কেদার।

কেদার।

শ্যালীর বিবাহ তো নির্বিঘ্নে হয়ে গেছে। কিন্তু বৈকুণ্ঠ থাকতে এখানে বাস করে সুখ হচ্ছে না। উপদ্রব তো করা যাচ্ছে, কিন্তু বুড়ো নড়ে না।

বৈকুণ্ঠের প্রবেশ

বৈকুণ্ঠের প্রবেশ

বৈকুণ্ঠ।

এই-যে কেদারবাবু, আপনাকে শুকনো দেখাচ্ছে যে। অসুখ করে নি তো?

কেদার।

ওর নাম কী, ডাক্তারে সকল রকম মানসিক পরিশ্রম নিষেধ করেছে--

বৈকুণ্ঠ।

আহা, কী দুঃখের বিষয়! আপনি এখানেই কিছুদিন বিশ্রাম করুন।

কেদার।

সেইরকমই তো স্থির করেছি।

বৈকুণ্ঠ।

তা দেখুন, বেণীবাবুকে--

কেদার।

বেণীবাবু নয়, বিপিনবাবুর কথা বলছেন বোধ হয়--

বৈকুণ্ঠ।

হাঁ হাঁ, বিপিনবাবুই বটে, ওই যে তিনি ছোটোবউমার কে হন--

কেদার।

খুড়ো হন--

বৈকুণ্ঠ।

খুড়োই হবেন। তা, তাঁকে আমার এই ঘরে থাকতে দিয়েছেন, সে কি তাঁর--

কেদার।

না, ওর নাম কী, তাঁর কোনো অসুবিধে হয় নি, তিনি বেশ আছেন--

বৈকুণ্ঠ।

জানেন তো কেদারবাবু, আমি এই ঘরেই লিখে থাকি--

কেদার।

তা বেশ তো, আপনি লিখবেন, ওর নাম কী, আপনি লিখবেন--তাতে বিপিনবাবুর কোনো আপত্তি নেই।

বৈকুণ্ঠ।

না, আপত্তি কেন করবেন, লোকটি বেশ--কিন্তু তাঁর একটি অভ্যাস আছে, তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রায় সর্বদাই গুন গুন করে গান করেন, তাতে লেখবার সময়--

কেদার।

কী বলে, সেজন্যে ভাবনা কী। আপনি তাঁকে ডেকেই বলুন-না--

বৈকুণ্ঠ।

না না না না। সে থাক্‌। তিনি ভদ্রলোক--

কেদার।

ওর নাম কী, আমিই তাঁকে ডেকে খুব ভৎসনা করে দিচ্ছি--

বৈকুণ্ঠ।

না না কেদারবাবু, সে করবেন না--লেখার সময় গান তো আমার ভালোই লাগে। কিন্তু আমি ভাবছিলুম, হয়তো আর কোনো ঘরে বেণীবাবু একলা থাকলে বেশ মন খুলে গাইতে পারেন।

কেদার।

ওর নাম কী, ঠিক উলটো। বিপিনবাবুর একটি লোক সর্বদাই চাই--

বৈকুণ্ঠ।

তা দেখেছি-- বড়ো মিশুক-- হয় গান নয় গল্প করছেনই-- তা আমি তাঁর কথা মন দিয়ে শুনে থাকি।-- কিন্তু দেখো কেদারবাবু, কিছু মনে কোরো না ভাই--একটা বড়ো গুরুতর বেদনা পেয়েছি, সে কথা তোমাকে না বলে থাকতে পারছি নে। ভাই, আমার সেই স্বরসূত্রসার পুঁথিখানি কে নিয়েছে।

কেদার।

কোথায় ছিল বলুন দেখি।

বৈকুণ্ঠ।

সে তো আপনি জানেন। এই ঘরে ঐ শেলফের উপর ছিল। আজকাল এ ঘরে সর্বদা লোক আনাগোনা করছেন, আমি কাউকে কিছুই বলতে পারছি নে--কিন্তু শেলফের ঐ জায়গাটা শূন্য দেখছি আর মনে হচ্ছে আমার বুকের কখানা পাঁজর খালি হয়ে গেছে।

কেদার।

তবে আপনাকে, ওর নাম কী, খুলে বলি, অবিনাশ আপনার লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে যায়।

বৈকুণ্ঠ।

অবু! সে তো এসব বই পড়ে না।

কেদার।

পড়ে না, ওর নাম কী, বিক্রি করে।

বৈকুণ্ঠ।

বিক্রি করে!

