অনেকদিন হইতেই কবিতা লিখিতেছি, এইজন্য যতই বিনয় করি না কেন এটুকু না বলিয়া পারি না যে, ছন্দের তত্ত্ব কিছু কিছু বুঝি। সেই ছন্দের বোধ লইয়া যখন গান লিখিতে বসিলাম, তখন চাঁদ সদাগরের উপর মনসার যে-রকম আক্রোশ, আমার রচনার উপর তালের ওস্তাদি দেবতা তেমনি ফোঁস করিয়া উঠিলেন। আমার জানা ছিল, ছন্দের মধ্যে যে-নিয়ম আছে তাহা বিধাতার গড়া নিয়ম, তা কামারের গড়া নিগড় নয়। সুতরাং, তাঁর সংযমে সংকীর্ণ করে না, তাহাতে বৈচিত্র্যকে উদঘাটিত করিতে থাকে। সেই কথা মনে রাখিয়া বাংলা কাব্যে ছন্দকে বিচিত্র করিতে সংকোচ বোধ করি নাই।

কাব্যে ছন্দের যে কাজ, গানে তালের সেই কাজ। অতএব, ছন্দ যে নিয়মে কবিতায় চলে তালে সেই নিয়মে গানে চলিবে এই ভরসা করিয়া গান বাঁধিতে চাহিলাম। তাহাতে কী উৎপাত ঘটিল একটা দৃষ্টান্ত নিই। মনে করা যাক, আমার গানের কথাটি এই--

কাঁপিছে দেহলতা থরথর,

চোখের জলে আঁখি ভরভর।

দোদুল তমালেরি বনছায়া

তোমার নীলবাসে নিল কায়া,

বাদল-নিশীথেরি ঝরঝর

তোমার আঁখি-'পরে ভরভর।

যে কথা ছিল তব মনে মনে

চমকে অধরের কোণে কোণে।

নীরব হিয়া তব দিল ভরি

কী মায়া-স্বপনে যে, মরি মরি,

নিবিড় কাননের মরমর

বাদল-নিশীথের ঝরঝর।

এ ছন্দে আমার পাঠকেরা কিছু আপত্তি করিলেন না। তাই সাহস করিয়া ঐটেই ঐ ছন্দেই সুরে গাহিলাম। তখন দেখি, যাঁরা কাব্যের বৈঠকে দিব্য খুশি ছিলেন তাঁরাই গানের বৈঠকে রক্তচক্ষু। তাঁরা বলেন, এ ছন্দের এক অংশে সাত আর-এক অংশে চার, ইহাতে কিছুতেই তাল মেলে না। আমার জবাব এই, তাল যদি না মেলে সেটা তালেরই দোষ, ছন্দটাতে দোষ হয় নাই। কেন তাহা বলি। এই ছন্দ তিন এবং চার মাত্রার যোগে তৈরি। এইজন্যই "তোমার নীলবাসে' এই সাত মাত্রার পর "নীল কায়া' এই চারমাত্রা খাপ খাইল। তিন মাত্রা হইলেও ক্ষতি হইত না। যেমন, "তোমার নীলবাসে মিলিল'। কিন্তু, ইহার মধ্যে ছয় মাত্রা কিছুতেই সইবে না। যেমন, "তোমারি নীলবাসে ধরিল শরীর'। অথচ, প্রথম অংশে যদি ছয়ের ভাগ থাকিত তবে দিব্য চলিত। যেমন, "তোমার সুনীল বাসে ধরিল শরীর'। এ আমি বলিতেছি কানের স্বাভাবিক রুচির কথা। এই কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিবার পথ। অতএব, এই কানের কাছে যদি ছাড় মেলে তবে ওস্তাদকে কেন ডরাইব।

আমার দৃষ্টান্তগত ছন্দটিতে প্রত্যেক লাইনেই সবসুদ্ধ ১১ মাত্রা আছে। কিন্তু এমন ছন্দ হইতে পারে যার প্রত্যেক লাইনে সমান মাত্রাবিভাগ নাই। যেমন--

বাজিবে, সখী, বাঁশি বাজিবে,

হৃদয়রাজ হৃদে রাজিবে।

বচন রাশি রাশি কোথা যে যাবে ভাসি,

অধরে লাজহাসি সাজিবে।

নয়নে আঁখিজল করিবে ছলছল

সুখবেদনা মনে বাজিবে।

মরমে মুরছিয়া মিলাতে চাবে হিয়া

সেই চরণযুগ-রাজীবে।

ইহার প্রথম দুই লাইনে মাত্রা ভাগ ৩ + ৪ + ৩ = ১০। তৃতীয় লাইনে ৩ + ৪ + ৩ + ৪ = ১৪। আমার মতে এই বৈচিত্র্যে ছন্দের মিষ্টতা বাড়ে। অতএব, উৎসাহ করিয়া গান ধরিলাম। কিন্তু, এক ফের ফিরিতেই তালওয়ালা পথ আটক করিয়া বসিল। সে বলিল, "আমার সমের মাশুল চুকাইয়া দাও।" আমি তো বলি, এটা বে আইনি আবোয়াব। কান মহারাজার উচ্চ আদালতে দরবার করিয়া খালাস পাই। কিন্তু, সেই দরবারের বাহিরে খাড়া আছে মাঝারি শাসনতন্ত্রের দারোগা। সে খপ্‌ করিয়া হাত চাপিয়া ধরে, নিজের বিশেষ বিধি খাটায়, রাজার দোহাই মানে না।

