প্রকাশ

গুহাদ্বার

প্রকাশ

গুহাদ্বার

দেখ্‌ দেখি ভাই, আবার আমাদের ফেলে রেখে চন্দ্রহাস কোথায় গেল।

ওকে কি ধরে রাখবার জো আছে।

বসে বিশ্রাম করি আমরা, ও চ'লে বিশ্রাম করে।

অন্ধ বাউলকে নিয়ে সে নদীর ওপারে চলে গেছে।

আর কিছু নয়, ঐ অন্ধের অন্ধতার মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়ে তবে ও ছাড়বে।

তাই আমাদের সর্দার ওকে ডুবুরি বলে।

চন্দ্রহাস একটু সরে গেলেই আর আমাদের খেলার রস থাকে না।

ও কাছে থাকলে মনে হয় কিছু হোক বা না হোক তবু মজা আছে। এমন-কি, বিপদের আশঙ্কা থাকলে মনে হয় সে আরো বেশি মজা।

আজ এই রাত্রে ওর জন্যে মনটা কেমন করছে।

দেখছিস এখানকার হাওয়াটা কেমনতরো?

এখানে আকাশটা যেন যাবার বেলাকার বন্ধুর মতো মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

যারা সেখানে বলছিল চল্‌ চল্‌, তারা এখানে বলছে যাই যাই।

কথাটা একই, সুরটা আলাদা।

মনটার ভিতরে কেমন ব্যথা দিচ্ছে, তবু লাগছে ভালো।

ঝাউগাছের বীথিকার ভিতর দিয়ে কোথা থেকে এই একটা নদীর স্রোত চলে আসছে, এ যেন কোন্‌ দুপুররাতের চোখের জল।

পৃথিবীর দিকে এমন করে কখনো আমরা দেখি নি।

উর্ধ্বশ্বাসে যখন সামনে ছুটি তখন সামনের দিকেই চোখ থাকে, চার পাশের দিকে নয়।

বিদায়ের বাঁশিতে যখন কোমল ধৈবত লাগে তখনি সকলের দিকে চোখ মেলি।

আর দেখি বড়ো মধুর। যদি সবাই চলে চলে না যেত তা হলে কি কোনো মাধুরী চোখে পড়ত।

চলার মধ্যে যদি কেবলই তেজ থাকত তা হলে যৌবন শুকিয়ে যেত। তার মধ্যে কান্না আছে তাই যৌবনকে সবুজ দেখি।

এই জায়গাটাতে এসে শুনতে পাচ্ছি, জগৎটা কেবল পাব পাব বলছে না--সঙ্গে সঙ্গেই বলছে, ছাড়ব, ছাড়ব।

সৃষ্টির গোধূলিলগ্নে "পাব'র সঙ্গে "ছাড়ব'র বিয়ে হয়ে গেছে রে--তাদের মিল ভাঙলেই সব ভেঙে যাবে।

অন্ধ বাউল আমাদের এ কোন্‌ দেশে আনলে ভাই।

ঐ তারাগুলোর দিকে তাকাচ্ছি আর মনে হচ্ছে, যুগে যুগে যাদের ফেলে এসেছি তাদের অনিমেষ দৃষ্টিতে সমস্ত রাত একেবারে ছেয়ে রয়েছে।

ফুলগুলোর মধ্যে কারা বলছে মনে রেখো, মনে রেখো, তাদের নাম তো মনে নেই কিন্তু মন যে উদাস হয়ে ওঠে।

একটা গান না গাইলে বুক ফেটে যাবে।

গান

গান

তুই ফেলে এসেছিস কারে। (মন, মন রে আমার)

তাই জনম গেল, শান্তি পেলি না রে। (মন, মন রে আমার)

যে পথ দিয়ে চলে এলি

সে পথ এখন ভুলে গেলি,

কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে। (মন, মন রে আমার)

নদীর জলে থাকি রে কান পেতে,

কাঁপে যে প্রাণ পাতার মর্মরেতে।

মনে হয় রে পাব খুঁজি

ফুলের ভাষা যদি বুঝি,

যে পথ গেছে সন্ধ্যাতারার পারে॥ (মন, মন রে আমার)