কেদার।

নতুন প্রণয়-- নতুন শখ-- ওর নাম কী, খরচ বেশি। আমি তাকে বলি অবু, কী বলে ভালো, মাইনের টাকা থেকে কিছু কিছু কেটে নিয়ে দাদাকে দিলেই হয়। অবু বলে, লজ্জা করে।

বৈকুণ্ঠ।

ছেলেমানুষ! প্রণয়ের খাতিরও এড়াতে পারে না, আবার দাদার সম্মানটিও রাখতে হবে।

কেদার।

ওর নাম কী, আমি আপনার বইখানি উদ্ধার করে আনব--

বৈকুণ্ঠ।

তা, যত টাকা লাগে--আপনার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে থাকব।

কেদার।

(স্বগত) বাজারে তো তার চার পয়সা দামও হল না, এ আরো হল ভালো-- ধর্মও রইল কিছু পাওয়াও গেল।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

অবিনাশের প্রবেশ

অবিনাশের প্রবেশ

অবিনাশ।

দাদা!

বৈকুণ্ঠ।

কী ভাই অবু!

অবিনাশ।

আমার কিছু টাকার দরকার হয়েছে--

বৈকুণ্ঠ।

তাতে লজ্জা কী অবু! আমি বলছি কী, এখন থেকে তোমার টাকা তুমিই রাখো না ভাই--আমি বুড়ো হয়ে গেলুম, হারিয়েই ফেলি কি ভুলেই যাই, আমার কি মনের ঠিক আছে।

অবিনাশ।

এ আবার কী নতুন কথা হল দাদা!

বৈকুণ্ঠ।

নতুন কথা নয় ভাই। তুমি বিয়েথাওয়া করে সংসারী হয়েছ, আমি তো সন্ন্যাসী মানুষ-

অবিনাশ।

তুমিই তো, দাদা, আমার বিয়ে দিয়ে দিলে--তাতেই যদি পর হয়ে থাকি, তবে থাক্‌, টাকাকড়ির কথা আর আমি বলব না।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

বৈকুণ্ঠ।

আহা, অবু, রাগ কোরো না , শোনো আমার কথাটা, আহা শুনে যাও--

"ভাবতে পারি নে পরের ভাবনা' গাহিতে গাহিতে বিপিনের প্রবেশ

"ভাবতে পারি নে পরের ভাবনা' গাহিতে গাহিতে বিপিনের প্রবেশ

বৈকুণ্ঠ।

এই-যে বেণীবাবু--

বিপিন।

আমার নাম বিপিনবিহারী।

বৈকুণ্ঠ।

হাঁ হাঁ, বিপিনবাবু। আপনার বিছানায় ওই-যে বইগুলি রেখেছেন ওগুলি পড়ছেন বুঝি?

বিপিন।

নাঃ, পড়ি নে, বাজাই।

বৈকুণ্ঠ।

বাজান? তা আপনাকে যদি বাঁয়া তবলা কি মৃদঙ্গ--

বিপিন।

সে তো আমার আসে না, আমি বই বাজাই। দেখুন বৈকুণ্ঠবাবু, আপনাকে রোজ বলব করি, ভুলে যাই-- আপনার এই ডেক্‌সো আর ঐ গোটাকতক শেলফ্‌ এখান থেকে সরাতে হচ্ছে, আমার বন্ধুরা সর্বদাই আসছে, তাদের বসাবার জায়গা পাচ্ছি নে--

