ভূমিকা
ভূমিকা
ফকির, স্বামী অচ্যুতানন্দের চেলা। গোঁফদাড়িতে মুখের বারো আনা অনাবিস্কৃত। ফকিরের স্ত্রী হৈমবতী। বাপের আদরের মেয়ে। তিনি টাকা রেখে গেছেন ওর জন্যে। ফকিরের বাপ বিশ্বেশ্বর পুত্রবধূকে স্নেহ করেন, পুত্রের অপরিমিত গুরুভক্তিতে তিনি উৎকণ্ঠিত।পুষ্পমালা এম| এ| পরীক্ষায় সংস্কৃতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া মেয়ে। দূরসম্পর্কে হৈমর দিদি। কলেজি খাঁচা থেকে ছাড়া পেয়ে পাড়াগাঁয়ে বোনের বাড়িতে সংসারটাকে প্রত্যক্ষ দেখতে এসেছে। কৌতূহলের সীমা নেই। কৌতুকের জিনিসকে নানা রকমে পরখ করে দেখতে কখনো নেপথ্যে, কখনো রঙ্গভূমিতে। ভারি মজা লাগছে। সকল পাড়ায় তার গতিবিধি, সকলেই তাকে ভালোবাসে।
পুষ্পমালার একজন গুরু আছেন, তিনি খাঁটি বনস্পতি জাতের। অগুরু-জঙ্গলে দেশ গেছে ছেয়ে। পুষ্পর ইচ্ছে সেইগুলোতে হাসির আগুন লাগিয়ে খাণ্ডবদাহন করে। কাজ শুরু করেছিল এই নবগ্রামে। শুনেছি, বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর পুণ্যকর্মে ব্যাঘাত ঘটেছে। তার পর থেকে পঞ্চশরের সঙ্গে হাসির শর যোগ করে ঘরের মধ্যেই সুমধুর অশান্তি আলোড়িত করেছে। সেই প্রহসনটা এই প্রহসনের বাইরে।
পাশের পাড়ার মোড়ল ষষ্ঠীচরণ। তার নাতি মাখন দুই স্ত্রীর তাড়ায় সাত বছর দেশছাড়া। ষষ্ঠীচরণের বিশ্বাস পুষ্পর অসামান্য বশীকরণ-শক্তি। সেই পারবে মাখনকে ফিরিয়ে আনতে। পুষ্প শুনে হাসে আর ভাবে, যদি সম্ভব হয় তবে প্রহসনটাকে সে সম্পূর্ণ করে দেবে। এই নিয়ে রবি ঠাকুর নামে একজন গ্রন্থকারের সঙ্গে মাঝে মাঝে সে পত্রব্যবহার করেছে।
ফকির, স্বামী অচ্যুতানন্দের চেলা। গোঁফদাড়িতে মুখের বারো আনা অনাবিস্কৃত। ফকিরের স্ত্রী হৈমবতী। বাপের আদরের মেয়ে। তিনি টাকা রেখে গেছেন ওর জন্যে। ফকিরের বাপ বিশ্বেশ্বর পুত্রবধূকে স্নেহ করেন, পুত্রের অপরিমিত গুরুভক্তিতে তিনি উৎকণ্ঠিত।
পুষ্পমালা এম| এ| পরীক্ষায় সংস্কৃতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া মেয়ে। দূরসম্পর্কে হৈমর দিদি। কলেজি খাঁচা থেকে ছাড়া পেয়ে পাড়াগাঁয়ে বোনের বাড়িতে সংসারটাকে প্রত্যক্ষ দেখতে এসেছে। কৌতূহলের সীমা নেই। কৌতুকের জিনিসকে নানা রকমে পরখ করে দেখতে কখনো নেপথ্যে, কখনো রঙ্গভূমিতে। ভারি মজা লাগছে। সকল পাড়ায় তার গতিবিধি, সকলেই তাকে ভালোবাসে।
পুষ্পমালার একজন গুরু আছেন, তিনি খাঁটি বনস্পতি জাতের। অগুরু-জঙ্গলে দেশ গেছে ছেয়ে। পুষ্পর ইচ্ছে সেইগুলোতে হাসির আগুন লাগিয়ে খাণ্ডবদাহন করে। কাজ শুরু করেছিল এই নবগ্রামে। শুনেছি, বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর পুণ্যকর্মে ব্যাঘাত ঘটেছে। তার পর থেকে পঞ্চশরের সঙ্গে হাসির শর যোগ করে ঘরের মধ্যেই সুমধুর অশান্তি আলোড়িত করেছে। সেই প্রহসনটা এই প্রহসনের বাইরে।
পাশের পাড়ার মোড়ল ষষ্ঠীচরণ। তার নাতি মাখন দুই স্ত্রীর তাড়ায় সাত বছর দেশছাড়া। ষষ্ঠীচরণের বিশ্বাস পুষ্পর অসামান্য বশীকরণ-শক্তি। সেই পারবে মাখনকে ফিরিয়ে আনতে। পুষ্প শুনে হাসে আর ভাবে, যদি সম্ভব হয় তবে প্রহসনটাকে সে সম্পূর্ণ করে দেবে। এই নিয়ে রবি ঠাকুর নামে একজন গ্রন্থকারের সঙ্গে মাঝে মাঝে সে পত্রব্যবহার করেছে।
নিদ্রামগ্ন ফকির। মুখের কাছে একছড়া কলা। জেগে উঠে
কলার ছড়া তুলে নেড়েচেড়ে দেখল
নিদ্রামগ্ন ফকির। মুখের কাছে একছড়া কলা। জেগে উঠে
কলার ছড়া তুলে নেড়েচেড়ে দেখল
ফকির।
আহা, গুরুদেবের কৃপা। (ছড়াটা মাথায় ঠেকিয়ে চোখ বুজে) শিবোহং শিবোহং শিবোহং। (একটা একটা ক'রে গোটা দশেক খেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে) আঃ!
