শ্রীশ ও বিপিন
গোলদিঘির পথ
শ্রীশ ও বিপিন
শ্রীশ।
ওহে বিপিন, আজ মাঘের শেষে প্রথম বসন্তের বাতাস দিয়েছে, জ্যোৎস্নাও দিব্যি, আজ যদি এখনই ঘুমোতে কিম্বা পড়া মুখস্থ করতে যাওয়া যায় তা হলে দেবতারা ধিক্কার দেবেন।
বিপিন।
তাঁদের ধিক্কার খুব সহজে সহ্য হয়, কিন্তু ব্যামোর ধাক্কা কিম্বা--
শ্রীশ।
দেখো, ঐজন্যে তোমার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়। আমি বেশ জানি দক্ষিনে হাওয়ায় তোমারও প্রাণটা চঞ্চল হয়, কিন্তু পাছে কেউ তোমাকে কবিত্বের অপবাদ দেয় ব'লে মলয়-সমীরণটাকে একেবারেই আমল দিতে চাও না। এতে তোমার বাহাদুরিটা কী জিজ্ঞাসা করি। আমি তোমার কাছে আজ মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করছি, আমার ফুল ভালো লাগে, জ্যোৎস্না ভালো লাগে।
বিপিন।
এবং--
শ্রীশ।
এবং যা-কিছু ভালো লাগবার মতো জিনিস সবই ভালো লাগে।
বিপিন।
বিধাতা তো তোমাকে ভারি আশ্চর্য রকম ছাঁচে গড়েছেন দেখছি।
শ্রীশ।
তোমার ছাঁচ আরো আশ্চর্য। তোমার লাগে ভালো, কিন্তু বল অন্যরকম-- আমার সেই শোবার ঘরের ঘড়িটার মতো-- সে চলে ঠিক, বাজে ভুল।
বিপিন।
কিন্তু শ্রীশ, তোমার যদি সব মনোরম জিনিসই মনোহর লাগতে লাগল তা হলে তো আসন্ন বিপদ।
শ্রীশ।
আমি তো কিছুই বিপদ বোধ করি নে।
বিপিন।
সেই লক্ষণটাই তো সব চেয়ে খারাপ। রোগের যখন বেদনাবোধ চলে যায় তখন আর চিকিৎসার রাস্তা থাকে না। আমি ভাই, স্পষ্টই কবুল করছি, স্ত্রীজাতির একটা আকর্ষণ আছে-- চিরকুমার-সভা যদি সেই আকর্ষণ এড়াতে চান তা হলে তাঁকে খুব তফাত দিয়ে যেতে হবে।
শ্রীশ।
ভুল, ভুল, ভয়ানক ভুল। তুমি তফাতে থাকলে কী হবে, তাঁরা তো তফাতে থাকেন না। সংসাররক্ষার জন্যে বিধাতাকে এত নারী সৃষ্টি করতে হয়েছে যে তাঁদের এড়িয়ে চলা অসম্ভব। অতএব কৌমার্য যদি রক্ষা করতে চাও তা হলে নারীজাতিকে অল্পে অল্পে সইয়ে নিতে হবে। ঐ-যে স্ত্রীসভ্য নেবার নিয়ম হয়েছে, এতদিন পরে কুমার-সভা চিরস্থায়ী হবার উপায় অবলম্বন করেছে। কিন্তু, কেবল একটিমাত্র মহিলা হলে চলবে না বিপিন, অনেকগুলি স্ত্রীসভ্য চাই। বদ্ধ ঘরের একটি জানলা খুলে ঠাণ্ডা লাগালে সর্দি ধরে, খোলা হাওয়ায় থাকলে সে বিপদ নেই।
বিপিন।
আমি তোমার ঐ খোলা-হাওয়া বদ্ধ-হাওয়া বুঝি নে ভাই। যার সর্দির ধাত তাকে সর্দি থেকে রক্ষা করতে দেবতা মনুষ্য কেউ পারে না।
শ্রীশ।
তোমার ধাত কী বলছে হে।
বিপিন।
সে কথা খোলসা করে বললেই বুঝতে পারবে তোমার ধাতের সঙ্গে তার চমৎকার মিল আছে। নাড়িটা যে সব সময়ে ঠিক চিরকুমারের নাড়ির মতো চলে তা জাঁক করে বলতে পারব না।
শ্রীশ।
ঐটে তোমার আর-একটা ভুল। চিরকুমারের নাড়ির উপরে ঊনপঞ্চাশ পবনের নৃত্য হতে দাও-- কোনো ভয় নেই, বাঁধাবাঁধি চাপাচাপি কোরো না। আমাদের মতো ব্রত যাদের তারা কি হৃদয়টিকে তুলো দিয়ে মুড়ে রাখতে পারে। তাকে অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়ার মতো ছেড়ে দাও, যে তাকে বাঁধবে তার সঙ্গে লড়াই করো।
বিপিন।
ও কে হে। পূর্ণ দেখছি। ও বেচারার এ গলি থেকে আর বেরোবার জো নেই। ঐ বীরপুরুষের অশ্বমেধের ঘোড়াটি বেজায় খোঁড়াচ্ছে। ওকে একবার ডাক দেব?
