গাথা

গভীর রজনী নীরব ধরণী,

মুমূর্ষু পিতার কাছে

বিজন আলয়ে আঁধার হৃদয়ে

বালক দাঁড়ায়ে আছে।

বীরের হৃদয়ে ছুরিকা বিঁধানো,

শোণিত বহিয়ে যায়,

বীরের বিবর্ণ মুখের মাঝারে

রোষের অনল ভায়!

পড়েছে দীপের অফুট আলোক

আঁধার মুখের 'পরে,

সে মুখের পানে চাহিয়া বালক

দাঁড়ায়ে ভাবনা-ভরে।

দেখিছে পিতার অসাড় অধরে

যেন অভিশাপলিখা,

স্ফূরিছে আঁধার নয়ন হইতে

রোষের অনলশিখা--

ঘুম হ'তে যেন চমকি উঠিল

সহসা নীরব ঘর,

মুমূর্ষু কহিলা বালকে চাহিয়া,

সুধীর গভীর স্বর--

"শোনো বৎস, শোনো, অধিক কি কব,

আসিছে মরণবেলা--

এই শোণিতের প্রতিশোধ নিতে

না করিবে অবহেলা।"

এতেক বলিয়া টানি উপাড়িলা

ছুরিকা হৃদয় হতে,

ঝলকে ঝলকে উছসি অমনি

শোণিত বহিল স্রোতে।

কহিল, "এই নে, এই নে ছুরিকা--

তাহার উরস-'পরে

যত দিন ইহা ঠাঁই নাহি পায়

থাকে যেন তোর করে!

হা হা ক্ষত্রদেব, কি পাপ করেছি--

এ তাপ সহিতে হ'ল,

ঘুমাতে ঘুমাতে বিছানায় পড়ি

জীবন ফুরায়ে এল।"

নয়নে জ্বলিল দ্বিগুণ আগুন,

কথা হয়ে গেল রোধ,

শোণিতে লিখিলা ভূমির উপরে--

"প্রতিশোধ! প্রতিশোধ!"

পিতার চরণ পরশ করিয়া

ছুঁইয়া কৃপাণখানি

আকাশের পানে চাহিয়া কুমার

কহিল শপথবাণী--

"ছুঁইনু কৃপাণ, শপথ করিনু

শুন ক্ষত্রকুলপ্রভু,

এর প্রতিশোধ তুলিব তুলিব,

অন্যথা নহিবে কভু!

সেই বুক ছাড়া এ ছুরিকা আর

কোথা না বিরাম পাবে,

তার রক্ত ছাড়া এই ছুরিকার

তৃষা কভু নাহি যাবে।"

রাখিলা শোণিত-মাখা সে ছুরিকা

বুকের বসনে ঢাকি।

ক্রমে মুমূর্ষুর ফুরাইল প্রাণ,

মুদিয়া পড়িল আঁখি।

ভ্রমিছে কুমার কত দেশে দেশে

ঘুচাতে শপথভার।

দেশে দেশে ভ্রমি তবুও ত আজি

পেলে না সন্ধান তার।

এখনো সে বুকে ছুরিকা লুকানো,

প্রতিজ্ঞা জ্বলিছে প্রাণে--

এখনো পিতার শেষ কথাগুলি

বাজিছে যেন সে কানে।

"কোথা যাও যুবা! যেও না, যেও না--

গহন কানন ঘোর,

সাঁঝের আঁধার ঢাকিছে ধরণী,

এস গো কুটীরে মোর!"

"ক্ষম গো আমায়, কুটীরস্বামী!

বিরাম আলয় চাহি না আমি,

যে কাজের তরে ছেড়েছি আলয়

সে কাজ পালিব আগে।"

"শুন গো পথিক, যেও নাকো আর,

অতিথির তরে মুক্ত এ দুয়ার!

দেখেছ চাহিয়া, ছেয়েছে জলদ

পশ্চিম গগনভাগে।"

কত না ঝটিকা বহিয়া গিয়াছে

মাথার উপর দিয়া,

প্রতিজ্ঞা পালিতে চলেছে তবুও

যুবক নির্ভীকহিয়া।

চলেছে-- গহন গিরি নদী মরু

কোন বাধা নাহি মানি।

বুকেতে রয়েছে ছুরিকা লুকানো

হৃদয়ে শপথবাণী!