মাখনের প্রবেশ
মাখনের প্রবেশ
মাখন।
কী দাদা, ভালো তো! আমার নাম শ্রীমাখনানন্দ।
ফকির।
গুরুর চরণ ভরসা।
মাখন।
গুরুই খুঁজে মরছি সদ্গুরু মেলে না তো দয়া হবে কি। নেবে কি অভাবজনকে।
ফকির।
ভয় নেই, সময় হোক আগে।
মাখন।
(কান্নার সুরে) সময় আমার হবে না প্রভু, হবে না। দিন যে গেল! বড়ো পাপী আমি। আমার কী গতি হবে।
ফকির।
গুরুপদে মন স্থির করো-- শিবোহং।
মাখন।
এই পদেই ঠেকল আমার তরী; যম তা হলে ভয়ে কাছে ঘেঁষবে না।
ফকির।
তোমার নিষ্ঠা দেখে বড়ো সন্তুষ্ট হলুম।
মাখন।
শুধু নিষ্ঠা নয় গুরু, এনেছি কিছু তালের বড়া। তালগাছটা সুদ্ধ উদ্ধার পাক।
ফকির।
(ব্যগ্রভাবে আহার) আহা, সুস্বাদ বটে। ভক্তির দান কি না।
মাখন।
সার্থক হল আমার নিবেদন। বাড়ির এঁয়োরা খবর পেলে কী খুশিই হবেন! যাই, ওঁদের সংবাদ পাঠিয়ে দিইগে, ওঁরা আরও কিছু হাতে নিয়ে আসবেন।-- প্রভু, গৃহাশ্রমে আর কি ফিরবেন না।
ফকির।
আর কেন। গুরু বলেন, বৈরাগ্যং এবং ভয়ং।
মাখন।
গৃহী আমি, ডাইনে বাঁয়ে মায়া-মাকড়সানি জড়িয়েছে আপাদমস্তক। ধনদৌলতের সোনার কেল্লাটা কত বড়ো ফাঁকি সেটা খুব করেই বুঝে নিয়েছি। বুঝেছি সেটা নিছক স্বপ্ন। ভগবান আমাকে অকিঞ্চন করে পথে পথে ঘোরাবেন এই তো আমার দিনরাত্রির সাধনা, কিন্তু আর তোর পারি নে, একটা উপায় বাৎলিয়ে দাও।
ফকির।
আছে উপায়।
মাখন।
(পা জড়িয়ে) বলে দাও, বলে দাও, বঞ্চিত কোরো না।
ফকির।
দিন-ভোর উপোষ ক'রে থেকে--
মাখন।
উপোষ! সর্বনাশ! সেটা অভ্যেস নেই একেবারেই। আমার দুষ্ট গ্রহ দিনে চারবার করে আহার জুটিয়ে দিয়ে অন্তরটা একেবারে নিরেট করে দিয়েছেন। আর কোনো রাস্তা যদি--
ফকির।
আচ্ছা, দুখানা রুটি--
মাখন।
আরও একটু দয়া করেন যদি, দু'বাটি ক্ষীর!
ফকির।
ভালো, তাই হবে।
মাখন।
আহা, কী করুণা প্রভুর! তেমন করে পা যদি চেপে থাকতে পারি তা হলে পাঁঠাটাও--
ফকির।
না না, ওটা থাক্।
মাখন।
আচ্ছা, তবে থাক্, একটা দিন বই তো নয়। তা কী করতে হবে বলুন। দেখুন, আমি মুখ্খু মানুষ, অনুস্বার-বিসর্গওয়ালা মন্তর মুখ দিয়ে বেরবে না, কী বলতে কী বলব, শেষকালে অপরাধ হবে।
ফকির।
ভয় নেই, তোমার জন্যে সহজ করেই দিচ্ছি। গুরুর মূর্তি স্মরণ করে সারারাত জপ করবে, সোনা তোমাকেই দিলুম, তোমাকেই দিলুম, যতক্ষণ না ধ্যানের মধ্যে দেখবে, সোনা আর নেই--কোত্থাও নেই।
মাখন।
হবে হবে প্রভু, এই অধমেরও হবে। বলব, সোনা নেই, সোনা নেই; এ হাতে নেই, ও হাতে নেই; ট্যাঁকে নেই, থলিতে নেই; ব্যাঙ্কে নেই, বাক্সোয় নেই। ঠিক সুরে বাজবে মন্ত্র। আচ্ছা, গুরুজি, ওর সঙ্গে একটা অনুস্বার জুড়ে দিলে হয় না? নইলে নিতান্ত বাংলার মতো শোনাচ্ছে। অনুস্বার দিলে জোর পাওয়া যায়-- সোনাং নেই, সোনাং নেই, কিছুং নেই, কিছুং নেই।
ফকির।
মন্দ শোনাচ্ছে না।
মাখন।
আচ্ছা, তবে অনুমতি হোক, পোলাওটা ঠাণ্ডা হয়ে এল।
[ প্রস্থান
[ প্রস্থান
ফকিরের গান
ফকিরের গান
ষষ্ঠীচরণ ছুটে এসে
বামনদাস বাবুর প্রবেশ
[সকলের উচ্চহাস্য
দুই স্ত্রীর প্রবেশ
সকলের হাস্য
[সকলের হাস্য
পাঁচু।
তুমি খাও তালের বড়া, দেয় এনে আর-এক মহাত্মা, এও তো মজা কম নয়। তাকে চেন না?
