দর্ভকপল্লী

দর্ভকপল্লী

গান

গান

পঞ্চক।

আমি যে সব নিতে চাই, সব নিতে ধাই রে।

আমি আপনাকে ভাই মেলব যে বাইরে।

পালে আমার লাগল হাওয়া,

হবে আমার সাগর যাওয়া,

ঘাটে তরী নাই বাঁধা নাই রে।

সুখে দুখে বুকের মাঝে

পথের বাঁশি কেবল বাজে,

সকল কাজে শুনি যে তাই রে।

পাগলামি আজ লাগল পাখায়,

পাখি কি আর থাকবে শাখায়?

দিকে দিকে সাড়া যে পাই রে।

আচার্যের প্রবেশ

আচার্যের প্রবেশ

পঞ্চক।

দূরে থেকে নানাপ্রকার শব্দ শুনতে পাচ্ছি আচার্যদেব। অচলায়তনে বোধ হয় খুব সমারোহ চলছে।

আচার্য।

সময় তো হয়েছে। কালই তো তাঁর আসবার কথা ছিল। আমার মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। একবার সূতসোমকে ওখানে পাঠিয়ে দিই।

পঞ্চক।

তিনি আজ একাদশীর তর্পণ করবেন বলে কোথায় ইন্দ্রতৃণ পাওয়া যায় সেই খোঁজে বেরিয়েছেন।

দর্ভকদলের প্রবেশ

দর্ভকদলের প্রবেশ

পঞ্চক।

কী ভাই, তোরা এত ব্যস্ত কিসের?

প্রথম দর্ভক।

শুনছি অচলায়তনে কারা সব লড়াই করতে এসেছে।

আচার্য।

লড়াই কিসের? আজ তো গুরু আসবার কথা।

দ্বিতীয় দর্ভক।

না না, লড়াই হচ্ছে খবর পেয়েছি। সমস্ত ভেঙেচুরে একাকার করে দিলে যে।

তৃতীয় দর্ভক।

বাবাঠাকুর, তোমরা যদি হুকুম কর আমরা যাই ঠেকাই গিয়ে।

আচার্য।

ওখানে তো লোক ঢের আছে, তোমাদের ভয় নেই বাবা।

প্রথম দর্ভক।

লোক তো আছে কিন্তু তারা লড়াই করতে পারবে কেন?

দ্বিতীয় দর্ভক।

শুনেছি কতরকম মন্ত্রলেখা তাগাতাবিজ দিয়ে তারা দুখানা হাত আগাগোড়া কষে বেঁধে রেখেছে। খোলে না, পাছে কাজ করতে গেলেই তাদের হাতের গুণ নষ্ট হয়।

পঞ্চক।

আচার্যদেব, এদের সংবাদটা সত্যই হবে। কাল সমস্ত রাত মনে হচ্ছিল চারদিকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন ভেঙেচুরে পড়ছে। ঘুমের ঘোরে ভাবছিলুম স্বপ্ন বুঝি।

আচার্য।

তবে কি গুরু আসেন নি?

পঞ্চক।

হয়তো বা দাদা ভুল করে আমার গুরুরই সঙ্গে লড়াই বাধিয়ে বসেছেন! আটক নেই। রাত্রে তাঁকে হঠাৎ দেখে হয়তো যমদূত বলে ভুল করেছিলেন।

প্রথম দর্ভক।

আমরা শুনেছি কে বলছিল গুরুও এসেছেন।

আচার্য।

গুরুও এসেছেন! সে কী রকম হল!

পঞ্চক।

তবে লড়াই করতে কারা এসেছে বল্‌ তো?

প্রথম দর্ভক।

লোকের মুখে শুনি তাদের নাকি বলে দাদাঠাকুরের দল।

পঞ্চক।

দাদাঠাকুরের দল! বল্‌ বল্‌ শুনি, ঠিক বলছিস তো রে?

দ্বিতীয় দর্ভক।

হাঁ, সকলেই তো বলছে দাদাঠাকুরের দল।

পঞ্চক।

ওরে কী আনন্দ রে কী আনন্দ!

আচার্য।

একি পঞ্চক, হঠাৎ তুমি এ রকম উন্মত্ত হয়ে উঠলে কেন।

পঞ্চক।

প্রভু, আমার মনের একটা বাসনা ছিল কোনো সুযোগে যদি আমাদের দাদাঠাকুরের সঙ্গে গুরুর মিলন করিয়ে দিতে পারি,

তাহলে দেখে নিই কে হারে কে জেতে!

