দুই মাত্রা বা দুই মাত্রার গুণক নিয়ে যে-সব ছন্দ তারা পদাতিক; বোঝা সামলিয়ে ধীরপদক্ষেপে তাদের চাল। এই জাতের ছন্দকে পয়ারশ্রেণীয় বলব। সাধারণ পয়ারে প্রত্যেক পঙ্‌ক্তিতে দুটি করে ভাগ, ধ্বনির মাত্রা ও যতির মাত্রা মিলিয়ে প্রত্যেক ভাগে আটটি করে মাত্রা, সুতরাং সমগ্র পয়ারের ধ্বনিমাত্রাসংখ্যা চোদ্দ এবং তার সঙ্গে মিলেছে যতিমাত্রাসংখ্যা দুই, অতএব সর্বসমেত ষোলো মাত্রা।

বচন নাহি তো মুখে । তবু মুখখানি ০ ০

হৃদয়ের কানে বলে । নয়নের বাণী ০ ০।

আট মাত্রার উপর ঝোঁক না রেখে প্রত্যেক দুই মাত্রার উপর ঝোঁক যদি রাখি তবে সেই দুল্‌কি চালে পয়ারের পদমর্যাদার লাঘব হয়।

কেন । তার । মুখ । ভার । বুক । ধুক । ধুক । ০ ০,

চোখ । লাল । লাজে । গাল । রাঙা । টুক । টুক । ০ ০।

অথবা প্রত্যেক চার মাত্রায় ঝোঁক দিয়ে পয়ার পড়া যেতে পারে। যেমন--

সুনিবিড় । শ্যামলতা । উঠিয়াছে । জেগে ০ ০

ধরণীর । বনতলে । গগনের । মেঘে ০ ০।

ছন্দের দুটি জিনিস দেখবার আছে-- এক হচ্ছে তার সমগ্র অবয়ব, আর তার সংঘটন। পয়ারের অবয়বের মাত্রাসমষ্টি ষোলো সংখ্যায়। এই ষোলো মাত্রা সংঘটিত হয়েছে দুইমাত্রার অংশযোজনায়। ধ্বনিরূপসৃষ্টিতে দুই সংখ্যার একটি বিশেষ প্রভাব আছে, তিন সংখ্যা থেকে তা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। দৃষ্টান্ত দেখাই--

শ্রাবণধারে সঘনে

কাঁদিয়া মরে যামিনী,

ছোটে তিমিরগগনে

পথহারানো দামিনী।

এই ছন্দটির সমগ্র অবয়ব ষোলোমাত্রায়। সেই ষোলো মাত্রাটি সংঘটিত হচ্ছে তিন-দুই-তিন মাত্রার যোগে, এইজন্যেই পয়ারের মতো এর চাল-চলন নয়। যে আট মাত্রা দুইয়ের অংশ নিয়ে সে চলে সোজা সোজা পা ফেলে, কিন্তু যে আট মাত্রা তিন দুই-তিনের ভাগে সে চলছে হেলতে দুলতে মরালগমনে।

চেয়ে থাকে মুখপানে,

সে চাওয়া নীরব গানে

মনে এসে বাজে,

যেন ধীর ধ্রুবতারা

কহে কথা ভাষাহারা

জনহীন সাঁঝে।

যতিমাত্রাসমেত চব্বিশ মাত্রায় এই ত্রিপদীর অবয়ব। এই চব্বিশ মাত্রা দুই মাত্রাখণ্ডের সমষ্টি, এইজন্যেই একে পয়ারশ্রেণীতে গণ্য করব।

রিমি ঝিমি বরিষে শ্রাবণধারা,

ঝিল্লি ঝনকিছে ঝিনি ঝিনি;

দুরু দুরু হৃদয়ে বিরামহারা

তাকায়ে পথপানে বিরহিণী।

এ ছন্দেরও অবয়ব চব্বিশ মাত্রায়। কিন্তু, এর গড়ন স্বতন্ত্র; এর অংশগুলি দুই-তিনের মিশ্রিত মাত্রা।

পয়ার ছন্দের বিশেষ গুণ এই যে, তার বুনোনি ঠাসবুনোনি নয়, তাকে বাড়ানো-কমানো যায়। সুর করে টেনে টেনে পড়বার সময় কেউ যদি যতির যোগে পয়ারের প্রথম ভাগে দশ ও শেষ ভাগে আট মাত্রা পড়ে তবু পয়ারের প্রকৃতি বজায় থাকে। যেমন--

মহাভারতের কথা ০ ০ । অমৃতসমান ০ ০।

কাশীরাম দাস ভণে ০ ০ । শুনে পুণ্যবান্‌ ০ ০।

অথবা--

মহা ০ ০ ভারতের কথা ০ ০ । অমৃত ০ ০ সমা ০ ০ ন।

কাশীর ০ ০ ম দাস ভণে ০ ০ । শুনে ০ ০ পুণ্যবা ০ ০ ন্‌।

পয়ার ছন্দ স্থিতিস্থাপক ব'লেই এটা সম্ভব, আর সেই গুণেই বাংলা কাব্যসাহিত্যকে সে এমন করে অধিকার করেছে।