শ্রীশ।
ডাকো। ও কিন্তু আমাদেরই দুজনকে অন্বেষণ করে গলিতে গলিতে ঘুরছে বলে বোধ হচ্ছে না।
বিপিন।
পূর্ণবাবু, খবর কী।
পূর্ণর প্রবেশ
পূর্ণর প্রবেশ
পূর্ণ।
অত্যন্ত পুরোনো। কাল-পরশু যে খবর চলছিল আজও তাই চলছে।
শ্রীশ।
কাল-পরশু শীতের হাওয়া বচ্ছিল, আজ বসন্তের হাওয়া দিয়েছে-- এতে দুটো-একটা নতুন খবরের আশা করা যেতে পারে।
পূর্ণ।
দক্ষিণের হাওয়ায় যে-সব খবরের সৃষ্টি হয় কুমার-সভার খবরের কাগজে তার স্থান নেই। তপোবনে একদিন অকালে বসন্তের হাওয়া দিয়েছিল, তাই নিয়ে কালিদাসের কুমারসম্ভব কাব্য রচনা হয়েছে-- আমাদের কপালগুণে বসন্তের হাওয়ায় কুমার-অসম্ভব কাব্য হয়ে দাঁড়ায়।
বিপিন।
হয় তো হোক-না পূর্ণবাবু-- সে কাব্যে যে দেবতা দগ্ধ হয়েছিলেন এ কাব্যে তাঁকে পুনর্জীবন দেওয়া যাক।
পূর্ণ।
এ কাব্যে চিরকুমার-সভা দগ্ধ হোক। যে দেবতা জ্বলেছিলেন তিনি জ্বালান। না, আমি ঠাট্টা করছি নে শ্রীশবাবু, আমাদের চিরকুমার-সভাটি একটি আস্ত জতুগৃহ-বিশেষ। আগুন লাগলে রক্ষে নেই। তার চেয়ে বিবাহিত সভা স্থাপন করো, স্ত্রীজাতি সম্বন্ধে নিরাপদ থাকবে। যে ইঁট পাঁজায় পুড়েছে তা দিয়ে ঘর তৈরি করলে আর পোড়বার ভয় থাকে না হে।
শ্রীশ।
যে-সে লোক বিবাহ ক'রে বিবাহ জিনিসটা মাটি হয়ে গেছে পূর্ণবাবু। সেইজন্যেই তো কুমার-সভা। আমার যতদিন প্রাণ আছে ততদিন এ সভায় প্রজাপতির প্রবেশ নিষেধ।
বিপিন।
পঞ্চশর?
শ্রীশ।
আসুন তিনি। একবার তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেলে, বাস্, আর ভয় নেই।
পূর্ণ।
দেখো শ্রীশবাবু--
শ্রীশ।
দেখব আর কী। তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। এক চোট দীর্ঘনিশ্বাস ফেলব, কবিতা আওড়াব, কনকবলয়ভ্রংসরিক্তপ্রকোষ্ঠ হয়ে যাব, তবে রীতিমত সন্ন্যাসী হতে পারব। আমাদের কবি লিখেছেন--
নিশি না পোহাতে জীবনপ্রদীপ
জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া,
তোমার অনল দিয়া।
কবে যাবে তুমি সমুখের পথে
দীপ্ত শিখাটি বাহি
আছি তাই পথ চাহি।
পুড়িবে বলিয়া রয়েছে আশায়
আমার নীরব হিয়া
আপন আঁধার নিয়া।
নিশি না পোহাতে জীবনপ্রদীপ
জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া।
পূর্ণ।
ওহে শ্রীশবাবু, তোমার কবিটি তো মন্দ লেখে নি--
নিশি না পোহাতে জীবনপ্রদীপ
জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া।
ঘরটি সাজানো রয়েছে-- থালায় মালা, পালঙ্কে পুষ্পশয্যা, কেবল জীবনপ্রদীপটি জ্বলছে না, সন্ধ্যা ক্রমে রাত্রি হতে চলল। বাঃ, দিব্যি লিখেছে। কোন্ বইটাতে আছে বলো দেখি।
শ্রীশ।
বইটার নাম "আবাহন'।
পূর্ণ।
নামটাও বেছে বেছে দিয়েছে ভালো। (আপন মনে)--
নিশি না পোহাতে জীবনপ্রদীপ
জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া। (দীর্ঘনিশ্বাস)
তোমরা কি বাড়ির দিকে চলেছ।
শ্রীশ।
বাড়ি কোন্ দিকে ভুলে গেছি ভাই।
পূর্ণ।
আজ পথ ভোলবার মতোই রাতটা হয়েছে বটে। কী বল বিপিনবাবু।
শ্রীশ।
বিপিনবাবু এ-সকল বিষয়ে কোনো কথাই কন না, পাছে ওঁর ভিতরকার কবিত্ব ধরা পড়ে। কৃপণ যে জিনিসটার বেশি আদর করে সেইটেকেই মাটির নীচে পুঁতে রাখে।
