ইতালিয়ার এই স্বপ্নময় কবির জীবন গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় হইতে শেষ পর্যন্ত বিয়াত্রিচে (Beatrice)। বিয়াত্রিচেই তাঁহার সমুদয় কাব্যের নায়িকা, বিয়াত্রিচেই তাঁহার জীবন-কাব্যের নায়িকা! বিয়াত্রিচেকে বাদ দিয়া তাঁহার কাব্য পাঠ করা বৃথা, বিয়াত্রিচেকে বাদ দিলে তাঁহার জীবন-কাহিনী শূন্য হইয়া পড়ে। তাঁহার জীবনের দেবতা বিয়াত্রিচে, তাঁহার সমুদয় কাব্য বিয়াত্রিচের স্তোত্র। বিয়াত্রিচের প্রতি প্রেমই তাঁহার প্রথম কবিতার উৎস উৎসারিত করিয়া দেয়। তাঁহার প্রথম গীতিকাব্য "ভিটা নুওভা'র (Vita Nuova) প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত বিয়াত্রিচেরই আরাধনা, ইহার কিয়দ্দূর লিখিয়াই তাঁহার বিরক্তি বোধ হইল-- তাঁহার মনঃপূত হইল না; পাঠকের চক্ষে বিয়াত্রিচেকে দূর-স্বর্গের অলৌকিক দেবতার ন্যায় চিত্রিত করিয়াও তিনি পরিতৃপ্ত হইলেন না। এই কাব্যের শেষ ভাগে তিনি লিখিতেছেন--

"এই পর্যন্ত লিখিয়াই আমি এক অতিশয় আশ্চর্য স্বপ্ন দেখিলাম-- সেই স্বপ্নে যাহা দেখিলাম তাহাতে এই স্থির করিলাম যে, আমি সেই প্রিয় দেবীর বিষয় যাহা লিখিতেছি তাহা তাঁহার যোগ্য নহে-- যে পর্যন্ত ইহা অপেক্ষা যোগ্যতর কবিতা না লিখিতে পারিব সে পর্যন্ত আর লিখিব না। ইহা নিশ্চয়ই যে, তিনি (বিয়াত্রিচে) জানিতেছেন, আমি তাঁহার বিষয়ে যোগ্যতর কবিতা লিখিবার ক্ষমতা প্রাপ্তির জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছি। সমুদয় জীবের প্রাণদাতা ঈশ্বর-প্রসাদে আর কিছুদিন যদি বাঁচিয়া থাকি, তবে তাঁহার বিষয়ে এমন লিখিব, যাহা এ পর্যন্ত কোনো মহিলার সম্বন্ধে কেহ কখনো লেখে নাই।' এই স্থির করিয়াই তিনি তাঁহার মহাকাব্য "ডিভাইনা কামেডিয়া' (Divina Commedia) লিখেন ও বিয়াত্রিচে সম্বন্ধে এমন কথা বলেন, যাহা কোনো মহিলা সম্বন্ধে কেহ কখনো বলে নাই।

দান্তে তাঁহার নয় বৎসর বয়স হইতেই বিয়াত্রিচেকে ভালোবাসিতে আরম্ভ করেন; কিন্তু তাঁহার প্রেম সাধারণ ভালোবাসা নামে অভিহিত হইতে পারে না। বিয়াত্রিচের সহিত তাঁহার প্রেমের আদান-প্রদান হয় নাই, নেত্রে নেত্রে নীরব প্রেমের উত্তর-প্রত্যুত্তর হয় নাই। অতিদূর সাক্ষাৎ-- দূর আলাপ ভিন্ন বিয়াত্রিচের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ ও আলাপ হয় নাই। অতি দূরস্থ দেবীর ন্যায় তিনি দূর হইতে সসম্ভ্রমে বিয়াত্রিচেকে দেখিতেন, অতি দূর হইতে তাঁহার গ্রীবানমিত নমস্কারে আপনাকে দেবানুগৃহীত মনে করিতেন। যে সভায় বিয়াত্রিচে আছেন, সে সভায় গেলে তিনি কেমন অভিভূত হইয়া পড়িতেন, তিনি কথা কহিতে পারিতেন না, তাঁহার শরীর কাঁপিতে থাকিত! বিয়াত্রিচেকে তিনি তাঁহার প্রেমের কাহিনী বলেন নাই, বলিতে সাহস করেন নাই, বা বলিবার আবশ্যক বোধ করেন নাই। তিনি আপনার প্রেমের স্বপ্নেই আপনি মগ্ন থাকিতেন, তাঁহার প্রেম জাগ্রত রাখিবার জন্য বিয়াত্রিচের প্রতিদান আবশ্যক ছিল না। তাঁহার কাব্য পড়িলে বিয়াত্রিচেকে মানুষ হইতে উচ্চ-পদবী-গত মনে হয়, তাঁহার নিকট হইতে অনুগ্রহ ভিন্ন প্রেম-প্রত্যাশা করিবার ইচ্ছা মনে এক মুহূর্তও স্থান পায় না। যদিও "ভিটা নুওভা' কাব্যের নায়িকাই বিয়াত্রিচে, কিন্তু পাঠকেরা বিয়াত্রিচের মুখ হইতে একটি কথাও শুনিতে পান নাই, বিয়াত্রিচে সর্বদাই তাঁহাদের নিকট হইতে দূরে রহিয়াছেন। রূপক প্রভৃতির দ্বারা বিয়াত্রিচেকে দান্তে এমন একটি মেঘময় অস্ফুট আবরণে আবৃত করিয়া রাখিয়াছেন যে, পাঠকের চক্ষে সেই অস্ফুট মূর্তি অতি পবিত্র বলিয়া প্রতিভাত হয়। দান্তে তাঁহার প্রেমার্দ্র হৃদয়ে মনে করিতেন, "যে ব্যক্তিই বিয়াত্রিচের নিকট আসিত তাহারই হৃদয়ে এমন গভীর ভক্তির উদ্রেক হইত যে, তাহার মুখের দিকে নেত্র তুলিতে তাহার সাহস হইত না।' দান্তে বলেন, "যখন মনুষ্যেরা তাঁহার দিকে চাহিত তখনি তাহারা কেবল একটি মাধুর্য ও মহত্ত্ব অনুভব করিত।' দান্তে ভক্তির চক্ষে দেখিতেন, সমস্ত পৃথিবী বিয়াত্রিচের পূজা করিতেছে, দেবতারা তাঁহাকে আপনাদের মধ্যে আনিবার জন্য প্রার্থনা করিতেছেন। দান্তের "ডিভাইনা কামেডিয়া'র নরকের দ্বার-রক্ষকেরা বিয়াত্রিচের নাম শুনিয়াই অমনি সসম্ভ্রমে দ্বার খুলিয়া দিতেছে-- দেবতারা বিয়াত্রিচের নাম শুনিয়া অমনি স্বর্গযাত্রীদ্বয়কে সহর্ষে আহ্বান করিতেছেন। বিয়াত্রিচের মৃত্যুর পর দান্তে অশ্রুপূর্ণ নয়নে দেখিলেন, যেন সমস্ত নগরীই রোদন করিতেছে। বিয়াত্রিচের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ বর্ণনাই "ভিটা নুওভা'র আরম্ভ--