যেমন দুইমাত্রামূলক পয়ার তেমনি তিনমাত্রামূলক ছন্দও বাংলাদেশে অনেককাল থেকে প্রচলিত। পয়ারের ব্যবহার প্রধানত আখ্যানে, রামায়ণ-মহাভারত-মঙ্গলকাব্য প্রভৃতিতে। তিনমাত্রামূলক ছন্দ গীতিকাব্যে, যেমন বৈষ্ণব পদাবলীতে।

পূর্বেই বলেছি পয়ারের চাল পদাতিকের চাল, পা ফেলে ফেলে চলে।

অভিসারযাত্রাপথে হৃদয়ের ভার

পদে পদে দেয় বক্ষে ব্যথার ঝংকার।

এই পা ফেলে চলার মাঝে মাঝে যতি পাওয়া যায় যথেষ্ট, ইচ্ছা করলে তাকে বাড়ানো-কমানো চলে। কিন্তু, তিনমাত্রার তালটা যেন গোল গড়নের, গড়িয়ে চলে। পরস্পরকে ঠেলে নিয়ে দৌড় দেয়।

চলিতে চলিতে চরণে উছলে

চলিবার ব্যাকুলতা,

নূপুরে নূপুরে বাজে বনতলে

মনের অধীর কথা।

এইজন্যে মাত্রা যদি কোথাও তিনের মাপের একটু বেশি হয় এ ছন্দ তাকে প্রসন্নমনে জায়গা দিতে পারে না। দায়ে পড়ে এই অত্যাচার কখনো করি নি এমন কথা বলতে পারব না।

প্রভু বুদ্ধ লাগি আমি ভিক্ষা মাগি,

ওগো পূরবাসী, কে রয়েছ জাগি,

অনাথপিণ্ডদ কহিলা অম্বুদ-

নিনাদে।

এ কথা বোঝা শক্ত নয় যে, "অনাথপিণ্ডদ' নামটার খাতিরে নিয়ম রদ করেছিলেম। গার্ড্‌ এসে গাড়ির কামরায় বরাদ্দর বেশি মানুষকে ঠেসে ঢুকিয়ে দিয়েছে, ঘুষ খেয়ে থাকবে কিম্বা আগন্তুক ভারি দরের।

সেকালে অক্ষরগন্‌তি-করা তিনমাত্রামূলক ছন্দে যুক্তধ্বনি বর্জন করে চলতুম। কিন্তু, তাতে রচনায় অতিলালিত্যের দুর্বলতা এসে পৌঁছত। সেটা যখন আমার কাছে বিরক্তিকর হল তখন যুক্তধ্বনির শরণ নিলুম। ছন্দটা একদিন ছিল যেন নবনী দিয়ে গড়া--

বরষার রাতে জলের আঘাতে

পড়িতেছে যূথী ঝরিয়া,

পরিমলে তারি সজল পবন

করুণায় উঠে ভরিয়া।

এই দুর্বলতার মধ্যে যুক্তবর্ণ এসে দেখা দিল--

নববর্ষার বারিসংঘাতে

পড়ে মল্লিকা ঝরিয়া,

সিক্তপবন সুগন্ধে তারি

কারুণ্যে উঠে ভরিয়া।

তিন-তিন মাত্রায় যার গ্রন্থিযোজনা এমন একটি ছন্দের দৃষ্টান্ত দেখাই--

আঁখির পাতায় নিবিড় কাজল

গলিছে নয়নসলিলে।

অক্ষরসংখ্যা সমান রেখে এই দুটো পদে যুক্তবর্ণ যদি চড়াই তাহলে সেটা কেমন হয়-- যেমন এক-এক সময়ে দেখা যায়, জোয়ান পুরুষ ক্ষীণ স্ত্রীর ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে পথে চলে নির্মমভাবে। প্রমাণ দিই--

চক্ষুর পল্লবে নিবিড় কজ্জ্বল

গলিছে অশ্রুর নির্ঝরে।

কিন্তু, এই বোঝা পয়ারজাতীয় পালোয়ানের স্কন্ধে চাপালে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকবে না। প্রথমে বিনা-বোঝার চালটা দেখানো যাক--

