প্রভাতে

উঠ, জাগ তবে-- উঠ, জাগ সবে--

হের ওই হের, প্রভাত এসেছে

স্বরণ-বরণ গো!

নিশার ভীষণ প্রাচীর আঁধার

শতধা শতধা করিয়া বিদার--

তরুণ বিজয়ী তপন এসেছে

অরুণচরণ গো!

মাথায় বিজয়কিরীট জ্বলিছে,

গলায় বিজয়কিরণমাল,

বিজয়বিভায় উজলি উঠেছে,

বিজয়ী রবির তরুণ ভাল!

উষা নববধূ দাঁড়াইয়া পাশে--

গরবে সরমে সোহাগে উলাসে

মৃদু মৃদু হেসে সারা হল বুঝি,

বুঝিবা সরম রহে না তার!

আঁখি দুটি নত, কপোলটি রাঙা,

পদতলে শুয়ে মেঘ ভাঙা ভাঙা,

অধর টুটিয়া পড়িছে ফুটিয়া

হাসি সে বারণ সহে না আর!

এস এস তবে -- ছুটে যাই সবে,

কর কর তবে ত্বরা--

এমন বহিছে প্রভাতবাতাস,

এমন হাসিছে ধরা!

সারা দেহে যেন অধীর পরাণ

কাঁপিছে সঘনে গো,

অধীর চরণ উঠিতে চায়,

অধীর চরণ ছুটিতে চায়,

অধীর হৃদয় মম

প্রভাতবিহগসম

নব নব গান গাহিতে গাহিতে,

অরুণের পানে চাহিতে চাহিতে

উড়িবে গগনে গো!

ছুটে আয় তবে, ছুটে আয় সবে,

অতি দূর-- দূর যাব,

করতালি দিয়া সকলে মিলিয়া

কত শত গান গাব!

কি গান গাইবে ? কি গান গাইব!

যাহা প্রাণ চায় তাহাই গাইব,

গাইব আমরা প্রভাতের গান,

হৃদয়ের গান, জীবনের গান--

ছুটে আয় তবে, ছুটে আয় সবে,

অতি দূর দূর যাব!

কোথায় যাইবে? কোথায় যাইব!

জানি না আমরা কোথায় যাইব,

সুমুখের পথ যেথা ল'য়ে যায়--

কুসুমকাননে, অচল শিখরে,

নিঝর যেথায় শত ধারে ঝরে,

মণিমুকুতার বিরল গুহায়--

সুমুখের পথ যেথা ল'য়ে যায়!

দেখ-চেয়ে দেখ-পথ ঢাকা আছে

কুসুমরাশিতে রে,

কুসুম দলিয়া-যাইব চলিয়া

হাসিতে হাসিতে রে!

ফুলে কাঁটা আছে ? কই! কাঁটা কই!

কাঁটা নাই-- নাই-- নাই,

এমন মধুর কুসুমেতে কাঁটা

কেমনে থাকিবে ভাই!

যদিও বা ফুলে কাঁটা থাকে ভুলে

তাহাতে কিসের ভয়!

ফুলেরি উপরে ফেলিব চরণ,

কাঁটার উপরে নয়!

ত্বরা ক'রে আয় ত্বরা ক'রে আয়

যাই মোরা যাই চল্‌।

নিঝর যেমন বহিয়া চলিছে

হরষেতে টলমল--

নাচিছে, ছুটিছে, গাহিছে, খেলিছে,

শত আঁখি তার পুলকে জ্বলিছে,

দিন রাত নাই কেবলি চলিছে,

হাসিতেছে খল খল্‌!

তরুণ মনের উছাসে অধীর

ছুটেছে যেমন প্রভাতসমীর,

ছুটেছে কোথায়?-- কে জানে কোথায়!

তেমনি তোরাও আয় ছুটে আয়,

তেমনি হাসিয়া-- তেমনি খেলিয়া,

পুলক-উজল নয়ন মেলিয়া,

হাতে হাতে বাঁধি করতালি দিয়া

গান গেয়ে যাই চল্‌।

আমাদের কভু হবে না বিরহ,

এক সাথে মোরা রব অহরহ,

এক সাথে মোরা করিব গমন,

সারা পথ মোরা করিব ভ্রমণ,

বহিছে এমন প্রভাতপবন,

হাসিছে এমন ধরা!

