খবর এল, সময় আমার গেছে,

আমার-গড়া পুতুল যারা বেচে

বর্তমানে এমনতরো পসারী নেই;

সাবেক কালের দালানঘরের পিছন কোণেই

ক্রমে ক্রমে

উঠছে জমে জমে

আমার হাতের খেলনাগুলো,

টানছে ধুলো।

হাল আমলের ছাড়পত্রহীন

অকিঞ্চনটা লুকিয়ে কাটায় জোড়াতাড়ার দিন।

ভাঙা দেয়াল ঢেকে একটা ছেঁড়া পর্দা টাঙাই;

ইচ্ছে করে, পৌষমাসের হাওয়ার তোড়টা ভাঙাই;

ঘুমোই যখন ফড়্‌ফড়িয়ে বেড়ায় সেটা উড়ে,

নিতান্ত ভুতুড়ে।

আধপেটা খাই শালুক-পোড়া; একলা কঠিন ভুঁয়ে

চেটাই পেতে শুয়ে

ঘুম হারিয়ে ক্ষণে ক্ষণে

আউড়ে চলি শুধু আপন-মনে--

"উড়কি ধানের মুড়কি দেব, বিন্নে ধানের খই,

সরু ধানের চিঁড়ে দেব, কাগমারে দই।"

আমার চেয়ে কম-ঘুমন্ত নিশাচরের দল

খোঁজ নিয়ে যায় ঘরে এসে, হায় সে কী নিষ্ফল।

কখনো বা হিসেব ভুলে আগে মাতাল চোর,

শূন্য ঘরের পানে চেয়ে বলে, "সাঙাত মোর,

আছে ঘরে ভদ্র ভাষায় বলে যাকে দাওয়াই?"

নেই কিছু তো, দু-এক ছিলিম তামাক সেজে খাওয়াই।

একটু যখন আসে ঘুমের ঘোর

সুড়সুড়ি দেয় আরসুলারা পায়ের তলায় মোর।

দুপুরবেলায় বেকার থাকি অন্যমনা;

গিরগিটি আর কাঠবিড়ালির আনাগোনা

সেই দালানের বাহির ঝোপে;

থামের মাথায় খোপে খোপে

পায়রাগুলোর সারাটা দিন বকম্‌-বকম্‌।

আঙিনাটার ভাঙা পাঁচিল, ফাটলে তার রকম-রকম

লতাগুল্ম পড়ছে ঝুলে,

হলদে সাদা বেগনি ফুলে

আকাশ-পানে দিচ্ছে উঁকি।

ছাতিমগাছের মরা শাখা পড়ছে ঝুঁকি

শঙ্খমণির খালে,

মাছরাঙারা দুপুরবেলায় তন্দ্রানিঝুম কালে

তাকিয়ে থাকে গভীর জলের রহস্যভেদরত

বিজ্ঞানীদের মতো।

পানাপুকুর, ভাঙনধরা ঘাট,

অফলা এক চালতাগাছের চলে ছায়ার নাট।

চক্ষু বুজে ছবি দেখি--কাৎলা ভেসেছে,

বড়ো সাহেবের বিবিগুলি নাইতে এসেছে।

ঝাউগুঁড়িটার 'পরে

কাঠঠোকরা ঠক্‌ঠকিয়ে কেবল প্রশ্ন করে।

আগে কানে পৌঁছত না ঝিঁঝিঁপোকার ডাক,

এখন যখন পোড়ো বাড়ি দাঁড়িয়ে হতবাক্‌

ঝিল্লিরবের তানপুরা-তান স্তব্ধতা-সংগীতে

লেগেই আছে একঘেয়ে সুর দিতে।

আঁধার হতে না হতে সব শেয়াল ওঠে ডেকে

কল্‌মিদিঘির ডাঙা পাড়ির থেকে।

পেঁচার ডাকে বাঁশের বাগান হঠাৎ ভয়ে জাগে,

তন্দ্রা ভেঙে বুকে চমক লাগে।

বাদুড়-ঝোলা তেঁতুলগাছে মনে যে হয় সত্যি,

দাড়িওয়ালা আছে ব্রহ্মদত্যি।

রাতের বেলায় ডোমপাড়াতে কিসের কাজে

তাক্‌ধুমাধুম বাদ্যি বাজে।

তখন ভাবি, একলা ব'সে দাওয়ার কোণে

মনে-মনে,

ঝড়েতে কাত জারুলগাছের ডালে ডালে

পির্‌ভু নাচে হাওয়ার তালে।

শহর জুড়ে নামটা ছিল, যেদিন গেল ভাসি

হলুম বনগাঁবাসী।

সময় আমার গেছে ব'লেই সময় থাকে পড়ে,

পুতুল গড়ার শূন্য বেলা কাটাই খেয়াল গ'ড়ে।

সজনেগাছে হঠাৎ দেখি কমলাপুলির টিয়ে--

গোধূলিতে সুয্যিমামার বিয়ে;