বৈকুণ্ঠ।

আর তো ঘর দেখি নে--দক্ষিণের ঘরে কেদারবাবু আছেন, ডাক্তার তাঁকে বিশ্রাম করতে বলেছে--পুবের ঘরটায় কে কে আছেন আমি ঠিক চিনি নে-- তা বেণীবাবু--

বিপিন।

বিপিনবাবু--

বৈকুন্ঠ।

হাঁ ,হাঁ, বিপিনবাবু--তা, যদি ওগুলো এক পাশে সরিয়ে রাখি তা হলে কি কিছু অসুবিধে হয়?

বিপিন।

অসুবিধা আর কী, থাকবার কষ্ট হয়। আমি আবার বেশ একটু ফাঁকা না হলে থাকতে পারি নে। "ভাবতে পারি নে পরের ভাবনা লো সই!'

ঈশানের প্রবেশ

ঈশানের প্রবেশ

বৈকুণ্ঠ।

ঈশেন, এ ঘরে বেণীবাবুর--

বিপিন।

বিপিনবাবুর--

বৈকুণ্ঠ।

হাঁ, বিপিনবাবুর থাকার কিছু কষ্ট হচ্ছে।

ঈশান।

কষ্ট হয়ে থাকে তো আর আবশ্যক কী, ওঁর বাপের ঘরদুয়োর কিছু নেই নাকি!

বৈকুণ্ঠ।

ঈশেন, চুপ কর্‌।

বিপিন।

কী রাস্কেল, তুই এতবড়ো কথা বলিস!

ঈশান।

দেখো, গালমন্দ দিয়ো না বলছি--

বৈকুণ্ঠ।

আঃ ঈশেন, থাম্‌--

বিপিন।

আমি তোদের এ ঘরে পায়ের ধুলো মুছতে চাই নে, আমি এখনই চললুম।

বৈকুণ্ঠ।

যাবেন না বেণীবাবু, আমি গলবস্ত্র হয়ে বলছি মাপ করবেন-- (বৈকুণ্ঠকে ঠেলিয়া বিপিনের প্রস্থান) ঈশেন, তুই কী করলি বল্‌ দেখি--তুই আর আমাকে বাড়িতে টিকতে দিলি নে দেখছি।

ঈশান।

আমিই দিলুম না বটে!

বৈকুণ্ঠ।

দেখ্‌ ঈশেন, অনেক কাল থেকে আছিস, তোর কথাবার্তাগুলো আমাদের অভ্যাস হয়ে এসেছে, এরা নতুন মানুষ--এরা সইতে পারবে কেন? তুই একটু ঠাণ্ডা হয়ে কথা কইতে পারিস নে?

ঈশান।

আমি ঠাণ্ডা থাকি কী করে! এদের রকম দেখে আমার সর্বশরীর জ্বলতে থাকে।

বৈকুণ্ঠ।

ঈশেন, ওরা আমাদের নতুন কুটুম্ব, ওরা কিছুতে ক্ষুণ্ন হলে অবিনাশের গায়ে লাগবে, সে আমাকেও কিছু বলতে পারবে না, অথচ তার হল--

ঈশান।

সে তো সব বুঝেছি। সেইজন্যেই তো ছোটো বয়সে ছোটোবাবুকে বিয়ে দেবার জন্যে কতবার বলেছি। সময়কালে বিয়ে হলে এতটা বাড়াবাড়ি হয় না।

বৈকুণ্ঠ।

যা, আর বকিস নে ঈশেন, এখন যা, আমি সকল কথা একবার ভেবে দেখি।

ঈশান।

ভেবে দেখো! এখন যে কথাটা বলতে এসেছিলুম বলে নিই। আমাদের ছোটোমার খুড়ি না পিসি না কে এক বুড়ি এসে দিদিঠাকরুনকে যে দুঃখ দিচ্ছে সে তো আমার আর সহ্য হয় না।

বৈকুণ্ঠ।

আমার নীরুমাকে! সে তো কারও কিছুতে থাকে না।

ঈশান।

তাঁকে তো দিনরাত্তির দাসীর মতো খাটিয়ে মারছে। তার পরে আবার মাগী তোমার নামে খোঁটা দিয়ে তাঁকে বলে কিনা যে, তুমি তোমার ছোটোভাইয়ের টাকায় গায়ে ফুঁ দিয়ে বড়োমানষি করে বেড়াচ্ছ! মাগীর যদি দাঁত থাকত তো নোড়া দিয়ে ভেঙে দিতুম না!

