রাজা, রাজকুমারগণ, ইশা খাঁ, নিশানরী ও ভাট
পরীক্ষাভূমি
রাজা, রাজকুমারগণ, ইশা খাঁ, নিশানরী ও ভাট
ইন্দ্রকুমার।
দাদা, আজ তোমাকে জিততেই হবে, নইলে চলবে না।
যুবরাজ।
চলবে না তো কী! আমার তীরটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও জগৎসংসার যেমন চলছিল ঠিক তেমনিই চলবে। আর, যদিবা নাই চলত তবু আমার জেতবার কোনো সম্ভাবনা দেখছি নে।
ইন্দ্রকুমার।
দাদা, তুমি যদি হারো তবে আমি ইচ্ছাপুর্বক লক্ষ্যভ্রষ্ট হব।
যুবরাজ।
না ভাই, ছেলেমানুষি কোরো না। ওস্তাদের নাম রাখতে হবে।
ইশা খাঁ।
যুবরাজ, সময় হয়েছে, ধনুক গ্রহণ করো। মনোযোগ কোরো। দেখো, হাত ঠিক থাকে যেন।
যুবরাজের তীর-নিক্ষেপ
যুবরাজের তীর-নিক্ষেপ
ইশা খাঁ।
যাঃ! ফসকে গেল।
যুবরাজ।
মনোযোগ করেছিলুম খাঁ সাহেব, তীরযোগ করতেই পারলুম না।
ইন্দ্রকুমার।
কখনো না। মন দিলে তুমি নিশ্চয়ই পারতে। দাদা, তুমি কেবল উদাসীন হয়ে সব জিনিস ঠেলে ফেলে দাও, এতে আমার ভারি কষ্ট হয়।
ইশা খাঁ।
তোমার দাদার বুদ্ধি তীরের মুখে কেন খেলে না, তা জান? বুদ্ধিটা তেমন সূক্ষ্ম নয়।
ইন্দ্রকুমার।
সেনাপতি সাহেব, তুমি অন্যায় বলছ।
ইশা খাঁ।
(রাজধরের প্রতি) কুমার, এবার তুমি লক্ষ্য ভেদ করো, মহারাজ দেখুন।
রাজধর।
আগে দাদার হোক।
ইশা খাঁ।
এখন উত্তর করবার সময় নয়, আমার আদেশ পালন করো।
রাজধরের তীর-নিক্ষেপ
রাজধরের তীর-নিক্ষেপ
ইশা খাঁ।
যাক্, তোমার তীরও তোমার দাদার তীরেরই অনুসরণ করেছে--লক্ষ্যের দিকে লক্ষও করে নি।
যুবরাজ।
ভাই, তোমার বাণ অনেকটা নিকট দিয়েই গেছে, আর-একটু হলেই লক্ষ্য বিদ্ধ করতে পারত।
রাজধর।
লক্ষ্য বিদ্ধ তো হয়েছে! দূর থেকে তোমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছ না। ঐ-যে বিদ্ধ হয়েছে।
যুবরাজ।
না, রাজধর, তোমার দৃষ্টির ভ্রম হয়েছে--লক্ষ্য বিদ্ধ হয় নি।
রাজধর।
আমার ধনুর্বিদ্যার প্রতি তোমাদের বিশ্বাস নেই বলেই তোমরা দেখেও দেখতে পাচ্ছ না। আচ্ছা, কাছে গেলেই প্রমাণ হবে।
ইন্দ্রকুমারের ধনুক-গ্রহণ
ইন্দ্রকুমারের ধনুক-গ্রহণ
যুবরাজ।
(ইন্দ্রকুমারের প্রতি) ভাই আমি অক্ষম, সেজন্যে আমার উপর তোমার রাগ করা উচিত না। তুমি যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট হও তা হলে তোমার ভ্রষ্টলক্ষ্য তীর আমার হৃদয় বিদীর্ণ করবে এ তুমি নিশ্চয় জেনো।
ইন্দ্রকুমারের তীর-নিক্ষেপ
ইন্দ্রকুমারের তীর-নিক্ষেপ
নেপথ্যে জনতা।
জয়, কুমার ইন্দ্রকুমারের জয়!
