অচলায়তনের গৃহ

অচলায়তনের গৃহ

গান

গান

পঞ্চক।

তুমি ডাক দিয়েছ কোন্‌ সকালে

কেউ তা জানে না,

আমার মন যে কাঁদে আপন- মনে,

কেউ তা মানে না।

ফিরি আমি উদাস- প্রাণে,

তাকাই সবার মুখের পানে,

তোমার মতন এমন টানে

কেউ তো টানে না।

মহাপঞ্চকের প্রবেশ

মহাপঞ্চকের প্রবেশ

মহাপঞ্চক।

গান! আবার গান!

পঞ্চক।

দাদা, তুমি তো দেখলে-- তোমাদের এখানকার মন্ত্র-তন্ত্র আচার-আচমন সূত্র-বৃত্তি কিছুই পারলুম না।

মহাপঞ্চক।

সে তো দেখতে বাকি নেই -- কিন্তু সেটা কি খুব আনন্দ করবার বিষয়? তাই নিয়ে কি গলা ছেড়ে গান গাইতে হবে?

পঞ্চক।

একমাত্র ওইটেই যে পারি।

মহাপঞ্চক।

পারি! ভারি অহংকার। গান তো পাখিও গাইতে পারে। সেই যে বজ্রবিদারণ-মন্ত্রটা আজ সাত দিন ধরে তোমার মুখস্থ হল না, আজ তার কী করলে?

পঞ্চক।

সাত দিন যেমন হয়েছে অষ্টম দিনেও অনেকটা সেইরকম। বরঞ্চ একটু খারাপ।

মহাপঞ্চক।

খারাপ! তার মানে কী হল।

পঞ্চক।

জিনিসটা যতই পুরোনো হচ্ছে মন ততই লাগছে না, ভুল ততই করছি-- ভুল যতই বেশি বার করছি ততই সেইটেই পাকা হয়ে যাচ্ছে। তাই, গোড়ায় তোমরা যেটা বলে দিয়েছিলে আর আজ আমি যেটা আওড়াচ্ছি, দুটোর মধ্যে অনেকটা তফাত হয়ে গেছে। চেনা শক্ত।

মহাপঞ্চক।

সেই তফাতটা ঘোচাতে হবে নির্বোধ।

পঞ্চক।

সহজেই ঘোচে, যদি তোমাদেরটাকেই আমার মতো করে নাও। নইলে আমি তো পারব না।

মহাপঞ্চক।

পারবে না কী! পারতেই হবে।

পঞ্চক।

তা হলে আর-একবার সেই গোড়া থেকে চেষ্টা করে

দেখি-- একবার মন্ত্রটা আউড়ে দিয়ে যাও।

মহাপঞ্চক।

আচ্ছা বেশ, আমার সঙ্গে আবৃত্তি করে যাও। ওঁ তট তট তোতয় তোতয় স্ফট স্ফট স্ফোটয় স্ফোটয় ঘুণ ঘুণ ঘুণাপয় ঘুণাপয় স্বর বসত্ত্বানি। চুপ করে রইলে যে!

পঞ্চক।

ওঁ তট তট তোতয় তোতয় -- আচ্ছা দাদা।

মহাপঞ্চক।

আবার দাদা। মন্ত্রটা শেষ করো বলছি।

পঞ্চক।

একটা কথা জিজ্ঞাসা করি -- এ মন্ত্রটার ফল কী?

মহাপঞ্চক।

এ মন্ত্র প্রত্যহ সূর্যোদয়-সূর্যাস্তে উনসত্তর বার করে জপ করলে নব্বই বৎসর পরমায়ু হয়।

পঞ্চক।

রক্ষা করো দাদা। এটা জপ করতে গিয়ে আমার এক বেলাকেই নব্বই বছর মনে হয়-- দ্বিতীয় বেলায় মনে হয় মরেই গেছি।

মহাপঞ্চক।

আমার ভাই হয়েও তোমার এই দশা! তোমার জন্যে আমাদের এই অচলায়তনের সকলের কাছে কি আমার কম লজ্জা!

পঞ্চক।

লজ্জার তো কোনো কারণ নেই দাদা।

মহাপঞ্চক।

কারণ নেই?

পঞ্চক।

না। তোমার পাণ্ডিত্যে সকলে আশ্চর্য হয়ে যায়। কিন্তু তার চেয়ে ঢের বেশি আশ্চর্য হয় তুমি আমারই দাদা বলে।

মহাপঞ্চক।

এই বানরটার উপর রাগ করাও শক্ত। দেখো পঞ্চক, তুমি তো আর বালক নও-- তোমার এখন বিচার করে দেখবার বয়স হয়েছে।

পঞ্চক।

তাই তো বিপদে পড়েছি। আমি যা বিচার করি তোমাদের বিচার একেবারে তার উলটো দিকে চলে, অথচ তার জন্যে যা দণ্ড সে আমাকে একলাই ভোগ করতে হয়।

মহাপঞ্চক।

পিতার মৃত্যুর পর কী দরিদ্র হয়ে, সকলের কী অবজ্ঞা নিয়েই এই আয়তনে আমরা প্রবেশ করেছিলুম, আর আজ কেবল নিজের শক্তিতে সেই অবজ্ঞা কাটিয়ে কত উপরে উঠেছি-- আমার এই দৃষ্টান্তও কি তোমাকে একটু সচেষ্ট করে না।

পঞ্চক।

সচেষ্ট করবার তো কথা নয়। তুমি যে নিজগুণেই দৃষ্টান্ত হয়ে বসে আছ, ওর মধ্যে আমার চেষ্টার তো কিছুমাত্র দরকার হয় না। তাই নিশ্চিন্ত আছি।

মহাপঞ্চক।

ঐ শঙ্খ বাজল। এখন আমার সপ্তকুমারিকাগাথা পাঠের সময়। কিন্তু বলে যাচ্ছি, সময় নষ্ট কোরো না।

[ প্রস্থান

গান

পঞ্চক।

বেজে ওঠে পঞ্চমে স্বর,

কেঁপে ওঠে বন্ধ এ ঘর,

বাহির হতে দুয়ারে কর

কেউ তো হানে না।

আকাশে কার ব্যাকুলতা,

বাতাস বহে কার বারতা,

এ পথে সেই গোপন কথা

কেউ তো আনে না।

তুমি ডাক দিয়েছ কোন্‌ সকালে

কেউ তা জানে না॥

ছাত্রদলের প্রবেশ

ছাত্রদলের প্রবেশ

প্রথম ছাত্র।

ওহে পঞ্চক।

পঞ্চক।

না ভাই, আমাকে বিরক্ত কোরো না।

দ্বিতীয় ছাত্র।

কেন? হল কী তোমার?

পঞ্চক।

ওঁ তট তট তোতয় তোতয়--

তৃতীয় ছাত্র।

এখনো তট তট তোতয় তোতয় ঘুচল না? ও যে আমাদের কোন্‌ কালে শেষ হয়ে গেছে তা মনেও আনতে পারি নে।

প্রথম ছাত্র।

না ভাই, পঞ্চককে একটু পড়তে দাও; নইলে ওর কী গতি হবে! এখনো ও বেচারা তট তট করে মরছে-- আমাদের যে ধ্বজাগ্রকেয়ূরী পর্যন্ত শেষ হয়ে গেছে!

দ্বিতীয় ছাত্র।

আচ্ছা পঞ্চক, এখনো তুমি চক্রেশমন্ত্র শেখ নি?

পঞ্চক।

না।

তৃতীয় ছাত্র।

মরীচি?

পঞ্চক।

না।

প্রথম ছাত্র।

মহামরীচি?