"যখন আমার জীবনের আরম্ভ হইতে নয় বার মাত্র সূর্য তাঁহার কক্ষ প্রদক্ষিণ করিয়াছে, এমন সময়ে আমার হৃদয়ের মহান মহিলা আমার চক্ষের সমক্ষে আবির্ভূত হইলেন।... তখন তাঁহার জীবনের আরম্ভ মাত্র এবং আমার বয়স নবম বৎসর অতিক্রম করিয়াছে। তাঁহার শরীরে সুন্দর লোহিত বর্ণের পরিচ্ছদ, একটি কটিবন্ধ ও বাল্যবয়সের উপযুক্ত কতকগুলি অলংকার। সত্য বলিতেছি তাঁহাকে দেখিয়া সেই মুহর্তেই আমার হৃদয়ের অতি নিভৃত নিলয়স্থিত মর্ম পর্যন্ত কাঁপিয়া উঠিল, এবং তাহার প্রভাব আমার শরীরের শিরায় শিরায় প্রকাশিত হইল। সে (মর্ম) কাঁপিতে কাঁপিতে এই কথাগুলি বলিল ওই দেখো, আমা অপেক্ষা সরলতর দেবতা আমার উপর আধিপত্য করিতে আসিয়াছেন;... সেই সময় হইতে প্রেম আমার হৃদয়-রাজ্যের অধিপতি হইল।... দেবতাদিগের মধ্যে কনিষ্ঠ দেবতাটিকে (বিয়াত্রিচেকে) দেখিবার জন্য প্রেমের দ্বারা উত্তেজিত হইয়া বাল্যকালে কতবার তাহার অন্বেষণে ফিরিয়াছি। সে এমন প্রশংসনীয়; তাহার ব্যবহার এমন মহৎ যে কবি হোমারের উক্তি তাহার প্রতি প্রয়োগ করা যাইতে পারে-- অর্থাৎ "তাহাকে দেখিয়া মনে হয় সে দেবতাদের মধ্যে জন্মলাভ করিয়াছে, মানুষের মধ্যে নহে।' বিয়াত্রিচের পিতা একটি ভোজ দেন, সেই ভোজে দান্তের পিতা তাঁহার পুত্রকে সঙ্গে লইয়া যান; সেই সভাতেই দান্তের সহিত বিয়াত্রিচের উক্ত প্রথম সাক্ষাৎ হয়। দ্বিতীয় সাক্ষাৎ এইরূপে বর্ণিত হয় : "উপরি-উক্ত মহান মহিলার সহিত সাক্ষাতের পর নয় বৎসর পূর্ণ হইয়াছে, এমন সময়ে নিষ্কলঙ্ক-শুভ্র-বসনা, সখীদ্বয়-পরিবেষ্টিতা সেই বিস্ময়জনক মহিলা আর-একবার আমার সম্মুখে আবির্ভূত হইলেন। তিনি রাজপথ দিয়া যাইবার সময় আমি যেখানে সসম্ভ্রমে স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইয়া ছিলাম, সেই দিকে নেত্র ফিরাইলেন, এবং তাঁহার সেই অনির্বচনীয় নম্রতার সহিত এমন শ্রীপূর্ণ নমস্কার করিলেন যে, আমি সেই মুহূর্তেই সৌন্দর্যের সর্বাঙ্গ যেন দেখিতে পাইলাম।... এইবার প্রথম তাঁহার কথা শুনিতে পাইলাম, শুনিয়া এমন আহ্লাদ হইল যে, সুরামত্তের ন্যায় আমার সঙ্গীদের সঙ্গ পরিত্যাগ করিয়া ছুটিয়া আসিলাম। আমার নির্জন গৃহে আসিয়া সেই অতিশয় ভদ্রমহিলার বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলাম। ভাবিতে ভাবিতে নিদ্রা আসিল ও এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখিলাম। সেই স্বপ্নের বিষয় সেই-সময়কার প্রধান প্রধান কবিদের জানাইব স্থির করিলাম। যাঁহারা যাঁহারা প্রেমের অধীন আছেন তাঁহাদের বন্দনা করিয়া ও তাঁহাদের এই স্বপ্নের প্রকৃত অর্থ-ব্যাখ্যা করিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিয়া এই স্বপ্নের বিষয়ে একটি কবিতা লিখিব স্থির করিলাম। সেই কবিতাটি (Sonnet) এই--

প্রেম-বন্দী হৃদি যাঁরা, সুকোমল মন,

যাঁরা পড়িবেন এই সংগীত আমার,

তাঁরা মোর অনুনয় করুন শ্রবণ,

বুঝায়ে দিউন্‌ মোরে অর্থ কী ইহার?

যে কালে উজ্জ্বল তারা উজলে আকাশ,

নিশার চতুর্থ ভাগ হয়ে গেছে শেষ,

প্রেম মোর নেত্রে আসি হলেন প্রকাশ,

স্মরিলে এখনো কাঁপে হৃদয় প্রদেশ!

দেখে মনে হল যেন প্রফুল্ল আনন;

মোর হৃদ্‌পিণ্ড রহে করতলে তাঁর;

বাহু-'পরে শান্ত ভাবে করিয়া শয়ন

ঘুমাইয়া রয়েছেন মহিলা আমার--

অবশেষে জাগি উঠি, প্রেমের আদেশে

সভয়ে জ্বলন্ত-হৃদি করিলা আহার!