মামি থাকেন, সোনার বরন ঘোমটাতে মুখ ঢাকা,

আলতা পায়ে আঁকা।

এইখানেতে ঘুঘুডাঙার খাঁটি খবর মেলে

কুলতলাতে গেলে।

সময় আমার গেছে ব'লেই জানার সুযোগ হল

"কলুদ ফুল' যে কাকে বলে, ওই যে থোলো থোলো

আগাছা জঙ্গলে

সবুজ অন্ধকারে যেন রোদের টুক্‌রো জ্বলে।

বেড়া আমার সব গিয়েছে টুটে;

পরের গোরু যেখান থেকে যখন খুশি ছুটে

হাতার মধ্যে আসে;

আর কিছু তো পায় না, খিদে মেটায় শুকনো ঘাসে।

আগে ছিল সাট্‌ন্‌ বীজে বিলিতি মৌসুমি,

এখন মরুভূমি।

সাত পাড়াতে সাত কুলেতে নেইকো কোথাও কেউ

মনিব যেটার, সেই কুকুরটা কেবলি ঘেউ-ঘেউ

লাগায় আমার দ্বারে; আমি বোঝাই তারে কত,

আমার ঘরে তাড়িয়ে দেবার মতো

ঘুম ছাড়া আর মিলবে না তো কিছু--

শুনে সে লেজ নাড়ে, সঙ্গে বেড়ায় পিছু পিছু।

অনাদরের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে পিঠের 'পরে

জানিয়ে দিলে, লক্ষ্ণীছাড়ার জীর্ণ ভিটের 'পরে

অধিকারের দলিল তাহার দেহেই বর্তমান।

দুর্ভাগ্যের নতুন হাওয়া-বদল করার স্থান

এমনতরো মিলবে কোথায়। সময় গেছে তারই,

সন্দেহ তার নেইকো একেবারেই।

সময় আমার গিয়েছে, তাই গাঁয়ের ছাগল চরাই;

রবিশস্যে ভরা ছিল, শূন্য এখন মরাই।

খুদকুঁড়ো যা বাকি ছিল ইঁদুরগুলো ঢুকে

দিল কখন ফুঁকে।

হাওয়ার ঠেলায় শব্দ করে আগলভাঙা দ্বার,

সারাদিনে জনামাত্র নেইকো খরিদ্দার।

কালের অলস চরণপাতে

ঘাস উঠেছে ঘরে আসার বাঁকা গলিটাতে।

ওরই ধারে বটের তলায় নিয়ে চিঁড়ের থালা

চড়ুইপাখির জন্যে আমার খোলা অতিথশালা।

সন্ধে নামে পাতাঝরা শিমূলগাছের আগায়,

আধ-ঘুমে আধ-জাগায়

মন চলে যায় চিহ্নবিহীন পস্‌টারিটির পথে

স্বপ্নমনোরথে;

কালপুরুষের সিংহদ্বারের ওপার থেকে

শুনি কে কয় আমায় ডেকে--

"ওরে পুতুলওলা

তোর যে ঘরে যুগান্তরের দুয়ার আছে খোলা,

সেথায় আগাম-বায়না-নেওয়া খেলনা যত আছে

লুকিয়ে ছিল গ্রহণ-লাগা ক্ষণিক কালের পাছে;

আজ চেয়ে দেখ্‌, দেখতে পাবি,

মোদের দাবি

ছাপ-দেওয়া তার ভালে।

পুরানো সে নতুন আলোয় জাগল নতুন কালে।

সময় আছে কিংবা গেছে দেখার দৃষ্টি সেই

সবার চক্ষে নেই--

এই কথাটা মনে রেখে ওরে পুতুলওলা,

আপন-সৃষ্টি-মাঝখানেতে থাকিস আপন-ভোলা।

ওই যে বলিস, বিছানা তোর ভুঁয়ে চেটাই পাতা,

ছেঁড়া মলিন কাঁথা--

ওই যে বলিস, জোটে কেবল সিদ্ধ কচুর পথ্যি--

এটা নেহাত স্বপ্ন কি নয়, এ কি নিছক সত্যি।

পাস নি খবর, বাহান্ন জন কাহার

পাল্‌কি আনে--শব্দ কি পাস তাহার।

বাঘনাপাড়া পেরিয়ে এল ধেয়ে,

সখীর সঙ্গে আসছে রাজার মেয়ে।

খেলা যে তার বন্ধ আছে তোমার খেলনা বিনে,

এবার নেবে কিনে।

কী জানি বা ভাগ্যি তোমার ভালো,

বাসরঘরে নতুন প্রদীপ জ্বালো;

নবযুগের রাজকন্যা আধেক রাজ্যসুদ্ধ

যদি মেলে, তা নিয়ে কেউ বাধায় যদি যুদ্ধ,

ব্যাপারখানা উচ্চতলায় ইতিহাসের ধাপে

উঠে পড়বে মহাকাব্যের মাপে।

বয়স নিয়ে পণ্ডিত কেউ তর্ক যদি করে

বলবে তাকে, একটা যুগের পরে

চিরকালের বয়স আসে সকল-পাঁজি-ছাড়া

যমকে লাগায় তাড়া।"

এতক্ষণ যা বকা গেল এটা প্রলাপমাত্র--

নবীন বিচারপতি ওগো, আমি ক্ষমার পাত্র;

পেরিয়ে মেয়াদ বাঁচে তবু যে-সব সময়হারা

স্বপ্নে ছাড়া সান্ত্বনা আর কোথায় পাবে তারা।