পঞ্চক।

না।

দ্বিতীয় ছাত্র।

পর্ণশবরী?

পঞ্চক।

না।

দ্বিতীয় ছাত্র।

আচ্ছা বলো দেখি, হরেত- পক্ষীর নখাগ্রে যে পরিমাণ ধূলিকণা লাগে সেই পরিমাণ যদি --

পঞ্চক।

আরে ভাই, হরেত- পক্ষীই কোনো জন্মে দেখি নি তো তার নখাগ্রের ধূলিকণা!

প্রথম ছাত্র।

হরেত- পক্ষী তো আমরাও কেউ দেখি নি। শুনেছি, সে দধিসমুদ্রের পারে মহাজম্বুদ্বীপে বাস করে। কিন্তু এ-সমস্ত তো জানা চাই, নিতান্ত মূর্খ হয়ে জীবনটাকে মাটি করলে তো চলবে না।

দ্বিতীয় ছাত্র।

পঞ্চক, তুমি আর বৃথা সময় নষ্ট কোরো না। তোমার কাছে তো কেউ বেশি আশা করে না। অন্তত শৃঙ্গভেরিব্রত, কাকচক্ষুপরীক্ষা, ছাগলোমশোধন, দ্বাবিংশপিশাচভয়ভঞ্জন-- এগুলো তো জানা চাইই; নইলে তুমি অচলায়তনের ছাত্র বলে লোকসমাজে পরিচয় দেবে কোন্‌ লজ্জায়?

তৃতীয় ছাত্র।

চলো বিশ্বম্ভর, আমরা যাই। ও একটু পড়ুক।

[ গমনোদ্যত

পঞ্চক।

ওহে বিশ্বম্ভর। তট তট তোতয় তোতয়--

বিশ্বম্ভর।

কেন। আবার ডাকো কেন?

পঞ্চক।

সঞ্জীব, জয়োত্তম, তট তট তোতয় তোতয়--

সঞ্জীব।

কী হয়েছে। পড়ো-না।

পঞ্চক।

দোহাই তোমাদের, একেবারে চলে যেয়ো না। ঐ শব্দগুলো আওড়াতে আওড়াতে মাঝে মাঝে বুদ্ধিমান জীবের মুখ দেখলে তবু আশ্বাস হয় যে, জগৎটা বিধাতাপুরুষের প্রলাপ নয়।

জয়োত্তম।

না হে, মহাপঞ্চক বড়ো রাগ করেন। তিনি মনে করেন, তোমার যে কিছু হচ্ছে না তার কারণ আমরা।

পঞ্চক।

আমি যে কারও কোনো সাহায্য না নিয়ে কেবলমাত্র নিজগুণেই অকৃতার্থ হতে পারি, দাদা আমার এটুকু ক্ষমতাও স্বীকার করেন না, এতেই আমি বড়ো দুঃখিত হই। আচ্ছা ভাই, তোমরা ওইখানে একটু তফাতে বসে কথাবার্তা কও। যদি দেখ একটু অন্যমনস্ক হয়েছি, আমাকে সতর্ক করে দিয়ো। স্ফট স্ফট স্ফোটয় স্ফোটয় --

জয়োত্তম।

আচ্ছা বেশ, এইখানে আমরা বসছি।

সঞ্জীব।

বিশ্বম্ভর, তুমি যে বললে এবার আমাদের আয়তনে গুরু আসবেন, সেটা শুনলে কার কাছ থেকে?

বিশ্বম্ভর।

কী জানি, কারা সব বলা-কওয়া করছিল। কেমন করে চারি দিকেই রটে গিয়েছে যে, চাতুর্মাস্যের সময় গুরু আসবেন।

পঞ্চক।

ওহে বিশ্বম্ভর, বল কী? আমাদের গুরু আসবেন নাকি?

সঞ্জীব।

আবার পঞ্চক! তোমার কাজ তুমি করো-না।

পঞ্চক।

ঘুণ ঘুণ ঘুণাপয় ঘুণাপয়--

জয়োত্তম।

কিন্তু অধ্যাপকদের কারও কাছে শুনেছ কি? মহাপঞ্চক কী বলেন?

বিশ্বম্ভর।

তাঁকে জিজ্ঞাসা করাই বৃথা। মহাপঞ্চক কারও প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সময় নষ্ট করেন না। আজকাল তিনি আর্যঅষ্টোত্তরশত নিয়ে পড়েছেন-- তাঁর কাছে ঘেঁষে কে!

পঞ্চক।

চলো-না ভাই, আচার্যদেবের কাছে যাই। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেই--

জয়োত্তম।

আবার! ফের!

পঞ্চক।

ঘুণ ঘুণ ঘুণাপয় ঘুণাপয়--

জয়োত্তম।

আমার তো উনিশ বছর বয়স হল-- এর মধ্যে একবারও আমাদের গুরু এ আয়তনে আসেন নি। আজ তিনি হঠাৎ আসতে যাবেন এটা বিশ্বাস করতে পারি নে।

সঞ্জীব।

তোমার তর্কটা কেমনতরো হলো হে জয়োত্তম? উনিশ বছর আসেন নি বলে বিশ বছরে আসাটা অসম্ভব হল কোন্‌ যুক্তিতে?

বিশ্বম্ভর।

তা হলে অঙ্কশাস্ত্রটাই অপ্রমাণ হয়ে যায়। তবে তো উনিশ পর্যন্ত বিশ নেই বলে উনিশের পরেও বিশ থাকতে পারে না।

সঞ্জীব।

শুধু অঙ্ক কেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটাও টেঁকে না। কারণ, যা এ মুহূর্তে ঘটে নি তা ও মুহূর্তেই বা ঘটে কী করে।

জয়োত্তম।

আরে, ওইটেই তো আমার তর্ক। কে বললে ঘটে? যা পূর্বে ঘটে নি তা কিছুতেই পরে ঘটতে পারে না। আচ্ছা, এসো, কিছু যে ঘটে সেইটে প্রমাণ করে দাও।

পঞ্চক।

(জয়োত্তমের কাঁধে চড়িয়া) প্রমাণ? এই দেখো প্রমাণ। ঘুণ ঘুণ ঘুণাপয় ঘুণাপয়--

জয়োত্তম।

আঃ পঞ্চক! কর কী! নাবো বলছি -- আঃ নাবো।

পঞ্চক।

আমি যে তোমার কাঁধে চড়েছি সেটা প্রমাণ না করে দিলে আমি কিছুতেই নাবছি নে। ঘূণ ঘুণ ঘুণাপয় ঘুণাপয়--

মহাপঞ্চকের প্রবেশ

মহাপঞ্চকের প্রবেশ

মহাপঞ্চক।

পঞ্চক, তুমি বড়ো উৎপাত করছ।

পঞ্চক।

দাদা, এরাই গোল করছিল। আমি আরও থামিয়ে দেবার জন্যেই এসেছি। তট তট তোতয় তোতয় স্ফট স্ফট--

মহাপঞ্চক।

তোমার নিজের কাজ অবহেলা করবার একটা উপলক্ষ জুটলেই তোমাকে সংবরণ করা অসম্ভব।

বিশ্বম্ভর।

দেখুন, একটা জনশ্রুতি শুনতে পাচ্ছি, বর্ষার আরম্ভে আমাদের গুরু নাকি এখানে আসবেন।

মহাপঞ্চক।

আসবেন কি না তা নিয়ে আন্দোলন না করে যদিই আসেন তার জন্যে প্রস্তুত হও।

পঞ্চক।

তিনি যদি আসেন তিনিই প্রস্তুত হবেন। এ দিক থেকে আবার আমরাও প্রস্তুত হতে গেলে হয়তো মিথ্যে একটা গোলমাল হবে।

মহাপঞ্চক।

ভারি বুদ্ধিমানের মতোই কথা বললে!

