এস এস বসন্ত ধরাতলে।
আনো কুহুতান, প্রেমগান,
আনো গন্ধমদভরে অলস সমীরণ;
আনো নবযৌবন-হিল্লোল, নব প্রাণ,
প্রফুল্ল নবীন বাসনা ধরাতলে।
পুরুষগণ।
এস থরথর-কম্পিত, মর্মর-মুখরিত,
নব-পল্লব-পুলকিত
ফুল-আকুল-মালতী-বল্লি বিতানে,
সুখছায়ে মধুবায়ে, এস এস।
এস অরুণ-চরণ-কমল-বরন তরুণ উষার কোলে।
এস জ্যোৎস্না-বিবশ নিশীথে,
কল-কল্লোল তটিনী-তীরে,
সুখসুপ্ত সরসী-নীরে, এস এস।
স্ত্রীগণ।
এস যৌবন-কাতর হৃদয়ে,
এস মিলন-সুখালস নয়নে,
এস মধুর শরম মাঝারে,
দাও বাহুতে বাহু বাঁধি,
নবীন কুসুম পাশে রচি দাও নবীন মিলন-বাঁধন।
অমর।
( শান্তার প্রতি ) মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে।
মধুর মলয়-সমীরে মধুর মিলন রটাতে।
কুহক লেখনী ছুটায়ে কুসুম তুলিছে ফুটায়ে,
লিখিছে প্রণয়-কাহিনী বিবিধ বরন-ছটাতে।
হেরো পুরানো প্রাচীন ধরণী হয়েছে শ্যামল-বরনী,
যেন যৌবন-প্রবাহ ছুটিছে কালের শাসন টুটাতে;
পুরানো বিরহ হানিছে, নবীন মিলন আনিছে,
নবীন বসন্ত আইল নবীন জীবন ফুটাতে।
স্ত্রীগণ।
আজি আঁখি জুড়াল হেরিয়ে,
মনোমোহন মিলনমাধুরী যুগল মুরতি।
পুরুষগণ।
ফুলগন্ধে আকুল করে, বাজে বাঁশরি উদাস স্বরে,
নিকুঞ্জ প্লাবিত চন্দ্রকরে;
স্ত্রীগণ।
তারি মাঝে মনোমোহন মিলনমাধুরী যুগল মুরতি।
আনো আনো ফুলমালা, দাও দোঁহে বাঁধিয়ে।
পুরুষগণ।
হৃদয়ে পশিবে ফুলপাশ, অক্ষয় হবে প্রেমবন্ধন।
স্ত্রীগণ।
চিরদিন হেরিব হে
মনোমোহন মিলনমাধুরী যুগল মুরতি।
প্রমদা ও সখীগণের প্রবেশ
প্রমদা ও সখীগণের প্রবেশ
অমর।
এ কি স্বপ্ন! এ কি মায়া!
এ কি প্রমদা! এ কি প্রমদার ছায়া!
শান্তা।
( প্রমদার প্রতি ) আহা কে গো তুমি মলিন-বয়নে,
আধ-নিমীলিত নলিন-নয়নে,
যেন আপনারি হৃদয়-শয়নে
আপনি রয়েছ লীন।
পুরুষগণ।
তোমা তরে সবে রয়েছে চাহিয়া,
তোমা লাগি পিক উঠিছে গাহিয়া,
ভিখারি সমীর কানন বাহিয়া
ফিরিতেছে সারা দিন।
অমর।
এ কি স্বপ্ন! এ কি মায়া!
এ কি প্রমদা! এ কি প্রমদার ছায়া!
শান্তা।
যেন শরতের মেঘখানি ভেসে,
চাঁদের সভাতে দাঁড়ায়েছ এসে,
এখনি মিলাবে ম্লান হাসি হেসে,
কাঁদিয়া পড়িবে ঝরি।
পুরুষগণ।
জাগিছে পূর্ণিমা পূর্ণ নীলাম্বরে,
কাননে চামেলি ফুটে থরে থরে,
হাসিটি কখন ফুটিবে অধরে
রয়েছি তিয়াষ ধরি।
অমর।
এ কি স্বপ্ন! এ কি মায়া!
এ কি প্রমদা! এ কি প্রমদার ছায়া!
