা--

গান

মোরা চলব না।

মুকুল ঝরে ঝরুক, মোরা ফলব না।

সূর্য তারা আগুন ভুগে

জ্বলে মরুক যুগে যুগে,

আমরা যতই পাই না জ্বালা

জ্বলব না।

বনের শাখা কথা বলে,

কথা জাগে সাগর-জলে,

এই ভুবনে আমরা কিছুই

বলব না।

কোথা হতে লাগে রে টান,

জীবনজলে ডাকে রে বান,

আমরা তো এই প্রাণের টলায়

টলব না॥

ওরে হাসি রে হাসি!

ঐ হাসি শোনা যাচ্ছে।

বাঁচা গেল, এতক্ষণে একটা হাসি শোনা গেল।

যেন গুমোটের ঘোমটা খুলে গেল।

এ যেন বৈশাখের এক পশলা বৃষ্টি।

কার হাসি ভাই।

শুনেই বুঝতে পারছিস নে, আমাদের চন্দ্রহাসের হাসি?

কী আশ্চর্য হাসি ওর।

যেন ঝরনার মতো, কালো পাথরটাকে ঠেলে নিয়ে চলে।

যেন সূর্যের আলো, কুয়াশার তাড়কা রাক্ষসীকে তলোয়ার দিয়ে টুকরো টুকরো করে কাটে।

যাক আমাদের চৌপদীর ফাঁড়া কাটল। এবার উঠে পড়্‌।

এবার কাজ ছাড়া কথা নেই--চরাচরমিদং সর্বং কীর্তির্যস্য স জীবতি।

ও আবার কী রকম কথা হল। ঈশানকে এখনো চৌপদীর ভূত ছাড়ে নি।

কীর্তি? নদী কি নিজের ফেনাকে গ্রাহ্য করে। কীর্তি তো আমাদের ফেনা--ছড়াতে ছড়াতে চলে যাব। ফিরে তাকাব না।

এসো ভাই চন্দ্রহাস এসো, তোমার হাসিমুখ যে!

চন্দ্রহাস।

বুড়োর রাস্তার সন্ধান পেয়েছি।

কার কাছ থেকে।

চন্দ্রহাস।

এই বাউলের কাছ থেকে।

ও কী। ও যে অন্ধ!

চন্দ্রহাস।

সেইজন্যে ওকে রাস্তা খুঁজতে হয় না, ও ভিতর থেকে দেখতে পায়।

কী হে ভাই, ঠিক নিয়ে যেতে পারবে তো?

বাউল।

ঠিক নিয়ে যাব।

কেমন ক'রে।

বাউল।

আমি যে পায়ের শব্দ শুনতে পাই।

কান তো আমাদেরও আছে, কিন্তু--

বাউল।

আমি যে সব-দিয়ে শুনি--শুধু কান-দিয়ে না।

চন্দ্রহাস।

রাস্তায় যাকে জিজ্ঞাসা করি বুড়োর কথা শুনলেই আঁতকে ওঠে, কেবল দেখি এরই ভয় নেই।

ও বোধ হয় চোখে দেখতে পায় না বলেই ভয় করে না।

বাউল।

না গো, আমি কেন ভয় করি নে বলি। একদিন আমার দৃষ্টি ছিল। যখন অন্ধ হলুম ভয় হল দৃষ্টি বুঝি হারালুম। কিন্তু চোখওয়ালার দৃষ্টি অস্ত যেতেই অন্ধের দৃষ্টির উদয় হল। সূর্য যখন গেল তখন দেখি অন্ধকারের বুকের মধ্যে আলো। সেই অবধি অন্ধকারকে আমার আর ভয় নেই।

তা হলে এখন চলো। ঐ তো সন্ধ্যাতারা উঠেছে।

বাউল।

আমি গান গাইতে গাইতে যাই, তোমরা আমার পিছনে পিছনে এসো। গান না গাইলে আমি রাস্তা পাই নে।

সে কী কথা হে।

বাউল।

আমার গান আমাকে ছাড়িয়ে যায়--সে এগিয়ে চলে, আমি পিছনে চলি।

গান

ধীরে বন্ধু ধীরে ধীরে

চলো তোমার বিজন মন্দিরে।

জানি নে পথ, নাই যে আলো,

ভিতর বাহির কালোয় কালো,

তোমার চরণশব্দ বরণ করেছি

আজ এই অরণ্যগভীরে।

ধীরে বন্ধু ধীরে ধীরে।

চলো অন্ধকারের তীরে তীরে।

চলব আমি নিশীথরাতে

তোমার হাওয়ার ইশারাতে,

তোমার বসনগন্ধ বরণ করেছি

আজ এই বসন্তসমীরে॥

১৫ ফাল্গুন, ১৩২২
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7