পঞ্চক।

অন্নের গ্রাস যখন মুখের কাছে এগোয় তখন মুখ স্থির হয়ে সেটা গ্রহণ করে-- এ তো সোজা কথা। আমার ভয় হয়, গুরু এসে হয়তো দেখবেন, আমরা যে দিক দিয়ে প্রস্তুত হতে গিয়েছি সে দিকটা উলটো। সেইজন্যে আমি কিছু করি নে।

মহাপঞ্চক।

পঞ্চক, আবার তর্ক?

পঞ্চক।

তর্ক করতে পারি নে বলে রাগ কর, আবার দেখি পারলেও রাগ'!

মহাপঞ্চক।

যাও তুমি।

পঞ্চক।

যাচ্ছি, কিন্তু বলো-না, গুরু কি সত্যই আসবেন?

মহাপঞ্চক।

তাঁর সময় হলেই তিনি আসবেন

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

সঞ্জীব।

মহাপঞ্চক কোনো কথার শেষ উত্তর দিয়েছেন এমন কখনোই শুনি নি।

জয়োত্তম।

কোনো কথার শেষ উত্তর নেই বলেই দেন না। মূর্খ যারা তারাই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে, যারা অল্প জানে তারাই জবাব দেয়; আর যারা বেশি জানে তারা জানে যে জবাব দেওয়া যায় না।

পঞ্চক।

সেইজন্যেই উপাধ্যায়মশায় যখন শাস্ত্র থেকে প্রশ্ন করেন তোমরা জবাব দাও, কিন্তু আমি একেবারে মূক হয়ে থাকি।

জয়োত্তম।

কিন্তু প্রশ্ন না করতেই যে কথাগুলো বল তাতেই--

পঞ্চক।

হ্যাঁ, তাতেই আমার খ্যাতি রটে গেছে, নইলে কেউ আমাকে চিনতেই পারত না।

বিশ্বম্ভর।

দেখো পঞ্চক, যদি গুরু আসেন তা হলে তোমার জন্যে আমাদের সকলকেই লজ্জা পেতে হবে।

সঞ্জীব।

আটান্ন প্রকার আচমনবিধির মধ্যে পঞ্চক বড়োজোর পাঁচটা প্রকরণ এতদিনে শিখেছে।

পঞ্চক।

সঞ্জীব, আমার মনে আঘাত দিও না। অত্যুক্তি করছ।

সঞ্জীব।

অত্যুক্তি!

পঞ্চক।

অত্যুক্তি নয় তো কী। তুমি বলছ পাঁচটা শিখেছি। আমি দুটোর বেশি একটাও শিখি নি। তৃতীয় প্রকরণে মধ্যমাঙ্গুলির কোন্‌ পর্বটা কতবার কতখানি জলে ডুবোতে হবে সেটা ঠিক করতে গিয়ে অন্য আঙুলের অস্তিত্বই ভুলে যাই। কেবল একমাত্র বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটা আমার খুব অভ্যাস হয়ে গেছে। হাসছ কেন। বিশ্বাস করছ না বুঝি?

জয়োত্তম।

বিশ্বাস করা শক্ত।

পঞ্চক।

সেদিন উপাধ্যায়মশায় যখন পরীক্ষা করতে এলেন তখন তাঁকে ওই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ পর্যন্ত দেখিয়ে বিস্মিত করবার চেষ্টায় ছিলুম, কিন্তু তিনি চোখ পাকিয়ে তর্জনী তুললেন, আমার আর এগোল না।

বিশ্বম্ভর।

না পঞ্চক, এবার গুরু আসার জন্যে তোমাকে প্রস্তুত হতে হবে।

পঞ্চক।

পঞ্চক পৃথিবীতে যেমন অপ্রস্তুত হয়ে জন্মেছে তেমনি অপ্রস্তুত হয়েই মরবে। ওর ওই একটি মহদ্‌গুণ আছে, ওর কখনো বদল হয় না।

সঞ্জীব।

তোমার সেই গুণে উপাধ্যায়মশায়কে যে মুগ্ধ করতে পেরেছ তা তো বোধ হয় না।

পঞ্চক।

আমি তাঁকে কত বোঝাবার চেষ্টা করি যে, বিদ্যা সম্বন্ধে আমার একটুও নড়চড় নেই-- ওই যাকে বল ধ্রুবনক্ষত্র-- তাতে সুবিধা এই যে, এখানকার ছাত্ররা কে কতদূর এগোল তা আমার সঙ্গে তুলনা করলেই বোঝা যাবে।

জয়োত্তম।

তোমার আশ্চর্য এই সুযুক্তিতে উপাধ্যায়মশায়ের বোধ হয়--

পঞ্চক।

না, কিছু না -- তাঁর মনে কিছুমাত্র বিকার ঘটল না। আমার সম্বন্ধে পূর্বে তাঁর যে ধারণা ছিল সেইটেই দেখলুম আরো পাকা হল।

সঞ্জীব।

আমরা যদি উপাধ্যায়মশায়কে তোমার মতন অমন যা-তা বলতুম তা হলে রক্ষা থাকত না। কিন্তু পঞ্চকের বেলায়--

পঞ্চক।

তার মানে আছে। কুতর্কটা আমার পক্ষে এমনি সুন্দর স্বাভাবিক যে, সেটা আমার মুখে ভারি মিষ্ট শোনায়। সকলেই খুশি হয়ে বলে, ঠিক হয়েছে, পঞ্চকের মতোই কথা হয়েছে। কিন্তু ঘোরতর বুদ্ধির পরিচয় না দিতে পারলে তোমাদের আদর নেই, এমনি তোমরা হতভাগ্য।

জয়োত্তম।

যাও ভাই পঞ্চক, আর বোকো না। আমরা চললুম। তুমি একটু মন দিয়ে পড়ো

[ তিনজনের প্রস্থান

[ তিনজনের প্রস্থান

পঞ্চক।

হবে না, আমার কিছুই হবে না। এখানকার একটা মন্ত্রও আমার খাটল না।

গান

দূরে কোথায় দূরে দূরে

মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে

যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে

সেই বাঁশিটির সুরে সুরে।

যে পথ সকল দেশ পারায়ে

উদাস হয়ে যায় হারায়ে

সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান

যেতে চায় কোন্‌ অচিন পুরে।

ও কী ও! কান্না শুনি যে! এ নিশ্চয়ই সুভদ্র। আমাদের এই আয়তনে ওর চোখের জল আর শুকোল না। ওর কান্না আমি সইতে পারি নে!

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

বালক সুভদ্রকে লইয়া পঞ্চকের পুনঃপ্রবেশ

বালক সুভদ্রকে লইয়া পঞ্চকের পুনঃপ্রবেশ

পঞ্চক।

তোর কোনো ভয় নেই ভাই, কোনো ভয় নেই। তুই আমার কাছে বল্‌, কী হয়েচে বল্‌।

সুভদ্র।

আমি পাপ করেছি।

পঞ্চক।

পাপ করেছিস? কী পাপ?

সুভদ্র।

সে আমি বলতে পারব না! ভয়ানক পাপ। আমার কী হবে!

পঞ্চক।

তোর সব পাপ আমি কেড়ে নেব, তুই বল্‌।

সুভদ্র।

আমি আমাদের আয়তনের উত্তর দিকের --

পঞ্চক।

উত্তর দিকের?

সুভদ্র।

হাঁ, উত্তর দিকের জানলা খুলে--

পঞ্চক।

জানলা খুলে কী করলি?