তার পরে চলি গেলা প্রেম অন্য দেশে

কাঁদিতে কাঁদিতে অতি বিষণ্ণ-আকার!

এই স্বপ্নের পর হইতে সেই অতি শ্রীমতী মহিলার চিন্তাতেই ব্যাপৃত ছিলাম। ক্রমে ক্রমে আমার স্বাস্থ্য এমন নষ্ট হইয়া আসিল যে, আমার আকার দেখিয়া বন্ধুরা অতিশয় চিন্তিত হইলেন; আবার যে গূঢ় কথা সকল-কথা অপেক্ষা আমি লুকাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিয়াছি, কেহ কেহ অসদভিপ্রায়ে তাহাই জানিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। আমি তাঁহাদের উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিয়া যুক্তি ও প্রেমের পরামর্শে উত্তর দিলাম যে, প্রেমের দ্বারাই আমার এই অবস্থা হইয়াছে। আমার আকারে প্রেমের চিহ্ন এমন স্পষ্ট প্রকাশ পাইতেছিল যে, সে গোপন করা বৃথা। কিন্তু যখন তাহারা জিজ্ঞাসা করিল-- "কাহার প্রেমে বিচলিত হইয়াছ?' আমি তাহাদের দিকে চাহিলাম, হাসিলাম, আর উত্তর দিলাম না।

পূর্বেই বলা হইয়াছে, বিয়াত্রিচে দান্তেকে অভিবাদন করিলে দান্তে কী আনন্দ অনুভব করিতেন! কিন্তু একবার দান্তের নামে এক অতি মিথ্যা নিন্দা উঠে, সেই নিন্দা "সেই অতি কোমলা, পাপের বিনাশয়িতা, পুণ্যের রাজ্ঞী-স্বরূপার' কানে গেল। দান্তে কহিতেছেন, "এবার যখন তিনি আমার সম্মুখ দিয়া গেলেন তখন আমার সুখের একমাত্র কারণ সেই সুন্দর নমস্কার হইতে বঞ্চিত করিলেন। যেখানে যখন তাঁহাকে দেখিয়াছি তাঁহার সেই অমূল্য নমস্কারের আশায় আমি পৃথিবীর শত্রুতা ভুলিয়াছি, আমার হৃদয়ে এমন একটি উদারতা জন্মিত যে, পৃথিবীতে যে আমার যাহা-কিছু দোষ করিয়াছে সমুদায় মার্জনা করিতাম।' এ নমস্কার হইতে, তাঁহার সেই প্রেমের একমাত্র পুরস্কার হইতে যখন তিনি বঞ্চিত হইলেন, তখন তিনি অত্যন্ত যন্ত্রণা পাইলেন, জনকোলাহল ভেদ করিয়া যেখানে একটি নির্জন স্থান পাইলেন সেইখানেই তীব্রতর অশ্রুজলে রোদন করিতে লাগিলেন! এইরূপে প্রথম উচ্ছ্বাস-বেগ নিবৃত্ত হইলে তাঁহার নির্জন গৃহে গিয়া "কাতর শিশুর' ন্যায় কাঁদিতে কাঁদিতে ঘুমাইয়া পড়িলেন।

একবার কোনো বন্ধুর বিবাহ-সভায় তিনি আহূত হন। তাঁহার বন্ধুকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য নব বধূর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিবেন স্থির করিতেছেন, এমন সময়ে সহসা তাঁহার শরীর কাঁপিতে লাগিল, তিনি দেখিলেন তাঁহার অতি নিকটেই বিয়াত্রিচে। তিনি এমন একপ্রকার অভিভূত হইয়া পড়িলেন যে, মহিলারা তাঁহার আকার দেখিয়া বিয়াত্রিচের সহিত চুপে চুপে কথা কহিতে লাগিলেন ও তাঁহাকে উপহাস করিতে আরম্ভ করিলেন! তিনি তাঁহাদের নিকট হইতে বিদায় লইয়া, নিজ গৃহে আসিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে কহিলেন-- "যদি এই মহিলা (বিয়াত্রিচে) আমার অবস্থা জানিতেন, তবে আমার আকার দেখিয়া কখনো তিনি এরূপ উপহাস করিতেন না, বরং তাঁহার দয়া হইত!'

দান্তে তাঁহার সেই অভিলষিত নমস্কার আর এ পর্যন্ত পান নাই। একবার কতকগুলি মহিলা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "যাঁহাকে তুমি ভালোবাস, তাঁহার দর্শন মাত্রেই তুমি যদি অমন অভিভূত হইয়া পড়, তবে তোমার ভালোবাসিবার ফল কী?' তিনি উত্তর দিলেন, "তাঁহার একটি নমস্কার পাওয়াই এ পর্যন্ত আমার ভালোবাসিবার একমাত্র লক্ষ্য ও ফল ছিল, তাঁহার নমস্কারই আমার ইচ্ছার একমাত্র গম্যস্থান ছিল-- কিন্তু তিনি যখন তাহা না দিয়াই সন্তুষ্ট হইয়াছেন তখন তাহাই হউক-- প্রেম আমাকে এমন আর-একটি সুখে নিবিষ্ট করিয়াছেন, যাহা কোনো কালেই শেষ হইবে না।' তাঁহারা জিজ্ঞাসা করিলেন, "সে কোন্‌ সুখে?' দান্তে কহিলেন, "আমার মহিলার প্রশংসা গান।' তাঁহার মহিলার প্রশংসার গান নিম্নে অনুবাদিত হইল--

রমণি! তোমরা বুঝ প্রেমের ব্যাপার--

মহিলার কথা মোর করহ শ্রবণ--

ব'লে ফুরায় না কভু প্রশংসা তাঁহার--

মন খুলে ব'লে তবু জুড়াইবে মন!

পৃথিবীতে যত কিছু আছে গো মহান--

তাহা হতে মহত্তর চরিত তাঁহার

হেন দীপিয়াছে প্রেমে এ মোর পরান,

চির বল অর্পিয়াছে বচনে আমার!