বিপিন।
অস্থানে বাজে খরচ করতে চাই নে ভাই, স্থান খুঁজে বেড়াচ্ছি। মরতে হলে একেবারে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে মরাই ভালো।
পূর্ণ।
এ তো উত্তম কথা, শাস্ত্রসংগত কথা। বিপিনবাবু একেবারে অন্তিম কালের জন্যে কবিত্ব সঞ্চয় করে রাখছেন, যখন অন্যে বাক্য কবেন কিন্তু উনি রবেন নিরুত্তর। আশীর্বাদ করি অন্যের সেই বাক্যগুলি যেন মধুমাখা হয়--
শ্রীশ।
এবং তার সঙ্গে যেন কিঞ্চিৎ ঝালের সম্পর্কও থাকে--
বিপিন।
এবং বাক্যবর্ষণ করেই যেন মুখের সমস্ত কর্তব্য নিঃশেষ না হয়--
পূর্ণ।
বাক্যের বিরামস্থলগুলি যেন বাক্যের চেয়ে মধুমত্তর হয়ে ওঠে--
শ্রীশ।
সেদিন নিদ্রা যেন না আসে--
পূর্ণ।
রাত্রি যেন না যায়--
বিপিন।
চন্দ্র যেন পূর্ণচন্দ্র হয়--
পূর্ণ।
বিপিন যেন বসন্তের ফুলে প্রফুল্ল হয়ে ওঠে--
শ্রীশ।
এবং হতভাগ্য শ্রীশ যেন কুঞ্জদ্বারের কাছে এসে উঁকিঝুঁকি না মারে।
পূর্ণ।
দূর হোক গে শ্রীশবাবু, তোমার সেই "আবাহন' থেকে আর-একটা কিছু কবিতা আওড়াও। চমৎকার লিখেছে হে--
নিশি না পোহাতে জীবনপ্রদীপ
জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া।
আহা! একটি জীবনপ্রদীপের শিখাটুকু আর-একটি জীবনপ্রদীপের মুখের কাছে কেবল একটু ঠেকিয়ে গেলেই হয়, বাস্, আর কিছুই নয়-- দুটি কোমল অঙ্গুলি দিয়ে দীপখানি একটু হেলিয়ে একটু ছুঁইয়ে যাওয়া, তার পরেই চকিতের মধ্যে সমস্ত আলোকিত।
(আপন মনে)--
নিশি না পোহাতে জীবনপ্রদীপ
জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া।
শ্রীশ।
পূর্ণবাবু, যাও কোথায়?
পূর্ণ।
চন্দ্রবাবুর বাসায় একখানা বই ফেলে এসেছি, সেইটে খুঁজতে যাচ্ছি।
বিপিন।
খুঁজলে পাবে তো? চন্দ্রবাবুর বাসা বড়ো এলোমেলো জায়গা-- সেখানে যা হারায় সে আর পাওয়া যায় না।
[ পূর্ণের প্রস্থান
[ পূর্ণের প্রস্থান
শ্রীশ।
(দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া) পূর্ণ বেশ আছে ভাই বিপিন।
বিপিন।
ভিতরকার বাষ্পের চাপে ওর মাথাটা সোডাওয়াটারের ছিপির মতো একেবারে টপ্ করে উড়ে না যায়।
শ্রীশ।
যায় তো যাক-না। কোনোমতে লোহার তার এঁটে মাথাটাকে ঠিক জায়গায় ধরে রাখাই কি জীবনের চরম পুরুষার্থ। মাঝে মাঝে মাথার বেঠিক না হলে রাত দিন মুটের বোঝার মতো মাথাটাকে বয়ে বেড়াচ্ছি কেন। দাও ভাই, তার কেটে, একবার উড়ুক। সেদিন তোমাকে শোনাচ্ছিলুম--
ওরে সাবধানী পথিক, বারেক
পথ ভুলে মর্ ফিরে।
খোলা আঁখি দুটো অন্ধ করে দে
আকুল আঁখির নীরে।
সে ভোলা পথের প্রান্তে রয়েছে
হারানো হিয়ার কুঞ্জ--
ঝরে পড়ে আছে কাঁটাতরু-তলে
রক্তকুসুমপুঞ্জ,
সেথা দুই বেলা ভাঙা-গড়া খেলা
অকূলসিন্ধুতীরে।
ওরে সাবধানী পথিক, বারেক
পথ ভুলে মর্ ফিরে।
বিপিন।
আজকাল তুমি খুব কবিতা পড়তে আরম্ভ করেছ, শীঘ্রই একটা মুশকিলে পড়বে দেখছি।
শ্রীশ।
যে লোক ইচ্ছে করে মুশকিলের রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছে তার জন্যে কেউ ভেবো না। মুশকিলকে এড়িয়ে চলতে গিয়ে হঠাৎ মুশকিলের মধ্যে পা ফেললেই বিপদ। আসুন আসুন রসিকবাবু, রাত্রে পথে বেরিয়েছেন যে!