"গভীর আঁধারে নাহি পাই পথ,

শুন গো কুটীরস্বামী--

খুলে দাও দ্বার আজিকার মত

এসেছি অতিথি আমি।"

অতি ধীরে ধীরে খুলিল দুয়ার,

পথিক দেখিল চেয়ে--

করুণার যেন প্রতিমার মত

একটি রূপসী মেয়ে।

এলোথেলো চুলে বনফুলমালা,

দেহে এলোথেলো বাস--

নয়নে মমতা, অধরে মাখানো

কোমল সরল হাস।

বালিকার পিতা রয়েছে বসিয়া

কুশের আসন-'পরি--

সম্ভ্রমে আসন দিলেন পাতিয়া

পথিকে যতন করি।

দিবসের পর যেতেছে দিবস,

যেতেছে বরষ মাস--

আজিও কেন সে কাননকুটীরে

পথিক করিছে বাস?

কি কর, যুবক, ছাড় এ কুটীর--

সময় যেতেছে চলি,

যে কাজের তরে ছেড়েছ আলয়,

সে কাজ যেও না ভুলি!

দিবসের পর যেতেছে দিবস,

যেতেছে বরষ মাস,

যুবার হৃদয়ে পড়িছে জড়ায়ে

ক্রমেই প্রণয়পাশ!

শোণিত লিখিত শপথ-আখর

মন হতে গেল মুছি।

ছুরিকা হইতে রকতের দাগ

কেন রে গেল না ঘুচি!

মালতীবালার সাথে কুমারের

আজিকে বিবাহ হবে--

কানন আজিকে হতেছে ধ্বনিত

সুখের হরষরবে!

মালতীর পিতা প্রতাপের দ্বারে

কাননবাসীরা যত,

গাহিছে নাচিছে হরষে সকলে,

যুবক রমণী শত।

কেহ বা গাঁথিছে ফুলের মালিকা,

গাহিছে বনের গান,

মালতীরে কেহ ফুলের ভূষণ

হরষে করিছে দান।

ফুলে ফুলে কিবা সেজেছে মালতী

এলায়ে চিকুরপাশ--

সুখের আভায় উজলে নয়ন,

অধরে সুখের হাস।

আইল কুমার বিবাহসভায়

মালতীরে লয়ে সাথে,

মালতীর হাত লইয়া প্রতাপ

সঁপিল যুবার হাতে।

ওকিও-- ওকিও-- সহসা প্রতাপ

বসনে নয়ন চাপি,

মূরছি পড়িল ভূমির উপরে

থর থর থর কাঁপি।

মালতীবালিকা পড়িল সহসা

মূরছি কাতররবে!

বিবাহসভায় ছিল যারা যারা

ভয়ে পলাইল সবে।

সভয়ে কুমার চাহিয়া দেখিল

জনকের উপছায়া--

আগুনের মত জ্বলে দুনয়ন,

শোণিতে মাখানো কায়া--

কি কথা বলিতে চাহিল কুমার,

ভয়ে হ'ল কথারোধ,

জলদগভীর স্বরে কে কহিল,

"প্রতিশোধ! প্রতিশোধ!

হা রে কুলাঙ্গার, অক্ষত্রসন্তান,

এই কি রে তোর কাজ?

শপথ ভুলিয়া কাহার মেয়েরে

বিবাহ করিলি আজ!

ক্ষত্রধর্ম্ম যদি প্রতিজ্ঞাপালন,

ওরে কুলাঙ্গার, তবে

এ চরণ ছুঁয়ে যে আজ্ঞা লইলি

সে আজ্ঞা পালিবি কবে!

নহিলে যদিন রহিবি বাঁচিয়া

দহিবে এ মোর ক্রোধ।"

নীরব সে গৃহ ধ্বনিল আবার--

"প্রতিশোধ! প্রতিশোধ!"

বুকের বসন হইতে কুমার

ছুরিকা লইল খুলি,

ধীরে প্রতাপের বুকের উপরে

সে ছুরি ধরিল তুলি।

অধীর হৃদয় পাগলের মত,

থর থর কাঁপে পাণি--

কত বার ছুরি ধরিল সে বুকে

কত বার নিল টানি।

মাথার ভিতরে ঘুরিতে লাগিল,

আঁধার হইল বোধ--

নীরব সে গৃহে ধ্বনিল আবার

"প্রতিশোধ! প্রতিশোধ!"