সাধ যায় করি তাঁর হেন যশোগান

সমস্ত পুরুষে তাঁর পদতলে আনি--

কিন্তু থাক্‌-- গাব নাকো সে সমুচ্চ তান

গাহিতে ক্ষমতা যদি না থাকে কী জানি!

আমার এ ভালোবাসা অতি সুকোমল,

গাব তাই অতিশয় সুকোমল তানে--

সুকোমল হৃদি ওগো মহিলা সকল!

যে গান লাগিবে ভালো তোমাদের কানে!

স্বর্গের দেবতা এক কহিলা ঈশ্বরে--

"দেখো প্রভু, দেখো চেয়ে এই পৃথ্বীতলে--

মানব হইতে এক হেন জ্যোতি ক্ষরে,

নিম্ন দেশ পৃথিবীরে সে জ্যোতি উজলে!

স্বর্গের অভাব প্রভু নাই কিছু আর,

শুধু ওই জ্যোতি, ওই বিমল কিরণ!

তাই দেব অনুনয় শুন গো আমার,

দেবতার মাঝে তারে করো আনয়ন।'

আমাদের প্রতি দয়া হইল বিধির--

কহিলেন, "ধৈর্য ধরো, আসুক সময়--

পৃথিবীতে এক জন আছে গো অধীর

কখন হারায় তারে সদা তার ভয়।'

...

প্রেম কহে তার পানে করি নিরীক্ষণ

...

ঈশ্বর নূতন সৃষ্টি করিলা সৃজন!

মুকুতার মতো পাণ্ডু বরন তাহার--

প্রকৃতির পূর্ণতম-শিল্প সেই জন,

কহি তারে পূর্ণতম আদর্শ শোভার!

সুন্দর নয়নে তার সদাই জাগ্রত

এমন প্রেমের জ্যোতি, এমন উজ্জ্বল

যে জ্যোতি দর্শক আঁখি করায় মুদিত--

সে জ্যোতি ঢালয়ে হৃদে আলোক বিমল।

হাসিতে চিত্রিত যেন প্রেমের আকার--

এক দৃষ্টে কে তাকাবে সে হাসি তাহার?

তোমারে কহি, হে গান, সন্তান প্রেমের,

তুমি তো যাইবে বহু মহিলার কাছে,

বিলম্ব কোরো না কভু, বলো তাঁহাদের--

"দেবীগণ, মোর শুধু এক কাজ আছে--

তাঁহার চরণে যাওয়া, যাঁর মহা যশে

ভাণ্ডার আমার এই পূর্ণ রহিয়াছে।'

যদিবা বিলম্ব তব হয় দৈববশে,

দেখো যেন রহিয়ো না তাহাদের কাছে--

অসাধু যাদের জান, মন ভালো নয়--

কেবল রমণী আর প্রেমিকের কানে

খুলিয়া হে গীত তুমি তোমার হৃদয়!

মহিলা আমার বসি আছেন সেখানে [যেখানে,]

সেখানে তোমারে তাঁরা যাবেন লইয়া--

তাঁরে মোর কথা তুমি দিয়ো বুঝাইয়া!

একবার দান্তে অত্যন্ত পীড়িত হন, পীড়ার সময় সহসা কেমন তাঁহার মনে হইল, বিয়াত্রিচের মৃত্যু হইবে! কল্পনা তাঁহাকে পাগলের মতো করিয়া তুলিল, কল্পনায় তিনি দেখিতে লাগিলেন, কেহ তাঁহাকে কহিতেছে, "তোমার মৃত্যু হইবে।' কেহ বা কহিতেছে, "তুমি মরিয়াছ।' তিনি দেখিলেন যেন সূর্য অন্ধকার, তারকারা রোদন করিতেছে, ভয়ানক ভূমিকম্প হইতেছে, তাঁহার চারি দিকে পাখিরা মরিতেছে ও পড়িতেছে-- এই বিপ্লবের মধ্যে কে যেন তাঁহাকে কহিল, "জান না তোমার অনুপম মহিলা পৃথিবী পরিত্যাগ করিয়াছেন?' তিনি যেন বিয়াত্রিচের মৃত্যুকালীন প্রশান্ত মুখ দেখিতে পাইলেন। সেই অজ্ঞান অবস্থায় এমন কাতর স্বরে মৃত্যুকে আহ্বান করিলেন যে, শয্যাপার্শ্বস্থ শুভ্রূষাকারিণী রমণী ভয়ে কাঁদিতে লাগিলেন। অবশেষে জাগ্রত হইয়া ইহা স্বপ্ন জানিতে পারিয়া সুস্থির হইলেন।

একদিন তিনি মনে করিলেন, এ পর্যন্ত তিনি তাঁহার মহিলার বিষয় যাহা-কিছু লিখিয়াছেন, সমুদয় অপূর্ণ হইয়াছে। ক্ষুদ্র গীতির মধ্যে ভাব প্রকাশ করিয়া পরিতৃপ্ত না হইয়া তিনি একটি বৃহৎ কবিতা লিখিতে আরম্ভ করিলেন--

কত কাল আছি আমি প্রেমের শাসনে,

এমন গিয়াছে স'য়ে অধীনতা তাঁর,

প্রথমে যা দুখ ব'লে করেছিনু মনে

এখন তা ধরিয়াছে সুখের আকার!

যদিও গো বলহীন হয়েছে পরান,

গেছে চলি তেজ যাহা ছিল এই চিতে,

তবু হেন সুখ প্রেম করেন গো দান

মৃত্যুমূল্য দিয়ে চাই সে সুখ কিনিতে!

প্রেমের প্রসাদে মোর হেন শক্তি আছে,

প্রত্যেক নিশ্বাস ধরি প্রার্থনা আকার--

অনুগ্রহ-ভিক্ষা চায় মহিলার কাছে--

অতি দীনভাবে অতি নম্রভাবে আর!