এবার আমাদের বসন্ত-উৎসবে এ কী রকম সুর লাগছে।

এ যেন ঝরা পাতার সুর।

এতদিন বসন্ত তার চোখের জলটা আমাদের কাছে লুকিয়েছিল।

ভেবেছিল আমরা বুঝতে পারব না, আমরা যে যৌবনে দুরন্ত।

আমাদের কেবল হাসি দিয়ে ভুলোতে চেয়েছিল।

কিন্তু আজ আমরা আমাদের মনকে মজিয়ে নেব এই সমুদ্রপারের দীর্ঘনিশ্বাসে।

প্রিয়া, এই পৃথিবী আমাদের প্রিয়া। এই সুন্দরী পৃথিবী। সে চাচ্ছে আমাদের যা আছে সমস্তই--আমাদের হাতের স্পর্শ, আমাদের হৃদয়ের গান--

চাচ্ছে যা আমাদের আপনার মধ্যে আপনার কাছ থেকেও লুকিয়ে আছে।

ও যে কিছু পায় কিছু পায় না, এইজন্যেই ওর কান্না। পেতে পেতেই সব হারিয়ে যায়।

ওগো পৃথিবী, তোমাকে আমরা ফাঁকি দেব না।

গান

আমি যাব না গো অমনি চলে।

মালা তোমার দেব গলে।

অনেক সুখে অনেক দুখে

তোমার বাণী নিলেম বুকে,

ফাগুনশেষে যাবার বেলা

আমার বাণী যাব বলে।

কিছু হল, অনেক বাকি;

ক্ষমা আমায় করবে না কি।

গান এসেছে সুর আসে নাই

হল না যে শোনানো তাই,

সে-সুর আমার রইল ঢাকা

নয়নজলে নয়নজলে॥

ও ভাই, কে যেন গেল বোধ হচ্ছে।

আরে, গেল গেল গেল, এ ছাড়া আর তো কিছুই বোধ হচ্ছে না।

আমার গায়ের উপর কোন্‌ পথিকের কাপড় ঠেকে গেল।

নিয়ে চলো পথিক, নিয়ে চলো তোমার সঙ্গে, হাওয়া যেমন ফুলের গন্ধ নিয়ে যায়।

কাকে ধরে আনবার জন্যে বেরিয়েছিলুম কিন্তু ধরা দেবার জন্যেই মন আকুল হল।

বাউলের প্রবেশ

বাউলের প্রবেশ

এই যে আমাদের বাউল। আমাদের এ কোথায় এনেছ, এখানে সমস্ত পথিক জগতের নিশ্বাস আমাদের গায়ে লাগছে--সমস্ত তারাগুলোর।

আমরা খেলাচ্ছলে বেরিয়েছিলুম কিন্তু খেলাটা যে কী তা ভুলেই গেছি।

আমরা তাকেই ধরতে বেরিয়েছিলুম পৃথিবীর মধ্যে যে বুড়ো।

রাস্তায় সবাই বললে সে ভয়ংকর। সে কেবলমাত্র একটা মুণ্ডু, একটা হাঁ, যৌবনের চাঁদকে গিলে খাবার জন্যেই তার একমাত্র লোভ।

কিন্তু ভয় ভেঙে গেছে। মনের ভিতর বলছে সে যদি আমাকে চায় তবে আমিও বসে থাকব না। ফুল যাচ্ছে, পাতা যাচ্ছে, নদীর জল যাচ্ছে-- তার পিছন পিছন আমিও যাব।

ও ভাই বাউল, তোমার একতারাতে একটা সুর লাগাও। রাত কত হল কে জানে। হয়তো বা ভোর হয়ে এল।

বাউলের গান

বাউলের গান

সবাই যারে সব দিতেছে

তার কাছে সব দিয়ে ফেলি।

কবার আগে চাবার আগে

আপনি আমায় দেব মেলি।

নেবার বেলা হলেম ঋণী,

ভিড় করেছি, ভয় করি নি,

এখনো ভয় করব না রে,

দেবার খেলা এবার খেলি।

প্রভাত তারি সোনা নিয়ে

বেরিয়ে পড়ে নেচে-কুঁদে।

সন্ধ্যা তারে প্রণাম করে

সব সোনা তার দেয় রে শুধে।

ফোটা ফুলের আনন্দ রে

ঝরা ফুলেই ফলে ধরে,

আপনাকে ভাই ফুরিয়ে দেওয়া

চুকিয়ে দে তুই বেলাবেলি॥

ওহে বাউল, চন্দ্রহাস এখনো এল না কেন।

বাউল।

সে যে গেছে, তা জানো না?