আচার্য।

পঞ্চক, তোমার কথা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি নে। তুমি দাদাঠাকুর বলছ কাকে?

পঞ্চক।

আচার্যদেব, ওইটে আমার গোপন কথা, অনেকদিন থেকেই মনে রেখে দিয়েছি। এখন তোমাকে বলব না প্রভু, যদি তিনি এসে থাকেন তাহলে একেবারে চোখে চোখে মিলিয়ে দেব।

প্রথম দর্ভক।

বাবাঠাকুর, হুকুম করো, একবার ওদের সঙ্গে লড়ে আসি-- দেখিয়ে দিই এখানে মানুষ আছে।

পঞ্চক।

আয় না ভাই আমিও তোদের সঙ্গে চলব রে।

দ্বিতীয় দর্ভক।

তুমিও লড়বে নাকি ঠাকুর?

পঞ্চক।

হাঁ, লড়ব।

আচার্য।

কী বলছ পঞ্চক! তোমাকে লড়তে কে ডাকছে!

পঞ্চক।

আমার প্রাণ ডাকছে। একটা কিসের মায়াতে মন জড়িয়ে রয়েছে প্রভু। যেন কেবলই স্বপ্ন দেখছি-- আর যতই জোর করছি কিছুতেই জাগতে পারছি নে। কেবল এমন বসে বসে হবে না দেব। একেবারে লড়াইয়ের মাঝখানে গিয়ে পড়তে না পারলে কিছুতেই এ ঘোর কাটবে না।

গান

গান

মালীর প্রবেশ

মালীর প্রবেশ

মালী।

আচার্যদেব, আমাদের গুরু আসছেন।

আচার্য।

বলিস কী! গুরু? তিনি এখানে আসছেন? আমাকে আহ্বান করলেই তো আমি যেতুম।

প্রথম দর্ভক।

এখানে তোমাদের গুরু এলে তাঁকে বসাব কোথায়!

দ্বিতীয় দর্ভক।

বাবাঠাকুর, তুমি এখানে তাঁর বসবার জায়গাকে একটু শোধন করে নাও-- আমরা তফাতে সরে যাই।

আর-একদল দর্ভকের প্রবেশ

আর-একদল দর্ভকের প্রবেশ

প্রথম দর্ভক।

বাবাঠাকুর, এ তোমাদের গুরু নয়-- সে এ পাড়ায় আসবে কেন! এ যে আমাদের গোঁসাই!

দ্বিতীয় দর্ভক।

আমাদের গোঁসাই?

প্রথম দর্ভক।

হাঁরে হাঁ, আমাদের গোঁসাই। এমন সাজ তার আর কখনো দেখি নি। একেবারে চোখ ঝলসে যায়।

তৃতীয় দর্ভক।

ঘরে কী আছে রে ভাই সব বের কর্‌।

দ্বিতীয় দর্ভক।

বনের জাম আছে রে।

চতুর্থ দর্ভক।

আমার ঘরে খেজুর আছে।

প্রথম দর্ভক।

কালো গোরুর দুধ শিগ্‌গির দুয়ে আনো দাদা।

দাদাঠাকুরের প্রবেশ

দাদাঠাকুরের প্রবেশ

আচার্য।

(প্রণাম করিয়া) জয় গুরুজির জয়!

পঞ্চক।

এ কী! এ যে দাদাঠাকুর! গুরু কোথায়?

দর্ভকদল।

গোঁসাইঠাকুর! প্রণাম হই। খবর দিয়ে এলে না কেন? তোমার ভোগ যে তৈরি হয় নি।

দাদাঠাকুর।

কেন ভাই, তোদের ঘরে আজ রান্না চড়ে নি নাকি? তোরাও মন্ত্র নিয়ে উপোস করতে আরম্ভ করেছিস নাকি রে?