তাঁরে দেখিলেই আসে সে ভাব আমার।

এই কয় ছত্র লিখিয়াই সহসা গান থামিয়া গেল-- সহসা ইহার নিম্নে লাটিন ভাষায় এই কথাগুলি লিখিত হইল "যে নগরী লোকে পূর্ণ ছিল সে আজ কী নির্জন হইয়াছে! সমস্ত জাতির মধ্যে যে জাতি মহত্তম ছিল সে জাতি আজ কী বিধবার আকার ধারণ করিয়াছে!' বিয়াত্রিচের মৃত্যু হইয়াছে-- এই সংবাদ শুনিয়াই সহসা যেন তাঁহার সংগীত থামিয়া গেল। এমন একটি মহান ঘটনা শুনিলেন যেন তাহা আর চলিত ভাষায় লিখা যায় না, গ্রাম্য ভাষায় লিখিলে তাহা যেন অতি লঘু হইয়া পড়ে। এই নিদারুণ দুঃখে তাঁহার আর কী সান্ত্বনা হইতে পারে? তিনি বিয়াত্রিচের মৃত্যু ও জন্মতিথি মিলাইয়া তখনকার জ্যোতিষ গণনার অনুসারে স্থির করিলেন-- বিয়াত্রিচের মৃত্যুর সহিত নিশ্চয়ই খৃস্টীয় ত্রিমূর্তির (Holy Trinity) কোনো-না-কোনো যোগ আছে।-- এই কল্পনাতেই তাঁহার কত সুখ হইল! তিনি নগরের প্রধান প্রধান লোকদিগকে পত্র লিখিলেন, তাহাতে বিয়াত্রিচের মৃত্যুতে নগরের কী দুর্দশা হইয়াছে তাহাই ব্যাখ্যা করিলেন-- তাঁহার বিশ্বাস হইল, যেন বিয়াত্রিচের মৃত্যুতে সমস্ত নগরী অভাব অনুভব করিতেছে, অথবা যদি না করে, তবে প্রকৃতপক্ষে তাহাদের যে অভাব হইয়াছে, এ বিষয়ে তাহাদের চেতনা জন্মাইয়া দেওয়া তাঁহার কর্তব্য কর্ম।

ক্রমে ক্রমে দুঃখের অন্ধকার তাঁহার হৃদয়ে গাঢ়তর হইতে লাগিল-- যখন অশ্রুজল শুকাইয়া গেল তখন স্থির করিলেন অশ্রুময় অক্ষরে তাঁহার মনের ভাব প্রকাশ করিবেন। এই ভাবিয়া, যাহারা তাঁহার দুঃখ বুঝিতে পারিবে, তাঁহার দুঃখে যাহারা সহজে মমতা করিতে পারিবে, সেই রমণীদের সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন--

এ নয়ন কাঁদিয়া কাঁদিয়া যন্ত্রণায়,

জীর্ণ হয়ে পড়িয়াছে গেছে শুকাইয়া--

নিভাতে এ জ্বালা যদি থাকে গো উপায়

(যেন জ্বালা অতি ধীরে যেতেছে লইয়া

ক্রমশ এ দেহ মোর কবরের পানে,)

তবে তাহা মৃত্যু, কিংবা প্রকাশি এ ব্যথা!

যখন মহিলা মোর আছিলা এখানে

আর কারে বলি নাই এ মর্মের কথা,

হে রমণি তোমাদের কোমল হৃদয়ে

মরমের কথা মোর ঢেলেছি কেবল।

যখন গেছেন তিনি স্বরগ আলয়ে--

রাখিয়া আমার তরে শোক-অশ্রুজল--

তখন যা-কিছু মোর বলিবার আছে

হে রমণি বলিব গো তোমাদেরি কাছে।

তিনি তাহাদিগকে কহিলেন-- বিয়াত্রিচে উচ্চতম স্বর্গে গিয়াছেন, সেখানে যাইতে তাঁহার কিছুমাত্র কষ্ট পাইতে হয় নাই! ঈশ্বর তাঁহাকে আপনি ডাকিয়া লইলেন-- ঈশ্বর দেখিলেন-- এই যন্ত্রণাময় পৃথিবী এমন সুন্দর প্রাণীর বাসযোগ্য নহে। সংগীতটি এই বলিয়া সমাপ্ত করিলেন--

যাও তুমি, হে করুণ সংগীত আমার,

যাও সেথা যেইখানে রমণীরা আছে,

আগে তুমি যেতে সেথা বহি সুখভার,

কত সুখ পেতে, রহি তাহাদের কাছে!

এখনো তাদেরি কাছে করো গো প্রয়াণ,

বিষণ্ণ ও শূন্য তুমি শোকের সন্তান!

এইরূপে প্রথম বৎসর কাটিয়া গেলে পর একবার একটি স্থান দেখিয়া সহসা তাঁহার পূর্ব-স্মৃতি জাগ্রত হইয়া উঠিল। সেইখানে দাঁড়াইয়া তিনি অতি বিষণ্ণ বদনে পুরাতন কথা ভাবিতে লাগিলেন। তাঁহার সেই বিষাদ আর কেহ দেখিতে পাইতেছে কিনা, তাহাই দেখিবার জন্য চারি দিকে নেত্রপাত করিলেন। সহসা দেখিতে পাইলেন-- একটি বাতায়ন হইতে অতি সুন্দরী এক যুবতী তাঁহাকে এমন মমতার সহিত নিরীক্ষণ করিতেছেন যে, দয়া যেন তাঁহার নেত্রে স্পষ্ট প্রতিভাত হইয়াছে। এই মমতা পাইয়া দান্তের হৃদয় গলিয়া গেল, অশ্রু উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। এই মমতা পাইয়া কেবল কৃতজ্ঞতা নহে, ঈষৎ প্রেমের ছায়াও তাঁহার তরুণ হৃদয়ে পতিত হইল! সেদিন চলিয়া গেলেন-- কিন্তু আবার তাহাকে দেখিতে কেমন বাসনা হইল, আর-একদিন সেইখানে গেলেন-- আবার তাহাকে দেখিতে পাইলেন-- দেখিলেন তাঁহার বিয়াত্রিচের ন্যায় তাহার মুখ পাণ্ডুবর্ণ। পাণ্ডুবর্ণকে দান্তে "প্রেমের বর্ণ' নাম দিয়াছেন। দান্তে কহিলেন, "আমার চক্ষু তাহাকে দেখিলে কেমন আনন্দ অনুভব করে।' পরক্ষণেই আবার চক্ষুকে তিরস্কার করিয়া কহিলেন, "চক্ষু! তোর অশ্রুজল দেখিয়া কত লোকে অশ্রু ফেলিয়াছে, তুই আজ কি ভুলিয়া গেলি যে মহিলার (বিয়াত্রিচের) জন্য তুই রোদন করিতেছিস, সেই মহিলার কথা স্মরণ করিয়াই ওই রমণী তোর দিকে চাহিতেছেন?' কিন্তু ওই তিরস্কার বৃথা! আপনাকে ভর্ৎসনা করিলেন কিন্তু শোধন করিতে পারিলেন না। যেদিকে মন ধাবিত হয়, তাহার অনুকূলে কখনো যুক্তির অভাব হয় না।-- অবশেষে স্থির করিলেন-- প্রেম তাঁহাকে শাস্তি দিবার জন্যই উক্ত মহিলাকে তাঁহার চক্ষের সম্মুখে স্থাপিত করিয়াছে-- অতএব তাঁহার হৃদয়ের অভাব এই মমতাময়ী মহিলাই পূর্ণ করিবেন। এইরূপে নূতন-প্রেম যখন তাঁহার হৃদয়ে বদ্ধমূল হইবার উপক্রম করিতেছিল, এমন সময়ে কল্পনার স্বপ্নে একদিন যেন প্রত্যক্ষ সেই লোহিত-বসনা বিয়াত্রিচেকে দেখিতে পাইলেন-- ভস্মাচ্ছন্ন পুরাতন প্রেমের বহ্নি আবার জ্বলিয়া উঠিল ও নূতন প্রেম অঙ্কুরেই শুকাইল!