যে যাইবি আয়-- যে থাকিবি থাক্‌--

যে আসিবি কর্‌ ত্বরা!

...

আমি যাব গো!--

প্রভাতের গান আর জীবনের গান

দেখি যদি পারি তবে আমি গাব গো,

আমি যাব গো!

যদিও শকতি নাই এ দীন চরণে আর,

যদিও নাইক জ্যোতি এ পোড়া নয়নে আর,

শরীর সাধিতে নারে মন মোর যাহা চায়,

শতবার আশা করি শতবার ভেঙ্গে যায়--

আমি যাব গো!

সারারাত ব'সে আছি, আঁখি মোর অনিমেষ।

প্রণের ভিতর দিকে চেয়ে দেখি অনিমিখে,

চারি দিকে যৌবনের ভগ্ন জীর্ণ অবশেষ।

ভগ্ন আশা ভগ্ন সুখ-- ধূলিমাখা জীর্ণ স্মৃতি।

সামান্য বায়ুর দাপে ভিত্তি থর থর কাঁপে,

একটি আধটি ইঁট খসিতেছে নিতি নিতি--

আমি যাব গো!

নবীন আশায় মাতি পথিকেরা যায়,

কত গান গায়!--

এ ভগ্ন প্রমোদালয়ে পশে সুর ভয়ে ভয়ে,

প্রতিধ্বনি মৃদুল জাগায়--

তারা ভগ্ন ঘরে ঘরে ঘুরিয়া বেড়ায়!

তখন নয়ন মুদি কত স্বপ্ন দেখি!

কত স্বপ্ন হায়!

কত দীপালোক -- কত ফুল--কত পাখী!

কত সুধামাখা কথা, কত হাসিমাখা আঁখি!

কত পুরাতন স্বর কে জানে কাহারে ডাকে!

কত কচি হাত এসে খেলে এ পলিত কেশে,

কত কচি রাঙ্গা মুখ কপোলে কপোল রাখে!

কত স্বপ্ন হায়!

হৃদয় চমকি উঠি চারি দিকে চায়,

দেখে গো কঙ্কালরাশি হেথায় হোথায়!

সে দীপ নিভিয়া গেছে,

সে ফুল শুখায়ে গেছে,

সে পাখী মরিয়া গেছে--

সুধামাখা কথাগুলি চিরতরে নীরবিত

হাসিমাখা আঁখিগুলি চিরতরে নিমীলিত।--

আমি যাব গো!

দেখি যদি পারি তবে প্রভাতের গান

আমি গাব গো!

এ ভগ্ন বীণার তন্ত্রী ছিঁড়েছে সকল আর--

দুটি বুঝি বাকি আছে তার!

এখানো প্রভাতে যদি হরিষিতপ্রাণ

এ বীণা বাজাতে চাই-- চমকি শুনিতে পাই

সহসা গাহিয়া উঠে যৌবনেরি গান

সেই দুটি তার।

টুটে গেছে, ছিঁড়ে গেছে বাকি যত আর।

যুগ-যুগান্তের এই শুষ্ক জীর্ণ গাছে

দুটি শাখা আছে--

এখনো যদি গো শুনে বসন্তপাখীর গীত,

এখনো পরশে যদি বসন্তমলয়বায়,

দু-চারিটি কিশলয়

এখনো বাহির হয়,

এখনো এ শুষ্ক শাখা হেসে উঠে মুকুলিত,

একটি ফুলের কুঁড়ি ফুটিয়া উঠিতে চায়,

ফুটে-ফুটো হয় যবে ঝরিয়া মরিয়া যায়।

এ ভগ্ন বীণার দুটি ছিন্নশেষ তারে

পরশ করেছে আজি গো--

নবযৌবনের গান ললিতরাগিণী

সহসা উঠেছে বাজি গো।--

এই ভগ্ন ঘরে ঘরে প্রতিধ্বনি খেলা করে

শ্মশানেতে হাসিমুখ শিশুটির প্রায়--

লইয়া মাথার খুলি আধ-পোড়া অস্থিগুলি,

প্রমোদে ভস্মের 'পরে ছুটিয়া বেড়ায়।

তোমরা তরুণ পাখী উড়েছ প্রভাতে

সকলে মিলিয়া এক সাথে,

এ পাখী এ শুষ্ক শাখে একেলা কেমনে থাকে!