প্রথম দর্ভক।

আমরা আজ শুধু মাষকলাই আর ভাত চড়িয়েছি। ঘরে আর কিছু ছিল না।

দাদাঠাকুর।

আমারও তাতেই হয়ে যাবে।

পঞ্চক।

দাদাঠাকুর, আমার ভারি গর্ব ছিল এ রাজ্যে একলা আমিই কেবল চিনি তোমাকে। কারও যে চিনতে আর বাকি নেই।

প্রথম দর্ভক।

ওই তো আমাদের গোঁসাই, পূর্ণিমার দিনে এসে আমাদের পিঠে খেয়ে গেছে, তার পর এই কতদিন পরে দেখা। চল্‌ ভাই, আমাদের যা আছে সব সংগ্রহ করে আনি

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

দাদাঠাকুর।

আচার্য, তুমি এ কী করেছ?

আচার্য।

কী যে করেছি তা বোঝবারও শক্তি আমার নেই। তবে এইটুকু বুঝি-- আমি সব নষ্ট করেছি।

দাদাঠাকুর।

যিনি তোমাকে মুক্তি দেবেন তাঁকেই তুমি কেবল বাঁধবার চেষ্টা করেছ।

আচার্য।

কিন্তু বাঁধতে তো পারি নি ঠাকুর। তাঁকে বাঁধছি মনে করে যতগুলো পাক দিয়েছি সব পাক কেবল নিজের চারিদিকেই জড়িয়েছি। যে হাত দিয়ে সেই বাঁধন খোলা যেতে পারত সেই হাতটা সুদ্ধ বেঁধে ফেলেছি।

দাদাঠাকুর।

যিনি সব জায়গায় আপনি ধরা দিয়ে বসে আছেন তাঁকে একটা জায়গায় ধরতে গেলেই তাঁকে হারাতে হয়।

আচার্য।

তিনি যে আছেন এই খবরটা মনের মধ্যে পৌঁছায় নি বলেই মনে করে বসেছিলুম তাঁকে বুঝি কৌশল করে গড়ে তুলতে হয়। তাই দিনরাত বসে বসে এত ব্যর্থচেষ্টার জাল পাকিয়েছি।

দাদাঠাকুর।

তোমার যে- কারাগারটাতে তোমার নিজেকেই আঁটে না সেইখানে তাঁকে শিকল পরাবার আয়োজন না করে তাঁরই এই খোলা মন্দিরের মধ্যে তোমার আসন পাতবার জন্যে প্রস্তুত হও।

আচার্য।

আদেশ করো প্রভু। ভুল করেছিলুম জেনেও সে ভুল ভাঙতে পারি নি। পথ হারিয়েছি তা জানতুম, যতই চলছি ততই পথ হতে কেবল বেশি দূরে গিয়ে পড়ছি তাও বুঝতে পেরেছিলুম, কিন্তু ভয়ে থামতে পারছিলুম না। এই চক্রে হাজার বার ঘুরে বেড়ানোকেই পথ খুঁজে পাবার উপায় বলে মনে করেছিলুম।

দাদাঠাকুর।

যে- চক্র কেবল অভ্যাসের চক্র, যা কোনো জায়গাতেই নিয়ে যায় না, কেবল নিজের মধ্যেই ঘুরিয়ে মারে, তার থেকেই বের করে সোজা রাস্তায় বিশ্বের সকল যাত্রীর সঙ্গে দাঁড় করিয়ে দেবার জন্যেই আমি আজ এসেছি।

আচার্য।

ধন্য করেছ। কিন্তু এতদিন আস নি কেন প্রভু? আমাদের আয়তনের পাশেই এই দর্ভকপাড়ায় তুমি আনাগোনা করছ আর কত বৎসর হয়ে গেল আমাদের আর দেখা দিলে না!

দাদাঠাকুর।

এদের দেখা দেওয়ার রাস্তা যে সোজা। তোমাদের সঙ্গে দেখা করা তো সহজ করে রাখ নি।

পঞ্চক।

ভালোই করেছি, তোমার শক্তি পরীক্ষা করে নিয়েছি। তুমি আমাদের পথ সহজ করে দেবে কিন্তু তোমার পথ সহজ নয়। এখন, আমি ভাবছি তোমাকে ডাকব কী বলে? দাদাঠাকুর, না গুরু?