"ভিটা নুওভা' কাব্যে বিদেশীর পথিকদিগকে সম্বোধন করিয়া নিম্নলিখিত গীতিটি লিখিত আছে--

ধীরে যাইতেছে চলি, ওগো যাত্রীদল

যেন কোন্‌ দূর বস্তু করি কল্পনা--

মোদের দহিছে যেই বিষাদ অনল

তোমাদের পরশে নি যেন সে যাতনা!

তোমাদের নিজদেশ এতই কি দূরে?

এ শোকার্ত নগরীর যাও মধ্য দিয়া

বোধ হয় তবু যেন জান না, এ পুরে

কী মহান শোকানল দহিতেছে হিয়া!

তবু যদি একবার দাঁড়াও হেথায়,

কিছুক্ষণ মোর কথা শোনো মন দিয়া--

তা হলে বিদায়কালে বিষম ব্যথায়

যাবে চলি উচ্চ স্বরে কাঁদিয়া কাঁদিয়া!

তিল মাত্র যার কথা করিলে বর্ণন,

তিল মাত্র যার কথা করিলে শ্রবণ,

মানুষ কাঁদিতে থাকে ব্যথিত অন্তর,

সেই বিয়াত্রিচে-হারা অভাগা নগর!

"ভিটা নুওভা' কাব্যে ইহার পরে আর-একটি মাত্র গীতি আছে। তাহাতে কবি কহিতেছেন, তাঁহার মন স্বর্গে গিয়াছিল, সেখানে দেখিলেন বিয়াত্রিচেকে দেবতারা পূজা করিতেছেন। সে বিয়াত্রিচেকে দেখিয়া কবি এমন বিস্মিত হইয়া গেলেন যে, ভাবিলেন, তাঁহাকে বর্ণনা করিতে গেলে এমন গভীর কথার প্রয়োজন হয় যে, সে কথার অর্থ তিনি নিজেই বুঝিতে পারেন না। তাহার পরেই বিয়াত্রিচে সম্বন্ধে যোগ্যতর কবিতা লিখিবেন স্থির করিয়া "ভিটা নুওভা' কাব্য শেষ করিলেন।

বিয়াত্রিচে সম্বন্ধে যোগ্যতর কাব্য "ডিভাইনা কমিডিয়া' (Divina Commedia)। "ভিটা নুওভা' লেখা শেষ হইলে তাহার অনেক দিন পরে তাহা লিখিত হয়। এই কাব্য সম্বন্ধে কিছু বলিবার পূর্বে দান্তের কবিতার বহির্ভুক্ত জীবনের বিষয়ে দুই-এক কথা বলিয়া লই।

দান্তের প্রকৃত নাম দুরান্তে আলিঘিয়ারি (Durante Alighieri)। তাঁহার সময়ে দুই দল ছিল। গুয়েলফ ও ঘিবেলীন (Guelf and Ghibelline) শ্বেত ও কৃষ্ণ, অর্থাৎ কুলীন ও সাধারণ অধিবাসী; ইহাদের উভয় দলের মধ্যে প্রায়ই বিপ্লব চলিত, একদল ক্ষমতাশালী হইলে অপর দল নিপীড়িত হইত। দান্তে Campaldino) সমরে তিনি স্বয়ং যুদ্ধ করিয়াছেন, ক্যাপ্রোনার যুদ্ধে তিনি উপস্থিত ছিলেন। গুয়েলফ দলের মধ্যে যখন আত্মবিবাদ উপস্থিত হয় তখন তিনি বিশেষ উদ্যমের সহিত তাহাদের মধ্যে একদলের সহায়তা করিতেছিলেন। বিয়াত্রিচের মৃত্যুর পর শাসনকার্য ভিন্ন তাঁহার অন্য কোনো কার্য ছিল না। রাজকার্যে নগরীর মধ্যে তিনি একজন বিখ্যাত লোক হইয়া উঠিলেন। ক্রমে ক্রমে তিনি রাজ্যের প্রধান শাসকদলভুক্ত হইলেন। কিন্তু এই পদে তিনি দুই মাস কাল মাত্র ছিলেন। ইতিমধ্যে রাজ্যে তাঁহার এত শত্রু হইয়াছিল যে শীঘ্রই তাঁহাকে তাঁহার জন্মভূমি ফ্লোরেন্স নগরী হইতে জন্মের মতো নির্বাসিত হইতে হইল। এই নগরে প্রবেশাধিকার পাইবার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। অবশেষে যখন তাঁহার কবিত্বের খ্যাতি চারি দিকে ব্যাপ্ত হইল-- তখন ফ্লোরেন্সবাসীরা তাঁহাকে অনুতপ্ত বেশে দোষ স্বীকার করিতে করিতে নগরে প্রবেশ করিতে অনুমতি দিয়াছিল, কিন্তু তিনি তাহাতে সম্মত হইলেন না। চিরজন্ম নির্বাসনে পরপ্রত্যাশী হইয়া তাঁহাকে কালযাপন করিতে হইয়াছিল। এইরূপে যখন বিয়াত্রিচেকে লইয়া হৃদয়ে তাঁহার ঝটিকা চলিতেছিল, তখন বাহিরের রাজ-বিপ্লব ঝটিকায় তিনি যে উদাসীন ছিলেন তাহা নহে। অনেক দিন রাজ্য সম্বন্ধে মগ্ন থাকিয়া বিয়াত্রিচের উদ্দেশে যোগ্যতর কবিতা লিখিতে পারেন নাই। কিন্তু কোনো বিশেষ সময়ে সহসা তাঁহার খ্যাতি মান যশের দুরাশা ছুটিয়া গেল ও মহাকাব্য এইরূপে আরম্ভ করিলেন--