সাধ-- তোমাদেরি, সাথে যায়,

সাধ-- তোমাদেরি গান গায়,

তরুণ কণ্ঠের সাথে এ পুরানো কণ্ঠ মোর

বাজিবে না সুরে?

নাহয় নীরবে রব', নাহয় কথা না কব--

শুনিব তোদেরি গান এ শ্রবণ পূরে।

এই ছিন্ন জীর্ণ পাখা বিছায়ে গগনে

যাব প্রাণপণে--

পথমাঝে শ্রান্ত যদি হই অতিশয়

তবে -- দিস্‌ রে আশ্রয়।

পথে যে কণ্টক আছে কি ভাবিলি তার?

কত শুষ্ক জলাশয়-- কত মাঠ মরুময়--

পর্ব্বতশিখরশায়ী বিস্তৃত তুষার!

কত শত বক্রগতি নদী খরস্রোত অতি,

ঘুরিছে দারুণ বেগে আবর্ত্তের জল--

হা দুর্ব্বল তুই তার কি ভাবিলি বল!

ভাবিয়া ত কাটায়েছি সারাটি জীবন,

ভবিতে পারি না আর, জীবন দুর্ব্বহ ভার--

সহিব এ পোড়া ভালে যা আছে লিখন।

যদি প্রতি পদে পদে অদৃষ্টের কাঁটা বিঁধে,

প্রতি কাঁটা তুলে তুলে কত আর চলি!

নাহয় চরণে বিঁধি মরিব গো জ্বলি।

আমি যাব গো।

...

মধ্যাহ্ন

"আর কত দূর?" "যত দূর হোক্‌

ত্বরা চল সেই দেশ।

বিলম্ব হইলে আজিকার দিনে

এ যাত্রা হবে না শেষ।"

"এ শ্রান্ত চরণে বিঁধিয়াছে বড়

কণ্টক বিষম গো।"

"প্রথম তপন হানিছে কিরণ

অনলের সম গো।"

"ছি ছি ছি সামান্য শ্রমেতে কাতর

করিছ রোদন কেন!

ছি ছি ছি সামান্য ব্যথায় অধীর

শিশুর মতন হেন!"

"যাহা ভেবেছিনু সকাল বেলায়

কিছুই তাহা যে নয়।"

"তাহাই ব'লে কি আধ' পথ হ'তে

ফিরে যেতে সাধ হয়?"

"তবে চল যাই-- যত দূর হোক্‌

ত্বরা চল সেই দেশ--

বিলম্ব হইলে আজিকার দিনে

এ যাত্রা হবে না শেষ।"

"বল দেখি তবে এই মরুময়

পথের কি শেষ আছে?

পাব কি আবার শ্যামল কানন

ঘন ছায়াময় গাছে?"

"হয়ত বা পাবে হয়ত পাবে না,

হয়ত বা আছে, হয়ত নাই!"

"ওই যে সুদুরে দূরদিগন্তরে

শ্যামল কানন দেখিতে পাই।"

"শ্যামল কানন-- শ্যামল কানন--

ওই যে গো হেরি শ্যামল কানন--

চল, সবে চল, হসিত-আনন,

চল ত্বরা চল, চল গো যাই!"

"ও যে মরীচিকা" -- "ও কি মরীচিকা?"

"মরীচিকা?" "তাই হবে!"

"বল, বল মোরে, এ দীর্ঘ পথের

শেষে কোন্‌ খানে তবে?"

...

অবশ চরণ হেন উঠিতে চাহে না যেন--

পারি না বহিতে দেহভার।

এ পথের বাকি কত আর!

কেন চলিলাম?

সে দিনের যত কথা কেন ভুলিলাম?

ছেলেবেলা এক দিন আমরাও চলেছিনু--

তরুণ আশায় মাতি আমরাও বলেছিনু--

"সারা পথ আমাদের হবে না বিরহ,

মোরা সবে এক সাথে রব অহরহ।"

অর্দ্ধপথে না যাইতে যত বাল্যসখা

কে কোথায় চ'লে গেল না পাইনু দেখা।

শ্রান্তপদে দীর্ঘ পথ ভ্রমিলাম একা।

নিরাশাপুরেতে গিয়া সে যাত্রা করেছি শেষ,

পুন কেন বাহিরিনু ভ্রমিতে নূতন দেশ?