দাদাঠাকুর।

যে জানতে চায় না যে আমি তাকে চালাচ্ছি আমি তার দাদাঠাকুর, আর যে আমার আদেশ নিয়ে চলতে চায় আমি তার গুরু।

পঞ্চক।

প্রভু, তুমি তাহলে আমার দুইই। আমাকে আমিই চালাচ্ছি, আর আমাকে তুমিই চালাচ্ছ এই দুটোই আমি মিশিয়ে জানতে চাই। আমি শোণপাংশু না, তোমাকে মেনে চলতে ভয় নেই। তোমার মুখের আদেশকেই আনন্দে আমার মনের ইচ্ছা করে তুলতে পারব। এবার তবে তোমার সঙ্গে তোমারই বোঝা মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ি ঠাকুর।

দাদাঠাকুর।

আমি তোমার জায়গা ঠিক করে রেখেছি।

পঞ্চক।

কোথায় ঠাকুর?

দাদাঠাকুর।

ওই অচলায়তনে।

পঞ্চক।

আবার অচলায়তনে! আমার কারাদণ্ডের মেয়াদ ফুরোয় নি?

দাদাঠাকুর।

কারাগার যা ছিল সে তো আমি ভেঙে ফেলেছি, এখন সেই উপকরণ দিয়ে সেইখানেই তোমাকে মন্দির গেঁথে তুলতে হবে।

পঞ্চক।

ঠাকুর, আমি তোমাকে জোড়হাত করে বলছি, আর আমাকে বসিয়ে রাখার কাজে লাগিয়ো না। তোমার ওই বীরবেশে আমার মন ভুলেছে-- তোমাকে এমন মনোহর আর কখনো দেখি নি।

দাদাঠাকুর।

ভয় নেই পঞ্চক। অচলায়তনে আর সেই শান্তি দেখতে পাবে না। তার দ্বার ফুটো করে দিয়ে আমি তার মধ্যেই লড়াইয়ের ঝোড়ো হাওয়া এনে দিয়েছি। নিজের নাসাগ্রভাগের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বসে থাকবার দিন এখন চিরকালের মতো ঘুচিয়ে দিয়েছি।

পঞ্চক।

কিন্তু অচলায়তনের লোকে যে আমাকে আপন বলে গ্রহণ করবে না প্রভু।

দাদাঠাকুর।

আমি বলছি তুমি অচলায়তনের লোকের সকলের চেয়ে আপন।

পঞ্চক।

কিন্তু দাদাঠাকুর, আমি কেবল একলা, একলা, ওরা আমাকে সবাই ঠেলে রেখে দেবে।

দাদাঠাকুর।

ওরা তোমাকে গ্রহণ করতে চাচ্ছে না, সেইজন্যেই ওখানে তোমার সবচেয়ে দরকার। ওরা তোমাকে ঠেলে দিচ্ছে বলেই তুমি ওদের ঠেলতে পারবে না।

পঞ্চক।

আমাকে কী করতে হবে?

দাদাঠাকুর।

যে যেখানে ছড়িয়ে আছে সবাইকে ডাক দিয়ে আনতে হবে।

পঞ্চক।

সবাইকে কি কুলোবে?

দাদাঠাকুর।

না যদি কুলোয় তাহলে এমনি করে দেয়াল আবার আর-একদিন ভাঙতেই হবে সেই বুঝে গেঁথো-- আমার আর কাজ বাড়িয়ো না।

পঞ্চক।

শোণপাংশুদের--

দাদাঠাকুর ।

হাঁ, ওদেরও ডেকে এনে বসাতে হবে, ওরা একটু বসতে শিখুক।

পঞ্চক।

ওদের বসিয়ে রাখা! সর্বনাশ! তার চেয়ে ওদের ভাঙতে চুরতে দিলে ওরা বেশি ঠাণ্ডা থাকে। ওরা যে কেবল ছটফট করাকেই মুক্তি মনে করে।

দাদাঠাকুর।

ছোটো ছেলেকে পাকা বেল দিলে সে ভারি খুশি হয়ে মনে করে এটা খেলার গোলা। কেবল সেটাকে গড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। ওরাও সেইরকম স্বাধীনতাকে বাইরে থেকে ভারি একটা মজার জিনিস বলে জানে-- কিন্তু জানে না স্থির হয়ে বসে তার ভিতর থেকে সার পদার্থটা বের করে নিতে হয়। কিছুদিনের জন্যে তোমার মহাপঞ্চকদাদার হাতে ওদের ভার দিলেই খানিকটা ঠাণ্ডা হয়ে ওরা নিজের ভিতরের দিকটাতে পাক ধরাবার সময় পাবে।