সুভদ্র।

বাইরেটা দেখে ফেলেছি!

পঞ্চক।

দেখে ফেলেছিস? শুনে লোভ হচ্ছে যে!

সুভদ্র।

হাঁ পঞ্চকদাদা। কিন্তু বেশিক্ষণ না-- একবার দেখেই তখনই বন্ধ করে ফেলেছি। কোন্‌ প্রায়শ্চিত্ত করলে আমার পাপ যাবে।

পঞ্চক।

ভুলে গেছি ভাই। প্রায়শ্চিত্ত বিশ-পঁচিশ হাজার রকম আছে। আমি যদি এই আয়তনে না আসতুম তা হলে তার বারো আনাই কেবল পুঁথিতে লেখা থাকত; আমি আসার পর প্রায় তার সব-কটাই ব্যবহারে লাগাতে পেরেছি, কিন্তু মনে রাখতে পারি নি।

বালকদলের প্রবেশ

বালকদলের প্রবেশ

প্রথম বালক।

অ্যাঁ, সুভদ্র! তুমি বুঝি এখানে?

দ্বিতীয় বালক।

জান পঞ্চকদাদা, সুভদ্র কী ভয়ানক পাপ করেছে।

পঞ্চক।

চুপ চুপ। ভয় নেই সুভদ্র। কাঁদছিস কেন ভাই। প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় তো করবি। প্রায়শ্চিত্ত করতে ভারি মজা। এখানে রোজই একঘেয়ে রকমের দিন কাটে, প্রায়শ্চিত্ত না থাকলে তো মানুষ টিঁকতেই পারত না।

প্রথম বালক।

(চুপি চুপি) জান পঞ্চকদাদা, সুভদ্র উত্তর দিকের জানলা--

পঞ্চক।

আচ্ছা আচ্ছা, সুভদ্রের মতো তোদের অমন সাহস আছে?

দ্বিতীয় বালক।

আমাদের আয়তনের উত্তর দিকটা যে একজটা দেবীর।

তৃতীয় বালক।

সে দিক থেকে আমাদের আয়তনে যদি একটুও হাওয়া ঢোকে তা হলে যে সে --

পঞ্চক।

তা হলে কী?

তৃতীয় বালক।

সে যে ভয়ানক।

পঞ্চক।

কী ভয়ানক, শুনিই-না।

তৃতীয় বালক।

জানি নে, কিন্তু সে ভয়ানক।

সুভদ্র।

পঞ্চকদাদা, আমি আর কখনো খুলব না পঞ্চকদাদা। আমার কী হবে।

পঞ্চক।

শোন্‌ বলি সুভদ্র, কিসে কী হয় আমি ভাই কিছুই জানি নে। কিন্তু যাই হোক-না, আমি তাতে একটুও ভয় করি নে।

সুভদ্র।

ভয় কর না?

সকল ছেলে।

ভয় কর না?

পঞ্চক।

না। আমি তো বলি, দেখিই-না কী হয়।

সকলে।

(কাছে ঘেঁষিয়া) আচ্ছা দাদা, তুমি বুঝি অনেক দেখেছ?

পঞ্চক।

দেখেছি বইকি। ও মাসে শনিবারে যেদিন মহাময়ূরী দেবীর পূজা পড়ল সেদিন আমি কাঁসার থালায় ইঁদুরের গর্তের মাটি রেখে তার উপর পাঁচটা শেয়ালকাঁটার পাতা আর তিনটে মাষকলাই সাজিয়ে নিজে আঠারো বার ফুঁ দিয়েছি।

সকলে।

অ্যাঁ! কী ভয়ানক! আঠারো বার!

সুভদ্র।

পঞ্চকদাদা, তোমার কী হল।

পঞ্চক।

তিনদিনের দিনে যে সাপটা এসে আমাকে নিশ্চয় কামড়াবে কথা ছিল সে আজ পর্যন্ত আমাকে খুঁজে বের করতে পারে নি।

প্রথম বালক।

কিন্তু ভয়ানক পাপ করেছ তুমি।

দ্বিতীয় বালক।

মহাময়ূরী দেবী ভয়ানক রাগ করেছেন।

পঞ্চক।

তাঁর রাগটা কিরকম সেইটে দেখবার জন্যেই তো এ কাজ করেছি।

সুভদ্র।

কিন্তু পঞ্চকদাদা, যদি তোমাকে সাপে কামড়াত।

পঞ্চক।

তা হলে এ সম্বন্ধে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোথাও কোনো সন্দেহ থাকত না।

প্রথম বালক।

কিন্তু পঞ্চকদাদা, আমাদের উত্তর দিকের

জানলাটা--

পঞ্চক।

সেটাও আমাকে একবার খুলে দেখতে হবে স্থির করেছি।

সুভদ্র।

তুমিও খুলে দেখবে?

পঞ্চক।

হাঁ ভাই সুভদ্র, তা হলে তুই তোর দলের একজন পাবি।

প্রথম বালক।

না পঞ্চকদাদা, পায়ে পড়ি পঞ্চকদাদা, তুমি--

পঞ্চক।

কেন রে, তোদের তাতে ভয় কী?

দ্বিতীয় বালক।

সে যে ভয়ানক।

পঞ্চক।

ভয়ানক না হলে মজা কিসের?

তৃতীয় বালক।

সে যে ভয়ানক পাপ।

প্রথম বালক।

মহাপঞ্চকদাদা আমাদের বলে দিয়েছেন, ওতে মাতৃহত্যার পাপ হয়; কেননা উত্তর দিকটা যে একজটা দেবীর।

পঞ্চক।

মাতৃহত্যা করলুম না অথচ মাতৃহত্যার পাপটা করলুম, সেই মজাটা কিরকম দেখতে আমার ভয়ানক কৌতূহল।

প্রথম বালক।

তোমার ভয় করবে না?

পঞ্চক।

কিছু না। ভাই সুভদ্র, তুই কী দেখলি বল্‌ দেখি।

দ্বিতীয় বালক।

না না, বলিস নে।

তৃতীয় বালক।

না, সে আমরা শুনতে পারব না-- কী ভয়ানক!

প্রথম বালক।

আচ্ছা, একটু, খুব একটুখানি বল্‌ ভাই।

সুভদ্র।

আমি দেখলুম-- সেখানে পাহাড়, গোরু চরছে--

বালকগণ।

(কানে আঙুল দিয়া) ও বাবা! না না, আর শুনব না। আর বোলো না সুভদ্র। ওই যে উপাধ্যায়মশায় আসছেন। চলো চলো-- আর না।

পঞ্চক।

কেন। এখন তোমাদের কী।

প্রথম বালক।

বেশ, তাও জান না বুঝি। আজ যে পূর্বফাল্গুনী নক্ষত্র--

পঞ্চক।

তাতে কী।

দ্বিতীয় বালক।

আজ কাকিনী সরোবরের নৈঋa-কোণে ঢোঁড়াসাপের খোলস খুঁজতে হবে না?

পঞ্চক।

কেন রে।

প্রথম বালক।

তুমি কিছু জান না পঞ্চকদাদা! সেই খোলস কালো রঙের ঘোড়ার লেজের সাতগাছি চুল দিয়ে বেঁধে পুড়িয়ে ধোঁয়া করতে হবে যে।

দ্বিতীয় বালক।

আজ যে পিতৃপুরুষেরা সেই ধোঁয়া ঘ্রাণ করতে আসবেন।

পঞ্চক।

তাতে তাঁদের কষ্ট হবে না?