ভগ্নআশাভিত্তি-'পরে নব-আশা কেন

গড়িতে গেলাম হায় উনমাদ-হেন?

আঁধার কবরে সেথা মৃত ঘটনার

কঙ্কাল আছিল প'ড়ে, স্মৃতি নাম যার।

এক দিন ছিল যাহা তাই সেথা আছে,

আর কভু হবে না যা তাই সেথা আছে--

এক দিন ফুটেছিল যে ফুল-সকল

তারি শুষ্ক দল,

এক দিন যে পাদপ তুলেছিল মাথা

তারি শুষ্ক পাতা,

এক দিন যে সঙ্গীত জাগাত রজনী

তারি প্রতিধ্বনি,

যে মঙ্গলঘট ছিল দুয়ারের পাশ

তারি ভগ্ন রাশ!

সে প্রেতভূমিতে আমি ছিনু রাত্রি দিন

প্রেতসহচর!

কেহ বা সমুখে আসি দাঁড়ায়ে কাঁদিত

শীর্ণকলেবর।

কেহ বা নীরবে আসি পাশেতে বসিয়া,

দিন নাই রাত্রি নাই, নয়নে পলক নাই,

শুধু ব'সে ছিল এই মুখেতে চাহিয়া।

সন্ধ্যা হ'লে শুইতাম, দীপহীন শূন্য ঘর--

কেহ কাঁদে, কেহ হাসে,

কেহ পায়, কেহ পাশে,

কেহ বা শিয়রে ব'সে শত প্রেতসহচর!

কেহ শত সঙ্গী ল'য়ে আকাশমাঝারে র'য়ে

ভাবশূন্য স্তব্ধমুখে করিত গো নেত্রপাত--

এমনি কাটিত দিন, এমনি কাটিত রাত!

কেন হেন দেশ ত্যজি আইলাম হা-- রে--

ফুরাত জীবনদিন চিন্তাহীন ভয়হীন,

মরিয়া গো রহিতাম মৃত সে সংসারে--

মৃত আশা, মৃত সুখ, মৃতের মাঝারে!

আবার নূতন করি জীবনের খেলা

আরম্ভ করিতে কি গো সময় আমার?

ফুরায়ে গিয়েছে যবে জীবনের বেলা

প্রভাতের অভিনয় সাজে কি গো আর?

তবে কেন চলিলাম?

সে দিনের যত কথা কেন ভুলিলাম?

এখন ফিরিতে নারি অতি দূর--দূর পথ,

সমুখে চলিতে নারি শ্রান্ত দেহ জড়বৎ,

হে তরুণ পান্থগণ, যেওনাকো আর--

শ্রান্ত হইয়াছি বড়, বসি একবার।

ছায়া নাই, জল নাই, সীমা দেখিতে না পাই--

অতি দূর-- দূর পথ-- বসি একবার।

...

"আর কত দূর" "যত দূর হোক্‌,

ত্বরা চল সেই দেশ।

বিলম্ব হইলে আজিকার দিনে

এ যাত্রা হবে না শেষ।"

"কোথা এর শেষ?" "যেথা হোক নাক"

তবুও যাইতে হবে--

পথে কাঁটা আছে, শুধু ফুল নহে,

তাহাও জানিও সবে!

হয়ত যাইব কুসুমকাননে,

হয়ত যাইব না--

হয়ত পাইব পূর্ণ জলাশয়,

হয়ত পাইব না।

এ দূর পথের অতি শেষ সীমা

হয়ত দেখিতে পাব,

হয়ত পাব না-- ভুলি যদি পথ

কে জানে কোথায় যাব!

শুনিলে সকল, এখন তোমরা

কে যাইবে মোর সাথ?

