বাগান

বাগান

সুকুমারীর প্রবেশ

সুকুমারীর প্রবেশ

সুকুমারী।

দেখো দেখি, এখন সতীশ কেমন পরিশ্রম করে কাজকর্ম করছে। দেখো, অতবড়ো সাহেব-বাবু আজকাল পুরোনো কালো আলপাকার চাপকানের উপরে কোঁচানো চাদর ঝুলিয়ে কেমন নিয়মিত আপিসে যায়!

শশধর।

বড়োসাহেব সতীশের খুব প্রশংসা করেন।

সুকুমারী।

ভালোই তো, যা মাইনে পাবে তাতেই বেশ চলে যাবে। তার উপরে যদি তোমার জমিদারিটা তাকে দিয়ে বস, তবে একদিনে সে টাই-কলার-জুতা-ছড়ি কিনেই সেটা নিলামে চড়িয়ে দেবে। আমার পরামর্শ নিয়ে যদি চলতে তবে সতীশ এতদিনে মানুষের মতো হত।

শশধর।

বিধাতা আমাদের বুদ্ধি দেন নি, কিন্তু স্ত্রী দিয়েছেন; আর তোমাদের বুদ্ধি দিয়েছেন, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে নির্বোধ স্বামীগুলাকেও তোমাদের হাতে সমর্পণ করেছেন -- আমাদেরই জিত।

সুকুমারী।

আচ্ছা, আচ্ছা, ঢের হয়েছে, ঠাট্টা করতে হবে না। কিন্তু সতীশের পিছনে এতদিন যে-টাকাটা ঢেলেছ সে যদি আজ থাকত, তবে --

শশধর।

সতীশ তো বলেছে, কোনো-একদিন সে সমস্তই শোধ করে দেবে।

সুকুমারী।

রইল। সে তো বরাবরই ঐরকম লম্বাচৌড়া কথা বলে থাকে। তুমি বুঝি সেই ভরসায় পথ চেয়ে বসে আছ।

শশধর।

এতদিন তো ভরসা ছিল, তুমি যদি পরামর্শ দাও তো সেটা বিসর্জন দিই।

সুকুমারী।

দিলে তোমার বেশি লোকসান হবে না, এই পর্যন্ত বলতে পারি। ঐ-যে তোমার সতীশবাবু আসছেন। আমি যাই।

সতীশের প্রবেশ

সতীশের প্রবেশ

সতীশ।

মাসিমা, পালাতে হবে না, এই দেখো, আমার হাতে অস্ত্রশস্ত্র কিছুই নেই -- কেবল খানকয়েক নোট আছে।

শশধর।

ইস্‌, এ যে একতাড়া নোট। যদি আপিসের টাকা হয় তো এমন করে সঙ্গে নিয়ে বেড়ানো ভালো হচ্ছে না, সতীশ।

সতীশ।

আর সঙ্গে নিয়ে বেড়াব না। মাসিমার পায়ে বিসর্জন দিলাম। প্রণাম হই মাসিমা। বিস্তর অনুগ্রহ করেছিলে, তখন তার হিসাব রাখতে হবে মনেও করি নি, সুতরাং পরিশোধের অঙ্কে কিছু ভুলচুক হতে পারে। এই পনরোহাজার টাকা গুনে নাও। তোমার হরেনের পোলাও-পরামান্নে একটি তণ্ডুলকণাও কম না পড়ুক।

শশধর।

এ কী কাণ্ড, সতীশ! এত টাকা কোথায় পেলে।

সতীশ।

আমি গুনচট আজ ছয়মাস আগাম খরিদ করে রেখেছি -- ইতিমধ্যে দর চড়েছে; তাই মুনাফা পেয়েছি।

শশধর।

সতীশ, এ-যে জুয়োখেলা।

সতীশ।

খেলা এইখানেই শেষ, আর দরকার হবে না।

শশধর।

তোমার এ-টাকা তুমি নিয়ে যাও, আমি চাই না।

সতীশ।

তোমাকে তো দিই নি, মেসোমশায়। এ মাসিমার ঋণশোধ, তোমার ঋণ কোনোকালে শোধ করতে পারব না।

শশধর।

কী সুকু, এ টাকাগুলো --

সুকুমারী।

গুনে খাতাঞ্জির হাতে দাও-না, ঐখানেই কি ছড়ানো পড়ে থাকবে।

[ নোটগুলি তুলিয়া গুনিয়া দেখা

[ নোটগুলি তুলিয়া গুনিয়া দেখা

শশধর।

সতীশ, খেয়ে এসেছ তো?

সতীশ।

বাড়ি গিয়ে খাব।

শশধর।

অ্যাঁ, সে কী কথা। বেলা-যে বিস্তর হয়েছে। আজ এইখানেই খেয়ে যাও।

সতীশ।

আর খাওয়া নয়, মেসোমশায়। এক দফা শোধ করলেম, অন্নঋণ আর নূতন করে ফাঁদতে পারব না।

[প্রস্থান

[প্রস্থান

সুকুমারী।

বাপের হাত থেকে রক্ষা করে এতদিন ওকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করলেম, আজ হাতে দুপয়সা আসতেই ভাবখানা দেখেছ? কৃতজ্ঞতা এমনই বটে! ঘোর কলি কিনা!