বৈকুন্ঠ।

তা, নীরু কী বলে?

ঈশান।

তিনি তো তাঁর বাপেরই মেয়ে, মুখখানি যেন ফুলের মতো শুকিয়ে যায়, একটি কথা বলে না--

বৈকুণ্ঠ।

(কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া) একটা কথা আছে, "যে সয় তারই জয়'--

ঈশান।

সে কথা আমি ভালো বুঝি নে। আমি একবার ছোটোবাবুকে--

বৈকুণ্ঠ।

খবরদার ঈশেন, আমার মাথার দিব্যি দিয়ে বলছি, অবিনাশকে কোনো কথা বলতে পারবি নে।

ঈশান।

তবে চুপ করে বসে থাকব?

বৈকুণ্ঠ।

না, আমি একটা উপায় ঠাউরেছি। এখানে জায়গাতেও আর কুলোচ্ছে না, এঁদের সকলেরই অসুবিধে হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি, তা ছাড়া অবিনাশের এখন ঘর-সংসার হল, তার টাকাকড়ির দরকার, তার উপরে ভার চাপাতে আমার আর ইচ্ছে নেই--আমি এখান থেকে যেতে চাই--

ঈশান।

সে তো মন্দ কথা নয়, কিন্তু--

বৈকুণ্ঠ।

ওর আর কিন্তুটিন্তু নেই ঈশেন। সময় উপস্থিত হলেই প্রস্তুত হতে হয়।

ঈশান।

তোমার লেখাপড়ার কী হবে?

বৈকুণ্ঠ।

(হাসিয়া) আমার লেখা! সে আবার একটা জিনিস! সবাই হাসে, আমি কি তা জানি নে ঈশেন? ওসব রইল পড়ে। সংসারে লেখায় কারও কোনো দরকার নেই।

ঈশান।

ছোটোবাবুকে তো বলে কয়ে যেতে হবে?

বৈকুণ্ঠ।

তা হলে সে কিছুতেই যেতে দেবে না। সে তো আর আমাকে "যাও' বলতে পারবে না ঈশেন। গোপনেই যেতে হবে, তার পর তাকে লিখে জানাব। যাই, আমার নীরুকে একবার দেখে আসি গে।

[ উভয়ের প্রস্থান

[ উভয়ের প্রস্থান

তিনকড়ি ও কেদারের প্রবেশ

তিনকড়ি ও কেদারের প্রবেশ

তিনকড়ি।

দাদা, তুই তো আমাকে ফাঁকি দিয়ে হাসপাতালে পাঠালি, সেখান থেকেও আমি ফাঁকি দিয়ে ফিরেছি। কিছুতেই মলেম না।

কেদার।

তাই তো রে, দিব্যি টিকে আছিস যে।

তিনকড়ি।

ভাগ্যে, দাদা, একদিনও দেখতে যাও নি--

কেদার।

কেন রে!

তিনকড়ি।

যম বেটা ঠাউরালে এ ছোঁড়ার দুনিয়ায় কেউই নেই, নেহাত তাচ্ছিল্য করে নিলে না। ভাই, তোকে বলব কী, এই তিনকড়ের ভিতরে কতটা পদার্থ আছে সেইটে দেখবার জন্যে মেডিকাল কালেজের ছোকরাগুলো সব ছুরি উঁচিয়ে বসে ছিল--দেখে আমার অহংকার হত। যাই হোক দাদা, তুমি তো এখানে দিব্যি জমিয়ে বসেছ।

কেদার।

যা, যা, মেলা বকিস নে। এখন এ আমার আত্মীয়বাড়ি তা জানিস?