পঞ্চক।

তাহলে আমার মহাপঞ্চকদাদাকে কি ওইখানেই--

দাদাঠাকুর।

হাঁ ওইখানেই বই কি

তার ওখানে অনেক কাজ। এতদিন ঘর বন্ধ করে অন্ধকারে ও মনে করছিল চাকাটা খুব চলছে, কিন্তু চাকাটা কেবল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘুরছিল তা সে দেখতেও পায় নি। এখন আলোতে তার দৃষ্টি খুলে গেছে, সে আর সে-মানুষ নেই। কী করে আপনাকে আপনি ছাড়িয়ে উঠতে হয় সেইটে শেখাবার ভার ওর উপর। ক্ষুধাতৃষ্ণা-লোভভয়-জীবনমৃত্যুর আবরণ বিদীর্ণ করে আপনাকে প্রকাশ করার রহস্য ওর হাতে আছে।

আচার্য।

আর এই চির-অপরাধীর কী বিধান করলে প্রভু?

দাদাঠাকুর।

তোমাকে আর কাজ করতে হবে না আচার্য। তুমি আমার সঙ্গে এসো।

আচার্য।

বাঁচালে প্রভু, আমাকে রক্ষা করলে। আমার সমস্ত চিত্ত শুকিয়ে পাথর হয়ে গেছে-- আমাকে আমারই এই পাথরের বেড়া থেকে বের করে আনো। আমি কোনো সম্পদ চাই নে-- আমাকে একটু রস দাও।

দাদাঠাকুর।

ভাবনা নেই আচার্য, ভাবনা নেই-- আনন্দের বর্ষা নেমে এসেছে-- তার ঝর ঝর শব্দে মন নৃত্য করছে আমার। বাইরে বেরিয়ে এলেই দেখতে পাবে চারিদিক ভেসে যাচ্ছে। ঘরে বসে ভয়ে কাঁপছে কারা। এ ঘনঘোর বর্ষার কালো মেঘে আনন্দ, তীক্ষ্ন বিদ্যুতে আনন্দ, বজ্রের গর্জনে আনন্দ। আজ মাথার উষ্ণীষ যদি উড়ে যায় তো যাক, গায়ের উত্তরীয় যদি ভিজে যায় তো ভিজে যাক-- আজ দুর্যোগ একে বলে কে! আজ ঘরের ভিত যদি ভেঙে গিয়ে থাকে যাক না-- আজ একেবারে বড়ো রাস্তার মাঝখানে হবে মিলন।

সুভদ্রের প্রবেশ

সুভদ্রের প্রবেশ

সুভদ্র।

গুরু!

দাদাঠাকুর।

কী বাবা?

সুভদ্র।

আমি যে-পাপ করেছি তার তো প্রায়শ্চিত্ত শেষ হল না!

দাদাঠাকুর।

তার আর কিছু বাকি নেই।

সুভদ্র।

বাকি নেই?

দাদাঠাকুর।

না। আমি সমস্ত চুরমার করে ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছি।

সুভদ্র।

একজটা দেবী--

দাদাঠাকুর।

একজটা দেবী! উত্তরের দিকের দেয়ালটা ভাঙবামাত্রই একজটা দেবীর সঙ্গে আমাদের এমনি মিল হয়ে গেল যে, সে আর কোনোদিন জটা দুলিয়ে কাউকে ভয় দেখাবে না। এখন তাকে দেখলে মনে হবে সে আকাশের আলো-- তার সমস্ত জটা আষাঢ়ের নবীন মেঘের মধ্যে জড়িয়ে গিয়েছে।

সুভদ্র।

এখন আমি কী করব।

পঞ্চক।

এখন তুমি আছ ভাই আর আমি আছি। দুজনে মিলে কেবলই উত্তর দক্ষিণ পুব পশ্চিমের সমস্ত দরজা-জানলাগুলো খুলে খুলে বেড়াব।

উপাচার্য।

(প্রবেশ করিয়া) তৃণ পাওয়া গেল না-- কোথাও তৃণ পাওয়া গেল না।

আচার্য।

সূতসোম, তুমি বুঝি তৃণ খুঁজেই বেড়াচ্ছিলে?

উপাচার্য।

হাঁ, ইন্দ্রতৃণ, সে তো কোথাও পাওয়া গেল না। হায় হায়! এখন আমি করি কী! এমন জায়গাতেও মানুষ বাস করে!

