আমাদের অলংকারশাস্ত্রে নয় রসের উল্লেখ আছে, কিন্তু ছেলেভুলানো ছড়ার মধ্যে যে রসটি পাওয়া যায়, তাহা শাস্ত্রোক্ত কোনো রসের অন্তর্গত নহে। সদ্যঃকর্ষণে মাটি হইতে যে সৌরভটি বাহির হয়, অথবা শিশুর নবনীতকোমল দেহের যে স্নেহোদ্‌বেলকর গন্ধ, তাহাকে পুষ্প চন্দন গোলাপ-জল আতর বা ধূপের সুগন্ধের সহিত এক শ্রেণীতে ভুক্ত করা যায় না। সমস্ত সুগন্ধের অপেক্ষা তাহার মধ্যে যেমন একটি অপূর্ব আদিমতা আছে, ছেলেভুলানো ছড়ার মধ্যে তেমনি একটি আদিম সৌকুমার্য আছে--সেই মাধুর্যটিকে বাল্যরস নাম দেওয়া যাইতে পারে। তাহা তীব্র নহে, গাঢ় নহে, তাহা অত্যন্ত স্নিগ্ধ সরস এবং যুক্তিসংগতিহীন।

শুধুমাত্র এই রসের দ্বারা আকৃষ্ট হইয়াই আমি বাংলাদেশের ছড়া-সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। রুচিভেদবশত সে রস সকলের প্রীতিকর না হইতে পারে, কিন্তু এই ছড়াগুলি স্থায়ীভাবে সংগ্রহ করিয়া রাখা কর্তব্য সে বিষয়ে বোধ করি কাহারো মতান্তর হইতে পারে না। কারণ, ইহা আমাদের জাতীয় সম্পত্তি। বহুকাল হইতে আমাদের দেশে মাতৃভাণ্ডারে এই ছড়াগুলি রক্ষিত হইয়া আসিয়াছে; এই ছড়ার মধ্যে আমাদের মাতৃমাতামহীগণের স্নেহ-সংগীতস্বর জড়িত হইয়া আছে, এই ছড়ার ছন্দে আমাদের পিতৃপিতামহগণের শৈশবনৃত্যের নূপুরনিক্কণ ঝংকৃত হইতেছে। অথচ, আজকাল এই ছড়াগুলি লোকে ক্রমশই বিস্মৃত হইয়া যাইতেছে। সামাজিক পরিবর্তনের স্রোতে ছোটোবড়ো অনেক জিনিস অলক্ষিতভাবে ভাসিয়া যাইতেছে। অতএব জাতীয় পুরাতন সম্পত্তি সযত্নে সংগ্রহ করিয়া রাখিবার উপযুক্ত সময় উপস্থিত হইয়াছে।

ছড়াগুলি ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ হইতে সংগ্রহ করা হইয়াছে; এইজন্য ইহার অনেকগুলির মধ্যে বাংলার অনেক উপভাষা (dialect) লক্ষিত হইবে। একই ছড়ার আনেকগুলি পাঠও পাওয়া যায়; তাহার মধ্যে কোনোটিই বর্জনীয় নহে। কারণ, ছড়ায় বিশুদ্ধ পাঠ বা আদিম পাঠ বলিয়া কিছু নির্ণয় করিবার উপায় অথবা প্রয়োজন নাই। কালে কালে মুখে মুখে এই ছড়াগুলি এতই জড়িত মিশ্রিত এবং পরিবর্তিত হইয়া আসিতেছে যে, ভিন্ন ভিন্ন পাঠের মধ্য হইতে কোনো-একটি বিশেষ পাঠ নির্বাচিত করিয়া লওয়া সংগত হয় না। কারণ, এই কামচারিতা, কামরূপধারিতা, ছড়াগুলির প্রকতিগত। ইহারা অতীত কীর্তির ন্যায় মৃতভাবে রক্ষিত নহে। ইহারা সজীব, ইহরা সচল; ইহারা দেশকালপাত্রবিশেষে প্রতিক্ষণে আপনাকে অবস্থার উপযোগী করিয়া তুলিতেছে। ছড়ার সেই নিয়তপরিবর্তনশীল প্রকৃতিটি দেখাইতে গেলে তাহার ভিন্ন ভিন্ন পাঠ রক্ষা করা আবশ্যক। নিম্নে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।--