ক্রমশঃ চেতন পাইল প্রতাপ,

মালতী উঠিল জাগি,

চারি দিক চেয়ে বুঝিতে নারিল

এসব কিসের লাগি।

কুমার তখন কহিলা সুধীরে

চাহি প্রতাপের মুখে,

প্রতি কথা তার অনলের মত

লাগিল তাহার বুকে--

"একদা গভীর বরষানিশীথে

নাই জাগি জন প্রাণী,

সহসা সভয়ে জাগিয়া উঠিনু

শুনিয়া কাতর বাণী।

চাহি চারি দিকে-- দেখিনু বিস্ময়ে

পিতার হৃদয় হ'তে--

শোণিত বহিছে, শয়ন তাঁহার

ভাসিছে শোণিতস্রোতে।

কহিলেন পিতা-- "অধিক কি কব

আসিছে মরণবেলা,

এই শোণিতের প্রতিশোধ নিতে

না করিবি অবহেলা।'

হৃদয় হইতে টানিয়া ছুরিকা

দিলেন আমার হাতে,

সে অবধি এই বিষম ছুরিকা

রাখিয়াছি সাথে সাথে।

করিনু শপথ ছুঁইয়া কৃপাণ

"শুন ক্ষত্রকুলপ্রভু,

এর প্রতিশোধ তুলিব-- তুলিব--

না হবে অন্যথা কভু।'

নাম কি তাহার জানিতাম নাকো

ভ্রমিনু সকল গ্রাম--"

অধীরে প্রতাপ উঠিল কহিয়া,

"প্রতাপ তাহার নাম!

এখনি এখনি ওই ছুরি তব

বসাইয়া দেও বুকে,

যে জ্বালা হেথায় জ্বলিছে-কেমনে

কব তাহা এক মুখে?

নিভাও সে জ্বালা, নিভাও সে জ্বালা

দাও তার প্রতিফল--

মৃত্যু ছাড়া এই হৃদি-অনলের

নাই আর কোন জল!"

কাঁদিয়া উঠিল মালতী কহিল

পিতার চরণ ধ'রে,

"ও কথা ব'লো না-- ব'লো না গো পিতা,

যেও না ছাড়িয়ে মোরে!

কুমার-- কুমার-- শুন মোর কথা

এক ভিক্ষা শুধু মাগি--

রাখ মোর কথা, ক্ষম গো পিতারে,

দুখিনী আমার লাগি!--

শোণিত নহিলে ও ছুরির তব

পিপাসা না মিটে যদি,

তবে এই বুকে দেহ গো বিঁধিয়া

এই পেতে দিনু হৃদি!"

আকাশের পানে চাহিয়া কুমার

কহিল কাতর স্বরে,

"ক্ষমা কর পিতা, পারিব না আমি,

কহিতেছি সকাতরে!

অতি নিদারুণ অনুতাপশিখা

দহিছে যে হৃদিতল,

সে হৃদয়মাঝে ছুরিকা বসায়ে

বল গো কি হবে ফল?

অনুতাপী জনে ক্ষমা কর পিতা!

রাখ এই অনুরোধ!"

নীরব সে গৃহে ধ্বনিল আবার,

"প্রতিশোধ! প্রতিশোধ!"--

হৃদয়ের প্রতি শিরা উপশিরা

কাঁপিয়া উঠিল হেন--

সবলে ছুরিকা ধরিল কুমার,

পাগলের মত যেন।

প্রতাপের সেই অবারিত বুকে

ছুরি বিঁধাইল বলে।

মালতী বালিকা মূর্চ্ছিয়া পড়িল

কুমারের পদতলে।

উন্মত্ত হৃদয়ে, জ্বলন্ত নয়নে,

বদ্ধ করি হস্তমুঠি--

কুটীর হইতে পাগল কুমার

বাহিরেতে গেল ছুটি।

এখনো কুমার সেই বনমাঝে

পাগল হইয়া ভ্রমে--

মালতীবালার চিরমূর্চ্ছা আর

ঘুচিল না এ জনমে!