কবিতায় যেটা ছন্দ, সংগীতে সেইটেই লয়। এই লয় জিনিসটি সৃষ্টি ব্যাপিয়া আছে; আকাশের তারা হইতে পতঙ্গের পাখা পর্যন্ত সমস্তই ইহাকে মানে বলিয়াই বিশ্বসংসার এমন করিয়া চলিতেছে অথচ ভাঙিয়া পড়িতেছে না। অতএব, কাব্যেই কি গানেই কি, এই লয়কে যদি মানি তবে তালের সঙ্গে বিবাদ ঘটিলেও ভয় করিবার প্রয়োজন নাই।

একটি দৃষ্টান্ত দিই--

ব্যাকুল বকুলের ফুলে

ভ্রমর মরে পথ ভুলে।

আকাশে কী গোপন বাণী

বাতাসে করে কানানানি,

বনের অঞ্চলখানি

পুলকে উঠে দুলে দুলে।

বেদনা সুমধুর হয়ে

ভুবনে গেল আজি বয়ে।

বাঁশিতে মায়া তান পুরি

কে আজি মন করে চুরি,

নিখিল তাই মরে ঘুরি

বিরহসাগরের কূলে।

এটা যে কী তাল তা আমি আনাড়ি জানি না। এবং কোনো ওস্তাদও জানেন না। গণিয়া দেখিলে দেখি প্রত্যেক লাইনে নয় মাত্রা। যদি এমন বলা যায় যে, নাহয় নয় মাত্রায় একটা নূতন তালের সৃষ্টি করা যাক, তবে আর-একটা নয় মাত্রার গান পরীক্ষা করিয়া দেখা যাক।

যে কাঁদনে হিয়া কাঁদিছে

সে কাঁদনে সেও কাঁদিল।

যে বাঁধনে মোরে বাঁধিছে

সে বাঁধনে তারে বাঁধিল।

পথে পথে তার খুঁজিনু

মনে মনে তারে পূজিনু,

সে পূজার মাঝে লুকায়ে

আমারেও সে যে সাধিল।

এসেছিল মন হরিতে

মহাপারাবার পারায়ে।

ফিরিল না আর তরীতে,

আপনারে গেল হারায়ে।

তারি আপনার মাধুরী

আপনারে করে চাতুরী,

ধরিবে কি ধরা দিবে সে

কী ভাবিয়া ফাঁদ ফাঁদিল।

এও নয় মাত্রা কিন্তু এর ছন্দ আলাদা। প্রথমটার লয় ছিল তিনে-ছয়ে, দ্বিতীয়টার লয় ছয়ে-তিনে। আরও একটা দেখা যাক।

দুয়ার মম পথপাশে,

সদাই তারে খুলে রাখি।

কখন তার রথ আসে

ব্যাকুল হয়ে জাগে আঁখি।

শ্রাবণ শুনি দূর মেঘে

লাগায় গুরু গরগর,

ফাগুন শুনি বায়ুবেগে

জাগায় মৃদু মরমর,

আমার বুকে উঠে জেগে

চমক তারি থাকি থাকি।

কখন তার রথ আসে

ব্যাকুল হয়ে জাগে আঁখি।

সবাই দেখি যায় চলে

পিছন-পানে নাহি চেয়ে

উতল রোলে কল্লোলে

পথের গান গেয়ে গেয়ে।

শরৎ-মেঘ ভেসে ভেসে

উধাও হয়ে যায় দূরে,

যেথায় সব পথ মেশে

গোপন কোন্‌ সুরপুরে--

স্বপনে ওড়ে কোন্‌ দেশে

উদাস মোর প্রাণ-পাখি।

কখন তার রথ আসে

ব্যাকুল হয়ে জাগে আঁখি।

চৌতাল তো বারো মাত্রার ছন্দ। কিন্তু, এই বারো মাত্রা রক্ষা করিলেও চৌতালকে রক্ষা করা যায় না এমন হয়। এই তো বারো মাত্রা--

বনের পথে পথে বাজিছে বায়ে

নূপুর-রুনুঝুনু কাহার পায়ে।

কাটিয়া যায় বেলা মনের ভুলে,

বাতাস উদাসিছে আকুল চুলে,

ভ্রমরমুখরিত বকুলছায়ে

নূপুর-রুনুঝুনু কাহার পায়ে।

ইহা চৌতালও নহে, একতালাও নহে, ধামারও নয়, ঝাঁপতালও নয়। লয়ের হিসাব দিলেও তালের হিসাব মেলে না। তালওয়ালা সেই গরমিল লইয়া কবিকে দায়িক করে।

কিন্তু, হাল আমলে এ সমস্ত উৎপাত চলিবে না। আমরা শাসন মানিব, তাই বলিয়া অত্যাচার মানিব না। কেননা, যে-নিয়ম সত্য সে-নিয়ম বাহিরের জিনিস নয়, তাহা বিশ্বের বলিয়াই তাহা আমার আপনার। যে-নিয়ম ওস্তাদের তাহা আমার ভিতরে নাই, বাহিরে আছে; সুতরাং তাকে অভ্যাস করিয়া বা ভয় করিয়া বা দায়ে পড়িয়া মানিতে হয়। এইরূপ মানার দ্বারাই শক্তির বিকাশ বন্ধ হইয়া যায়। আমাদের সংগীতকে এই মানা হইতে মুক্তি দিলে তবেই তার স্বভাব তার স্বরূপকে নব নব উদ্ভাবনার ভিতর দিয়া ব্যক্ত করিতে থাকিবে।

ভাদ্র, ১৩২৪