তিনকড়ি।

সমস্তই জানি, আমার অগোচর কিছুই নেই। কিন্তু বুড়ো বৈকুণ্ঠকে দেখছি নে যে। তাকে বুঝি ঠেলে দিয়েছিস? ওইটে তোর দোষ। কাজ ফুরোলেই--

কেদার।

তিনকড়ে! ফের! কানমলা খাবি।

তিনকড়ি।

তা, দে মলে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে হয়, বৈকুণ্ঠকে যদি তুই ফাঁকি দিস তা হলে অধর্ম হবে, আমার সঙ্গে যা করিস সে আলাদা--

কেদার।

ইস, এত ধর্ম শিখে এলি কোথা।

তিনকড়ি।

তা, যা বলিস ভাই, যদিচ তুমি-আমি এতদিন টিকে আছি তবু ধর্ম বলে একটা কিছু আছে। দেখো কেদারদা, আমি যখন হাসপাতালে পড়ে ছিলুম, বুড়োর কথা আমার সর্বদা মনে হত। পড়ে পড়ে ভাবতুম, তিনকড়ি নেই, এখন কেদারদার হাত থেকে বুড়োকে কে ঠেকাবে। বড়ো দুঃখ হত।

কেদার।

দেখ্‌ তিনকড়ে, তুই যদি এখানে আমাকে জ্বালাতে আসিস তা হলে--

তিনকড়ি।

মিথ্যে ভয় করছ দাদা। আমাকে আর হাসপাতালে পাঠাতে হবে না। এখানে তুমি একলাই রাজত্ব করবে। আমি দুদিনের বেশি কোথাও টিকতে পারি নে, এ জায়গাও আমার সহ্য হবে না।

কেদার।

তা হলে আর জামাকে দগ্ধাস কেন, নাহয় দুটো দিন আগেই গেলি।

তিনকড়ি।

বৈকুণ্ঠের খাতাখানা না চুকিয়ে যেতে পারছি নে, তুমি তাকে ফাঁকি দেবে জানি। অদৃষ্টে যা থাকে ওটা এই অভাগাকেই শুনতে হবে।

কেদার।

এ ছোঁড়াটাকে মেরে ধরে, গাল দিয়ে, কিছুতেই তাড়াবার জো নেই। তিনকড়ে, তোর খিদে পেয়েছে ?

তিনকড়ি।

কেন আর মনে করিয়ে দাও ভাই?

কেদার।

চল্‌, তোকে কিছু পয়সা দিই গে, বাজার থেকে জলখাবার কিনে এনে খাবি।

তিনকড়ি।

এ কী হল। তোমারও ধর্মজ্ঞান। হঠাৎ, ভালোমন্দ একটা কিছু হবে না তো।

[ উভয়ের প্রস্থান

[ উভয়ের প্রস্থান

ঈশান ও বৈকুণ্ঠের প্রবেশ

ঈশান ও বৈকুণ্ঠের প্রবেশ

বৈকুণ্ঠ।

ভেবেছিলুম, খাতাপত্রগুলো আর সঙ্গে নেব না--শুনে নীরুমা কাঁদতে লাগল, ভাবলে বুড়ো বয়সের খেলাগুলো বাবা কোথায় ফেলে যাচ্ছে। এগুলো নে ঈশেন--ঈশেন!

ঈশান।

কী বাবু!

বৈকুণ্ঠ।

ছোটোর উপর বড়োর যেরকম স্নেহ, বড়োর উপর ছোটোর সেরকম হয় না-- না ঈশেন?