প্রথম বালক।

পুণ্য হবে যে, ভয়ানক পুণ্য

[বালকগণের প্রস্থান

[বালকগণের প্রস্থান

উপাধ্যায়ের প্রবেশ

উপাধ্যায়ের প্রবেশ

উপাধ্যায়।

পঞ্চককে শিশুদের দলেই প্রায় দেখতে পাই।

পঞ্চক।

এই আয়তনে ওদের সঙ্গেই আমার বুদ্ধির একটু মিল হয়। ওরা একটু বড়ো হলেই আর তখন--

উপাধ্যায়।

কিন্তু তোমার সংসর্গে যে ওরা অসংযত হয়ে উঠছে। সেদিন পটুবর্ম আমার কাছে এসে নালিশ করেছে, শুক্রবারের প্রথম প্রহরেই উপতিষ্য তার গায়ের উপর হাই তুলে দিয়েছে।

পঞ্চক।

তা দিয়েছে বটে। আমি স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিলুম।

উপাধ্যায়।

সে আমি অনুমানেই বুঝেছি, নইলে এতবড়ো আয়ুক্ষয়কর অনিয়মটা ঘটবে কেন। শুনেছি, তুমি নাকি সকলের সাহস বাড়িয়ে দেবার জন্য পটুবর্মকে ডেকে তোমার গায়ের উপর এক শো বার হাই তুলতে বলেছিলে?

পঞ্চক।

আপনি ভুল শুনেছেন।

উপাধ্যায়।

ভুল শুনেছি?

পঞ্চক।

একলা পটুবর্মকে নয়, সেখানে যত ছেলে ছিল প্রত্যেককেই আমার গায়ের উপর অন্তত দশটা করে হাই তুলে যাবার জন্যে ডেকেছিলুম-- পক্ষপাত করি নি।

উপাধ্যায়।

প্রত্যেককেই ডেকেছিলে?

পঞ্চক।

প্রত্যেককেই। আপনি বরঞ্চ জিজ্ঞাসা করে জানবেন। কেউ সাহস করে এগোল না। তারা হিসেব করে দেখলে, পনেরো জন ছেলেতে মিলে দেড় শো হাই তুললে তাতে আমার সমস্ত আয়ু ক্ষয় হয়ে গিয়েও আরো অনেকটা বাকি থাকে, সেই উদ্‌বৃত্তটাকে নিয়ে যে কী হবে তাই স্থির করতে না পেরে তারা মহাপঞ্চকদাদাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে গেল, তাতেই তো আমি ধরা পড়ে গেছি।

উপাধ্যায়।

দেখো, তুমি মহাপঞ্চকের ভাই বলে এতদিন অনেক সহ্য করেছি, কিন্তু আর চলবে না। আমাদের গুরু আসছেন শুনেছ?

পঞ্চক।

গুরু আসছেন? নিশ্চয় সংবাদ পেয়েছেন?

উপাধ্যায়।

হাঁ। কিন্তু এতে তোমার উৎসাহের তো কোনো কারণ নেই।

পঞ্চক।

আমারই তো গুরুর দরকার বেশি, আমার যে কিছুই শেখা হয় নি।

সুভদ্রের প্রবেশ

সুভদ্রের প্রবেশ

সুভদ্র।

উপাধ্যায়মশায়।

পঞ্চক।

আরে, পালা পালা। উপাধ্যায়মশায়ের কাছ থেকে একটু পরমার্থতত্ত্ব শুনছি, এখন বিরক্ত করিস নে, একেবারে দৌড়ে পালা।

উপাধ্যায়।

কী সুভদ্র, তোমার বক্তব্য কী শীঘ্র বলে যাও।

সুভদ্র।

আমি ভয়ানক পাপ করেছি।

পঞ্চক।

ভারি পণ্ডিত কিনা! পাপ করেছি! পালা বলছি।

উপাধ্যায়।

(উৎসাহিত হইয়া) ওকে তাড়া দিচ্ছ কেন। সুভদ্র, শুনে যাও।

পঞ্চক।

আর রক্ষা নেই, পাপের একটুকু গন্ধ পেলে একেবারে মাছির মতো ছোটে।

উপাধ্যায়।

কী বলছিলে?

সুভদ্র।

আমি পাপ করেছি।

উপাধ্যায়।

পাপ করেছ? আচ্ছা বেশ। তা হলে বোসো। শোনা যাক।

সুভদ্র।

আমি আয়তনের উত্তর দিকের--

উপাধ্যায়।

বলো, বলো, উত্তর দিকের দেওয়ালে আঁক কেটেছ?

সুভদ্র।

না, আমি উত্তর দিকের জানলায়--

উপাধ্যায়।

বুঝেছি, কুনুই ঠেকিয়েছ। তা হলে তো সেদিকে আমাদের যতগুলি যজ্ঞের পাত্র আছে সমস্তই ফেলা যাবে। সাত মাসের বাছুরকে দিয়ে ওই জানলা না চাটাতে পারলে শোধন হবে না।

পঞ্চক।

এটা আপনি ভুল বলছেন। ক্রিয়াসংগ্রহে আছে ভূমিকুষ্মাণ্ডের বোঁটা দিয়ে একবার--

উপাধ্যায়।

তোমার তো স্পর্ধা কম দেখি নে। কুলদত্তের ক্রিয়াসংগ্রহের অষ্টাদশ অধ্যায়টি কি কোনোদিন খুলে দেখা হয়েছে?

পঞ্চক।

(জনান্তিকে) সুভদ্র, যাও তুমি।-- কিন্তু কুলদত্তকে তো আমি--

উপাধ্যায়।

কুলদত্তকে মান না? আচ্ছা, ভরদ্বাজ মিশ্রের প্রয়োগপ্রজ্ঞপ্তি তো মানতেই হবে-- তাতে--

সুভদ্র।

উপাধ্যায়মশায়, আমি ভয়ানক পাপ করেছি।

পঞ্চক।

আবার! সেই কথাই তো হচ্ছে। তুই চুপ কর্‌।

উপাধ্যায়।

সুভদ্র, উত্তরে দেয়ালে যে আঁক কেটেছ সে চতুষ্কোণ, না গোলাকার?

সুভদ্র।

আঁক কাটি নি। আমি জানলা খুলে বাইরে চেয়েছিলুম।

উপাধ্যায়।

(বসিয়া পড়িয়া) আঃ সর্বনাশ! করেছিস কী! আজ তিন-শ পঁয়তাল্লিশ বছর ওই জানলা কেউ খোলে নি তা জানিস?

সুভদ্র।

আমার কী হবে।

পঞ্চক।

(সুভদ্রকে আলিঙ্গন করিয়া) তোমার জয়জয়কার হবে সুভদ্র। তিনশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের আগল তুমি ঘুচিয়েছ। তোমার এই অসামান্য সাহস দেখে উপাধ্যায়মশায়ের মুখে আর কথা নেই।

[ সুভদ্রকে টানিয়া লইয়া প্রস্থান

[ সুভদ্রকে টানিয়া লইয়া প্রস্থান

উপাধ্যায়।

জানি নে কী সর্বনাশ হবে। উত্তরের অধিষ্ঠাত্রী যে একজটা দেবী। বালকের দুই চক্ষু মুহূর্তেই পাথর হয়ে গেল না কেন তাই ভাবছি। যাই, আচার্যদেবকে জানাই গে।

[প্রস্থান

[প্রস্থান

আচার্য ও উপাচার্যের প্রবেশ

আচার্য ও উপাচার্যের প্রবেশ

আচার্য।

এতকাল পরে আমাদের গুরু আসছেন।

উপাচার্য।

তিনি প্রসন্ন হয়েছেন।

আচার্য।

প্রসন্ন হয়েছেন? তা হবে। হয়তো প্রসন্নই হয়েছেন। কিন্তু কেমন করে জানব?