রসিকের প্রবেশ
রসিকের প্রবেশ
রসিক।
আমার রাতই বা কী, আর দিনই বা কী--
বরমসৌ দিবসো ন পুনর্নিশা
ননু নিশৈব বরং ন পুনর্দিনম্।
উভয়মেতদুপৈত্বথবা ক্ষয়ং
প্রিয়জনেন ন যত্র সমাগমঃ।
শ্রীশ।
অস্যার্থঃ?
রসিক।
অস্যার্থ হচ্ছে--
আসে তো আসুক রাতি, আসুক বা দিবা
যায় যদি যাক নিরবধি।
তাহাদের যাতায়াতে আসে যায় কিবা
প্রিয় মোর নাহি আসে যদি।
অনেকগুলো দিন রাত এ-পর্যন্ত এসেছে এবং গেছে, কিন্তু তিনি আজ পর্যন্ত এসে পৌঁছলেন না-- তাই, দিনই বলুন আর রাতই বলুন, ও দুটোর 'পরে আমার আর কিছুমাত্র শ্রদ্ধা নেই।
শ্রীশ।
আচ্ছা রসিকবাবু, প্রিয়জন এখনই যদি হঠাৎ এসে পড়েন।
রসিক।
তা হলে আমার দিকে তাকাবেন না, তোমাদের দুজনের মধ্যে একজনের ভাগেই পড়বেন।
শ্রীশ।
তা হলে তদ্দণ্ডেই তিনি অরসিক বলে প্রমাণ হয়ে যাবেন।
রসিক।
এবং পরদণ্ডেই পরমানন্দে কালযাপন করতে থাকবেন। তা, আমি ঈর্ষা করতে চাই নে শ্রীশবাবু। আমার ভাগ্যে যিনি আসতে বহু বিলম্ব করলেন আমি তাঁকে তোমাদের উদ্দেশেই উৎসর্গ করলুম। দেবী, তোমার বরমাল্য গেঁথে আনো। আজ বসন্তের শুক্লরজনী, আজ অভিসারে এসো।--
মন্দং নিধেহি চরণৌ পরিধেহি নীলং
বাসঃ পিধেহি বলয়াবলিমঞ্চলেন।
মা জল্প সাহসিনি শারদচন্দ্রকান্ত-
দন্তাংশবস্তব তমাংসি সমাপয়ন্তি।
ধীরে ধীরে চলো তন্বী, পরো নীলাম্বর,
অঞ্চলে বাঁধিয়া রাখো কঙ্কণ মুখর।
কথাটি কোয়ো না, তব দন্ত-অংশু-রুচি
পথের তিমিররাশি পাছে ফেলে মুছি।
শ্রীশ।
রসিকবাবু, আপনার ঝুলি যে একেবারে ভরা। এমন কত তর্জমা করে রেখেছেন।
রসিক।
বিস্তর। লক্ষ্মী তো এলেন না, কেবল বাণীকে নিয়েই দিন যাপন করছি।
শ্রীশ।
ওহে বিপিন, অভিসার-ব্যাপারটা কল্পনা করতে বেশ লাগে।
বিপিন।
ওটা পুনর্বার চালাবার জন্যে চিরকুমার-সভায় একটা প্রস্তাব এনে দেখো-না।
শ্রীশ।
কতকগুলো জিনিস আছে যার আইডিয়াটা এত সুন্দর যে সংসারে সেটা চালাতে সাহস হয় না। যে রাস্তায় অভিসার হতে পারে, যেখানে কামিনীদের হার থেকে মুক্তো ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়ে, সে রাস্তা কি তোমার পটলডাঙা স্ট্রীট? সে রাস্তা জগতে কোথাও নেই। বিরহিণীর হৃদয় নীলাম্বরী পরে মনোরাজ্যের পথে ঐরকম করে বেরিয়ে থাকে-- বক্ষের উপর থেকে মুক্তো ছিঁড়ে পড়ে, চেয়েও দেখে না-- সত্যিকার মুক্তো হলে কুড়িয়ে নিত। কী বলেন রসিকবাবু।
রসিক।