ঈশান।

তাই তো দেখতে পাই।

বৈকুণ্ঠ।

আমি চলে গেলে অবু বোধ হয় বিশেষ কষ্ট পাবে না।

ঈশান।

না পাবারই সম্ভব। বিশেষ--

বৈকুণ্ঠ।

হাঁ, বিশেষ তার নতুন সংসার হয়েছে, আর তো আত্মীয়স্বজনের অভাব নেই, কী বলিস ঈশেন--

ঈশান।

আমিও তাই বলছিলুম।

বৈকুণ্ঠ।

বোধ হয় নীরুমার জন্যে তার মনটা, নীরুকে অবু বড়ো ভালোবাসে-- না ঈশেন?

ঈশান।

আগে তো তাই বোধ হত, কিন্তু--

বৈকুণ্ঠ।

অবিনাশ কি এসব জানে?

ঈশান।

তা কি আর জানেন না? তিনি যদি এর মধ্যে না থাকতেন, তা হলে কি আর বুড়িটা সাহস করত--

বৈকুণ্ঠ।

দেখ্‌ ঈশেন, তোর কথাগুলো বড়ো অসহ্য। তুই একটা মিষ্টিকথা বানিয়েও বলতে পারিস নে? এতটুকু বেলা থেকে আমি তাকে মানুষ করলুম--একদিনের জন্যেও চোখের আড়াল করি নি--আমি চলে গেলে তার কষ্ট হবে না এমন কথা তুই মুখে আনিস হারামজাদা বেটা! সে জেনে শুনে আমার নীরুকে কষ্ট দিয়েছে! লক্ষ্মীছাড়া পাজি, তোর কথা শুনলে বুক ফেটে যায়!

"ভাবতে পারি নে পরের ভাবনা" গাহিতে গাহিতে বিপিনের প্রবেশ

"ভাবতে পারি নে পরের ভাবনা" গাহিতে গাহিতে বিপিনের প্রবেশ

বিপিন।

ভেবেছিলুম ফিরে ডাকবে। ডাকে না যে। এই যে, বুড়ো এইখেনেই আছে।-- বৈকুণ্ঠবাবু, আমার জিনিসপত্র নিতে এলুম। আমার ওই হুঁকোটা আর ওই ক্যাম্বিসের ব্যাগটা। ঈশেন, শিগগির মুটে ডাকো।

বৈকুন্ঠ।

সে কী কথা! আপনি এখানেই থাকুন। আমি করজোড় করে বলছি, আমাকে মাপ করুন বেণীবাবু।

বিপিন।

বিপিনবাবু--

বৈকুণ্ঠ।

হাঁ হাঁ, বিপিনবাবু। আপনি থাকুন, আমরা এখনই ঘর খালি করে দিচ্ছি।

বিপিন।

এই বইগুলো কী হবে?

বৈকুণ্ঠ।

সমস্তই সরাচ্ছি।

[শেল্‌ফ হইতে বই ভুমিতে নাবাইতে প্রবৃত্ত

[শেল্‌ফ হইতে বই ভুমিতে নাবাইতে প্রবৃত্ত

ঈশান।

এ বইগুলিকে বাবু যেন বিধবার পুত্রসন্তানের মতো দেখত, ধুলো নিজের হাতে ঝাড়ত, আজ ধুলোয় ফেলে দিচ্ছে!

[ চক্ষু-মোছন

[ চক্ষু-মোছন

বিপিন।

কেদারের ঘরে আফিমের কৌটা-- ফেলে এসেছি--নিয়ে আসি গে। "ভাবতে পারি নে পরের ভাবনা লো সই'।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

তিনকড়ির প্রবেশ

তিনকড়ির প্রবেশ

তিনকড়ি।

এই-যে পেয়েছি। বৈকুণ্ঠবাবু, ভালো তো?

বৈকুণ্ঠ।

কী বাবা, তুমি ভালো আছ? অনেক দিন দেখি নি।

তিনকড়ি।

ভয় কী বৈকুণ্ঠবাবু, আবার অনেক দিন দেখতে পাবেন। ধরা দিয়েছি, এখন আপনার খাতাপত্র বের করুন।

বৈকুণ্ঠ।

সে-সব আর নেই তিনকড়ি, তুমি এখন নিশ্চিন্ত মনে এখানে থাকতে পারবে।

তিনকড়ি।

তা হলে আর লিখবেন না?