[ উভয়ের প্রস্থান

[ উভয়ের প্রস্থান

সতীশের প্রবেশ

সতীশের প্রবেশ

সতীশ।

এই পিস্তলে দুটি গুলি পুরেছি -- এই যথেষ্ট। আমার অন্তিমের প্রেয়সী। ও কে ও? হরেন! কী করছিস? এই সন্ধ্যার সময় বাগানে অন্ধকার যে, চারি দিকে কেউ নেই -- পালা, পালা, পালা। (কপালে আঘাত করিয়া) সতীশ, কী ভাবছিস তুই -- ওরে সর্বনেশে, চুপ চুপ -- না না না, এ কি বকছি। আমি কি পাগল হয়ে গেলুম -- কে আছিস ওখানে। বেহারা, বেহারা! কেউ না, কেউ কোত্থাও নেই। মাসিমা! শুনতে পাচ্ছ? ইঃ, একেবারে লুটোপুটি করতে থাকবে। আঃ। হাতকে আর সামলাতে পারছি নে। হাতটাকে নিয়ে কী করি। হাতটাকে নিয়ে কী করা যায়।

[ ছড়ি লইয়া সতীশ সবেগে চারাগাছগুলিকে ক্রমাগত আঘাত করিতে লাগিল। তাহাতে তাহার উত্তেজনা ক্রমশ আরো বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। অবশেষে নিজের হাতকে সবেগে আঘাত করিল, কিন্তু কোনো বেদনা বোধ করিল না, শেষে পকেটের ভিতর হইতে পিস্তল সংগ্রহ করিয়া লইয়া সে হরেনের দিকে সবেগে অগ্রসর হইতে লাগিল। ]

[ ছড়ি লইয়া সতীশ সবেগে চারাগাছগুলিকে ক্রমাগত আঘাত করিতে লাগিল। তাহাতে তাহার উত্তেজনা ক্রমশ আরো বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। অবশেষে নিজের হাতকে সবেগে আঘাত করিল, কিন্তু কোনো বেদনা বোধ করিল না, শেষে পকেটের ভিতর হইতে পিস্তল সংগ্রহ করিয়া লইয়া সে হরেনের দিকে সবেগে অগ্রসর হইতে লাগিল। ]

হরেন।

(চমকিয়া উঠিয়া) এ কী! দাদা নাকি। তোমার দুটি পায়ে পড়ি দাদা, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, কাঁচা পেয়ারা পাড়ছিলুম, বাবাকে বলে দিয়ো না।

সতীশ।

(চীৎকার করিয়া) মেসোমশায়, মেসোমশায়, এই বেলা রক্ষা করো, আর দেরি কোরো না -- তোমার ছেলেকে এখনো রক্ষা করো।

শশধর।

(ছুটিয়া আসিয়া) কী হয়েছে, সতীশ। কী হয়েছে।

সুকুমারী।

(ছুটিয়া আসিয়া) কী হয়েছে, সতীশ। কী হয়েছে।

হরেন।

কিছুই হয় নি, মা -- কিছুই না -- দাদা তোমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছেন।

সুকুমারী।

এ কী রকম বিশ্রী ঠাট্টা। ছি ছি, সকলই অনাসৃষ্টি। দেখো দেখি! আমার বুক এখনো ধড়াস-ধড়াস করছে। সতীশ, মদ ধরেছে বুঝি।

সতীশ।

পালাও -- তোমার ছেলেকে নিয়ে এখনই পালাও! নইলে তোমাদের রক্ষা নেই।

[ হরেনকে লইয়া ত্রস্তপদে সুকুমারীর পলায়ন

[ হরেনকে লইয়া ত্রস্তপদে সুকুমারীর পলায়ন

শশধর।

সতীশ, অমন উতলা হোয়ো না। ব্যাপারটা কী বলো। হরেনকে কার হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য ডেকেছিলে।

সতীশ।

আমার হাত থেকে। (পিস্তল দেখাইয়া) এই দেখো, এই দেখো, মেসোমশায়।

দ্রুতপদে বিধুমুখীর প্রবেশ

দ্রুতপদে বিধুমুখীর প্রবেশ

বিধুমুখী।

সতীশ, তুই কোথায় কী সর্বনাশ করে এসেছিস বল্‌ দেখি! আপিসের সাহেব পুলিস সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়িতে খানাতল্লাসি করতে এসেছে। যদি পালাতে হয়, এই বেলা পালা। হায় ভগবান, আমি তো কোনো পাপ করি নি, আমারই অদৃষ্টে এত দুঃখ ঘটে কেন।

