বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং, আমি সেই মহান্ পুরুষকে জানিয়াছি।
তাঁহাকে পাওয়া যায় কি না এ প্রশ্নের ইহা অপেক্ষা সুস্পষ্ট এবং সরল উত্তর আর কী হইতে পারে যে, আমি তাঁহাকে পাইয়াছি। যিনি জানিতে চাহিয়াছিলেন তিনি তাঁহাকে জানিয়াছেন, যিনি পাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন তিনি তাঁহাকে পাইয়াছেন, ইহাই আমাদের আশার কথা। ইহার উপরে আর তর্ক নাই। তর্কের দ্বারা যদি কেহ প্রমাণ করিত যে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় তবে তর্কের দ্বারা তাহার খণ্ডন সম্ভব হইতে পারিত, কিন্তু অনেক সহস্র বৎসর পূর্বে নির্জন ধ্যানাসন হইতে দণ্ডায়মান হইয়া ব্রহ্মবাদী মহর্ষি বিশ্বলোককে আহ্বানপূর্বক এই এক মহাসাক্ষ্য ঘোষণা করিয়াছেন যে --
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং, আমি সেই মহান্ পুরুষকে জানিয়াছি।
সেই সত্যবাণী আজিও সমস্ত দেশকালকে অতিক্রম করিয়া সমস্ত তর্কসংশয়কে অভিভূত করিয়া দিব্যধামবাসী অমৃতের পুত্রগণের নিকট উত্থিত হইতেছে।
অদ্যকার ভারতবর্ষে আমাদের মধ্যেও মাঝে মাঝে এ তর্ক উঠিয়া থাকে যে, নিরাকার ব্রহ্মকে কি পাওয়া যাইতে পারে? প্রাচীন ভারতের মহাসাক্ষ্যবাণী আজিও লয়প্রাপ্ত হয় নাই; সেই প্রশান্ত তপোভূমি হইতে অমৃত আশ্বাসবাক্য আজিও আমাদের বিক্ষুব্ধ কর্মভূমিতে আসিয়া উপনীত হইতেছে -- এই অনিত্য সংসারের রূপ-রস-গন্ধ-ব্যূহ ভেদ করিয়া স্বাধীন আত্মার সনাতন জয়শঙ্খধ্বনি বাজিয়া উঠিতেছে, ব্রহ্মবিদাপ্নোতি পরম্--ব্রহ্মবিৎ পরম পুরুষকে পাইয়া থাকেন-- তবু আমরা প্রশ্ন তুলিয়াছি নিরাকার পরব্রহ্মকে কি পাওয়া যায়? অদ্য তেমন সবল গভীর কন্ঠে, তেমন সরল সতেজ চিত্তে এমন সুষ্পষ্ট উত্তর কে দিবে --
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং, আমি সেই মহান্ পুরুষকে জানিয়াছি।
আজ সেই প্রশ্নের উত্তরে কেবল সংশয়ধূলিসমাচ্ছন্ন তর্ক উঠিয়াছে-- ইহা কি কখনো সম্ভব হয়? নিরাকার পরব্রহ্মকে কি কখনো পাওয়া যাইতে পারে?
কিন্তু পাওয়া কাহাকে বলে?