বৈকুণ্ঠ।

না, সে-সব খেয়াল ছেড়ে দিয়েছি।

তিনকড়ি।

ছেড়ে দিয়েছেন, সত্যি বলছেন?

বৈকুণ্ঠ।

হাঁ, ছেড়ে দিয়েছি।

তিনকড়ি।

আঃ, বাঁচলেম। তা হলে ছুটি--আমি যেতে পারি?

বৈকুণ্ঠ।

কোথায় যাবে বাপু?

তিনকড়ি।

অলক্ষ্মী যেখানে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ান। ভেবেছিলুম মেয়াদ ফুরোয় নি, খাতা এখনো অনেকখানি বাকি আছে, শুনে যেতে হবে। তা হলে প্রণাম হই।

বৈকুণ্ঠ।

এসো বাবা, ঈশ্বর তোমার ভালো করুন।

তিনকড়ি।

উঁহু! একটা কী গোল হয়েছে! ঠিক বুঝতে পারছি নে। ভাই ঈশেন, এতদিন পরে দেখা, তুমিও তো আমাকে মার্‌ মার্‌ শব্দে খেদিয়ে এলে না-- তোমার জন্যে ভাবনা হচ্ছে।

অবিনাশের প্রবেশ

অবিনাশের প্রবেশ

অবিনাশ।

দাদা, কোথা থেকে তুমি যত--সব লোক জুটিয়েছ বাড়ির মধ্যে, বাইরে, কোথাও তো আর টিঁকতে দিলে না।

বৈকুণ্ঠ।

তারা কি আমার লোক অবু। তোমারই তো সব--

অবিনাশ।

আমার কে! আমি তাদের চিনি নে। কেদারের সব আত্মীয়, তুমিই তো তাদের স্থান দিয়েছ। সেইজন্যেই তো আমি তাদের কিছু বলতে পারি নে। তা, তুমি যদি পার তো তাদের সামলাও দাদা, আমি বাড়ি ছেড়ে চললুম।

বৈকুণ্ঠ।

আমিই তো যাব মনে করছিলুম--

তিনকড়ি।

তার চেয়ে তাঁরা গেলেই তো ভালো হয়। আপনারা দু-জনেই গেলে তাঁদের আদর-অভ্যর্থনা করবে কে?

অবিনাশ।

বাড়ির মধ্যে একটা কে বুড়ি এসেছে, সে তো ঝগড়া করে একটাও দাসী টিঁকতে দিলে না--তাও সয়েছিলুম--কিন্তু আজ আমি স্বচক্ষে দেখলুম, সে নীরুর গায়ে হাত তুললে! আর সহ্য হল না, তাকে এইমাত্র গঙ্গাপার করে দিয়ে আসছি।

ঈশান।

বেঁচে থাকো ছোটোবাবু, বেঁচে থাকো।

বৈকুণ্ঠ।

অবিনাশ, তিনি ছোটবউমার আত্মীয়া হন, তাঁকে--

তিনকড়ি।

কেউ না, কেউ না, ও বুড়ি কেদারদার পিসি। ওকে বিবাহ করে কেদারের পিসে আর বাঁচতে পারলে না, বিধবা হয়ে ভাইয়ের বাড়ি আসতে ভাইও মরে বাঁচল, এখন কেদারদা নিজের প্রাণ রক্ষে করতে ওকে তোমাদের এখানে চালান করেছে।

অবিনাশ।

দাদা, তোমার এই বইগুলো মাটিতে নাবাচ্ছ কেন? তোমার ডেক্‌সো গেল কোথায়?

ঈশান।

এ ঘরে যে বাবুটি থাকেন বই থাকলে তাঁর থাকবার অসুবিধে হয়, বড়োবাবুকে তিনি লুটিস দিয়েছেন!