গেছে? কোথায় গেছে।

বাউল।

সে বললে, আমি তাকে জয় করে আনব।

কাকে।

বাউল।

যাকে সবাই ভয় করে। সে বললে, নইলে আমার কিসের যৌবন।

বাঃ, এ তো বেশ কথা! দাদা গেল পাড়ার লোককে চৌপদী শোনাতে, আর চন্দ্রহাস কোথায় গেল ঠিকানাই নেই!

বাউল।

সে বললে, যুগে যুগে মানুষ লড়াই করেছে, আজ বসন্তের হাওয়ায় তারি ঢেউ।

তারি ঢেউ?

বাউল।

হাঁ। খবর এসেছে মানুষের লড়াই শেষ হয় নি।

বসন্তের এই কি খবর।

বাউল।

যারা ম'রে অমর, বসন্তের কচি পাতায় তারাই পত্র পাঠিয়েছে। দিগ্‌দিগন্তে তারা রটাচ্ছে-- "আমরা পথের বিচার করি নি--আমরা পাথেয়ের হিসাব রাখি নি--আমরা ছুটে এসেছি, আমরা ফুটে বেরিয়েছি। আমরা যদি ভাবতে বসতুম তা হলে বসন্তের দশা কী হত।"

চন্দ্রহাস তাই বুঝি খেপে উঠেছে?

বাউল।

সে বললে--

গান

বসন্তে ফুল গাঁথল আমার

জয়ের মালা।

বইল প্রাণে দখিন হাওয়া

আগুন-জ্বালা।

পিছের বাঁশি কোণের ঘরে

মিছে রে ওই কেঁদে মরে,

মরণ এবার আনল আমার

বরণ-ডালা।

যৌবনেরি ঝড় উঠেছে

আকাশ পাতালে।

নাচের তালের ঝংকারে তা'র

আমায় মাতালে।

কুড়িয়ে নেবার ঘুচল পেশা,

উড়িয়ে দেবার লাগল নেশা,

আরাম বলে, "এল আমার

যাবার পালা।"

কিন্তু সে গেল কোথায়।

বাউল।

সে বললে, আমি পথ চেয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারব না। আমি এগিয়ে গিয়ে ধরব। আমি জয় করে আনব।

কিন্তু গেল কোন্‌ দিকে।

বাউল।

সেই গুহার মধ্যে চলে গেছে।

সে কী কথা। সে যে ঘোর অন্ধকার।

কোনো খবর না নিয়েই একেবারে--

বাউল।

সে নিজেই খবর নিতে গেছে।

ফিরবে কখন।

তুইও যেমন! সে কি আর ফিরবে।

কিন্তু চন্দ্রহাস গেলে আমাদের জীবনের রইল কী।

আমাদের সর্দারের কাছে কী জবাব দেব।

এবার সর্দারও আমাদের ছাড়বে।

যাবার সময় আমাদের কী বলে গেল সে।

বাউল।

বললে, আমার জন্যে অপেক্ষা ক'রো, আমি আবার ফিরে আসব।

ফিরে আসবে? কেমন করে জানব।

বাউল।

সে তো বললে, আমি জয়ী হয়ে ফিরে আসব।

তা হলে আমরা সমস্ত রাত অপেক্ষা করে থাকব।

বাউল, এই-যে গুহার ভিতর থেকে নদীর জল বেরিয়ে আসছে এরই মুখের কাছে।

ঐ গুহায় কোন্‌ রাস্তা দিয়ে গেল। ওখানে যে কালো খাঁড়ার মতো অন্ধকার।

বাউল।

রাত্রের পাখিগুলোর ডানার শব্দ ধ'রে গেছে।

তুমি সঙ্গে গেলে না কেন।

বাউল।

আমাকে তোমাদের আশ্বাস দেবার জন্যে রেখে গেল।

কখন গেছে বলো তো।

বাউল।

অনেকক্ষণ--রাতের প্রথম প্রহরেই।

এখন বোধ হয় তিন প্রহর পেরিয়ে গেছে। কেমন একটা ঠাণ্ডা হাওয়া দিয়েছে--গা সির্‌ সির্‌ করছে।

দেখ্‌ ভাই, স্বপ্ন দেখেছি যেন তিন জন মেয়েমানুষ চুল এলিয়ে দিয়ে--

তোর স্বপ্নের কথা রেখে দে। ভালো লাগছে না।

সব লক্ষণগুলো কেমন খারাপ ঠেকছে।

পেঁচাটা ডাকছিল, এতক্ষণ কিছু মনে হয় নি--কিন্তু--

মাঠের ওপারে কুকুরটা কী রকম বিশ্রী সুরে চেঁচাচ্ছে শুনছিস!