বাদ্য বাজিয়া উঠিল
যুবরাজ ইন্দ্রকুমারকে আলিঙ্গন করিলেন
বাদ্য বাজিয়া উঠিল
যুবরাজ ইন্দ্রকুমারকে আলিঙ্গন করিলেন
ইশা খাঁ।
পুত্র, আল্লার কৃপায় তুমি দীর্ঘজীবী হয়ে থাকো। মহারাজ, মধ্যমকুমার পুরস্কারের পাত্র। যেরূপ প্রতিশ্রুত আছেন তা পালন করুন।
রাজধর।
না মহারাজ, পুরস্কার আমারই প্রাপ্য। আমারই তীর লক্ষ্যভেদ করেছে।
মহারাজ।
কখনোই না।
রাজধর।
সেনাপতি সাহেব পরীক্ষা করে আসুন কার তীর লক্ষ্যে বিঁধে আছে।
ইশা খাঁ।
আচ্ছা, আমি দেখে আসি।
[প্রস্থান
[প্রস্থান
তীর হাতে লইয়া ইশা খাঁর পুনঃপ্রবেশ
তীর হাতে লইয়া ইশা খাঁর পুনঃপ্রবেশ
ইশা খাঁ।
(ইন্দ্রকুমারের প্রতি) বাবা, আমি বুড়োমানুষ, চোখে তো ভুল দেখছি নে? এই তীরের ফলায় যেন রাজধরের নাম দেখা যাচ্ছে।
ইন্দ্রকুমার।
হাঁ, রাজধরেরই নাম।
মহারাজ।
দেখি, তাই তো! একসঙ্গে আমাদের সকলেরই ভুল হল!
রাজধর।
আজ নয় মহারাজ, আমার প্রতি বরাবরই ভুল হয়ে আসছে!
ইশা খাঁ।
কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
ইন্দ্রকুমার।
আমি বুঝেছি।
রাজধর।
মহারাজ, আজ বিচার করুন।
ইন্দ্রকুমার।
(জনান্তিকে) বিচার! তুমি বিচার চাও! তা হলে যে মুখে চুনকালি পড়বে! বংশের লজ্জা প্রকাশ করব না, অন্তর্যামী তোমার বিচার করবেন।
ইশা খাঁ।
কী হয়েছে বাবা? এর মধ্যে একটা রহস্য আছে। শিলা কখনো জলে ভাসে না, বানরে কখনো সংগীত গায় না। বাবা ইন্দ্রকুমার ঠিক কথা বলো তো কী হয়েছে। তূণ বদল হয় নি তো?
রাজধর।
কখনোই না। পরীক্ষা করে দেখো।
ইশা খাঁ।
তাই তো দেখছি--তূণ তো ঠিকই আছে। আচ্ছা, বাবা ইন্দ্রকুমার, সত্য করে বলো, এর মধ্যে তোমার অস্ত্রশালায় কেউ কি প্রবেশ করেছিল?
ইন্দ্রকুমার।
সে কথায় প্রয়োজন নেই খাঁ সাহেব।
ইশা খাঁ।
ঠিক করে বলো বাবা, তুমি নিশ্চয় জান কেউ তোমার অস্ত্রশালায় গিয়ে তোমার সঙ্গে তীর বদল করেছে।
ইন্দ্রকুমার।
চুপ করো খাঁ সাহেব। ও কথা থাক্।
ইশা খাঁ।
তা হলে তুমি হার মানছ?
