মুরলা ও কবি

মুরলা ও কবি

কবি।

কত দিন দেখিয়াছি তোরে, লো মুরলে,

একেলা কাঁদিতেছিস বসিয়া বিরলে।

করতলে রাখি মুখ-- কি জানি কিসের দুখ--

বড় বড় আঁখিদুটি মগ্ন অশ্রুজলে!

বড়, সখি, ব্যথা লাগে হেরি তোর মুখ!

এমন করুণ আহা! ফেটে যায় বুক।

ভাল কি বাসিস কারে? কত দিন বল্‌

পোষণ করিবি হৃদে হৃদয়-অনল?

যত তোর কথা আছে বলিস আমার কাছে,

এত স্নেহ কোথা পাবি-- এত অশ্রুজল?

মুরলা।

কারে বা ভাল বাসিব কবি গো আমার?

ভালবাসা সাজে কি গো এই মুরলার?

সখা, এত আমি দীন, এতই গো গুণহীন,

ভালবাসিতে যে, কবি, মরি গো লজ্জায়।

যদি ভুলি আপনারে, যদি ভালবাসি কারে,

সে জন ফিরেও কভু দেখে কি আমায়?

যদি বা সে দয়া ক'রে আদর করে গো মোরে,

সঙ্কোচেতে দিবানিশি দহি না কি তবু?

তাই, কবি, বলি তাই-- ভাল যে বাসিতে নাই,

ভালবাসা মুরলারে সাজে কি গো কভু?

দূর হোক-- মুরলার কথা দূর হোক--

মুরলার দুখজ্বালা মুরলার র'ক--

বল, কবি, গেছিল কি নলিনীর কাছে?

নলিনীর কথা কিছু বলিবার আছে?

কবি।

সখি লো, বড়ই মনে পাইয়াছি ব্যথা!

কাল আমি সন্ধ্যাকালে গিয়েছিনু সেথা--

পথপার্শ্বে সেই বনে নীরবে আপনমনে

দেখিতেছিলাম একা বসি কতক্ষণ

সন্ধ্যার কপোল হতে সুধীর কেমন

মিলায়ে আসিতেছিল সরমের রাগ--

একটি উঠেছে তারা, বিপাসা হরষে হারা

ছায়া বুকে লয়ে কত করিছে সোহাগ!

কতক্ষণ পথ চেয়ে রয়েছি বসিয়া--

এমন সময়ে হেরি সখীদের সঙ্গে করি

আসিছে নলিনীবালা হাসিয়া হাসিয়া!

নাচিয়া উঠিল মন হরষে উল্লাসে,

রহিনু অধীর হয়ে মিলনের আশে।

কিন্তু নলিনীর কেন চরণ উঠে না যেন,

দুই পা চলিয়া যেন পারে না চলিতে!

কেহ যেন তার তরে বসে নাই আশা ক'রে,

সে যেন কাহারো সাথে আসে নি মিলিতে!

কোন কাজ নাই তাই এসেছে খেলিতে!

যেতে যেতে পথমাঝে যদি হেরে ফুল

করতালি দিয়ে উঠে তাড়াতাড়ি যায় ছুটে--

আনে তুলে, পরে চুলে, হেসেই আকুল!

কভু হেরি প্রজাপতি কৌতূহলে ব্যগ্র অতি

ধীরে ধীরে পা টিপিয়া যায় তার কাছে।

কভু কহে, "চল্‌ সখি, সেই চাঁপা গাছে

আজিকে সকাল বেলা কুঁড়ি দেখেছিনু মেলা,

এতক্ষণে বুঝি তারা উঠিয়াছে ফুটে,

চল্‌, সখি, একবার দেখে আসি ছুটে!"

কত-না বিলম্ব পথে করিল এমন,

বড়ই অধীর হয়ে উঠিল গো মন।

কতক্ষণ পরে শেষে গান গেয়ে হেসে হেসে

যেথা আমি বসেছিনু আসিল সেথায়--

চলিয়া গেল সে, যেন দেখে নি আমায়

একেলা বসিয়া আমি রহিনু আঁধারে

সমস্ত রজনী, সখি, সেই পথধারে।

কেন, সখি, এত হাসি, এক কেন গান?

কিসের উল্লাসে এত পূর্ণ ছিল প্রাণ?

মন এক দলিবার আছে গো ক্ষমতা,

যখন তখন খুসী দিতে পারে ব্যথা,

তাই গর্ব্বে কোন দিকে ফিরেও না চায়?

তাই এত হাসে হাসি, এত গান গায়?

কৃপাণ যে হাসি হাসে ঝলসি নয়ন,

বিদ্যুৎ যে হাসি হাসে অশনিদশন!

অথবা হয়ত, সখি, আমারিই ভুল;

হয়ত সে মনে মনে কল্পনায় অকারণে

প্রণয়ে সন্দেহ ক'রে হয়েছে আকুল!

অভিমানে জানাইতে চায় মোর কাছে--

রাখে না আমার আশা, নাই কিছু ভালবাসা,

ভাল না বেসেও মোরে বড় সুখে আছে।

যখন গাহিতেছিল মরমে দহিতেছিল--

হাসি সে মুখের হাসি আর কিছু নয়,

গোপনে কাঁদিতেছিল অশান্ত হৃদয়!

আজ আমি তার কাছে যাই একবারে--

শুধাই, অমন ক'রে কেন সে নিষ্ঠুর মোরে

দিয়াছে বেদনা দলি হৃদয় আমার?