ঠিক যেন তার পিঠের উপর ডাইনি সওয়ার হয়ে তাকে চাবকাচ্ছে।

যদি ফেরবার হত চন্দ্রহাস এতক্ষণে ফিরত।

রাতটা কেটে গেলে বাঁচা যায়।

শোন্‌ রে ভাই, ঐ মেয়েমানুষের কান্না!

ওরা তো কাঁদছেই -- কেবল কাঁদছেই, অথচ কাউকে ধরে রাখতে পারছে না।

নাঃ, আর পারা যায় না -- চুপ করে বসে থাকলেই যত কুলক্ষণ দেখা যায়।

চল্‌ আমরাও যাই -- পথ চললেই ভয় থাকে না।

পথ দেখাবে কে।

ঐ যে বাউল আছে।

কী হে, তুমি পথ দেখাতে পারো?

বাউল।

পারি।

বিশ্বাস করতে সাহস হয় না। তুমি চোখে না দেখে পথ বের কর শুধু গান গেয়ে?

তুমি চন্দ্রহাসকে কী রাস্তা দেখিয়ে দিলে। যদি সে ফিরে আসে তবে তোমাকে বিশ্বাস করব।

ফিরে যদি না আসে তা হলে কিন্তু--

চন্দ্রহাসকে যে আমরা এত ভালোবাসতুম তা জানতুম না।

এতদিন ওকে নিয়ে আমরা যা-খুশি তাই করেছি।

যখন খেলি তখন খেলাটাই হয় বড়ো, যার সঙ্গে খেলি তাকে নজর করি নে।

এবার যদি সে ফেরে, তাকে মুহূর্তের জন্যে অনাদর করব না।

আমার মনে হচ্ছে আমরা কেবলই তাকে দুঃখ দিয়েছি।

তার ভালোবাসা সব দুঃখকে ছাড়িয়ে উঠেছিল।

সে যে কী সুন্দর ছিল তাকে চোখে দেখলুম তখন সেটা চোখে পড়ে নি।

গান

চোখের আলোয় দেখেছিলেম

চোখের বাহিরে।

অন্তরে আজ দেখব, যখন

আলোক নাহি রে।

ধরায় যখন দাও না ধরা

হৃদয় তখন তোমায় ভরা,

এখন তোমার আপন আলোয়

তোমায় চাহি রে।

তোমায় নিয়ে খেলেছিলেম

খেলার ঘরেতে।

খেলার পুতুল ভেঙে গেছে

প্রলয় ঝড়েতে।

থাক্‌ তবে সেই কেবল খেলা,

হোক-না এখন প্রাণের মেলা--

তারের বীণা ভাঙল, হৃদয়-

বীণায় গাহি রে॥

ঐ বাউলটা চুপ করে বসে থাকে, কথা কয় না, ভালো লাগছে না।

ও কেমন যেন একটা অলক্ষণ।

যেন কালবৈশাখীর প্রথম মেঘ।

দাও ভাই দাও, ওকে বিদায় করে দাও।

না, না, ও বসে আছে তবু একটা ভরসা আছে।

দেখছ না ওর মুখে কিচ্ছু ভয় নেই।

মনে হচ্ছে ওর কপালে যেন কী সব খবর আসছে।

ওর সমস্ত গা যেন অনেক দূরের কাকে দেখতে পাচ্ছে। ওর আঙুলের আগায় চোখ ছড়িয়ে আছে।

ওকে দেখলেই বুঝতে পারি কে আসছে অন্ধকারের ভিতর দিয়ে পথ করে।

ঐ দেখো জোড়হাত করে উঠে দাঁড়িয়েছে।

পুবের দিকে মুখে করে কাকে প্রণাম করছে।

ওখানে তো কিচ্ছুই নেই--একটু আলোর রেখাও না।

একবার জিজ্ঞাসাই করো-না, ও কী দেখছে--কাকে দেখছে।

না, না এখন ওকে কিছু বোলো না।

আমার কী মনে হচ্ছে জান? যেন ওর মধ্যে সকাল হয়েছে।

যেন ওর ভুরুর মাঝখানে অরুণের আলো খেয়া-নৌকোটির মতো এসে ঠেকেছে।