ইন্দ্রকুমার।
হাঁ, আমি হার মানছি।
ইশা খাঁ।
শাবাশ বাবা, শাবাশ! তুমি রাজার ছেলে বটে। মহারাজ, কোথাও একটা-কিছু অন্যায় হয়ে গেছে, সে কথাটা প্রকাশ হচ্ছে না। আর-একবার পরীক্ষা না হলে ঠিকমত মীমাংসা হতে পারবে না।
রাজধর।
খাঁ সাহেব, অন্যায় আর কিছু নয়, আমার জেতাই অন্যায় হয়েছে। কিন্তু তাই বলে আবার পরীক্ষার অপমান আমি স্বীকার করতে পারব না। আমার জিত হওয়া যদি অন্যায় হয়ে থাকে সে অন্যায়ের সহজ প্রতিকার আছে। আমি পুরস্কার চাই নে, মধ্যম কুমারকেই পুরস্কার দেওয়া হোক।
মহারাজ।
সে কথা আমি বলতে পারি নে--তীরে যখন তোমার নাম লেখা আছে তখন তোমাকে পুরস্কার দিতেই আমি বাধ্য। এই তুমি নাও।
তলোয়ার প্রদান
তলোয়ার প্রদান
রাজধর।
পুরস্কার আমি শিরোধার্য করে নিচ্ছি, কিন্তু আমার এই সৌভাগ্যে কারো মন যখন প্রসন্ন হচ্ছে না তখন এই তলোয়ার আমি দাদা ইন্দ্রকুমারকেই দিলুম।
ইন্দ্রকুমারের দিকে তলোয়ার অগ্রসর-করণ
ইন্দ্রকুমারের দিকে তলোয়ার অগ্রসর-করণ
ইন্দ্রকুমার।
(তলোয়ার মাটিতে নিক্ষেপ করিয়া) ধিক্! তোমার হাত থেকে এ পুরস্কারের অপমান গ্রহণ করবে কে?
ইশা খাঁ।
(ইন্দ্রকুমারের হাত ধরিয়া) কী? ইন্দ্রকুমার, মহারাজের দত্ত তলোয়ার তুমি মাটিতে ফেলে দিতে সাহস কর! তোমার এই অপরাধের সমুচিত শাস্তি হওয়া চাই।
ইন্দ্রকুমার।
(হাত ছাড়াইয়া লইয়া) বৃদ্ধ, আমাকে স্পর্শ কোরো না।
ইশা খাঁ।
পুত্র, একি পুত্র! তুমি আজ আত্মবিস্মৃত হয়েছ।
ইন্দ্রকুমার।
সেনাপতি সাহেব, আমাকে ক্ষমা করো। আমি যথার্থই আত্মবিস্মৃত হয়েছি। আমাকে শাস্তি দাও।
যুবরাজ।
ক্ষান্ত হও ভাই, ঘরে ফিরে চলো।
ইন্দ্রকুমার।
(মহারাজের পদধূলি লইয়া) পিতা, অপরাধ মার্জনা করুন। আজ সকল রকমেই আমার হার হয়েছে।
ইশা খাঁ।
মহারাজ, আমার একটি নিবেদন আছে। খেলার পরীক্ষা তো চুকেছে, এবার কাজের পরীক্ষা হোক। দেখা যাবে তাতে আপনার কোন্ পুত্র পুরস্কার আনতে পারে।
মহারাজ।
কোন্ কাজের কথা বলছ সেনাপতি।
ইশা খাঁ।
আরাকান-রাজের সঙ্গে মহারাজের যুদ্ধের মতলব আছে। সৈন্যও তো প্রস্তুত হয়েছে। এইবার কুমারদের সেই যুদ্ধে পাঠানো হোক।
মহারাজ।
ভালো কথাই বলেছ সেনাপতি। খবর পেয়েছি আরাকানের রাজা চট্টগ্রামের সীমানার কাছে এসেছেন। বারবার শিক্ষা দিয়েছি, কিন্তু মূর্খের শিক্ষার শেষ তো কিছুতেই হয় না, যমরাজের পাঠশালায় না পাঠালে গতি নেই। কী বল বৎসগণ! আমাদের সেই চিরশত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ে যাত্রা করে ক্ষাত্রচর্যে দীক্ষা গ্রহণ করতে রাজি আছ কি?
ইন্দ্রকুমার।
রাজি। দাদাও যাবেন।
রাজধর।
আমিও যাব না মনে করছ না কি?
মহারাজ।
তবে ইশা খাঁ, তুমি সৈন্যাধ্যক্ষ হয়ে এঁদের সকলকে শত্রুবিজয়ে নিয়ে যাও। ত্রিপুরেশ্বরী তোমদের সহায় হোন।











