অনিল

অনিল

উহু, কি না করিলাম হৃদয়ের সাথ!

ঘোর উন্মত্তের মত সবলে যুঝিনু কত,

অশান্তির বিপ্লাবনে গেছে দিন রাত।

নিশীথে গিয়েছি ছুটে দারুণ অধীর--

নয়নেতে নিদ্রা নাই, চোখে না দেখিতে পাই,

হাহা করে ভ্রমিয়াছি বিপাশার তীর!

করেছে দারুণ ঝড় বজ্রদন্ত কড়্‌ মড়্‌,

চারি দিকে অন্ধকার সম্মুখে পশ্চাতে--

মাথার উপরে চাই-- একটিও তারা নাই,

সৃষ্টি যেন ঠাঁই নাহি পেতেছে দাঁড়াতে!

সাধ গেছে, ঝটিকার রুদ্রদেবগণ

বিশাল চরণ দিয়া দলি যায় এই হিয়া--

নিষ্পেষিত করি ফেলে কীটের মতন।

চূর্ণ হয়ে একেবারে মিশে ধূলিরাশে

উড়ে পড়ে চারি দিকে বাতাসে বাতাসে!

অশান্তির এক উপদেবতার মত

নিজের হৃদয়-সাথে যুধিয়াছি কত!

করি অশ্রুবারিপাত গেছে চলি দিনরাত,

অবশেষে আপনি হলেন পরাভূত!

ইচ্ছা করে ছিঁড়ি ছিঁড়ি হৃদয় আমার

শকুনী গৃধিনীদের যোগাই আহার!

এহেন অসার দীন হৃদী অতি বলহীন,

যোগ্য শুধু শিশুর খেলেনা গড়িবার।

এ হৃদি কি বলবান পুরুষের মন--

সামান্য বহিলে বায় সঘনে কাঁপিবে কায়,

মাটিতে নোয়াবে মাথা লতার মতন!

কেন ধরা, কেন ওরে, জন্ম দিয়েছিলি মোরে?

এমন অসার লঘু দুর্ব্বল এ প্রাণ?

এখনি গো দ্বিধা হও, লও মোরে কোলে লও!

এ হীন জীবনশিখা করে গো নির্ব্বাণ!

আর একবার দেখি, যদি এ হৃদয়

পারি আমি বজ্রবলে করিবারে জয়!

কিন্তু হায় কে আমরা? ভাগ্যের খেলেনা,

প্রচণ্ড অদৃষ্টস্রোতে ক্ষুদ্র তৃণকণা!

অন্তরে দুর্দ্দান্ত হৃদি পড়িছে উঠিছে,

বাহিরে চৌদিকে হতে ঝটিকা ছুটিছে

যা কিছু ধরিতে চাই কিছুই খুঁজে না পাই,

স্রোতোমুখে ছুটিয়াছি বিদ্যুতের মত

দিগ্বিদিক হারাইয়া হয়ে জ্ঞানহত।

চোখে না দেখিতে পাই, কানে না শুনিতে পাই,

তীব্রবেগে বহে বায়ু বধিরি শ্রবণ--

চারি দিকে টলমল তরঙ্গের কোলাহল,

আকাশে ছুটিছে তারা উল্কার মতন--

ঘুরিতে ঘুরিতে শেষে পড়ি গো আবর্ত্তে এসে,

চৌদিকে ফেনায়ে উঠে ঊর্ম্মির পর্ব্বত--

মস্তক ঘুরিয়া উঠে, সঘনে শোণিত ছুটে,

ঘুরিতে ঘুরিতে যাই কোথায় ভেবে না পাই--

তলায়ে তলায়ে যাই পাতালের পথ--

আঁধারে দেখিতে নারি এনু কোন্‌ ঠাঁই,

ঊর্দ্ধে হাত তুলি কিছু ধরিতে না পাই--

ঘুরি ঘুরি রাত্রি দিন হয়ে পড়ি জ্ঞানহীন,

নিম্নে কে চরণ ধরি করে আকর্ষণ!

কোথায় দাঁড়াব গিয়ে কে জানে তখন!

তবে আর কি করিব! যাই--যাই ভেসে--

পাষাণ বজ্রের মত অদৃষ্টের মুষ্টি শত

হৃদয়েরে আকর্ষিছে ধরি তার কেশে!

কি করিতে পারি বল আমি ক্ষুদ্র নর!

অদৃষ্টের সাথে কভু সাজে কি সমর!

দিন রাত্রি তুষানলে মরি তবে জ্ব'লে জ্ব'লে--

হাসুক সমস্ত ধরা তীব্র ঘৃণাহাসি,

সে মোরে করুক ঘৃণা যারে ভালবাসি!

আপনার কাছে সদা হয়ে থাকি দোষী,

হৃদয়ে ঘনাতে থাক্‌ কলঙ্কের মসী!

যায় ভালবাসা-তরে আকুল হৃদয়,

যার লাগি সহি জ্বালা তীব্র অতিশয়--

তারে ভালবাসি ব'লে, তারি লাগি কাঁদি ব'লে,

তারি লাগি সহি ব'লে এতেক যাতনা--

সেই মোরে ঘৃণা ক'রে ভালবাসিবে না!