অবিনাশ।

কী! দাদাকে ঘর ছেড়ে যেতে হবে!

বিপিনের প্রবেশ

বিপিনের প্রবেশ

বিপিন।

"ভাবতে পারি নে পরের ভাবনা'--

অবিনাশ।

(তাড়া করিয়া গিয়া) বেরোও, বেরোও, বেরোও বলছি, বেরোও এখান থেকে-- বেরোও এখনই--

বৈকুণ্ঠ।

আহা, থামো অবু, থামো থামো, কী কর--বেণীবাবুকে--

বিপিন।

বিপিনবাবুকে--

বৈকুণ্ঠ।

হাঁ, বিপিনবাবুকে অপমান কোরো না--

তিনকড়ি।

কেদারদাকে ডেকে আনতে হচ্ছে। এ তামাশা দেখা উচিত।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

ঈশান বিপিনকে বলপূর্বক বাহির করিল

ঈশান বিপিনকে বলপূর্বক বাহির করিল

বিপিন।

ঈশেন, একটা মুটে ডাকো, আমার হুঁকো আর ক্যাম্বিসের ব্যাগটা--

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

বৈকুণ্ঠ।

ঈশেন, হারামজাদা কোথাকার, ভদ্রলোককে তুই, তোকে আর--

ঈশান।

আজ আমাকে গাল দাও, ধরে মারো, আমি কিছু বলব না--প্রাণ বড়ো খুশি হয়েছে।

কেদারকে লইয়া তিনকড়ির প্রবেশ

কেদারকে লইয়া তিনকড়ির প্রবেশ

কেদার।

ওর নাম কী, অবিনাশ ডাকছ?

অবিনাশ।

হাঁ-- তোমার চুলো প্রস্তুত হয়েছে, এখন ঘর থেকে নাবতে হবে।

কেদার।

তোমার ঠাট্টাটা অবিনাশ অন্য লোকের ঠাট্টার চেয়ে, ওর নাম কী, কিছু কড়া হয়।

বৈকুণ্ঠ।

আহা, অবিনাশ, তুমি থামো! কেদারবাবু, অবিনাশের উদ্ধত বয়েস, আপনার আত্মীয়দের সঙ্গে ওঁর ঠিক--

অবিনাশ।

বনছিল না। তাই তিনি তাঁদের হাত ধরে সদর দরজার বার করে দিয়ে এসেছেন--

তিনকড়ি।

এতক্ষণে আবার তাঁরা খিড়কির দরজা দিয়ে ঢুকেছেন, সাবধান থাকবেন--

অবিনাশ।

এখন তোমাকেও তাঁদের পথে--

তিনকড়ি।

ওঁকে দোসরা পথ দেখাবেন, সব কটিকে একত্রে মিলতে দেবেন না--

কেদার।

অবু, ওর নাম কী, তা হলে আমার সম্বন্ধে করতলের পরিবর্তে পদতলেই স্থির হল--

অবিনাশ।

হাঁ, যার যেখানে স্থান--

কেদার।

ঈশৈন, তা হলে একটা ভালো দেখে সেকেণ্ড্‌ ক্লাস গাড়ি ডেকে দাও তো।

তিনকড়ি।

ভেবেছিলুম এবার বুঝি একলা বেরোতে হবে--শেষ, দাদাও জুটল। বরাবর দেখে আসছি কেদারদা, শেষকালটা তুমি ধরা পড়ই, আমি সর্বাগ্রেই সেটা সেরে রাখি, আমার আর ভাবনা থাকে না।

কেদার।

তিনকড়ে! ফের!

বৈকুন্ঠ।

কেদারবাবু, এখনই যাচ্ছেন কেন? আসুন, কিঞ্চিৎ জলযোগ করে নিন--

তিনকড়ি।

তা বেশ তো, আমাদের তাড়া নেই।

বৈকুণ্ঠ।

ঈশেন!
1 | 2 | 3