আচার্য।

থাক তোমার তৃণ। এদিকে একবার চেয়ে দেখো।

উপাচার্য।

এ কী! এ যে আমাদের গুরু! এখানে! এই দর্ভকদের পাড়ায়! এখন উপায় কী! ওঁকে কোথায়--

দর্ভকগণের অর্ঘ্য লইয়া প্রবেশ

দর্ভকগণের অর্ঘ্য লইয়া প্রবেশ

প্রথম দর্ভক।

গোঁসাই, এই-সব তোমার জন্যে এনেছি। কেতনের মাসি পরশু পিঠে তৈরি করেছিল, তার কিছু বাকি আছে--

উপাচার্য।

আরে আরে, সর্বনাশ করলে রে! করিস কী! উনি যে আমাদের গুরু।

দ্বিতীয় দর্ভক।

তোমাদের গুরু আবার কোথায়? এ তো আমাদের গোঁসাই।

দাদাঠাকুর।

দে ভাই, আর কিছু এনেছিস?

দ্বিতীয় দর্ভক।

হাঁ, জাম এনেছি।

তৃতীয় দর্ভক।

কিছু দই এনেছি।

দাদাঠাকুর।

সব এখানে রাখ্‌। এসো ভাই পঞ্চক, এসো আচার্য অদীনপুণ্য-নূতন আচার্য আর পুরাতন আচার্য এসো, এদের ভক্তির উপহার ভাগ করে নিয়ে আজকের দিনটাকে সার্থক করি।

বালকগণের প্রবেশ

বালকগণের প্রবেশ

সকলে।

গুরু!

দাদাঠাকুর।

এসো বাছা, তোমরা এসো।

প্রথম বালক।

কখন আমরা বের হব?

দাদাঠাকুর।

আর দেরি নেই -- এখনই বের হতে হবে।

দ্বিতীয় বালক।

এখন কী করব?

দাদাঠাকুর।

এই যে তোমাদের ভোগ তৈরি হয়েছে।

প্রথম বালক।

ও ভাই, এই যে জাম-- কী মজা।

দ্বিতীয় বালক।

ওরে ভাই, খেজুর-- কী মজা।

তৃতীয় বালক।

গুরু, এতে কোনো পাপ নেই?

দাদাঠাকুর।

কিছু না-- পূণ্য আছে।

প্রথম বালক।

সকলের সঙ্গে এইখানে বসে খাব?

দাদাঠাকুর।

হাঁ এইখানেই।

শোণপাংশুদলের প্রবেশ

শোণপাংশুদলের প্রবেশ

প্রথম শোণপাংশু।

দাদাঠাকুর।

দ্বিতীয় শোণপাংশু।

আর তো পারি নে। দেয়াল তো একটাও বাকি রাখি নি। এখন কী করব? বসে বসে পা ধরে গেল যে।

দাদাঠাকুর।

ভয় নেই রে। শুধু শুধু বসিয়ে রাখব না। তোদের কাজ দেব।

সকলে।

কী কাজ দেবে?

দাদাঠাকুর।

আমাদের পঞ্চকদাদার সঙ্গে মিলে ভাঙা ভিতের উপর আবার গাঁথতে লেগে যেতে হবে।

সকলে।

বেশ, বেশ, রাজি আছি।

দাদাঠাকুর।

ওই ভিতের উপর কাল যুদ্ধের রাত্রে স্থবিরকের রক্তের সঙ্গে শোণপাংশুর রক্ত মিলে গিয়েছে।

সকলে।

হাঁ মিলেছে।

দাদাঠাকুর।

সেই মিলনেই শেষ করলে চলবে না। এবার আর লাল নয়, এবার একেবারে শুভ্র। নূতন সৌধের সাদা ভিতকে আকাশের আলোর মধ্যে অভ্রভেদী করে দাঁড় করাও। মেলো তোমরা দুইদলে, লাগো তোমাদের কাজে।

সকলে।

তাই লাগব। পঞ্চকদাদা, তাহলে তোমাকে উঠতে হচ্ছে, অমন করে ঠাণ্ডা হয়ে বসে থাকলে চলবে না। ত্বরা করো। আর দেরি না।

পঞ্চক।

প্রস্তুত আছি। গুরু তবে প্রণাম করি। আচার্যদেব আশীর্বাদ করো।

১৫ আষাঢ়, ১৩১৮ শিলাইদহ
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7