তাই হোক, তাই হোক, ভাগ্য, তাই হোক--

অভাগার কাছ হতে সবে দুরে র'ক।

যাই যাই ভেসে যাই-- যা হবার হবে তাই--

কে আছে আমার তরে করিবারে শোক?

[ললিতার প্রবেশ]

এই যে, এই যে হেথা, ললিতা আমার,

আয়, আয়, মুখখানি দেখি একবার!

আসিবি কি ফিরে যাবি তাই যেন ভাবি ভাবি

অতি ধীর মৃদুগতি সঙ্কোচে তোমার--

আয় বুকে ছুটে আয়, ভাবিস নে আর!

কেন লো ললিতারাণি, বিষণ্ন ও মুখখানি?

কেন লো অধরে নাই হাসির আভাস?

নয়ন এ মুখে কেন চাহিতে চাহে না যেন--

কি কথা রয়েছে মনে, বলিতে না চাস্‌!

অপরাধ করেছি কি প্রেয়সী আমার?

বল্‌ লো কি শান্তি মোরে দিতে চাস তার!

যা দিবি তাহাই সব', মাথায় পাতিয়া লব,

তাহে যদি প্রায়শ্চিত্ত হয় লো তাহার!

সজনি, জানিস্‌ হা রে, ভাল তুই বাসিস যারে

মন তার অতি নীচ, অতি অন্ধকার!

অপরাধ করিবে সে, আশ্চর্য্য কি তার?

সখি লো, মার্জ্জনা তুই করিস নে তারে,

চিরকাল ঘৃণা কর্‌ হৃদয়মাঝারে!

সখি, তুই কেন ভাল বাসিলি আমায়

তাই ভেবে দিবানিশি মরি যাতনায়!

কেন, সখি, দুজনে দেখা হল আমাদের,

দারুণ মিলন হেন কেন হল হায়?

জানি যে রে এ হৃদয় দারুণকলঙ্কময়!

কি ব'লে দিব এ হৃদি চরণে তোমার!

চরণে ফেল লো দলি হেন উপহার!

সতত শরমে বিঁধি লুকাতে চাহি এ হৃদি--

এ হৃদে বাসিলে ভাল মরে যাই লাজে,

হেন নীচ হৃদয়েরে ভালবাসা সাজে!

ভাল আমি বাসি তোরে, চিরকাল বাসিব রে,

তবু চাহি নাকো আমি তোর ভালবাসা--

লয়ে তোর নিজ মন সুখে থাক্‌ অনুক্ষণ,

হেন নীচ হৃদয়ের রাখিস নে আশা!

বল লো কিসের ব্যথা পেয়েছিস মনে?

থাক্‌, থাক্‌, কাজ নেই, থাক্‌ তা গোপনে--

হয়েছে, ত যা হবার, বলে তা কি হবে আর!

হয়ত আমিই কিছু করিয়াছি দোষ!

কাজ কি সে কথা তুলে, সে-সব যা না লো ভুলে,

একবার কাছে আয় এইখেনে বোস্‌!

আধেক আধর-ভরা দেখি সেই হাসি,

ঢাল্‌ লো তৃষিত নেত্রে সুধা রাশি রাশি!

সখি মুখ তুলে চা' লো, একটি কথা ক'না লো--

ললিতা রে, মৌন হয়ে থাকিস নে আর!

একবার দয়া করে কর্‌ তিরস্কার!

সন্ধ্যা হয়ে আসিয়াছে গেল দিনমান--

একটি রাখিবি কথা? গাহিবি কি গান?

ললিতার গান

বুঝেছি বুঝেছি সখা, ভেঙ্গেছে প্রণয়,

ও মিছা আদর তবে না করিলে নয়?

ও শুধু বাড়ায় ব্যথা-- সে-সব পুরাণো কথা

মনে করে দেয় শুধু, ভাঙ্গে এ হৃদয়।

প্রতি হাসি, প্রতি কথা, প্রতি ব্যবহার--

আমি যত বুঝি তব কে বুঝিবে আর!

প্রেম যদি ভুলে থাক' সত্য ক'রে বল'-নাকো,

করিব না মুহূর্ত্তের তরে তিরস্কার!

আমি তো বলেই ছিনু ক্ষুদ্র আমি নারী,

তোমার ও প্রণয়ের নহি অধিকারী।

আর কারে ভালবেসে সুখী যদি হও শেষে

তাই ভালবেসো নাথ, না করি বারণ।

মনে ক'রে মোর কথা মিছে পেয়ো নাকো ব্যথা,

পুরাণো প্রেমের কথা করো না স্মরণ!

অনিল।

[স্বগত]

কি!-- শেষে এই হ'ল, এই হ'ল হায়!

কি করেছি যার লাগি এ গান সে গায়?

তবে সে সন্দেহ করে প্রণয়ে আমার!

বিশ্বাস নাইক তবে মোর 'পরে আর!

