কোন্‌ দূর শতাব্দের কোন্‌-এক অখ্যাত দিবসে

নাহি জানি আজি

মারাঠার কোন্‌ শৈলে অরণ্যের অন্ধকারে ব'সে,

হে রাজা শিবাজি,

তব ভাল উদ্ভাসিয়া এ ভাবনা তড়িৎপ্রভাবৎ

এসেছিল নামি--

"একধর্মরাজ্যপাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত

বেঁধে দিব আমি।'

সেদিন এ বঙ্গদেশ উচ্চকিত জাগে নি স্বপনে,

পায় নি সংবাদ--

বাহিরে আসে নি ছুটে, উঠে নাই তাহার প্রাঙ্গণে

শুভ শঙ্খনাদ--

শান্তমুখে বিছাইয়া আপনার কোমলনির্মল

শ্যামল উত্তরী

তন্দ্রাতুর সন্ধ্যাকালে শত পল্লিসন্তানের দল

ছিল বক্ষে করি।

তার পরে একদিন মারাঠার প্রান্তর হইতে

তব বজ্রশিখা

আঁকি দিল দিগ্‌দিগন্তে যুগান্তের বিদ্যুদ্‌বহ্নিতে

মহামন্ত্রলিখা।

মোগল-উষ্ণীষশীর্ষ প্রস্ফুরিল প্রলয়প্রদোষে

পক্কপত্র যথা--

সেদিনও শোনে নি বঙ্গ মারাঠার সে বজ্রনির্ঘোষে

কী ছিল বারতা।

তার পরে শূন্য হল ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ নিবিড় নিশীথে

দিল্লিরাজশালা--

একে একে কক্ষে কক্ষে অন্ধকারে লাগিল মিশিতে

দীপালোকমালা।

শবলুব্ধ গৃধ্রদের ঊর্ধ্বস্বর বীভৎস চীৎকারে

মোগলমহিমা

রচিল শ্মশানশয্যা--মুষ্টিমেয় ভস্মরেখাকারে

হল তার সীমা।

সেদিন এ বঙ্গপ্রান্তে পণ্যবিপণীর এক ধারে

নিঃশব্দচরণ

আনিল বণিকলক্ষ্মী সুরঙ্গপথের অন্ধকারে

রাজসিংহাসন।

বঙ্গ তারে আপনার গঙ্গোদকে অভিষিক্ত করি

নিল চুপে চুপে--

বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল পোহালে শর্বরী

রাজদণ্ডরূপে।

সেদিন কোথায় তুমি হে ভাবুক, হে বীর মারাঠি,

কোথা তব নাম!

গৈরিক পতাকা তব কোথায় ধুলায় হল মাটি--

তুচ্ছ পরিণাম!

বিদেশীর ইতিবৃত্ত দস্যু বলি করে পরিহাস

অট্টহাস্যরবে--

তব পুণ্য চেষ্টা যত তস্করের নিষ্ফল প্রয়াস,

এই জানে সবে।

অয়ি ইতিবৃত্তকথা, ক্ষান্ত করো মুখর ভাষণ।

ওগো মিথ্যাময়ী,

তোমার লিখন-'পরে বিধাতার অব্যর্থ লিখন

হবে আজি জয়ী।

যাহা মরিবার নহে তাহারে কেমনে চাপা দিবে

তব ব্যঙ্গবাণী?

যে তপস্যা সত্য তারে কেহ বাধা দিবে না ত্রিদিবে

নিশ্চয় সে জানি।

হে রাজতপস্বী বীর, তোমার সে উদার ভাবনা

বিধির ভাণ্ডারে

সঞ্চিত হইয়া গেছে, কাল কভু তার এক কণা

পারে হরিবারে?