আমরা কোন্ জিনিসটাকে পাই? যে-সকল পদার্থকে আমার পাইয়াছি বলিয়া কল্পনা করি তাহাদের উপরে আমাদের কতটুকু অধিকার? আলোককে আমরা চোখে দেখি মাত্র, তাহাকে স্পর্শ করিতে পারি না, তবু বলি আলোক পাইলাম; উত্তাপকে আমরা স্পর্শ দ্বারা জানি কিন্তু চোখে দেখিতে পাই না, তবু বলি আমরা উত্তাপ লাভ করিলাম। গন্ধকে আমরা দেখিও না স্পর্শও করি না তবু গন্ধ আমরা যে পাই ইহাতে কোনো সংশয় বোধ করি না।
দেখা যাইতেছে ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্য পাইবার ভিন্ন ভিন্ন পথ আছে। কোনোটা দৃষ্টিতে পাই, কোনোটা স্পর্শে পাই, কোনোটা কর্ণে শুনি, কোনোটা ঘ্রাণে লাভ করি, কোনোটা-বা দুই-তিন ইন্দ্রিয়শক্তির একত্রযোগেও পাইয়া থাকি। সংগীতকে কেহ যদি চক্ষু দিয়া পাইবার চেষ্টা করে তবে সে চেষ্টাকে লোকে বাতুলতা বলিবে এবং পুষ্পকে কেহ যদি গানের মতো লাভ করিবার ইচ্ছা করে তবে সে ইচ্ছা নিতান্তই ব্যর্থ হয়।
কেবল তাহাই নহে। আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তি সীমাবদ্ধ, এইজন্য ইন্দ্রিয় দ্বারা আমরা কোনো বস্তুকে যতটুকু পাই তাহাও অত্যন্ত অসম্পূর্ণ। আমরা যখন কোনো বস্তুর এক পিঠ দেখি তখন অন্য পিঠ দেখিতে পাই না, যখন বাহিরটা দেখি তখন ভিতরটা আমাদের অগোচর থাকে। অধিকক্ষণ কিছু অনুভব করিতে গেলে আমাদের ইন্দ্রিয় ক্লান্ত, আমাদের স্নায়ুশক্তি অসাড় হইয়া আসে।
কিন্তু তথাপি জড়বস্তুসকলকে আমরা পাইলাম বলিয়া সন্তুষ্ট আছি; এবং যে বস্তুকে যে উপায়ে যে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা পাওয়া সম্ভব সেই উপায়ে সেই ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই তাহাকে লাভ করিবার চেষ্টা করিয়া থাকি।
লৌকিক বস্তু সম্বন্ধেই যখন এরূপ তখন নিরাকার ব্রহ্মকে পাওয়ারই কি কোনো বিশেষত্ব নাই? তাঁহাকে চোখে দেখিলাম না বলিয়াই কি তাঁহাকে পাইলাম না?
এ কথা আমরা কেন না মনে করি যে, স্বরূপতই তিনি যখন চোখে দেখার অতীত তখন তাঁহাকে চোখে দেখার চেষ্টা করাই মূঢ়তা। আমরা যদি আলোককে সংগীতরূপে ও সংগীতকে গন্ধরূপে পাইবার কল্পনাকেও দুরাশা বলিয়া জ্ঞান করি তবে নিরাকারকে সাকাররূপে লাভ না করিলে তাঁহাকে লাভ করাই হইল না এ কথা কেমন করিয়া মনে স্থান দিই?
আমরা যখন টাকা হাতে পাই তাহাকে কি আমাদের অন্তরাত্মার মধ্যে তুলিয়া রাখিতে পারি? যে ব্যক্তি তাহাকে অত্যন্ত নিজের করিয়া রাখিতে চেষ্টা করে সে তাহাকে মাটিতে পুতিয়া ফেলে, লোহার সিন্দুকে পুরিয়া রাখে, নিজের করিতে গিয়া নিজের কাছ হইতে দূরেই তাহাকে রাখিতে হয়। কিন্তু একান্ত চেষ্টাতেও সে টাকাকে কৃপণ আপনার অন্তরের মধ্যে রাখিতে পারে না; বাহিরের টাকা বাহিরেই পড়িয়া থাকে এবং মৃত্যুকালে ধূলির সহিত তাহার কোনো প্রভেদ থাকে না। কৃপণ তবুও তো জানে টাকা আমার, টাকা আমি পাইয়াছি। বাহিরের ধনকে অন্তরে না পাইয়াও আমরা তাহাকে পাইলাম বলিয়া স্বীকার করি; আর যিনি আমাদের একমাত্র ধন, যিনি অন্তরের অন্তরতম, তাঁহাকে বস্তুরূপে মূর্তিরূপে মনুষ্যরূপে বাহিরে না পাইলে কি আমাদের পাওয়া হইল না? যিনি চক্ষুষশ্চক্ষুঃ, চক্ষুর চক্ষু, তাঁহাকে কি চক্ষুর বাহিরে দেখিব? যিনি শোত্রস্য শ্রোত্রং, কর্ণের কর্ণ, তাঁহাকে কি কর্ণের বাহিরে শুনিব? যাঁহার সম্বন্ধে ঋষি বলিয়াছেন --
ন সন্দৃশে তিষ্ঠতি রূপমস্য
ন চক্ষুষা পশ্যতি কশ্চনৈনং।
হৃদা মনীষা মনসাভিক্প্তো
য এনমেবং বিদুরমৃতাস্তে ভবন্তি॥
ইহার স্বরূপ চক্ষুর সম্মুখে স্থিত নহে, ইহাকে কেহ চক্ষুতে দেখে না-- হৃদিস্থিত বুদ্ধি দ্বারা ইনি কেবল হৃদয়েই প্রকাশিত, ইঁহাকে যাঁহারা এইরূপেই জানেন তাঁহারা অমর হন-- এমন-যে আত্মার অন্তরাত্মা তাঁহাকে বহির্বস্তুর মতো বাহিরে পাইতে গেলেই তাঁহাকে পাওয়া যায় না এ কথা আমরা কেন না স্মরণ করি?