ওর মনটা ভোরবেলাকার আকাশের মতো চুপ।

এখনি যেন পাখির গানের ঝড় উঠবে--তার আগে সমস্ত থম্‌থমে।

ঐ যে একটু একটু একতারাতে ঝংকার দিচ্ছে, ওর মন গান গাচ্ছে।

চুপ করো চুপ করো, ঐ গান ধরেছে।

বাউলের গান

বাউলের গান

হবে জয়, হবে জয়,হবে জয় রে

ওহে বীর, হে নির্ভয়।

জয়ী প্রাণ, চিরপ্রাণ,

জয়ী রে আনন্দগান,

জয়ী প্রেম, জয়ী ক্ষেম,

জয়ী জ্যোতির্ময় রে।

এ আঁধার হবে ক্ষয়, হবে ক্ষয় রে,

ওহে বীর, হে নির্ভয়।

ছাড়ো ঘুম, মেলো চোখ,

অবসাদ দূর হোক,

আশার অরুণালোক

হোক অভ্যুদয় রে॥

ঐ-যে!

চন্দ্রহাস, চন্দ্রহাস!

রোস্‌ রোস্‌, ব্যস্ত হোস্‌ নে--এখনো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।

না, ও চন্দ্রহাস ছাড়া আর কেউ হতে পারে না।

বাঁচলুম, বাঁচলুম।

এসো এসো চন্দ্রহাস।

এতক্ষণ আমাদের ছেড়ে কী করলে ভাই বলো।

চন্দ্রহাস।

ধরেছি, তাকে ধরেছি।

কই তাকে তো দেখছি নে।

চন্দ্রহাস।

সে আসছে--এখনি আসছে।

কী তুমি দেখলে আমাকে বলো ভাই।

চন্দ্রহাস।

সে তো আমি বলতে পারব না।

কেন।

চন্দ্রহাস।

সে তো আমি চোখ দিয়ে দেখি নি।

তবে?

চন্দ্রহাস।

আমার সব দিয়ে দেখেছিলুম।

তা হোক-না, বলো-না ভাই।

চন্দ্রহাস।

আমার সমস্ত দেহ মন যদি কণ্ঠ হত বলতে পারত।

কাকে তুমি ধরেছ তাও কি বুঝতে পারলে না।

জগতের সেই বিরাট বুড়োটাকে?

যে-বুড়োটা অগস্ত্যের মতো পৃথিবীর যৌবনসমুদ্র শুষে খেতে চায়?

সেই যে ভয়ংকর? যে অন্ধকারের মতো? যার বুকে চোখ?

যার পা উলটো দিকে? যে পিছনে হেঁটে চলে?

নরমুণ্ড যার গলায়? শ্মশানে যার বাস?

ভাই বাউল, তুমি দেখেছ তাকে?

বাউল।

হাঁ, এই তো দেখছি।

কই।

বাউল।

এই-যে।

ঐ-যে বেরিয়ে এল, বেরিয়ে এল।

ঐ-যে কে গুহা থেকে বেরিয়ে এল।

আশ্চর্য! আশ্চর্য!

তুমি! সেই আমাদের সর্দার!

আমাদের সর্দার রে!

বুড়ো কোথায়।

সর্দার।

কোথাও তো নেই।

কোথাও না?

সর্দার।

না।

তবে সে কী।

সর্দার।

সে স্বপ্ন।

চন্দ্রহাস।

তবে তুমিই চিরকালের?

সর্দার।

হাঁ।

চন্দ্রহাস।

আর আমরাই চিরকালের?

সর্দার।

হাঁ।

পিছন থেকে যারা তোমাকে দেখলে তারা যে তোমাকে কত লোকে কত রকম মনে করলে তার ঠিক নেই।

সেই ধুলোর ভিতর থেকে আমরা তো তোমাকে চিনতে পারি নি।

তখন তোমাকে হঠাৎ বুড়ো বলে মনে হল।

তার পর গুহার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল। এখন মনে হচ্ছে যেন তুমি বালক।