তোমার সে প্রাণোৎসর্গ, স্বদেশলক্ষ্মীর পূজাঘরে

সে সত্যসাধন,

কে জানিত, হয়ে গেছে চিরযুগযুগান্তর-তরে

ভারতের ধন।

অখ্যাত অজ্ঞাত রহি দীর্ঘকাল, হে রাজবৈরাগী,

গিরিদরীতলে

বর্ষার নির্ঝর যথা শৈল বিদারিয়া উঠে জাগি

পরিপূর্ণ বলে,

সেইমত বাহিরিলে-- বিশ্বলোক ভাবিল বিস্ময়ে,

যাহার পতাকা

অম্বর আচ্ছন্ন করে, এতকাল এত ক্ষুদ্র হয়ে

কোথা ছিল ঢাকা।

সেইমত ভাবিতেছি আমি কবি এ পূর্ব-ভারতে,

কী অপূর্ব হেরি,

বঙ্গের অঙ্গনদ্বারে কেমনে ধ্বনিল কোথা হতে

তব জয়ভেরী।

তিন শত বৎসরের গাঢ়তম তমিস্রা বিদারি

প্রতাপ তোমার

এ প্রাচীদিগন্তে আজি নবতর কী রশ্মি প্রসারি

উদিল আবার।

মরে না, মরে না কভু সত্য যাহা শত শতাব্দীর

বিস্মৃতির তলে--

নাহি মরে উপেক্ষায়, অপমানে না হয় অস্থির,

আঘাতে না টলে।

যারে ভেবেছিল সবে কোন্‌কালে হয়েছে নিঃশেষ

কর্মপরপারে,

এল সেই সত্য তব পূজ্য অতিথির ধরি বেশ

ভারতের দ্বারে।

আজও তার সেই মন্ত্র-- সেই তার উদার নয়ান

ভবিষ্যের পানে

একদৃষ্টে চেয়ে আছে, সেথায় সে কী দৃশ্য মহান্‌

হেরিছে কে জানে।

অশরীর হে তাপস, শুধু তব তপোমূর্তি লয়ে

আসিয়াছ আজ--

তবু তব পুরাতন সেই শক্তি আনিয়াছ বয়ে,

সেই তব কাজ।

আজি তব নাহি ধ্বজা, নাই সৈন্য রণ-অশ্বদল

অস্ত্র খরতর--

আজি আর নাহি বাজে আকশেরে করিয়া পাগল

"হর হর হর'।

শুধু তব নাম আজি পিতৃলোক হতে এল নামি,

করিল আহ্বান--

মুহূর্তে হৃদয়াসনে তোমারেই বরিল, হে স্বামী,

বাঙালির প্রাণ।

এ কথা ভাবে নি কেহ এ তিন-শতাব্দ-কাল ধরি--

জানে নি স্বপনে--

তোমার মহৎ নাম বঙ্গ-মারাঠারে এক করি

দিবে বিনা রণে।

তোমার তপস্যাতেজ দীর্ঘকাল করি অন্তর্ধান

আজি অকস্মাৎ

মৃত্যুহীন বাণী-রূপে আনি দিবে নূতন পরান

নূতন প্রভাত।

মারাঠার প্রান্ত হতে একদিন তুমি ধর্মরাজ,

ডেকেছিলে যবে

রাজা ব'লে জানি নাই, মানি নাই, পাই নাই লাজ

সে ভৈরব রবে।

তোমার কৃপাণদীপ্তি একদিন যবে চমকিলা

বঙ্গের আকাশে

সে ঘোর দুর্যোগদিনে না বুঝিনু রুদ্র সেই লীলা,

লুকানু তরাসে।

মৃত্যুসিংহাসনে আজি বসিয়াছ অমরমুরতি--

সমুন্নত ভালে

যে রাজকিরীট শোভে লুকাবে না তার দিব্যজ্যোতি

কভু কোনোকালে।

তোমারে চিনেছি আজি, চিনেছি চিনেছি হে রাজন্‌,

তুমি মহারাজ।

তব রাজকর লয়ে আট কোটি বঙ্গের নন্দন

দাঁড়াইবে আজ।

সেদিন শুনি নি কথা-- আজ মোরা তোমার আদেশ

শির পাতি লব।

কণ্ঠে কণ্ঠে বক্ষে বক্ষে ভারতে মিলিবে সর্বদেশ

ধ্যানমন্ত্রে তব।

ধ্বজা করি উড়াইব বৈরাগীর উত্তরী বসন--

দরিদ্রের বল।

"একধর্মরাজ্য হবে এ ভারতে' এ মহাবচন

করিব সম্বল।

মারাঠির সাথে আজি, হে বাঙালি, এক কন্ঠে বলো

"জয়তু শিবাজি'।

মারাঠির সাথে আজি, হে বাঙালি, এক সঙ্গে চলো

মহোৎসবে সাজি।

আজি এক সভাতলে ভারতের পশ্চিম-পূরব

দক্ষিণে ও বামে

একত্রে করুক ভোগ একসাথে একটি গৌরব

এক পুণ্য নামে।