উপাচার্য।

নইলে তিনি আসবেন কেন?

আচার্য।

এক-এক সময়ে মনে ভয় হয় যে, হয়তো অপরাধের মাত্রা পূর্ণ হয়েছে বলেই তিনি আসছেন।

উপাচার্য।

না, আচার্যদেব, এমন কথা বলবেন না। আমরা কঠোর নিয়ম সমস্তই নিঃশেষে পালন করেছি -- কোনো ত্রুটি ঘটে নি।

আচার্য।

কঠোর নিয়ম? হাঁ, সমস্তই পালিত হয়েছে।

উপাচার্য।

বজ্রশুদ্ধিব্রত আমাদের আয়তনে এইবার নিয়ে ঠিক সাতাত্তর বার পূর্ণ হয়েছে। আর কোনো আয়তনে এ কি সম্ভবপর হয়।

আচার্য।

না, আর কোথাও হতে পারে না।

উপাচার্য।

কিন্তু তবু আপনার মনে এমন দ্বিধা হচ্ছে কেন।

আচার্য।

দ্বিধা? তা দ্বিধা হচ্ছে সে কথা স্বীকার করি। (কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া) দেখো সূতসোম, অনেক দিন থেকে মনের মধ্যে বেদনা জেগে উঠছে, কাউকে বলতে পারছি নে। আমি এই আয়তনের আচার্য; আমার মনকে যখন কোনো সংশয় বিদ্ধ করতে থাকে তখন একলা চুপ করে বহন করতে হয়। এতদিন তাই বহন করে এসেছি। কিন্তু যেদিন পত্র পেয়েছি গুরু আসছেন সেই দিন থেকে মনকে আর যেন চুপ করিয়ে রাখতে পারছি নে। সে কেবলই আমাদের প্রতিদিনের সকল কাজেই বলে বলে উঠছে-- বৃথা, বৃথা, সমস্তই বৃথা।

উপাচার্য।

আচার্যদেব, বলেন কী। বৃথা, সমস্তই বৃথা?

আচার্য।

সূতসোম, আমরা এখানে কতদিন হল এসেছি মনে পড়ে কি? কত বছর হবে?

উপাচার্য।

সময় ঠিক করে বলা বড়ো কঠিন। এখানে মনের পক্ষে প্রাচীন হয়ে উঠতে বয়সের দরকার হয় না। আমার তো মনে হয় আমি জন্মের বহু পূর্ব হতেই এখানে স্থির হয়ে বসে আছি।

আচার্য।

দেখো সূতসোম, প্রথম যখন এখানে সাধনা আরম্ভ করেছিলুম তখন নবীন বয়স, তখন আশা ছিল সাধনার শেষে একটা-কিছু পাওয়া যাবে। সেইজন্যে সাধনা যতই কঠিন হচ্ছিল উৎসাহ আরো বেড়ে উঠছিল। তার পরে সেই সাধনার চক্রে ঘুরতে ঘুরতে একেবারেই ভুলে বসেছিলুম যে, সিদ্ধি বলে কিছু-একটা আছে। আজ গুরু আসবেন শুনে হঠাৎ মনটা থমকে দাঁড়াল-- আজ নিজেকে জিজ্ঞাসা করলুম, ওরে পণ্ডিত, তোর সব শাস্ত্রই তো পড়া হল, সব ব্রতই তো পালন করলি, এখন বল্‌ মূর্খ, কী পেয়েছিস। কিছু না কিছু না, সূতসোম। আজ দেখছি-- এই অতিদীর্ঘকালের সাধনা কেবল আপনাকেই আপনি প্রদক্ষিণ করেছে-- কেবল প্রতিদিনের অন্তহীন পুনরাবৃত্তি রাশীকৃত হয়ে জমে উঠেছে।

উপাচার্য।

বোলো না, বোলো না, এমন কথা বোলো না। আচার্যদেব, আজ কেন হঠাৎ তোমার মন এত উদ্‌ভ্রান্ত হল!

আচার্য।

সূতসোম, তোমার মনে কি তুমি শান্তি পেয়েছ?

উপাচার্য।

আমার তো একমুহূর্তের জন্যে অশান্তি নেই।

আচার্য।

অশান্তি নেই?

উপাচার্য।

কিছুমাত্র না। আমার অহোরাত্র একেবারে নিয়মে বাঁধা। সে হাজার বছরের বাঁধন। ক্রমেই সে পাথরের মতো বজ্রের মতো শক্ত হয়ে জমে গেছে। এক মুহূর্তের জন্যেও কিছু ভাবতে হয় না। এর চেয়ে আর শান্তি কী হতে পারে?

আচার্য।

না না, তবে আমি ভুল করছিলুম সূতসোম, ভুল করছিলুম। যা আছে এই ঠিক, এইই ঠিক। যে ক'রেই হোক এর মধ্যে শান্তি পেতেই হবে।

উপাচার্য।

সেইজন্যেই তো অচলায়তন ছেড়ে আমাদের কোথাও বেরোনো নিষেধ। তাতে যে মনের বিক্ষেপ ঘটে -- শান্তি চলে যায়।

আচার্য।

ঠিক, ঠিক -- ঠিক বলেছ সূতসোম। অচেনার মধ্যে গিয়ে কোথায় তার অন্ত পাব? এখানে সমস্তই জানা, সমস্তই অভ্যস্ত-- এখানকার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এখানকারই সমস্ত শাস্ত্রের ভিতর থেকে পাওয়া যায়-- তার জন্যে একটুও বাইরে যাবার দরকার হয় না। এই তো নিশ্চল শান্তি। গুরু, তুমি যখন আসবে, কিছু সরিয়ো না, কিছু আঘাত কোরো না-- চারি দিকেই আমাদের শান্তি, সেই বুঝে পা ফেলো। দয়া কোরো, দয়া কোরো আমাদের। আমাদের পা আড়ষ্ট হয়ে গেছে, আমাদের আর চলবার শক্তি নেই। অনেক বৎসর অনেক যুগ যে এমনি করেই কেটে গেল-- প্রাচীন, প্রাচীন, সমস্ত প্রাচীন হয়ে গেছে-- আজ হঠাৎ বোলো না যে নূতনকে চাই-- আমাদের আর সময় নেই।

উপাচার্য।

আচার্যদেব, তোমাকে এমন বিচলিত হতে কখনো দেখি নি।

আচার্য।

কী জানি, আমার কেমন মনে হচ্ছে কেবল একলা আমিই না, চারি দিকে সমস্তই বিচলিত হয়ে উঠেছে। আমার মনে হচ্ছে আমাদের এখানকার দেয়ালের প্রত্যেক পাথরটা পর্যন্ত বিচলিত। তুমি এটা অনুভব করতে পারছ না সূতসোম?