ফকির।
আজ্ঞে না।
সিধু।
সে চেনে না তোমাকে?
ফকির।
আজ্ঞে না।
নকুল।
এ যে আরব্য উপন্যাস।
[সকলের হাস্য
[সকলের হাস্য
ষষ্ঠী।
যা হবার তা তো হয়ে গেছে, এখন ঘরে চলো।
ফকির।
কার ঘরে যাব?
১।
মরি মরি, ঘর চেন না পোড়ারমুখো! বলি, আমাদের দুটিকে চেন তো?
ফকির।
সত্যি কথা বলি, রাগ করবেন না, চিনি নে।
সকলে।
ঐ লোকটার ভণ্ডামি তো সইবে না। জোর করে নিয়ে যাও ওকে ধ'রে তালা বন্ধ করে রাখো।
ফকির।
গুরো।
সকলে।
(মিলে ঠেলাঠেলি) ওঠো, ওঠো বলছি।
সুধীর।
বৌ দুটোকে এড়াতে চাও তার মানে বুঝি; কিন্তু তোমার ছেলেমেয়েগুলিকে? তোমার চারটি মেয়ে, তিনটি ছেলে, তাও ভুলেছ না কি।
ফকির।
ও সর্বাশ! আমাকে মেরে ফেললেও এখান থেকে নড়ব না। (গাছের গুঁড়ি আঁকড়িয়ে ধ'রে) কিছুতেই না।
হরিশ উকিল।
জান আমি কে? পূর্ব-আশ্রমে জানতে। অনেক সাধুকে জেলে পাঠিয়েছি। আমি হরিশ উকিল। জান? তোমার দুই স্ত্রী!
ফকির।
এখানে এসে প্রথম জানলুম।
হরিশ।
আর, তোমার চার মেয়ে তিন ছেলে।
ফকির।
আপনারা জানেন, আমি কিছুই জানি নে।
হরিশ।
এদের ভরণ-পোষণের ভার তুমি যদি না নাও, তা হলে মকদ্দমা চলবে বলে রাখলুম।
ফকির।
বাপ রে! মকদ্দমা! পায়ে ধরি, একটু রাস্তা ছাড়ুন।
দুই স্ত্রী।
যাবে কোথায়, কোন্ চুলোয়, যমের কোন্ দুয়োরে।
ফকির।
গুরো! (হতবুদ্ধি হয়ে বসে পড়ল)
হৈমবতীর প্রবেশ ও ফকিরকে প্রণাম
হৈমবতীর প্রবেশ ও ফকিরকে প্রণাম
ফকির।
(লাফিয়ে উঠে) এ কী, এ যে হৈমবতী! বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও।
১।
ওলো, ওর সেই কাশীর বৌ, এখনো মরে নি বুঝি।
মাখনকে নিয়ে পুষ্পর প্রবেশ
মাখনকে নিয়ে পুষ্পর প্রবেশ
মাখন।
ধরা দিলেম-- বেওজর। লাগাও হাতকড়ি। প্রমাণের দরকার নেই। একেবারে সিধে নাকের দিকে তাকান। আমি মাখনচন্দ্র। এই আমার দড়ি আর এই আমার কল্সি। মা অঞ্জনা, কিষ্কিন্ধ্যায় তো ঢোকালে। মাঝে মাঝে খবর নিয়ো। নইলে বিপদে পড়লে আবার লাফ মারব।
পুষ্প।
ফকিরদা, তোমার মুক্তি কোথায় সে তো এখন বুঝেছ?
ফকির।
খুব বুঝেছি-- এ রাস্তা আর ছাড়ছি নে।
পুষ্প।
বাছা মাখন, তোমার মস্ত সুবিধে আছে-- তোমার ফুর্তি কেউ মারতে পারবে না। এ দুটিও নয়।
দুই স্ত্রী।
ছি ছি, আর একটু হলে তো সর্বনাশ হয়েছিল! (গড় হয়ে প্রণাম ক'রে) বাঁচালে এসে।