সে কথা মানতেই হয়-- অভিসারটা মনে মনেই ভালো, গাড়িঘোড়ার রাস্তায় অত্যন্ত বেমানান। আশীর্বাদ করি শ্রীশবাবু, এইরকম বসন্তের জ্যোৎস্নারাত্রে কোনো-একটি জালনা থেকে কোনো-এক রমণীর ব্যাকুল হৃদয় তোমার বাসার দিকে যেন অভিসারে যাত্রা করে।
শ্রীশ।
তা করবে রসিকবাবু, আপনার আশীর্বাদ ফলবে। আজকের হাওয়াতে সেই খবরটা আমি মনে মনে পাচ্ছি। বিশে-ডাকাত যেমন খবর দিয়ে ডাকাতি করত আমার অজানা অভিসারিকা তেমনই পূর্বে হতেই আমাকে অভিসারের খবর পাঠিয়েছে।
বিপিন।
তোমার সেই ছাতের বারান্দাটা সাজিয়ে প্রস্তুত হয়ে থেকো।
শ্রীশ।
তা, আমার সেই দক্ষিণের বারান্দায় একটি চৌকিতে আমি বসি, আর-একটি চৌকি সাজানো থাকে।
বিপিন।
সেটাতে আমি এসে বসি।
শ্রীশ।
মধ্বভাবে গুড়ং দদ্যাৎ, অভাবপক্ষে তোমাকে নিয়ে চলে।
বিপিন।
মধুময়ী যখন আসবেন তখন হতভাগার ভাগ্যে লগুড়ং দদ্যাৎ।
রসিক।
(জনান্তিকে) শ্রীশবাবু, আপনার সেই দক্ষিণের ছাতটিকে চিহ্নিত করে রাখবার জন্যে যে পতাকা ওড়ানো আবশ্যক সেটা যে ফেলে এলেন।
শ্রীশ।
রুমালটা কি এখন চেষ্টা করলে পাওয়া যেতে পারবে?
রসিক।
চেষ্টা করতে দোষ কী।
শ্রীশ।
বিপিন, তুমি ভাই রসিকবাবুর সঙ্গে একটু কথাবার্তা কও, আমি চট্ করে আসছি।
[ প্রস্থান
[ প্রস্থান
বিপিন।
আচ্ছা রসিকবাবু, রাগ করবেন না--
রসিক।
যদি বা করি আপনার ভয় করবার কোনো কারণ নেই, আমি ভারি দুর্বল।
বিপিন।
দু-একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করব, আপনি বিরক্ত হবেন না।
রসিক।
আমার বয়স সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন নয় তো?
বিপিন।
না।
রসিক।
তবে জিজ্ঞাসা করুন, ঠিক উত্তর পাবেন।
বিপিন।
সেদিন যে মহিলাটিকে দেখলুম, তিনি--
রসিক।
তিনি আলোচনার যোগ্য, আপনি সংকোচ করবেন না বিপিনবাবু-- তাঁর সম্বন্ধে যদি আপনি মাঝে মাঝে চিন্তা ও চর্চা করে থাকেন তবে তাতে আপনার অসাধারণত্ব প্রমাণ হয় না, আমরাও ঠিক ঐ কাজ করে থাকি।
বিপিন।
অবলাকান্তবাবু বুঝি--
রসিক।
তাঁর কথা বলবেন না, তাঁর মুখে অন্য কথা নেই।
বিপিন।
তিনি কি--
রসিক।
হাঁ, তাই বটে। তবে হয়েছে কী, তিনি নৃপবালা নীরবালা দুজনের কাকে যে বেশি ভালোবাসেন স্থির করে উঠতে পারেন না-- তিনি দুজনের মধ্যে সর্বদাই দোলায়মান।
বিপিন।
কিন্তু, তাঁদের কেউ কি ওঁর প্রতি--
রসিক।
না, এমন ভাব নয় যে ওঁকে বিবাহ করতে পারেন। সে হলে তো কোনো গোলই ছিল না।
বিপিন।
তাই বুঝি অবলাকান্তবাবু কিছু--
রসিক।
কিছু যেন চিন্তান্বিত।
বিপিন।
শ্রীমতী নীরবালা বুঝি গান ভালোবাসেন?