জীবনের মধ্যপথে দেখিনু সহসা,

ভ্রমিতেছি ঘোর বনে পথ হারাইয়া--

সে যে কী ভীষণ অতি দারুণ গহন--

স্মৃতি তার ভয়ে মোরে করে অভিভূত!

সে ভয়ের চেয়ে মৃত্যু নহে ভয়ানক!

জীবনের মধ্য পথে, অর্থাৎ যখন তিনি তাঁহার পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়সে পৌঁছিয়াছেন-- তিনি এই কাব্য লিখিতে আরম্ভ করেন। ভীষণ অরণ্য আর কিছুই নহে-- সে তাঁহার রাজ্য-শাসন-কার্য, খ্যাতি-প্রতিপত্তির নিমিত্ত সংগ্রাম। অর্ধ অজ্ঞানের মতো হইয়া যখন তিনি এই বনে ভ্রমণ করিতেছেন এমন সময়ে একটি চিতাবাঘ দেখিতে পাইলেন এবং এইরূপ পর্যায়ক্রমে একটি সিংহ ও ক্ষুধাতুরা এক নেকড়িয়া ব্যাঘ্রী দেখিতে পাইলেন। এ সমস্তই রূপক মাত্র, চিতাব্যাঘ্র সুখতৃষা, সিংহ দুরাশা ও নেকড়িয়া ব্যাঘ্রী লোভ। এইরূপে এই-সকল রিপুদিগের দ্বারা ভীত হইয়া অরণ্যে ভ্রমণ করিতেছিলেন,

হেনকালে সহসা দেখিনু এক জন

বহুদিন মৌন রহি ক্ষীণ স্বর তাঁর--

"জীবিত বা মৃত আত্মা যে হও-না কেন

দয়া করো মোরে' আমি সমুচ্চে কহিনু

সে অরণ্য মাঝে যবে হেরিনু তাঁহারে!

ইনি আর কেহ নহেন-- কবি বর্জিলের প্রেতাত্মা। তিনি দান্তেকে স্বর্গ ও নরক প্রদর্শন করাইতে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবেন বলিয়া প্রস্তাব করিলেন। কিন্তু দান্তে ভয় প্রকাশ করিলেন--

মহাছায়া কহিলেন "মিথ্যা আশঙ্কায়

হৃদয় হয়েছে তব বৃথা অভিভূত--

পশু যথা ভয় পায় সন্ধ্যার আঁধারে

হেরিয়া অলীক ছায়া-- তেমনি মানুষ

মহান সংকল্প হতে হয় গো বিরত

বৃথা ভয়ে। এ আশঙ্কা করিবারে দূর--

কহি তোরে কোথা হতে এলেম হেথায়--

প্রথমে কাহার কথা করিয়া শ্রবণ

তোরে দয়া হল মোর, কহি তোরে তাহা!

পরলোকে থাকে যারা সংশয় আঁধারে--

তাহাদের মধ্যে মোর নিবাস কহিনু।

একদা রমণী এক আহ্বানিলা মোরে--

হেন পুণ্যময় মূর্তি এমন সুন্দরী

দেখেই অমনি তাঁর মাগিনু আদেশ--

অতিশয় মৃদু আর অতি সুকোমল

দেবতার স্বরে সুর বাঁধি, কহিলেন--

"অয়ি উপছায়া! তুমি যাহার সুযশ

যদিন প্রকৃতি রবে, রহিবে বাঁচিয়া--

এই অনুনয় মোর করহ শ্রবণ!--

বন্ধু এক মোর (নহে বন্ধু সম্পদের)

মহারণ্যে নিদারুণ বাধা বিঘ্ন পেয়ে--

ভয়ে অভিভূত হয়ে পড়েছেন তিনি।

ভয় করি পাছে হন হেন পথহারা

আর তাঁরে একেবারে ফিরাতে না পারি!

উদ্দীপনা-বাক্যে তব, যে-কোনো উপায়ে,

ফিরাইয়া আনো, তবে লভিব বিরাম!

আসিয়াছি স্বর্গ হতে বিয়াত্রিচে আমি

প্রেম-উত্তেজনে আমি কৈনু অনুরোধ,

বর্জিল সেই বিয়াত্রিচের অনুরোধেই দান্তেকে ভ্রষ্ট-পথ হইতে ফিরাইতে আসিয়াছেন। দান্তে বর্জিলের সহিত নরক-দর্শন করিতে যাইতে আহ্লাদের সহিত সম্মত হইলেন। তৃতীয় স্বর্গে দান্তে নরকের তোরণে গিয়া উপস্থিত হইলেন। তোরণে অস্ফুট অক্ষরে লিখা আছে--

মোর মধ্য দিয়া সবে যাও দুঃখদেশে;

মোর মধ্য দিয়া যাও চির-দুঃখভোগে--

চিরকাল তরে যারা হয়েছে পতিত,

মোর মধ্য দিয়া যাও তাহাদের কাছে!

ন্যায়ের আদেশে আমি হয়েছি নির্মিত--

অনন্ত জ্ঞান ও প্রেম স্বর্গীয় ক্ষমতা--

আমারে পোষণ করা কার্য তাহাদের!