[কবির প্রস্থান

[কবির প্রস্থান

মুরলা।

আসিয়াছে সন্ধ্যা হয়ে নিস্তব্ধ গভীর--

তারা নাহি দেখা যায় কুয়াশা-ভিতরে,

একটি একটি করে পড়িছে শিশির

মুরলার মাথার শুকানো ফুল -'পরে!

জীর্ণ শাখা শীতবায়ে উঠে শিহরিয়া,

গাছের শুকনো পাতা পড়িছে ঝরিয়া!

ওঠ্‌ লো মুরলা, ওঠ্‌, দিন হল শেষ,

পর্‌ লো মুরলা, পর্‌ সন্ন্যাসিনীবেশ।

মুরলা? মুরলা কোথা? গেছে সে মরিয়া--

সেই যে দুখিনী ছিল বিষণ্ন মলিন,

সেই যে ভাল বাসিত হৃদয় ভরিয়া,

সেই যে কাঁদিত বনে আসি প্রতিদিন,

সে বালা মরিয়া গেছে, কোথায় সে আর?

ছিন্ন বস্ত্র, ম্লান মুখ, লয়ে দুঃখভার,

তাহার সে বুকের লুকানো কথা লয়ে

মরেছে সে বালা আজ সন্ধ্যার উদয়ে!

তবে এ কাহারে হেরি নিশীথে শ্মশানে?

ও একটি উদাসিনী সন্ন্যাসিনী যায়--

কারে বাসে না ভাল, কারেও না জানে,

আপনার মনে শুধু ভ্রমিয়া বেড়ায়!

একটি ঘটনা ওর ঘটে নি জীবনে,

একটি পড়ে নি রেখা ওর শুন্য মনে!

পথ ছাড়, পান্থ, কিবা শুধাইছ আর?

জীবনে কাহিনী কিছু নাই বলিবার!

মুরলা, সত্যই তবে হলি সন্ন্যাসিনী?

সত্যই ত্যজিলি তোর যত কিছু আশা?

তবে রে বিলম্ব কেন, বসিয়া আছিস হেন?

এখনো কি-- এখনো কি সব ফুরায় নি?

এখনো কি মনে ্‌মনে চাস ভালবাসা?

বড় মনে সাধ ছিল রহিব হেথায়--

কষ্ট পাই, দুঃখ পাই, রব তাঁরি সাথ--

আজন্ম কালের তাঁর সহচরী হায়

আমরণ বেড়াইব ধরি তাঁরি হাত!

কিছুতে নারিনু অশ্রু করিতে দমন,

কিছুতে এল না হাসি বিষণ্ন বদনে,

সদাই এড়াতে হ'ত কবির নয়ন,

কাঁদিতে আসিত হ'ত এ আঁধার বনে!

আজিকে সুখের দিন কবির আমার,

হৃদয়ে তিলেক নাহি বিষাদ-আঁধার,

নূতন প্রণয়ে মগ্ন তাঁহার হৃদয়

বিশ্বচরাচর হেরে হাস্যসুধাময়!

এখন, মুরলা আমি, কেন রহি আর?

যেখানেই যান কবি হর্ষে হাসি হাসি

সেথাই দেখিতে পান এ মুখ আমার--

বিষাদের প্রতিমূর্ত্তি অন্ধকাররাশি!

ওঠ্‌ লো মুরলা তবে-- দিন হ'ল শেষ!

পরথ লো মুরলা তবে সন্ন্যাসিনীবেশ।

বেড়াইবি তীর্থে তীর্থে, ত্যজিবি সংসার--

ভুলে যাবি যত কিছু আছে আপনার!

কত শত দিন কত বর্ষ যাবে চলি--

তখন কপালে তোর পড়েছে ত্রিবলী,

নয়ন হইয়া তোর গেছে জ্যোতিহীন,

কত কত বর্ষ গেছে, গেছে কত দিন--

এই গ্রামে ফিরিয়া আসিবি একবার,

যাইবি মাগিতে ভিক্ষা কবির দুয়ার,

দেখিবি আছেন সুখে নলিনীরে লয়ে

দুইজনে একমন একপ্রাণ হয়ে!

কত-না শুনাইছেন কবিতা তাহারে!

কত-না সাজাইছেন কুসুমের হারে!

মোরে হেরে কবি মোর অবাক্‌ নয়নে

মোর মুখপানে চেয়ে রহিবেন কত,

মনে পড়ি পড়ি করি পড়িবে না মনে

নিশীথের ভুলে-যাওয়া স্বপনের মত!

কতক্ষণ মুখপানে চেয়ে থেকে থেকে

সবিস্ময়ে নলিনীরে কহিবেন ডেকে,

"যেন হেন মুখ আমি দেখেছিনু প্রিয়া!

কিছুতেই মনে তবু পড়িছে না আর!"

অমনি নলিনীবালা উঠিবে হাসিয়া--

কহিবে, "কল্পনা,কবি, কল্পনা তোমার!"

শুনিয়া হাসিবে কবি, ফিরাবে নয়ন,

নলিনীর পাখীটিরে করিবে আদর--

আমিও সেখান হতে করিব গমন

ভ্রমিয়া বেড়াতে পুনঃ দূর দেশান্তর!

ওঠ্‌ লো মুরলা তবে-- দিক হ'ল শেষ

পর্‌ লো মুরলা তবে সন্ন্যাসিনীবেশ!

থাক্‌ থাক্‌, আজ থাক্‌, আজ থাক্‌ আর!

কবিরে দেখিতে হবে আরেকটি বার!

কাল হব সন্ন্যাসিনী, বরিব বিরাগে--

দেখিব আরেক বার যাইবার আগে।
1...11 | 12 | 13 | 14 | 15 | 16 | 17 | 18 | 19...35