উপাচার্য।

কিছুমাত্র না। এখানকার অটল স্তব্ধতার লেশমাত্র বিচ্যুতি দেখতে পাচ্ছি নে। আমাদের তো বিচলিত হবার কথাও না। আমাদের সমস্ত শিক্ষা কোন্‌ কালে সমাধা হয়ে গেছে। আমাদের সমস্ত লাভ সমাপ্ত, সমস্ত সঞ্চয় পর্যাপ্ত।

আচার্য।

আজ আমার একটু একটু মনে পড়ছে বহুপূর্বে সবপ্রথমে সেই ভোরের বেলা অন্ধকার থাকতে থাকতে যাঁর কাছে শিক্ষা আরম্ভ করেছিলুম তিনি গুরুই-- তিনি পুঁথি নন, শাস্ত্র নন, বৃত্তি নন, তিনি গুরু। তিনি যা ধরিয়ে দিলেন তাই নিয়ে আরম্ভ করলুম-- এতদিন মনে করে নিশ্চিন্ত ছিলুম সেইটেই বুঝি আছে, ঠিক চলছে-- কিন্তু--

উপাচার্য।

ঠিক আছে, ঠিক চলছে আচার্যদেব, ভয় নেই। প্রভু, আমাদের এখানে সেই প্রথম উষার বিশুদ্ধ অন্ধকারকে হাজার বছরেও নষ্ট হতে দিই নি। তারই পবিত্র অস্পষ্ট ছায়ার মধ্যে আমরা আচার্য এবং ছাত্র, প্রবীণ এবং নবীন, সকলেই স্থির হয়ে বসে আছি। তুমি কি বলতে চাও এতদিন পরে কেউ এসে সেই আমাদের ছায়া নাড়িয়ে দিয়ে যাবে! সর্বনাশ! সেই ছায়া!

আচার্য।

সর্বনাশই তো!

উপাচার্য।

তা হলে হবে কী! এতদিন যারা স্তব্ধ হয়ে আছে তাদের কি আবার উঠতে হবে?

আচার্য।

আমি তো তাই সামনে দেখছি। সে কি আমার স্বপ্ন! অথচ আমার তো মনে হচ্ছে এই-সমস্তই স্বপ্ন-- এই পাথরের প্রাচীর, এই বন্ধ দরজা, এইসব নানা রেখার গণ্ডি, এই স্তূপাকার পুঁথি, এই অহোরাত্র মন্ত্রপাঠের গুঞ্জনধ্বনি-- সমস্তই স্বপ্ন।

উপাচার্য।

ওই-যে পঞ্চক আসছে। পাথরের মধ্যে কি ঘাস বেরোয়। এমন ছেলে আমাদের আয়তনে কী করে সম্ভব হল! শিশুকাল থেকেই ওর ভিতর এমন-একটা প্রবল অনিয়ম আছে, তাকে কিছুতেই দমন করা গেল না। ঐ বালককে আমার ভয় হয়। ঐ আমাদের দুর্লক্ষণ। এই আয়তনের মধ্যে ও কেবল তোমাকেই মানে। তুমি ওকে একটু ভর্ৎসনা করে দিয়ো।

আচার্য।

আচ্ছা, তুমি যাও। আমি ওর সঙ্গে একটু নিভৃতে কথা কয়ে দেখি

[ উপাচার্যের প্রস্থান

[ উপাচার্যের প্রস্থান

পঞ্চকের প্রবেশ

পঞ্চকের প্রবেশ

আচার্য।

(পঞ্চকের গায়ে হাত দিয়া) বৎস পঞ্চক!

পঞ্চক।

করলেন কী! আমাকে ছুঁলেন?

আচার্য।

কেন, বাধা কী আছে?

পঞ্চক।

আমি যে আচার রক্ষা করতে পারি নি।

আচার্য।

কেন পার নি বৎস?

পঞ্চক।

প্রভু, কেন, তা আমি বলতে পারি নে। আমার পারবার উপায় নেই।

আচার্য।

সৌম্য, তুমি তো জান, এখানকার যে নিয়ম সেই নিয়মকে আশ্রয় করে হাজার বছর হাজার হাজার লোক নিশ্চিন্ত আছে। আমরা যে খুশি তাকে কি ভাঙতে পারি?

পঞ্চক।

আচার্যদেব, যে নিয়ম সত্য তাকে ভাঙতে না দিলে তার যে পরীক্ষা হয় না।

আচার্য।

নিয়মের জন্য ভয় নয়, কিন্তু যে লোক ভাঙতে যাবে তারই বা দুর্গতি ঘটতে দেব কেন?

পঞ্চক।

আমি কোনো তর্ক করব না। আপনি নিজমুখে যদি আদেশ করেন যে, আমাকে সমস্ত নিয়ম পালন করতেই হবে তা হলে পালন করব। আমি আচার-অনুষ্ঠান কিছুই জানি নে, আমি আপনাকেই জানি।

আচার্য।

আদেশ করব-- তোমাকে! সে আর আমার দ্বারা হয়ে উঠবে না।

পঞ্চক।

কেন আদেশ করবেন না প্রভু।

আচার্য।

কেন। বলব বৎস? তোমাকে যখন দেখি আমি মুক্তিকে যেন চোখে দেখতে পাই। এত চাপেও যখন দেখলুম তোমার মধ্যে প্রাণ কিছুতেই মরতে চায় না তখনই আমি প্রথম বুঝতে পারলুম মানুষের মন মন্ত্রের চেয়ে সত্য, হাজার বছরের অতিপ্রাচীন আচারের চেয়ে সত্য। যাও বৎস, তোমার পথে তুমি যাও। আমাকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা কোরো না।

পঞ্চক।

আচার্যদেব, আপনি জানেন না কিন্তু আপনিই আমাকে নিয়মের চাকার নীচে থেকে টেনে নিয়েছেন।

আচার্য।

কেমন করে বৎস?

পঞ্চক।

তা জানি নে, কিন্তু আপনি আমাকে এমন একটা-কিছু দিয়েছেন যা আচারের চেয়ে নিয়মের চেয়ে অনেক বেশি।

আচার্য।

তুমি কী কর না কর আমি কোনোদিন জিজ্ঞাসা করি নে, কিন্তু আজ একটি কথা জিজ্ঞাসা করব। তুমি কি অচলায়তনের বাইরে গিয়ে শোণপাংশু-জাতির সঙ্গে মেশ।

পঞ্চক।

আপনি কি এর উত্তর শুনতে চান?

আচার্য।

না না, থাক্‌, বোলো না। কিন্তু শোণপাংশুরা যে অত্যন্ত ম্লেচ্ছ। তাদের সহবাস কি--

পঞ্চক।

তাদের সম্বন্ধে আপনার কি কোনো বিশেষ আদেশ আছে।

আচার্য।

না না, আদেশ আমার কিছুই নেই। যদি ভুল করতে হয় তবে ভুল করো গে-- তুমি ভুল করো গে-- আমাদের কথা শুনো না। আমাদের গুরু আসছেন পঞ্চক-- তাঁর কাছে তোমার মতো বালক হয়ে যদি বসতে পারি-- তিনি যদি আমার জরার বন্ধন খুলে দেন, আমাকে ছেড়ে দেন, তিনি যদি অভয় দিয়ে বলেন আজ থেকে ভুল করে করে সত্য জানবার অধিকার তোমাকে দিলুম, আমার মনের উপর থেকে হাজার দু-হাজার বছরের পুরাতন ভার যদি তিনি নামিয়ে দেন!

পঞ্চক।

ঐ উপাচার্য আসছেন -- বোধ করি কাজের কথা আছে-- বিদায় হই

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

উপাধ্যায় ও উপাচার্যের প্রবেশ

উপাধ্যায় ও উপাচার্যের প্রবেশ

উপাচার্য।

(উপাধ্যায়ের প্রতি) আচার্যদেবকে তো বলতেই হবে। উনি নিতান্ত উদ্‌বিগ্ন হবেন-- কিন্তু দায়িত্ব যে ওঁরই।

আচার্য।

উপাধ্যায়, কোনো সংবাদ আছে নাকি?