রসিক।
বাসেন বটে, আপনার পকেটের মধ্যেই তো তার সাক্ষী আছে।
বিপিন।
(পকেট হইতে গানের খাতা বাহির করিয়া) এখানা নিয়ে আসা আমার অত্যন্ত অভদ্রতা হয়েছে--
রসিক।
সে অভদ্রতা আপনি না করলে আমরা কেউ-না-কেউ করতেম।
বিপিন।
আপনারা করলে তিনি মার্জনা করতেন, কিন্তু আমি-- বাস্তবিক অন্যায় হয়েছে, কিন্তু এখন ফিরিয়ে দিলেও তো--
রসিক।
মূল অন্যায়টা অন্যায়ই থেকে যায়।
বিপিন।
অতএব--
রসিক।
যাঁহাতক বাহান্ন তাঁহাতক তিপ্পান্ন। হরণে যে দোষটুকু হয়েছে রক্ষণে নাহয় তাতে আর-একটু যোগ হল।
বিপিন।
খাতাটা সম্বন্ধে তিনি কি আপনাদের কাছে কিছু বলেছেন?
রসিক।
বলেছেন অল্পই, কিন্তু না বলেছেন অনেকটা।
বিপিন।
কিরকম?
রসিক।
লজ্জায় অনেকখানি লাল হয়ে উঠলেন।
বিপিন।
ছি ছি, সে লজ্জা আমারই।
রসিক।
আপনার লজ্জা তিনি ভাগ করে নিলেন, যেমন অরুণের লজ্জায় উষা রক্তিম।
বিপিন।
আমাকে আর পাগল করবেন না রসিকবাবু।
রসিক।
দলে টানছি মশায়।
বিপিন।
(খাতা পুনর্বার পকেটে পুরিয়া) ইংরেজিতে বলে, দোষ করা মানবের ধর্ম, ক্ষমা করা দেবতার।
রসিক।
আপনি তা হলে মানবধর্ম-পালনটাই সাব্যস্ত করলেন।
বিপিন।
দেবীর ধর্মে যা বলে তিনি তাই করবেন।
শ্রীশের প্রবেশ
শ্রীশের প্রবেশ
শ্রীশ।
অবলাকান্তবাবুর সঙ্গে দেখা হল না।
বিপিন।
তুমি রাতারাতিই তাঁকে সন্ন্যাসী করতে চাও নাকি।
শ্রীশ।
যা হোক, অক্ষয়বাবুর কাছে বিদায় নিয়ে এলুম।
বিপিন।
বটে বটে, তাঁকে বলে আসতে ভুলে গিয়েছিলেম-- একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসি গে।
রসিক।
(জনান্তিকে) পুনর্বার কিছু সংগ্রহের চেষ্টায় আছেন বুদ্ধি? মানবধর্মটা ক্রমেই আপনাকে চেপে ধরছে।
[ বিপিনের প্রস্থান
[ বিপিনের প্রস্থান
শ্রীশ।
রসিকবাবু, আপনার কাছে আমার একটা পরামর্শ আছে।
রসিক।
পরামর্শ দেবার উপযুক্ত বয়স হয়েছে, বুদ্ধি না হতেও পারে।
শ্রীশ।
আপনাদের ওখানে সেদিন যে দুটি মহিলাকে দেখেছিলেম তাঁদের দুজনকেই আমার সুন্দরী বলে বোধ হল।
রসিক।
আপনার বোধশক্তির দোষ দেওয়া যায় না। সকলেই তো ঐ এক কথাই বলে।
শ্রীশ।
তাঁদের সম্বন্ধে যদি মাঝে মাঝে আপনার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করি তা হলে কি--
রসিক।
তা হলে আমি খুশি হব, আপনারও সেটা ভালো লাগতে পারে, এবং তাঁদেরও বিশেষ ক্ষতি হবে না।
শ্রীশ।
কিছুমাত্র না। ঝিল্লি যদি নক্ষত্র সম্বন্ধে জল্পনা করে--
রসিক।
তাতে নক্ষত্রের নিদ্রার ব্যাঘাত হয় না।
শ্রীশ।
ঝিল্লিরই অনিদ্রারোগ জন্মাতে পারে। কিন্তু তাতে আমার আপত্তি নেই।
রসিক।
আজ তো তাই বোধ হচ্ছে।
শ্রীশ।
যাঁর রুমাল কুড়িয়ে পেয়েছিলুম তাঁর নামটি বলতে হবে।
রসিক।
তাঁর নাম নৃপবালা।
শ্রীশ।
তিনি কোন্টি।
রসিক।
আপনিই আন্দাজ করে বলুন দেখি।
শ্রীশ।
যাঁর সেই লাল রঙের রেশমের শাড়ি পরা ছিল?