সতীশ।

ভয় নেই -- পালাবার উপায় আমার হাতেই আছে।

শশধর।

তবে কি তুমি --

সতীশ।

তাই বটে মেসোমশায়, যা সন্দেহ করছ তাই। আমি চুরি করে মাসির ঋণ শোধ করেছি। আমি চোর। মা, তুমি শুনে খুশি হবে, আমি চোর, আমি খুনী! তোমার কীর্তি পুরো হল। এখন আর কাঁদতে হবে না-- যাও তুমি, যাও তুমি, যাও যাও, আমার সম্মুখ থেকে যাও। আমার অসহ্য বোধ হচ্ছে।

শশধর।

সতীশ, তুমি আমার কাছেও তো কিছু ঋণী আছ, তাই শোধ করে যাও।

সতীশ।

বলো কেমন করে শোধ করব। কী আমি দিতে পারি। কী চাও তুমি।

শশধর।

ঐ পিস্তলটা।

সতীশ।

এই দিলাম। আমি জেলেই যাব। না গেলে আমার পাপের ঋণ শোধ হবে না।

শশধর।

পাপের ঋণ শাস্তির দ্বারা শোধ হয় না সতীশ, কর্মের দ্বারাই শোধ হয়। তুমি নিশ্চয় জেনো, আমি অনুরোধ করলে তোমার বড়োসাহেব তোমাকে জেলে দেবেন না। এখন থেকে জীবনকে সার্থক করে বেঁচে থাকো।

সতীশ।

মেসোমশায়, আমার পক্ষে বাঁচা যে কত কঠিন তা তুমি জানো না--

শশধর।

তবু বাঁচতে হবে, আমার ঋণের এই শোধ। আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে না।

সতীশ।

তবে তাই হবে।

শশধর।

আমার একটা অনুরোধ শোনো। তোমার মাকে আর মাসীকে ক্ষমা করো।

বিধুমুখী।

বাবা, আমার কপালে ক্ষমা না থাকে নাই থাক্‌, ভগবান তোকে যেন ক্ষমা করেন। দিদির কাছে যাই। তাঁর পায়ে ধরি গে।

[প্রস্থান

[প্রস্থান

শশধর।

তবে এসো সতীশ, আমার ঘরে আজ আহার করে যেতে হবে।

দ্রুতপদে নলিনীর প্রবেশ

দ্রুতপদে নলিনীর প্রবেশ

নলিনী।

সতীশ!

সতীশ।

কী নলিনী।

নলিনী।

এর মানে কী? এ চিঠি তুমি আমাকে কেন লিখেছ।

সতীশ।

মানে যেমন বুঝেছিলে সেইটেই ঠিক। আমি তোমাকে প্রতারণা করে চিঠি লিখি নি। তবে আমার ভাগ্যক্রমে সকলই উলটো হয়। তুমি মনে করতে পার, তোমার দয়া উদ্রেক করবার জন্যই আমি -- কিন্তু মেসোমশায় সাক্ষী আছেন, আমি অভিনয় করছিলেম না -- তবু যদি বিশ্বাস না হয় প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবার এখনো সময় আছে!

নলিনী।

কী তুমি পাগলের মতো বকছ। আমি তোমার কী অপরাধ করেছি যে তুমি আমাকে এমন নিষ্ঠুরভাবে --

সতীশ।

যেজন্য আমি এই সংকল্প করেছি সে তুমি জান, নলিনী -- আমি তো একবর্ণও গোপন করি নি, তবু কি আমার উপর শ্রদ্ধা আছে।

নলিনী।

শ্রদ্ধা! সতীশ, তোমার উপর ঐজন্যই আমার রাগ ধরে। শ্রদ্ধা -- ছি ছি, শ্রদ্ধা তো পৃথিবীতে অনেকেই অনেককে করে। তুমি যে-কাজ করেছ আমিও তাই করেছি -- তোমাতে আমাতে কোনো ভেদ রাখি নি। এই দেখো, আমার গহনাগুলি সব এনেছি -- এগুলো এখনো আমার সম্পত্তি নয় -- এগুলি আমার বাপ-মায়ের। আমি তাঁদের না ব'লে চুরি করেই এনেছি, এর কত দাম হত পারে আমি কিছুই জানি নে; কিন্তু এ দিয়ে কি তোমার উদ্ধার হবে না।

শশধর।

উদ্ধার হবে; এই গহনাগুলির সঙ্গে আরো অমূল্য যে-ধনটি দিয়েছ তা দিয়েই সতীশের উদ্ধার হবে।

নলিনী।

এই যে শশধরবাবু, মাপ করবেন, তাড়াতাড়িতে আপনাকে আমি--

শশধর।

মা, সেজন্য লজ্জা কী। দৃষ্টির দোষ কেবল আমাদের মতো বুড়োদেরই হয় না -- তোমাদের বয়সে আমাদের মতো প্রবীণ লোক হঠাৎ চোখে ঠেকে না। -- সতীশ, তোমার আপিসের সাহেব এসেছেন দেখছি। আমি তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে আসি। ততক্ষণ তুমি আমার হয়ে অতিথিসৎকার করো। মা, এই পিস্তলটা এখন তোমার জিম্মাতেই থাকতে পারে।