বিশ্বাস নাইক তবে? তাই হবে, তাই হবে--

এত করে এই তার হ'ল পুরস্কার!

সন্দেহ করিবে কেন? কি আমি করেছি হেন!

সন্দেহ করিতে তার কোন্‌ অধিকার?

আমি কি রে দিন রাত রহি নি তাহারি সাথ?

সতত করি নি তারে আদর যতন?

বার বার তারে কি রে শুধাই নি ফিরে ফিরে

মুহূর্ত্তের তরে হেরি বিষণ্ন আনন?

একটি কথার তরে কত-না শুধাই তারে--

একটি হেরিতে হাসি রজনী পোহাই!

তাই কি রে এই হল? শেষে কি রে এই হল?

তাইতে সংশয় এত? অবিশ্বাস তাই?

কল্পনায় অকারণে সে যদি কি করে মনে,

আমি কেন তার লাগি সব' তিরস্কার?

তবে কি সে মনে করে ভাল বাসি নাকো তারে!

সকলি কপট তবে প্রণয় আমার?

নাহয় ভাল না বাসি, দোষ তাহে কার?

কখনো সে কাছে এসে করেছে আদর?

কখনো সে মুঝায়েছে অশ্রুবারি মোর?

আমি তারে যত্ন যত করেছি সতত

বিনিময় আমি তার পেয়েছি কি তত?

করেছি ত আমার যা ছিল করিবার,

সহিতে হয় নি কভু অনাদর তার!

তবু সে কি করে আশা! হৃদয়ের ভালবাসা?

আদরেই ভালবাসা বাহিরে প্রকাশ,

তবু সে করিবে কেন মোরে অবিশ্বাস?

[প্রস্থান

[প্রস্থান

ললিতা।

আর কেন অনুক্ষণ রহি তার পাশে

নিতান্তই যদি মোরে ভাল নাহি বাসে?

বিরক্তিতে ওষ্ঠ তার কাঁপিতেছে বার বার,

তবুও ললিতা তার পায়ে পড়ে আছে!

সঙ্গ তার তেয়াগিয়া আছেন বিরলে গিয়া,

সেথাও ললিতা ছুটে গেছে তাঁর কাছে!

এই মুখে হাসি ছিল তারে দেখি মিলাইল,

তবু সে রয়েছে বসি পদতলে তাঁর!

যেখানেই তিনি যান সেথাই দেখিতে পান

এই এক পুরাতন মুখ ললিতার!

প্রমোদ-আগারে বসি-- সেথা এই মুখ!

বিরলে ভাবনা-মন্ত্র-- সেথা এই মুখ!

বিজনে বিষাদভরে নয়নে সলিল ঝরে,

সেথাও সমুখে আছে এই-- এই মুখ!

কি আছে এ মুখে তোর ললিতা অভাগী?

ওই মুখ-- ওই মুখ-- দিবানিশি ওই মুখ

যেথা যাস্‌ সেথা লয়ে যাস্‌ রে কি লাগি?

ছিনু ওই পদতলে প'ড়ে দিন রাত--

করেছিনু পথরোধ, দিয়েছ তাহার শোধ--

ভালই করেছ সখা, করেছ আঘাত!

মনে করেছিনু, সখা, প্রণয় আমার

ফুলময় পথ হবে, তোমার বুকেতে লবে--

চরণে কঠিন মাটি বাজিবে না আর!

কিন্তু যদি ও পদের কাঁটা হয়ে থাকি

এখনিই তুলে ফেল, এখনিই দ'লে ফেল--

এমন পথের বাধা কি হবে গো রাখি?

আজ হতে দিবানিশি রব নাকো কাছে?

নিতান্তই ফাটে বুক, অশ্রুবারি আছে--

বিজনে কাঁদিতে পারি-- একেলা ভাবিতে পারি--

আর কি করি গো আশা? হবে যা হবার,

না ডাকিলে কাছে কভু যাবে নাকো আর!

এক দিন, দুই দিন, চলে যাবে কত দিন,

তবু যদি ললিতারে না পান দেখিতে--

সে ললিতা দিন রাত রহিত গো সাথে সাথ,

সতত রাখিত তাঁরে আঁখিতে আঁখিতে,

বহু দিন যদি তারে না দেখেন আর

তবু কি তাহারে মনে পড়ে নাকো তাঁর?

ভাবেন কি একবার-- "তারে যে দেখি না আর?

ললিতা কোথায় গেল? কোথায় সে আছে?"

হয়ত গো একবার ডাকিবেন কাছে--

দেখিবেন ললিতার মুখে হাসি নাই আর,

কেঁদে কেঁদে আঁখি গেছে জ্যোতিহীন হয়ে--

একবার তবু কি রে আদর করেন মোরে

অতি শীর্ণ মুখ মোর বুকে তুলে লয়ে?

তখন কাঁদিয়া কব পা-দুখানি ধরে

"বড় কষ্ট পেয়েছি গো, আর, সখা, সহে নাকো!

মাঝে মাঝে একবার দেখা দিও মোরে!"
1...16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 | 23 | 24...35