রসিক।
বলে যান।
শ্রীশ।
যিনি লজ্জায় পালাতে চাচ্ছিলেন, অথচ পালাতেও লজ্জা বোধ করছিলেন-- তাই মুহূর্তকালের জন্য হঠাৎ ত্রস্ত হরিণীর মতো থমকে দাঁড়িয়েছিলেন, সামনের দুই-এক গুচ্ছ চুল প্রায় চোখের উপরে এসে পড়েছিল-- চাবির-গোছা-বাঁধা চ্যুত অঞ্চলটি বাঁ হাতে তুলে ধরে যখন দ্রুতবেগে চলে গেলেন তখন তাঁর পিঠ-ভরা কালো চুল আমার দৃষ্টিপথের উপর দিয়ে একটি কালো জ্যোতিষ্কের মতো ছুটে নৃত্য করে চলে গেল।
রসিক।
এ তো নৃপবালাই বটে। পা দুখানি লজ্জিত, হাত দুখানি কুণ্ঠিত, চোখ দুটি ত্রস্ত, চুলগুলি কুঞ্চিত, দুঃখের বিষয় হৃদয়টি দেখতে পান নি-- সে যেন ফুলের ভিতরকার লুকোনো মধুটুকুর মতো মধুর, শিশিরটুকুর মতো করুণ।
শ্রীশ।
রসিকবাবু, আপনার মধ্যে এত যে কবিত্বরস সঞ্চিত হয়ে রয়েছে তার উৎস কোথায় এবার টের পেয়েছি।
রসিক।
ধরা পড়েছি শ্রীশবাবু--
কবিন্দ্রাণাং চেতঃ কমলবনমালাতপরুচিং
ভজন্তে যে সন্তঃ কতিচিদরুণামেব ভবতীং।
বিরিঞ্চিপ্রেয়স্যাস্তরুণতরশৃঙ্গারলহরীং
গভীরাভির্বাগ্ভির্বিদধতি সভারঞ্জনময়ীং।
কবীন্দ্রদের চিত্তকমলবনমালার কিরণলেখা যে তুমি, তোমাকে যারা লেশমাত্র ভজনা করে তারাই গভীর বাক্য দ্বারা সরস্বতীর সভারঞ্জনময়ী তরুণলীলালহরী প্রকাশ করতে পারে। আমি সেই কবিচিত্তকমলবনের কিরণলেখাটির পরিচয় পেয়েছি।
শ্রীশ।
আমিও অল্প দিন হল একটু পরিচয় পেয়েছি, তার পর থেকে কবিত্ব আমার পক্ষে সহজ হয়ে এসেছে।
অক্ষয়ের প্রবেশ
অক্ষয়ের প্রবেশ
অক্ষয়।
(স্বগত) নাঃ, দুটি নবযুগকে মিলে আমাকে আর ঘরে তিষ্ঠতে দিলে না দেখছি। একটি তো গিয়ে চোরের মতো আমার ঘরের মধ্যে হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন-- ধরা পড়ে ভালোরকম জবাবদিহি করতে পারলে না, শেষকালে আমাকে নিয়ে পড়ল। তার খানিক বাদেই দেখি দ্বিতীয় ব্যক্তিটি গিয়ে ঘরের বইগুলি নিয়ে উল্টেপাল্টে নিরীক্ষণ করছে। তফাত থেকে দেখেই পালিয়ে এসেছি। বেশ মনের মতো করে চিঠিখানি যে লিখব এরা তা আর দিলে না-- আহা, চমৎকার জ্যোৎস্না হয়েছে।
শ্রীশ।
এই-যে অক্ষয়বাবু।
অক্ষয়।
ঐ রে। একটা ডাকাত ঘরের মধ্যে, আর- একটা ডাকাত পথের ধারে। হা প্রিয়ে, তোমার ধ্যান থেকে যারা আমার মনকে বিক্ষিপ্ত করছে তারা মেনকা উর্বশী রম্ভা হলে আমার কোনো খেদ ছিল না-- মনের মতো ধ্যানভঙ্গও অক্ষয়ের অদৃষ্টে নেই, কলিকালে ইন্দ্রদেবের বয়স বেশি হয়ে বেরসিক হয়ে উঠেছে।
বিপিনের প্রবেশ
বিপিনের প্রবেশ
বিপিন।
এই-যে অক্ষয়বাবু, আপনাকেই খুঁজছিলুম।
অক্ষয়।
হায় হতভাগ্য, এমন রাত্রি কি আমাকে খোঁজ করে বেড়াবার জন্যই হয়েছিল--
In such a night as this,