যেন তোমাকে এই প্রথম দেখলুম।

চন্দ্রহাস।

এ তো বড়ো আশ্চর্য! তুমি বারে বারেই প্রথম, তুমি ফিরে ফিরেই প্রথম।

ভাই চন্দ্রহাস, তোমারই হার হল। বুড়োকে ধরতে পারলে না।

চন্দ্রহাস।

আর দেরি না--এবার উৎসব শুরু হোক। সূর্য উঠেছে।

ভাই বাউল, তুমি যদি অমন চুপ করে থাক তা হলে মূর্ছিত হয়ে পড়বে। একটা গান ধরো।

বাউলের গান

বাউলের গান

তোমায় নতুন করেই পাব বলে

হারাই ক্ষণে ক্ষণ,

ও মোর ভালোবাসার ধন।

দেখা দেবে বলে তুমি

হও যে অদর্শন,

ও মোর ভালোবাসার ধন।

ওগো তুমি আমার নও আড়ালের,

তুমি আমার চিরকালের,

ক্ষণকালের লীলার স্রোতে

হও যে নিমগন,

ও মোর ভালোবাসার ধন।

আমি তোমায় যখন খুঁজে ফিরি

ভয়ে কাঁপে মন,

প্রেমে আমার ঢেউ লাগে তখন।

তোমার শেষ নাহি, তাই শূন্য সেজে

শেষ করে দাও আপনাকে যে,

ওই হাসি রে দেয় ধুয়ে মোর

বিরহের রোদন,

ও মোর ভালোবাসার ধন॥

ঐ-যে গুন গুন শব্দ শোনা যাচ্ছে।

শুনছি বটে।

ও তো মধুকরের দল নয়, পাড়ার লোক।

তা হলে দাদা আসছে চৌপদী নিয়ে।

দাদা।

সর্দার নাকি।

সর্দার।

কী, দাদা।

দাদা।

ভালোই হয়েছে। চৌপদীগুলো শুনিয়ে দিই।

না, না, গুলো নয়, গুলো নয়। একটা।

দাদা।

আচ্ছা ভাই, ভয় নেই, একটাই হবে।

সূর্য এল পূর্বদ্ধারে তূর্য বাজে তার।

রাত্রি বলে, ব্যর্থ নহে এ মৃত্যু আমার,

এত বলি পদপ্রান্তে করে নমস্কার।

ভিক্ষাঝুলি স্বর্ণে ভরি গেল অন্ধকার॥

অর্থাৎ--

আবার অর্থাৎ !

না, এখানে অর্থাৎ চলবে না।

দাদা।

এর মানে--

না, মানে না। মানে বুঝব না এই আমাদের প্রতিজ্ঞা।

দাদা।

এমন মরিয়া হয়ে উঠলে কেন।

আজ আমাদের উৎসব।

দাদা।

উৎসব নাকি। তা হলে আমি পাড়ায়--

চন্দ্রহাস।

না, তোমাকে পাড়ায় যেতে দিচ্ছি নে।

দাদা।

আমাকে দরকার আছে না কি।

আছে।

দাদা।

আমার চৌপদী--

চন্দ্রহাস।

তোমার চৌপদীকে আমরা এমনি রাঙিয়ে দেব যে তার অর্থ আছে কি না আছে বোঝা দায় হবে।

সুতরাং অর্থ না থাকলে মানুষের যে দশা হয় তোমার তাই হবে।

অর্থাৎ পাড়ার লোকে তোমাকে ত্যাগ করবে।

কোটাল তোমাকে বলবে অবোধ।

পণ্ডিত বলবে অর্বাচীন।

ঘরের লোক বলবে অনাবশ্যক।

বাইরের লোক বলবে অদ্ভুত।

চন্দ্রহাস।

আমরা তোমার মাথায় পরাব নব পল্লবের মুকুট।

তোমার গলায় পরাব নব মল্লিকার মালা।

পৃথিবীতে এই আমরা ছাড়া আর কেউ তোমার আদর বুঝবে না।

সকলে মিলিয়া

উৎসবের গান

আয় রে তবে মাত্‌ রে সবে আনন্দে

আজ নবীন প্রাণের বসন্তে।

পিছনপানের বাঁধন হতে

চল্‌ ছুটে আজ বন্যাস্রোতে,

আপনাকে আজ দখিন হাওয়ায়

ছড়িয়ে দে রে দিগন্তে,

আজ নবীন প্রাণের বসন্তে।

বাঁধন যত ছিন্ন করো আনন্দে

আজ নবীন প্রাণের বসন্তে।

অকূল প্রাণের সাগর-তীরে

ভয় কী রে তোর ক্ষয়-ক্ষতিরে।

যা আছে রে সব নিয়ে তোর

ঝাঁপ দিয়ে পড়্‌ অনন্তে

আজ নবীন প্রাণের বসন্তে॥

১৫ ফাল্গুন, ১৩২২
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7