মোর পূর্বে আর কিছু হয় নি সৃজিত--

অনন্ত-পদার্থ ছাড়া, তাই কহিতেছি

হেথায় অনন্ত কাল দহিতেছি আমি।

"হে প্রবেশি, ত্যজি স্পৃহা, প্রবেশ এ দেশে।'

কবি বর্জিল ভীত দান্তেকে সান্ত্বনা করিয়া এক স্থানে লইয়া গেলেন-- সেখানে দীর্ঘশ্বাস, আর্তনাদ, ক্রন্দন, বিলাপ--

তারকা-অবিদ্ধ শূন্য করিছে ধ্বনিত,

শুনিয়া, প্রবেশি সেথা উঠিনু কাঁদিয়া।

নানাবিধ ভাষা আর ভয়ানক কথা,

যন্ত্রণার আর্তনাদ, ক্রোধের চীৎকার

করতালি-- কঠোর ও ভগ্নকণ্ঠ-ধ্বনি--

নিরেট সে আঁধারের চার দিক ঘেরি

ঘূর্ণ-বায়ে রেণুসম ফিরিছে সতত!

এইরূপে আরম্ভ করিয়া কাব্যের প্রথম খণ্ড, অর্থাৎ ইনফর্নো, অর্থাৎ নরক-- ক্রমাগত নরকের বর্ণনা; পরে পর্গেটরি-- অর্থাৎ যাহাদের পরিত্রাণ পাইবার আশা আছে তাহাদের বাসভূমি-- পরে স্বর্গ। ক্রমাগত একই পদার্থের বর্ণনার বিবরণ পাঠকদিগের নিদ্রাকর্ষক হইবে, এই নিমিত্ত তাহা হইতে বিরত হইলাম, পর্গেটরি কাব্যের শেষভাগে বিয়াত্রিচের সহিত কবির সাক্ষাৎ হইল।-- বর্জিল ও দান্তে উভয়েই বিস্ময়ে দেখিলেন একটি আশ্চর্য রথে বিয়াত্রিচে আসিতেছেন। সুরবালারা তাঁহার চারি দিকে এমন পুষ্প-বৃষ্টি করিতেছেন যে, তাঁহার আকার অতি অস্ফুটভাবে দেখা যাইতেছে, দান্তে সে পুষ্পরাশির মধ্যে তাঁহাকে ভালো করিয়া দেখিতে পান নাই, চিনিতেও পারেন নাই-- তিনি কহিতেছেন,

আঁখি মোর দেখে তাঁরে পারে নি চিনিতে

তবু তাঁর দেহ হতে এমন একটি

বিকীরিত হতেছিল শুভ্র-পূণ্য-জ্যোতি,

তাহার পরশে যেন পুরাতন প্রেম

হৃদয়ে আমার পুন উঠিল জাগিয়া।

সেই পুরাতন স্বপ্ন কত শত দিন

যে স্বপ্নে হৃদয় মোর আছিল মগন--

যখনি উঠিল জাগি স্বর্গীয় কিরণে,

অমনি আকুল হয়ে ফিরিয়া ধাইনু।

কবি বার্জিলের পানে, শিশু সে যেমন

ভয় কিংবা শোক-ভারে হলে বিচলিত,

অমনি মায়ের বুকে যায় লুকাবারে!

ভাবিনু কাতর স্বরে কহিব তাঁহারে--

"প্রতি রক্তবিন্দু মোর কাঁপিছে শিরায়,

পুরানো সে অগ্নি পুন উঠিছে জ্বলিয়া।'

হা-- বর্জিল কোথা-- হয়েছেন অন্তর্ধান!

প্রিয়তম পিতা তুমি বর্জিল আমার!

দান্তেকে বর্জিলের এই সহসা অন্তর্ধানে ব্যথিত হইয়া কাঁদিতে দেখিয়া বিয়াত্রিচে কহিলেন যে "দান্তে, কাঁদিয়ো না, ইহা অপেক্ষা তীক্ষ্ণতর ছুরিকা তোমার হৃদয়ে বিদ্ধ হইবে ও তাহার যন্ত্রণায় তোমাকে কাঁদিতে হইবে।' সুরবালারা পুষ্পবৃষ্টি স্থগিত করিলেন ও পুষ্প-মেঘ-মুক্ত সূর্য প্রকাশ পাইলেন। বিয়াত্রিচে সেই উচ্চ রথের উপরি হইতে কহিলেন, "চাহিয়া দেখো, আমি বিয়াত্রিচে।' বিয়াত্রিচের সেই "অটল মহিমায়' দান্তে "জননীর সম্মুখে ভীত সন্তানের' ন্যায় অভিভূত হইয়া পড়িলেন। বিয়াত্রিচে তখন তাঁহাকে ভর্ৎসনা করিয়া কহিলেন, অল্পবয়সে দান্তের হৃদয় ধর্মে ভূষিত ছিল, বিয়াত্রিচে তাঁহার যৌবনময় চক্ষের আলোকে তাঁহাকে সর্বদাই সৎপথে লইয়া যাইতেন। কিন্তু তিনি যখন তাঁহার মর্ত্যদেহ পরিত্যাগ করিয়া অমর দেহ ধারণ করিলেন, যখন ধুলি-আবরণ হইতে মুক্ত হইয়া পূণ্য ও সৌন্দর্যে অধিকতর ভূষিত হইলেন, তখন তাঁহার প্রতি দান্তের সে ভালোবাসা কমিয়া গেল। বিয়াত্রিচের তীব্র ভর্ৎসনায় তিনি অতিশয় যন্ত্রণা পাইলেন। পরে অনুতাপ-অশ্রু বর্ষণ করিয়া ও স্বর্গের নদীতে স্নান করিয়া তিনি পাপ-বিমুক্ত হইলেন। তখন তিনি তাঁহার প্রিয়তমা সঙ্গিনীর সহিত স্বর্গ দর্শনে চলিলেন। যখন স্বর্গনরক পরিভ্রমণ করা শেষ হইল, তখন কবি কহিলেন--

জাগি উঠি স্বপ্ন যদি ভুলে যাই সব,

তবু তার ভাব যেমন থাকে মনে মনে,

তেমনি আমারো হল, স্বপ্ন গেল ছুটে

মাধুর্য তবুও তার রহিল হৃদয়ে।

ভারতী, ভাদ্র, ১২৮৫