উপাধ্যায়।

অত্যন্ত মন্দ সংবাদ।

আচার্য।

অতএব সেটা সত্বর বলা উচিত।

উপাচার্য।

উপাধ্যায়, কথাটা বলে ফেলো। এদিকে প্রতিকারের সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের গ্রহাচার্য বলছেন আজ তিন প্রহর সাড়ে তিন দণ্ডের মধ্যে দ্ব্যাত্মকচরাংশলগ্নে যা-কিছু করবার সময়-- সেটা অতিক্রম করলেই গোপরিক্রমণ আরম্ভ হবে, তখন প্রায়শ্চিত্তের কেবল এক পাদ হবে বিপ্র, অর্ধ পাদ বৈশ্য, বাকি সমস্তটাই শূদ্র।

উপাধ্যায়।

আচার্যদেব, সুভদ্র আমাদের আয়তনের উত্তর দিকের জানলা খুলে বাইরে দৃষ্টিপাত করেছে।

আচার্য।

উত্তর দিকটা তো একজটা দেবীর।

উপাধ্যায়।

সেই তো ভাবনা। আমাদের আয়তনের মন্ত্রঃপূত রুদ্ধ বাতাসকে সেখানকার হাওয়া কতটা দূর পর্যন্ত আক্রমণ করেছে বলা তো যায় না।

উপাচার্য।

এখন কথা হচ্ছে এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত কী।

আচার্য।

আমার তো স্মরণ হয় না। উপাধ্যায় বোধ করি--

উপাধ্যায়।

না, আমিও তো মনে আনতে পারি নে। আজ তিনশ বছর এ প্রায়শ্চিত্তটার প্রয়োজন হয় নি-- সবাই ভুলেই গেছে। ওই-যে মহাপঞ্চক আসছে-- যদি কারো জানা থাকে তো সে ওর।

মহাপঞ্চকের প্রবেশ

মহাপঞ্চকের প্রবেশ

উপাধ্যায়।

মহাপঞ্চক, সব শুনেছ বোধ করি।

মহাপঞ্চক।

সেইজন্যেই তো এলুম; আমরা এখন সকলেই অশুচি, বাহিরের হাওয়া আমাদের আয়তনে প্রবেশ করেছে।

উপাচার্য।

এর প্রায়শ্চিত্ত কী, আমাদের কারো স্মরণ নেই-- তুমিই বলতে পার।

মহাপঞ্চক।

ক্রিয়াকল্পতরুতে এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়

না-- একমাত্র ভগবান জ্বলনানন্তকৃত আধিকর্মিক বর্ষায়ণে লিখছে অপরাধীকে ছয় মাস মহাতামস সাধন করতে হবে।

উপাচার্য।

মহাতামস?

মহাপঞ্চক।

হাঁ, আলোকের এক রশ্মিমাত্র সে দেখতে পাবে না। কেননা আলোকের দ্বারা যে অপরাধ অন্ধকারের দ্বারাই তার ক্ষালন।

উপাচার্য।

তা হলে, মহাপঞ্চক, সমস্ত ভার তোমার উপর রইল।

উপাধ্যায়।

চলো, আমিও তোমার সঙ্গে যাই। ততক্ষণ সুভদ্রকে হিঙ্গুমর্দনকুণ্ডে স্নান করিয়ে আনি গে

আচার্য।

শোনো, প্রয়োজন নেই।

উপাধ্যায়।

কিসের প্রয়োজন নেই?

আচার্য।

প্রায়শ্চিত্তের।

মহাপঞ্চক।

প্রয়োজন নেই বলছেন! আধিকর্মিক বর্ষায়ণ খুলে আমি এখনই দেখিয়ে দিচ্ছি--

আচার্য।

দরকার নেই -- সুভদ্রকে কোনো প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না, আমি আশীর্বাদ করে তার--

মহাপঞ্চক।

এও কি কখনো সম্ভব হয়? যা কোনো শাস্ত্রে নেই আপনি কি তাই--

আচার্য।

না, হতে দেব না, যদি কোনো অপরাধ ঘটে সে আমার। তোমাদের ভয় নেই।

উপাধ্যায়।

এরকম দুর্বলতা তো আপনার কোনোদিন দেখি নি। এই তো সেবার অষ্টাঙ্গশুদ্ধি উপবাসে তৃতীয় রাত্রে বালক কুশলশীল "জল জল' করে পিপাসায় প্রাণত্যাগ করলে কিন্তু তবু তার মুখে যখন এক বিন্দু জল দেওয়া গেল না তখন তো আপনি নীরব হয়ে ছিলেন। তুচ্ছ মানুষের প্রাণ আজ আছে কাল নেই, কিন্তু সনাতন ধর্মবিধি তো চিরকালের।

সুভদ্রকে লইয়া পঞ্চকের প্রবেশ

সুভদ্রকে লইয়া পঞ্চকের প্রবেশ

পঞ্চক।

ভয় নেই সুভদ্র, তোর কোনো ভয় নেই।-- এই শিশুটিকে অভয় দাও প্রভু।

আচার্য।

বৎস, তুমি কোনো পাপ কর নি বৎস, যারা বিনা অপরাধে তোমাকে হাজার হাজার বৎসর ধরে মুখ বিকৃত করে ভয় দেখাচ্ছে পাপ তাদেরই। এসো পঞ্চক।

[ সুভদ্রকে কোলে লইয়া পঞ্চকের সঙ্গে প্রস্থান

[ সুভদ্রকে কোলে লইয়া পঞ্চকের সঙ্গে প্রস্থান

উপাধ্যায়।

এ কী হল উপাচার্যমশায়!

মহাপঞ্চক।

আমরা অশুচি হয়ে রইলুম, আমাদের যাগযজ্ঞ ব্রত-উপবাস সমস্তই পণ্ড হতে থাকল, এ তো সহ্য করা শক্ত।

উপাধ্যায়।

এ সহ্য করা চলবেই না। আচার্য কি শেষে আমাদের ম্লেচ্ছের সঙ্গে সমান করে দিতে চান!

মহাপঞ্চক।

উনি আজ সুভদ্রকে বাঁচাতে গিয়ে সনাতনধর্মকে বিনাশ করবেন! এ কী রকম বুদ্ধিবিকার ওঁর ঘটল! এ অবস্থায় ওঁকে আচার্য বলে গণ্য করাই চলবে না।

উপাচার্য।

সে কি হয়। যিনি একবার আচার্য হয়েছেন তাঁকে কি আমাদের ইচ্ছামতো--

মহাপঞ্চক।

উপাচার্যমশায়, আপনাকেও আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে হবে।

উপাচার্য।

নূতন কিছুতে যোগ দেবার বয়স আমার নয়।

উপাধ্যায়।

আজ বিপদের সময় বয়স-বিচার!

উপাচার্য।

ধর্মকে বাঁচাবার জন্যে যা করবার করো। আমাকে দাঁড়াতে হবে আচার্যদেবের পাশে। আমরা একসঙ্গে এসেছিলুম, যদি বিদায় হবার দিন এসে থাকে তবে একসঙ্গেই বাহির হয়ে যাব।

মহাপঞ্চক।

কিন্তু একটা কথা চিন্তা করে দেখবেন। আচার্যদেবের অভাবে আপনারই আচার্য হবার অধিকার।

উপাচার্য।

মহাপঞ্চক, সেই প্রলোভনে আমি আচার্যদেবের বিরুদ্ধে দাঁড়াব? এ কথা বলবার জন্যে তুমি যে মুখ খুলেছ সে কি এখানকার উত্তর দিকের জানলা খোলার চেয়ে কম পাপ!

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

মহাপঞ্চক।

চলো উপাধ্যায়, আর বিলম্ব নয়। আচার্য অদীনপুণ্য যতক্ষণ এ আয়তনে থাকবেন ততক্ষণ ক্রিয়াকর্ম সমস্ত বন্ধ, ততক্ষণ আমাদের অশৌচ।

১৫ আষাঢ়, ১৩১৮ শিলাইদহ
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7