When the sweet wind did gently kiss the trees
And they did make no noise, in such a night
Troilus methinks mounted the Trojan walls
And sighed his soul toward the Grecian tents,
Where Cressid lay that night।
শ্রীশ।
in such a night আপনি কী করতে বেরিয়েছেন অক্ষয়বাবু।
রসিক।
অপসরতি ন চক্ষুষো মৃগাক্ষী
রজনিরিয়ং চ ন যাতি নৈতি নিদ্রা।
চক্ষু-'পরে মৃগাক্ষীর চিত্রখানি ভাসে--
রজনীও নাহি যায়, নিদ্রাও না আসে।
অক্ষয়বাবুর অবস্থা আমি জানি মশায়।
অক্ষয়।
তুমি কে হে।
রসিক।
আমি রসিকচন্দ্র-- দুই দিকে দুই যুবককে আশ্রয় করে যৌবনসাগরে ভাসমান।
অক্ষয়।
এ বয়সে যৌবন সহ্য হবে না রসিকদাদা।
রসিক।
যৌবনটা কোন্ বয়সে যে সহ্য হয় তা তো জানি নে, ওটা অসহ্য ব্যাপার। শ্রীশবাবু, আপনার কিরকম বোধ হচ্ছে।
শ্রীশ।
এখনো সম্পূর্ণ বোধ করতে পারি নি।
রসিক।
আমার মতো পরিণত বয়সের জন্যে অপেক্ষা করছেন বুঝি?-- অক্ষয়দা, আজ তোমাকে বড়ো অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে।
অক্ষয়।
তুমি তো অন্যমনস্ক দেখবেই, মনটা ঠিক তোমার দিকে নেই।-- বিপিনবাবু, তুমি আমাকে খুঁজছিলে বললে বটে, কিন্তু খুব যে জরুরি দরকার আছে ব'লে বোধ হচ্ছে না, অতএব আমি এখন বিদায় হই-- একটু বিশেষ কাজ আছে।
[ প্রস্থান
[ প্রস্থান
রসিক।
বিরহী চিঠি লিখতে চলল।
শ্রীশ।
অক্ষয়বাবু আছেন বেশ। রসিকবাবু, ওঁর স্ত্রীই বুঝি বড়ো বোন? তাঁর নাম?
রসিক।
পুরবালা।
বিপিন।
(নিকটে আসিয়া) কী নাম বললেন।
রসিক।
পুরবালা।
বিপিন।
তিনিই বুঝি সব চেয়ে বড়ো?
রসিক।
হাঁ।
বিপিন।
সব-ছোটোটির নাম?
রসিক।
নীরবালা।
শ্রীশ।
আর নৃপবালা কোন্টি।
রসিক।
তিনি নীরবালার বড়ো।
শ্রীশ।
তা হলে নৃপবালাই হলেন মেজো।
বিপিন।
আর নীরবালা ছোটো।
শ্রীশ।
পুরবালার ছোটো নৃপবালা।
বিপিন।
তাঁর ছোটো হচ্ছেন নীরবালা।
রসিক।
(স্বগত) এরা তো নাম জপ করতে শুরু করলে। আমার মুশকিল। আর তো হিম সহ্য হবে না, পালাবার উপায় ধরা যাক।
বনমালীর প্রবেশ
বনমালীর প্রবেশ
বনমালী।
এই-যে আপনারা এখানে। আমি আপনাদের বাড়ি গিয়েছিলুম।
শ্রীশ।
এইবার আপনি এখানে থাকুন, আমরা বাড়ি যাই।
বনমালী।
আপনারা সর্বদাই ব্যস্ত দেখতে পাই।
বিপিন।
তা, আপনাকে দেখলে একটু বিশেষ ব্যস্ত হয়েই পড়ি।
বনমালী।
পাঁচ মিনিট যদি দাঁড়ান--
শ্রীশ।
রসিকবাবু, একটু ঠাণ্ডা বোধ হচ্ছে না?
রসিক।
আপনাদের এতক্ষণে বোধ হল, আমার অনেকক্ষণ থেকেই বোধ হচ্ছে।
বনমালী।
চলুন-না, ঘরেই চলুন-না।
শ্রীশ।
মশায়, এত রাত্রে যদি আমার ঘরে ঢোকেন তা হলে কিন্তু--
বনমালী।
যে আজ্ঞে, আপনারা কিছু ব্যস্ত আছেন দেখছি, তা হলে আর-এক সময় হবে।