ললিতা

ললিতা

আদর করিয়া কেন না পাই আদর?

লজ্জা নাই কিছু নাই, না ডাকিতে কাছে যাই--

সঙ্কোচে চরণ যেন করে থর থর--

ধীরে ধীরে এক পাশে বসি পদতলে!

বড় মনে সাধ যায় মুখখানি তুলে চায়,

বারেক হাসিয়া কাছে বসিবারে বলে!

বড় সাধ কাছে গিয়ে মুখখানি তুলে নিয়ে

চাপিয়া ধরি গো এই বুকের মাঝার,

মুখপানে চেয়ে চেয়ে কাঁদি একবার!

সে কেন বারেক চেয়ে কথাও না কয়,

পাষাণে গঠিত যেন, স্থির হয়ে রয়!

যেন রে ললিতা তার কেহ নয়-- কেহ নয়--

দাসী দাসীও নয়, পথের পথিকো নয়!

যেন একবারে কেহ-- কেহ নাই কাছে,

ভাবনা লইয়া তার একেলা সে আছে!

কি যেন দেখিছে ছবি আকাশের পটে,

মুহূর্ত্তের তরে যেন মনে মনে ভাবে হেন--

"ললিতা এসেছে বুঝি, বসেছে নিকটে,

সে এমন মাঝে মাঝে এসে থাকে বটে!"

মাঝে মাঝে আসে বটে, পারে না সে নাথ--

সখা গো, নিতান্ত তাই কথাটি শুধাতে নাই?

বারেক করিতে নাই স্নেহনেত্রপাত?

নিতান্তই পদতলে পড়ে থাকে বটে!

সখা, তাই কি গো তারে তুলিয়া উঠাবে না রে,

বারেক রাখিবে নাকি বুকের নিকটে!

লতা আজ লুটাইয়া আছে পদমূলে,

মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে-- আপনারে ভুলে--

প্রাণপণে ভালবেসে জড়ায়ে জড়ায়ে শেষে

এক দিন উঠিবে সে বুকে মাথা তুলে,

শাখাটি বাঁধিতে দিবে আলিঙ্গনে তার,

দুখিনীর সে আশা কি বড় অহঙ্কার?

কি করেছি অপরাধ বুঝিতে না পারি!

দিন রাত্রি, সখা, আমি রয়েছি তোমারি--

কিসে তুমি ভাল রবে, কিসে তুমি সুখী হবে,

দিন রাত সে ভাবনা জাগিছে অন্তরে!

মুহূর্ত্ত ভাবি না আমি আপনার তরে।

তারি বিনিময়ে কি গো এত অনাদর!

শতখানা ফেটে যায় বুকের ভিতর।

সখা, আমি অভিমান কভু করি নাই--

মনে করিতেও তাহা লাজে মরে যাই।

ধীরে ধীরে এনে কাছে মনে মনে হাস পাছে--

"দুখিনী ললিতা সেও অভিমান করিয়াছে!"

তাই অভিমান কভু মনেও না ভায়,

অশ্রুজল হেরে পাছে হাসি তব পায়!

বুকে বড় ব্যথা বাজে, তাই ভাবি মাঝে মাঝে

ভিক্ষুকের মত গিয়া পড়ি তব পায়--

কেঁদে গিয়ে ভিক্ষা করিয়া বিনয়,

"সর্ব্বস্ব দিয়েছি ওগো-- পরাণ হৃদয়--

হৃদয় দিয়েছি বলে হৃদয় চাহি না ভুলে--

একটু ভালবাসিও, আর কিছু নয়!"

পাছে গো চাহিলে ভিক্ষা, ধরিলে চরণে,

বিরক্ত বা হও তাই ভয় করি মনে।

তবে গো কি হবে মোর! জানাব কি করে?

এমন ক'দিন আর রব প্রাণ ধরে?

হা দেবি! হা ভগবতি! জীবন দুর্ভর অতি!

কিছুতে কি পাব নাকো ভালবাসা তাঁর?

তবে নে মা, কোলে নে মা, কোথাও আশ্রয় দে মা--

একটু স্নেহের ঠাঁই দেখা মা আমার!

[চপলার প্রবেশ]

[চপলার প্রবেশ]

চপলা।

ললিতাও হলি নাকি মুরলার মত!

তেমনি বিষাদময় আঁখি দুটি নত।

তেমনি মলিন মুখে আছিস কিসের দুখে,

তোদের একি এ হল ভাবি লো কেবল--

চপলারে তোরা বুঝি করিবি পাগল!

ছেলেবেলা বেশ ছিলি, ছিল না ত জ্বালা--

সদা মৃদুহাসিময়ী লাজময়ী বালা।

এক দিন-- মনে পড়ে? সরসীর তীরে

বসেছিলি নিরিবিলি, কেবল দেখিতেছিলি

নিজের মুখের ছায়া পড়েছিল নীরে।

বুঝি মেতে গিয়েছিলি রূপে আপনার!

(তোর মত গরবিনী দেখি নি ত আর!)

সহসা পিছন হ'তে ডাকিলাম তোরে,

কি দারুণ শরমেতে গিয়েছিলি ম'রে?

আজ তোর হ'ল কি লো ললিতা আমার?

সে সব লাজের ভাব নাই যে লো আর!

শুধু বিষাদের হাসি, মুরলার মত!

বল্‌ তোরা হলি একি? পৃথিবীর মাঝে দেখি

কেবল চপলা সুখী, দুঃখী আর যত!

মোরে কিছু বলিবি নে?-- আহা ম'রে যাই!--

অনিল সে কত ক'রে আদর করে যে তোরে

লুকায়ে লুকায়ে আমি যেন দেখি নাই!

ভাল, ভাল, বলিস নে, আমার কি তায়?

চল্‌ তুই, ললিতা লো, মুরলা যেথায়!

যাহা তোর মনে আছে কহিস তাহারি কাছে,

তা হলে ঘুচিয়া যাবে হৃদয়ের ভার।

ত্বরা করে চল্‌ তবে ললিতা আমার!

[কবির প্রবেশ]

[কবির প্রবেশ]

চপলা।

[কবির প্রতি]

চল, কবি, মুরলার কাছে--

বড় সে মনের দুঃখে আছে!

তুমি, কবি, তারে দেখো-- সদা কাছে কাছে রেখো,

তুমি তারে ভাল ক'রে করিও যতন!

তুমি ছাড়া কে তাহার আছে বা স্বজন!

কবি।

মুরলার মুখ দেখে প্রাণে বড় বাজে--

কিসের যে দুঃখ তার শুধায়েছি কতবার,

কিছুতে আমার কাছে প্রকাশে না লাজে!

কত দিন হতে মোরা বাঁধা এক ডোরে

যাহা কিছু থাকে কথা, যাহা কিছু পাই ব্যখ্যা,

দুজনে তখনি তাহা বলি দুজনেরে।

কিছু দিন হতে একি হ'ল মুরলার,

আমারে মনের কথা বলে না সে আর!

মাঝে মাঝে ভাবি তাই-- বড় মনে ব্যথা পাই--

বুঝি মোর 'পরে নাই প্রণয় তাহার!

এত কথা বলি তারে এত ভালবাসি,

সে কেন আমারে কিছু কহে না প্রকাশি!
1...15 | 16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 | 23...35