যাঁহারা ঈশ্বরকে পাইবার চেষ্টা করিয়াছেন তাঁহারা কী বলিয়াছেন? তাঁহারা বলেন --
ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্র তারকাং
নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোইয়মগ্নিঃ।
সূর্য তাঁহাকে প্রকাশ করিতে পারে না, চন্দ্রতারাও তাঁহাকে প্রকাশ করিতে পারে না, এই বিদ্যুৎসকলও তাঁহাকে প্রকাশ করিতে পারে না, তবে এই অগ্নি তাঁহাকে কী প্রকারে প্রকাশ করিবে?
তাঁহারা বলেন --
তমাত্মস্থং যে অনুপশ্যন্তি ধীরাঃ
তেষাং শান্তিঃ শাশ্বতী নেতরেষাম্॥
যে ধীরেরা তাঁহাকে আত্মস্থ করিয়া দেখেন তাঁহারাই নিত্য শান্তি লাভ করেন আর কেহ নহে। আর আমরা ঈশ্বরকে পাইবার কোনো চেষ্টা কোনো সাধনা না করিয়া এমন কথা কোন্ স্পর্ধায় বলিয়া থাকি যে, নিরাকার ব্রহ্মকে আত্মার মধ্যে না দেখিয়া, মূর্তির মধ্যে, অগ্নির মধ্যে, বাহ্যবস্তুর মধ্যেই দেখিতে হইবে, কারণ তাঁহাকে আর কোনো উপায়ে আমাদের পাইবার সামর্থ্য নাই। এ কথা কেন মনে করি না যে, একমাত্র যে উপায়ে তাঁহাকে পাওয়া যাইতে পারে-- অর্থাৎ আত্মার দ্বারা আত্মার মধ্যে-- তাহা ছাড়া তাঁহাকে পাইবার উপায়ান্তর মাত্র নাই।
কেন করি না তাহার কারণ, আমরা তর্ক করি, কিন্তু ঈশ্বরকে চাহি না।
আমরা ব্রহ্মকে কখন চাই? যখন দেখিতে পাই সংসারের পরিমিত পদার্থমাত্রই পরিবর্তনশীল-- যখন এই চঞ্চল ঘূর্ণ্যমান বিষয়াবর্তের মধ্যে একটি নির্বিকার ধ্রুব অবলম্বনের জন্য আমাদের আত্মা ব্যাকুল হইয়া উঠে। তখন যিনি সকল আকার বিকার এবং সীমার অতীত সহজেই তাঁহাকেই চাই। যিনি-- নিত্যোইত্যানাং, অনিত্য সকলের মধ্যে নিত্য, চেতনশ্চেতনানাং, সমস্ত চেতনার চেতয়িতা, তাঁহাকে সেই নিত্যরূপে, সেই চেতয়িতারূপেই পাইতে চাই। তখন এ সংকল্প মনে উদয় হইতেই পারে না যে, নিরাকারকে আমরা কৌশলপূর্বক সাকাররূপে লাভ করিতে চেষ্টা করিব। যখন কারাগারের পাষাণভিত্তি আমাদিগকে ক্লিষ্ট করে তখন নূতন প্রাচীর গাঁথিয়া আমরা মুক্তি কল্পনা করিতে পারি না। অসৎ যখন আমাদিগকে পীড়িত করে, যখন কাতর অন্তঃকরণ হইতে প্রার্থনা ধ্বনিত হইয়া উঠে, অসতো মা সদ্গময়, অসৎ হইতে আমাকে সত্যে লইয়া যাও, তখন কি নবতর অসত্যপাশ আমাদিগকে প্রলুব্ধ করিতে পারে?
