মুরলা

মুরলা

ওই ধীরে সন্ধ্যা হয়-হয়!

গ্রামের কানন হল অন্ধকারময়!

যতই ঘনায়ে আসে সন্ধ্যার আঁধার--

কাঁদিয়া ওঠে গো কেন হৃদয় আমার?

দুঃখ যেন অতিশয় ধীরে ধীরে আসে--

পা টিপিয়া, পা টিপিয়া, বসে মোর পাশে!

মরমেতে আঁখি রাখে, এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে,

কি মন্ত্র পড়িতে থাকে বুকের উপরে!

কেন গো এমন হয় প্রাণের ভিতরে?

সন্ধ্যাদীপ ঘরে ঘরে উঠিল জ্বলিয়া--

বাহিরে যে দিকে চাই কিছু না দেখিতে পাই--

আঁধার বিশালকায়া আছে ঘুমাইয়া!

ভিতরে কুঁড়ের বুকে নিভৃতে মনের সুখে

ছোট ছোট আলোগুলি রয়েছে জাগিয়া!

আমার আলয় নাই-- ভাই নাই, বন্ধু নাই,

কেহ নাই এক তিল করিবারে স্নেহ--

দিবস ফুরায়ে এলে মোর তরে কহে

জ্বালায়ে রাখে না কভু প্রদীপটি ঘরে,

পথপানে চেয়ে কেহ নাই মোর তরে!

দিবসের শ্রমে ক্লান্ত--সন্ধ্যা যবে হয়

কোথায় যে যাব, নাই স্নেহের আলয়!

বিরাম বিশ্রাম নাই-- আদর যতন নাই--

পথপ্রান্তে ধূলি'পরে করি গো শয়ন,

চেয়ে দেখিবার লোক নাই এক জন।

অন্ধকার শাখা মেলি শুধু বৃক্ষ যত

কি ক'রে যে চেয়ে থাকে অবাকের মত!

তারকার স্নেহশূণ্য লক্ষ লক্ষ আঁখি

এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে দূরাকাশে থাকি!

স্নেহের অভাব মনে জেগে উঠে কেন?

আশ্রয়ের তরে মন হুহু করে যেন!

এত লক্ষ লক্ষ আছে সুখের কুটীর,

একটিও নহে ওর এই অভাগীর!

সারাদিন নিরাশ্রয় ঘুরিয়া বেড়াই,

সন্ধ্যায় যে কোথা যাব তারো নাই ঠাঁই!

কত শত দিন হ'ল ছেড়েছি আলয়--

আজো কেন ফিরে যেতে তবু সাধ হয়?

ঘুরে ঘুরে পথশ্রান্ত, নাই দিগ্বিদিক--

আকাশ মাথার 'পরে চেয়ে অনিমিখ!

লক্ষ্য নাই, আশা নাই, কিছু নাই চিতে--

এমন ক'দিন আর পারিব থাকিতে?

আহা সে চপলা মোর, থাকিত সে কাছে।

হয়ত তাহার মনে ব্যথা লাগিয়াছে!

আমি কোথা হ'তে এক আসিয়া আঁধার

মলিন করিয়া দিনু হৃদয় তাহার।

সদাই সে থাকে আহা প্রমোদের ভরে,

মুহূর্ত্ত সে মোর তরে কাঁদিবে কেন রে?

এতক্ষণে কবি মোর এসেছে ভবনে,

কে রয়েছে তাঁর তরে বসি বাতায়নে?

পদশব্দ শুনি তাঁর ত্বরায় অমনি

দিতেছে দুয়ার খুলি কে গো সে রমণী!

প্রতিদিন মালা গেঁথে দিতাম যেমন,

আজো কি তেমনি কেহ করে গো রচন?

হয়ত আলয় তাঁর রয়েছে আঁধার,

হয়ত কেহই নাই বাতায়নে তার।

হয়ত গো কবি মোর ম্রিয়মাণ মন,

কেহ নাই যার সাথে কথাটিও কন!

হয়ত গো মুরলার তরে মাঝে মাঝে

করুণ হৃদয়ে তাঁর ব্যথা বড় বাজে!

হা নিষ্ঠুর মুরলা রে, কেন ছেড়ে এলি তাঁরে

নিতান্ত একেলা ফেলি কবিরে আমার--

হয়ত রে তোর তরে প্রাণ কাঁদে তাঁর!

বড় স্বার্থপর তুই, নয় দুঃখে তোর

কাঁদিয়া কাটিয়া হ'ত এ জীবন ভোর,

তাই কি ফেলিয়া আসে কবিরে একলা!

ফিরে চল্‌ মুরলা রে, চল্‌ এই বেলা!

হা অভাগী, সন্ন্যাসিনী, আবার, আবার?

কোথা কবি? কোন্‌ কবি? কে গো সে তোমার?

মাঝে মাঝে দেখিস রে একি স্বপ্ন মিছে!

স্বপনের অশ্রুজল ত্বরা ফেল্‌ মুছে!

জীবনের স্বপ্ন তোর ভাঙ্গিবে ত্বরায়--

জীবনের দিন তোর ফুরায়-ফুরায়!

ওই দেখ্‌ মৃত্যু তোর সমুখে বসিয়া

কঙ্কালের ক্রোড় তার আছে প্রসারিয়া!

সম্বন্ধ হয়েছে তোর মরণের সাথে,--

দে রে তোর হাত তার অস্থিময় হাতে!

এ সৎসারে কেহ যদি তোরে ভালবাসে

সে কেবল ওই মৃত্যু--ওই রে আকাশে!

গুরুভার রক্তহীন হিমহস্তে তার

আলিঙ্গন করেছে সে হৃদয় তোমার!

হে মরণ! প্রিয়তম-- স্বামী গো, জীবন মম,

কবে আমাদের সেই সম্মিলন হবে?

জীবনের মৃতুশয্যা তেয়াগিব কবে?
1...22 | 23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 | 30...35