যে থাকিবে থাক, যে যাইবে এস--

ধর সবে মোর হাত।

দিন যায় চ'লে, সন্ধ্যা হ'ল ব'লে,

অধিক সময় নাই--

বহু দূর পথ রহিয়াছে বাকি,

চল ত্বরা ক'রে যাই।"

"ও পথে যাব না, মিছা সব আশা

হইব উত্তরগামী।"

"দক্ষিণে যাইব।" "পশ্চিমে যাইব"

"পুরবে যাইব আমি।"

"যে যাইবে যাও, যে আসিবে এস,

চল ত্বরা ক'রে যাই।

দিন যায় চ'লে, সন্ধ্যা হ'ল ব'লে,

অধিক সময় নাই।"

যেও না ফেলিয়া মোরে, যেও নাকো আর--

মুহূর্ত্তের তরে হোথা বসি একবার।

ছায়া নাই, জল নাই, সীমা দেখিতে না পাই,

যেও না, বড়ই শ্রান্ত এ দেহ আমার।

"চলিলাম তবে, দিন যায় যায়,

হইনু উত্তরগামী।"

"দক্ষিণে চলিনু।" "পশ্চিমে চলিনু।"

"পুরবে চলিনু আমি।"

"যে থাকিবে থাক, যে আসিবে এস,

মোরা ত্বরা করে যাই।

দিন যায় চ'লে, সন্ধ্যা হ'ল ব'লে,

অধিক সময় নাই।"

...

হাসিতে হাসিতে প্রাতে আইনু সবার সাথে,

সায়াহ্নে সকলে তেয়াগিল

দক্ষিণে কেহ বা যায়, পশ্চিমে কেহ বা যায়,

কেহ বা উত্তরে চলি গেল।

চৌদিকে অসীম মরু, নাই তৃণ, নাই তরু,

দারুণ নিস্তব্ধ চারি ধার--

পথ ঘোর জনহীন, মরিয়া যেতেছে দিন,

চুপি চুপি আসিছে আঁধার।

অনল-উত্তপ্ত ভূঁয়ে নিস্পন্দ রয়েছি শুয়ে,

অনাবৃত্ত মাথায় উপর।

সঘনে ঘুরিছে মাথা, মুদে আসে আঁখিপাতা,

অসাড় দুর্ব্বল কলেবর।

কেন চলিলাম?

সহসা কি মদে মাতি আপনারে ভুলিলাম?

দক্ষিণাবাতাস বহা ফুরায়েছে এ জীবনে,

হৃদয়ে উত্তরবায় করিতেছে হায় হায়--

আমি কেন আইলাম বসন্তের উপবনে?

জানিস কি হৃদয় রে, শীতের সমাধি-'পরে

বসন্তের কুসুমশয়ন?

অরুণকিরণময় নিশার চিতায় হয়

প্রভাতের নয়ন-মেলন?

যৌবনবীণার মাঝে আমি কেন থাকি আর--

মলিন, কলঙ্ক-ধরা একটি বেসুরা তার!

কেন আর থাকি আমি যৌবনের ছন্দ-মাঝে,

নিরর্থ অমিল এক কানেতে কঠোর বাজে!

আমার আরেক ছন্দ, আমার আরেক বীণ--

সেই ছন্দে এক গান বাজিতেছে নিশিদিন।

সন্ধ্যার আঁধার আর শীতের বাতাসে মিলি

সে ছন্দ হয়েছে গাঁথা মরণকবির হাতে--

সেই ছন্দ ধ্বনিতেছে হৃদয়ের নিরিবিলি,

সেই ছন্দ লিখা আছে হৃদয়ের পাতে পাতে!

তবে কেন চলিলাম?

সহসা কি মদে মাতি আপনারে ভুলিলাম!

তবে যত দিন বাঁচি রহিব হেথায় পড়ি--

এক পদ উঠিব না, মরি ত হেথায় মরি--

প্রভাতে উঠিবে রবি, নিশীথে উঠিবে তারা,

পড়িবে মাথার 'পরে রবিকর বৃষ্টিধারা।

হেথা হতে উঠিব না, মৌনব্রত টুটিব না--

চরণ অচল রবে অচল পাষাণ-পারা।

দেখিস, প্রভাত কাল হইবে যখন,

তরুণ পথিক দল করি হর্ষকোলাহল

সমুখের পথ দিয়া করিবে গমন,

আবার নাচিয়া যেন উঠে না রে মন!

উল্লাসে অধীরহিয়া দুখশ্রান্তি ভুলি গিয়া

আর উঠিস না কভু করিতে ভ্রমণ।

প্রভাতের মুখ দেখি উনমাদ-হেন

ভুলিস নে-- ভুলিস নে-- সায়াহ্নেরে যেন!