সখীগণ।
আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,
এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়,
সখীর হৃদয় কুসুম-কোমল--
কার অনাদরে আজি ঝরে যায়।
কেন কাছে আস, কেন মিছে হাস,
কাছে যে আসিত সে তো আসিতে না চায়।
সুখে আছে যারা, সুখে থাক্ তারা,
সুখের বসন্ত সুখে হোক সারা,
দুখিনী নারীর নয়নের নীর
সুখী জনে যেন দেখিতে না পায়।
তারা দেখেও দেখে না, তারা বুঝেও বোঝে না,
তারা ফিরেও না চায়।
শান্তা।
আমি তো বুঝেছি সব, যে বোঝে না বোঝে,
গোপনে হৃদয় দুটি কে কাহারে খোঁজে।
আপনি বিরহ গড়ি, আপনি রয়েছ পড়ি,
বাসনা কাঁদিছে বসি হৃদয়-সরোজে।
আমি কেন মাঝে থেকে, দু-জনারে রাখি ঢেকে,
এমন ভ্রমের তলে কেন থাকি মজে।
অশোক।
( প্রমদার প্রতি ) এতদিন বুঝি নাই, বুঝেছি ধীরে,
ভালো যারে বাস তারে আনিব ফিরে।
হৃদয়ে হৃদয় বাঁধা, দেখিতে না পায় আঁধা,
নয়ন রয়েছে ঢাকা নয়ন-নীরে।
শান্তা ও স্ত্রীগণ।
চাঁদ হাসো, হাসো।
হারা হৃদয় দুটি ফিরে এসেছে।
পুরুষ।
কত দুখে কত দূরে, আঁধার সাগর ঘুরে,
সোনার তরণী দুটি তীরে এসেছে।
মিলন দেখিবে বলে, ফিরে বায়ু কুতূহলে,
চারি ধারে ফুলগুলি ঘিরে এসেছে।
সকলে।
চাঁদ হাসো, হাসো।
হারা হৃদয় দুটি ফিরে এসেছে।
প্রমদা।
আর কেন, আর কেন,
দলিত কুসুমে বহে বসন্ত-সমীরণ।
ফুরায়ে গিয়াছে বেলা, এখন এ মিছে খেলা,
নিশান্তে মলিন দীপ কেন জ্বলে অকারণ।
সখীগণ।
অশ্রু যবে ফুরায়েছে তখন মুছাতে এলে,
অশ্রুভরা হাসিভরা নবীন নয়ন ফেলে।
প্রমদা।
এই লও, এই ধরো, এ মালা তোমরা পরো,
এ খেলা তোমরা খেলো, সুখে থাকো অনুক্ষণ।
অমর।
এ ভাঙা সুখের মাঝে নয়ন-জলে,
এ মলিন মালা কে লইবে।
ম্লান আলো ম্লান আশা হৃদয়-তলে,
এ চির বিষাদ কে বহিবে।
সুখনিশি অবসান, গেছে হাসি গেছে গান,
এখন এ ভাঙা প্রাণ লইয়া গলে
নীরব নিরাশা কে সহিবে।
শান্তা।
যদি কেহ নাহি চায়, আমি লইব,
তোমার সকল দুখ আমি সহিব।
আমার হৃদয় মন, সব দিব বিসর্জন,
তোমার হৃদয়-ভার আমি বহিব।
ভুল-ভাঙা দিবালোকে, চাহিব তোমার চোখে,
প্রশান্ত সুখের কথা আমি কহিব।
[ অমর ও শান্তার প্রস্থান
মায়াকুমারীগণ।
দুখের মিলন টুটিবার নয়।
নাহি আর ভয় নাহি সংশয়।
নয়ন-সলিলে যে হাসি ফুটে গো,
রয় তাহা রয় চিরদিন রয়।
প্রমদা।
কেন এলি রে, ভালোবাসিলি, ভালোবাসা পেলি নে।
কেন সংসারেতে উঁকি মেরে চলে গেলি নে।
সখীগণ।
সংসার কঠিন বড়ো কারেও সে ডাকে না,
কারেও সে ধরে রাখে না।
যে থাকে সে থাকে, আর যে যায় সে যায়,
কারো তরে ফিরেও না চায়।
প্রমদা।
হায় হায়, এ সংসারে যদি না পুরিল
আজন্মের প্রাণের বাসনা,
চলে যাও ম্লান মুখে, ধীরে ধীরে ফিরে যাও,
থেকে যেতে কেহ বলিবে না।
তোমার ব্যথা তোমার অশ্রু তুমি নিয়ে যাবে,
আর তো কেহ অশ্রু ফেলিবে না।
সকলে।
এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না,
প্রথমা।
শুধু সুখ চলে যায়।
দ্বিতীয়া।
এমনি মায়ার ছলনা।
তৃতীয়া।
এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়।
সকলে।
তাই কেঁদে কাটে নিশি, তাই দহে প্রাণ,
তাই মান অভিমান,
প্রথমা।
তাই এত হায় হায়।
দ্বিতীয়া।
প্রেমে সুখ দুখ ভুলে তবে সুখ পায়।
সকলে।
সখী চলো, গেল নিশি, স্বপন ফুরাল,
মিছে আর কেন বল।
প্রথমা।
শশী ঘুমের কুহক নিয়ে গেল অস্তাচল।
সকলে।
সখী চলো।
প্রথমা।
প্রেমের কাহিনী গান, হয়ে গেল অবসান।
দ্বিতীয়া।
এখন কেহ হাসে, কেহ বসে ফেলে অশ্রুজল।