আমরা ব্রহ্মকে কখন চাই? একদিন যখন উপলব্ধি করি আমাদের প্রবৃত্তি আমাদের বাসনা মুহূর্তে মুহূর্তে অসৎ সংসারের ধূলিকর্দম আহরণ করিয়া আমাদের আলোকের পথ অবরুদ্ধ করিয়াছে; আমরা সেই নিবিড় মোহান্ধকারে মণি বলিয়া যাহা সংগ্রহ করিতেছি তাহা মুষ্টির মধ্যে ধূলি হইয়া যাইতেছে, সুখ বলিয়া যাহা আলিঙ্গন করিতেছি তাহা সহস্রশিখা জ্বালারূপে আপাদমস্তক দগ্ধ করিতেছে, জল বলিয়া যাহা পান করিতেছি তাহা তৃষাহুতাশনে আহুতি-স্বরূপে বর্ষিত হইতেছে; তখন পাপের বিভীষিকায় ভয়াতুর হইয়া যাঁহাকে ডাকিয়া বলি "তমসো মা জ্যোতির্গময়' তিনি কি আমাদেরই মতো বাসনা-প্রবৃত্তির দ্বারা জড়িত সুখদুঃখপীড়িত পুরাণকল্পিত তমসাচ্ছন্ন দেবতা?
আমরা ব্রহ্মকে কখন চাই? যখন আমাদের আত্মা ব্রহ্মবাদিনী মৈত্রেয়ীর ন্যায় সমস্ত সংসারকে এক পার্শ্বে সরাইয়া দিয়া বলিয়া উঠে, যেনাহং নামৃতা স্যাম্ কিমহং তেন কুর্যাম্, যাহার দ্বারা আমি অমর না হইব তাহা লইয়া আমি কী করিব? আমরা সংসারের যত সুখ যত ঐশ্বর্য তাহার নিকট আহরণ করি সে বলিতে থাকে, এ তো আমার মৃত্যুর উপকরণ! সে আপন ক্ষুধার অন্ন পিপাসার জল চাহিয়া উচ্চকণ্ঠে ডাকিয়া উঠে। মৃত্যোর্মামৃতং গময়, মৃত্যু হইতে আমাকে অমৃতে লইয়া যাও। মৃত্যুপীড়িত আত্মার সেই অমৃতস্বরূপ কে? --
সত্য জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি।
সত্যস্বরূপ জ্ঞানস্বরূপ অনন্তস্বরূপ ব্রহ্ম, যিনি আনন্দরূপে অমৃতরূপে প্রকাশ পাইতেছেন।
অতএব, যখন আমরা যথার্থরূপে তাহাকে চাই তখন ব্রহ্ম বলিয়াই তাঁহাকে চাই। তিনি যদি সত্যস্বরূপ জ্ঞানস্বরূপ অনন্তস্বরূপ না হইতেন তবে এই অসৎ সংসার, এই অন্ধকার হৃদয়, এই মৃত্যুবীজসংকুল সুখসম্পদের মধ্যে থাকিয়া তাঁহাকে চাহিতাম না। কেন তবে আমরা তর্ক করিয়া থাকি যে, আমরা অপূর্ণ জীব এবং তিনি সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম, অতএব তাঁহাকে আমরা পাইতেই পারি না। এবং সেইজন্য অসত্য অজ্ঞান এবং অন্ধবিশিষ্ট আমরা আকারকে কেন তাঁহার স্থানে আরোপ করি? আমরা অপূর্ণ বলিয়াই সেই পূর্ণস্বরূপকে আমাদের একান্তই চাই, আমরা অপূর্ণ বলিয়াই সেই সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্মই আমাদের একমাত্র আনন্দ-- একমাত্র মুক্তি। আমরা অপূর্ণ বলিয়াই আমরা অপূর্ণের পূজা করিব না; অপূর্ণের উপরে আমাদের অমর আত্মার, আমাদের অনন্ত জীবনের প্রতিষ্ঠা স্থাপন করিব না; আমরা এই অসৎ, এই অন্ধকার, এই মর্তবিষয়পুঞ্জের মধ্যস্থলে "শান্তোদান্ত উপরতস্তিতিক্ষুঃ সমাহিতোভূত্বা' সাধনা করিতে থাকিব যতদিন না বলিতে পারি--
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
মাঘ ১৩০৫