শ্রাবণের কালো ছায়া নেমে আসে তমালের বনে

যেন দিক্‌-ললনার গলিত কাজল-বরিষনে।

এইটিকে গুরুভার করে দিই--

বর্ষার তমিস্রচ্ছায়া ব্যাপ্ত হল অরণ্যের তলে

যেন অশ্রুসিক্তচক্ষু দিগ্‌বধূর গলিত কজ্জলে।

এতটা ভারবৃদ্ধি যে সম্ভব হয় তার কারণ পয়ার স্থিতিস্থাপক।

ধ্বনির দুইমাত্রা এবং তিনমাত্রা বাংলা ছন্দের আদিম এবং রূঢ়িক উপাদান। তারপরে এই দুই এবং তিনের যোগে যৌগিকমাত্রার ছন্দের উৎপত্তি। তিন + দুই, তিন + চার, তিন + দুই + চার প্রভৃতি নানাপ্রকার যোগ চলেছে আধুনিক বাংলা ছন্দে। তিন +দুই-মাত্রামূলক ছন্দের দৃষ্টান্ত--

আঁধার রাতি জ্বেলেছে বাতি

অযুতকোটি তারা,

আপন কারা-ভবনে পাছে

আপনি হয় হারা।

দেখা যাচ্ছে, এখানে পদশেষের অংশটিকে খর্ব করা হয়েছে। যদি লেখা যেত--

আঁধার রাতি জ্বেলেছে বাতি

আকাশ ভরি অযুত তারা

তাহলে ছন্দের কাছে দেনা বাকি থাকত না। কিন্তু, পূর্বোক্ত প্রথম শ্লোকটির পদশেষে পাঁচমাত্রার থেকে তিনমাত্রাকে জবাব দেওয়া হয়েছে। তাহলে বুঝতে হবে, সেই তিনমাত্রা দেহত্যাগ করে ঐখানেই বসে আছে যতিকে ভর করে।

কিন্তু, এই কৈফিয়তটা সম্পূর্ণ হল বলে মনে হয় না, আরও কথা আছে। প্রকৃতির কাজের অলংকরণতত্ত্বটা আলোচ্য। দুই পা দুই হাত নিয়ে দেহটা দাঁড়ালো, দুই কাঁধে দুটো মুণ্ড বসালেই সম্মিতি অর্থাৎ ড়ঁললনঢ়ক্ষঁ ঘটত। তা না করে দুই কাঁধের মাঝখানে একটি মুণ্ড বসিয়ে সমাপ্তিটা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। কৃষ্ণচূড়ার গাছে ডাঁটার দু ধারে দুটি করে পত্রগুচ্ছ চলতে চলতে প্রান্তে এসে থামল একটিমাত্র গুচ্ছে। অলংকরণের ধারা যেখানে পূর্ণ হয়েছে সেখানে একটিমাত্র তর্জনী, ছোটো একটি ইশারা।

সকল ভাষারই যতি আছে, কিন্তু যতিকে বাটখারাস্বরূপ করে ছন্দের ওজন পূরণ বাংলা ছন্দ ছাড়া আর কোনো ছন্দে আছে কি না জানি নে। সংস্কৃত ছন্দে এই রীতি বিরল, তবু একেবারে পাওয়া যায় না তা নয়।

বদসি যদি কিঞ্চিদপি দন্তরুচিকৌমুদী

হরতি দরতিমিরমতি ঘোরম্‌ ০ ০।

যতিকে কেবল বিরতির স্থান না দিয়ে তাকে পূর্তির কাজে লাগাবার অভ্যাস আরম্ভ হয়েছে আমাদের ছড়ার ছন্দ থেকে। ছড়া আবৃত্তি করবার সময় আপনি যতির জোগান দেয় আমাদের কান।

কাক কালো বটে, পিক সেও কালো,

কালো সে ফিঙের বেশ,

তাহার অধিক কালো যে, কন্যা,

তোমার চিকন কেশ।

এমন করে ছন্দটাকে পুরোপুরি ভরিয়ে দিলে কানের কাছে ঋণী হতে হত না। কিন্তু, এতে ছড়ার জাত যেত। ছড়ার রীতি এই যে, সে কিছু ধ্বনি জোগায় নিজে, কিছু আদায় করে কণ্ঠের কাছ থেকে; এ দুয়ের মিলনে সে হয় পূর্ণ। প্রকৃতি আমের মধুরতায় জল মিশিয়েছেন, তাকে আমসত্ত্ব করে তোলেন নি; সেজন্যে রসজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই কৃতজ্ঞ। তেমনি যথেষ্ট যতি মিশোল করা হয়েছে ছড়ার ছন্দে, শিশুকাল থেকে বাঙালি তাতে আনন্দ পায়। সে সহজেই আউড়েছে--

কাক কালো, কোকিল কালো,

কালো ফিঙের বেশ,

তাহার অধিক কালো, কন্যে,

তোমার চিকন কেশ।

কিম্বা--

টুমুস টুমুস বাদ্যি বাজে,

লোকে বলে কী,

শামুকরাজা বিয়ে করে

ঝিনুকরাজার ঝি

১৩৪১