প্রথম পাঠ

আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।

ঢাক মৃদং ঝাঁঝর বাজে॥

বাজতে বাজতে চলল ডুলি।

ডুলি গেল সেই কমলাপুলি॥

কমলাপুলির টিয়েটা।

সূয্যিমামার বিয়েটা॥

আয় রঙ্গ হাটে যাই।

গুয়া পান কিনে খাই॥

একটা পান ফোঁপরা।

মায়ে ঝিয়ে ঝগড়া॥

কচি কচি কুমড়োর ঝোল।

ওরে খুকু গা তোল্‌॥

আমি তো বটে নন্দঘোষ--

মাথায় কাপড় দে॥

হলুদ বনে কলুদ ফুল।

তারার নামে টগর ফুল॥

দ্বিতীয় পাঠ

আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।

ঢাঁই মিরগেল ঘাঘর বাজে॥

বাজতে বাজতে প'ল ঠুলি।

ঠুলি গেল কমলাফুলি॥

আয় রে কমলা হাটে যাই।

পান-গুয়োটা কিনে খাই॥

কচি কুমড়োর ঝোল।

ওরে জামাই গা তোল্‌॥

জ্যোৎস্নাতে ফটিক ফোটে--

কদমতলায় কে রে।

আমি তো বটে নন্দঘোষ--

মাথায় কাপড় দে রে॥

তৃতীয় পাঠ

আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।

লাল মিরগেল ঘাঘর বাজে॥

বাজতে বাজতে এল ডুলি।

ডুলি গেল সেই কমলাপুলি॥

কমলাপুলির বিয়েটা।

সূয্যিমামার টিয়েটা॥

হাড় মুড়্‌ মুড়্‌ কেলে জিরে।

কুসুম কুসুম পানের বিঁড়ে॥

রাই রাই রাই রাবণ।

হলুদ ফুলে কলুদ ফুল।

তারার নামে টগ্‌গর ফুল॥

এক গাচি করে মেয়ে খাঁড়া।

এক গাচি করে পুরুষ খাঁড়া॥

জামাই বেটা ভাত খাবি তো

এখানে এস বোস্‌।

খা গণ্ডা গণ্ডা কাঁটালের কোষ॥

উপরি-উদ্‌ধৃত ছড়াগুলির মধ্যে মূল পাঠ কোনটি, তাহা নির্ণয় করা অসম্ভব এবং মূল পাঠটি রক্ষা করিয়া অন্য পাঠগুলি ত্যাগ করাও উচিত হয় না। ইহাদের পরিবর্তনগুলিও কৌতুকাবহ এবং বিশেষ আলোচনার যোগ্য। "আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে'--এই ছত্রটির কোনো পরিষ্কার অর্থ আছে কি না জানি না; অথবা যদি ইহা অন্য কোনো ছত্রের অপভ্রংশ হয় তবে সে ছত্রটি কী ছিল তাহাও অনুমান করা সহজ নহে। কিন্তু ইহা স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, প্রথম কয়েক ছত্র বিবাহযাত্রার বর্ণনা। দ্বিতীয় ছত্রে যে বাজনা কয়েকটির উল্লেখ আছে, তাহা ভিন্ন ভিন্ন পাঠে কতই বিকৃত হইয়াছে। আবার ভিন্ন স্থান হইতে আমরা এই ছড়ার আর-একটি পাঠ প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহাতে আছে--

আগ্‌ডম বাগ্‌ডম ঘোড়াডম সাজে।

ডান মেকড়া ঘাঘর বাজে॥

বাজতে বাজতে পড়ল টুরি।

টুরি গেল কমলাপুরি॥

ভাষার যে ক্রমশ কিরূপে রূপান্তর হইতে থাকে, এই-সকল ছড়া হইতে তাহার প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

মাঘ ১৩০১। কার্তিক ১৩০২
1 | 2