জগত্তারিণী, পুরবালা ও অক্ষয়
অক্ষয়ের বাসা
জগত্তারিণী, পুরবালা ও অক্ষয়
জগত্তারিণী।
বাবা অক্ষয়, দেখো তো, মেয়েদের নিয়ে আমি কী করি। নেপো বসে বসে কাঁদছে; নীর রেগে অস্থির, সে বলে সে কোনোমতেই বেরোবে না। ভদ্রলোকের ছেলেরা আজ এখনই আসবে, তাদের এখন কী বলে ফেরাব। তুমিই বাপু, ওদের শিখিয়ে পড়িয়ে বিবি করে তুলেছ, এখন তুমিই ওদের সামলাও।
[ প্রস্থান
[ প্রস্থান
পুরবালা।
সত্যি, আমি ওদের রকম দেখে অবাক হয়ে গেছি, ওরা কি মনে করেছে ওরা--
অক্ষয়।
বোধ হয় আমাকে ছাড়া আর-কাউকে ওরা পছন্দ করছে না; তোমারই সহোদরা কিনা, রুচিটা তোমারই মতো।
পুরবালা।
ঠাট্টা রাখো, এখন ঠাট্টার সময় নয়। তুমি ওদের একটু বুঝিয়ে বলবে কি না বলো। তুমি না বললে ওরা শুনবে না।
অক্ষয়।
এত অনুগত! একেই বলে ভগ্নীপতিব্রতা শ্যালী। আচ্ছা, আমার কাছে একবার পাঠিয়ে দাও-- দেখি।
[ পুরবালার প্রস্থান
[ পুরবালার প্রস্থান
নৃপবালা ও নীরবালার প্রবেশ
নৃপবালা ও নীরবালার প্রবেশ
নীরবালা।
না, মুখুজ্জেমশায়, সে কোনোমতেই হবে না।
নৃপবালা।
মুখুজ্জেমশায়, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাদের যার-তার সামনে ও-রকম করে বের কোরো না।
অক্ষয়।
ফাঁসির হুকুম হলে একজন বলেছিল আমাকে বেশি উঁচুতে চড়িয়ো না, আমার মাথা ঘোরা ব্যামো আছে। তোদের যে তাই হল। বিয়ে করতে যাচ্ছিস, এখন দেখা দিতে লজ্জা করলে চলবে কেন।
নীরবালা।
কে বললে আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি।
অক্ষয়।
অহো, শরীরে পুলক সঞ্চার হচ্ছে। কিন্তু হৃদয় দুর্বল এবং দৈব বলবান, যদি দৈবাৎ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে হয়--
নীরবালা।
না, ভঙ্গ হবে না।
অক্ষয়।
হবে না তো? তবে নির্ভয়ে এসো, যুবক-দুটোকে দেখা দিয়ে আধপোড়া করে ছেড়ে দাও-- হতভাগারা বাসায় ফিরে গিয়ে মরে থাকুক।
নীরবালা।
অকারণে প্রাণিহত্যা করবার জন্য আমাদের এত উৎসাহ নেই।
অক্ষয়।
জীবের প্রতি কী দয়া! কিন্তু, সামান্য ব্যাপার নিয়ে গৃহবিচ্ছেদ করবার দরকার কী। তোদের মা দিদি যখন ধরে পড়েছেন এবং ভদ্রলোক দুটি যখন গাড়িভাড়া করে আসছে তখন একবার মিনিট-পাঁচেকের মতো দেখা দিস, তার পরে আমি আছি-- তোদের অনিচ্ছায় কোনোমতেই বিবাহ দিতে দেব না।
নীরবালা।
কোনোমতেই না?
অক্ষয়।
কোনোমতেই না।
পুরবালার প্রবেশ
পুরবালার প্রবেশ
পুরবালা।
আয়, তোদের সাজিয়ে দিই গে।
নীরবালা।
আমরা সাজব না।
পুরবালা।
ভদ্রলোকদের সামনে এইরকম বেশেই বেরোবি! লজ্জা করবে না!
নীরবালা।
লজ্জা করবে বৈকি দিদি, কিন্তু সেজে বেরোতে আরো বেশি লজ্জা করবে।
অক্ষয়।
উমা তপস্বিনীবেশে মহাদেবের মনোহরণ করেছিলেন, শকুন্তলা যখন দুষ্মন্তের হৃদয় জয় করেছিল তখন তার গায়ে একখানি বাকল ছিল-- কালিদাস বলেন, সেও কিছু আঁট হয়ে পড়েছিল-- তোমার বোনেরা সেই-সব পড়ে সেয়ানা হয়ে উঠেছে, সাজতে চায় না।
পুরবালা।
সে-সব হল সত্যযুগের কথা। কলিকালের দুষ্মন্ত মহারাজারা সাজ-সজ্জাতেই ভোলেন।
অক্ষয়।
যথা--
পুরবালা।
যথা তুমি। যেদিন তুমি দেখতে এলে, মা বুঝি আমাকে সাজিয়ে দেন নি?
অক্ষয়।
আমি মনে মনে ভাবলেম, সাজেও যখন একে সেজেছে তখন সৌন্দর্যে না জানি কত শোভা হবে।
পুরবালা।
আচ্ছা, তুমি থামো। নীরু, আয়।
নীরবালা।
না ভাই দিদি--
পুরবালা।
আচ্ছা, সাজ নাই করলি, চুল তো বাঁধতে হবে?
অক্ষয়।
গান
অলকে কুসুম না দিয়ো,
শুধু শিথিল কবরী বাঁধিয়ো।
কাজলবিহীন সজল নয়নে
হৃদয়দুয়ারে ঘা দিয়ো।
আকুল আঁচলে পথিকচরণে
মরণের ফাঁদ ফাঁদিয়ো।
না করিয়া বাদ মনে যাহা সাধ
নিদয়া নীরবে সাধিয়ো।
পুরবালা।
তুমি আবার গান ধরলে! আমি কখন কী করি বলো দেখি। তাদের আসবার সময় হল-- এখনো আমার খাবার তৈরি করা বাকি আছে।
[ নৃপবালা ও নীরবালাকে লইয়া প্রস্থান
[ নৃপবালা ও নীরবালাকে লইয়া প্রস্থান
রসিকের প্রবেশ
রসিকের প্রবেশ
অক্ষয়।
পিতামহ ভীষ্ম, যুদ্ধের সমস্তই প্রস্তুত?
রসিক।
সমস্তই। বীরপুরুষ দুটিও সমাগত।
অক্ষয়।
এখন কেবল দিব্যাস্ত্র-দুটি সাজতে গেছেন। তুমি তা হলে সেনাপতির ভার গ্রহণ করো, আমি একটু অন্তরালে থাকতে ইচ্ছা করি।
রসিক।
আমিও প্রথমটা একটু আড়াল হই।
[ রসিক ও অক্ষয়ের প্রস্থান
[ রসিক ও অক্ষয়ের প্রস্থান
শ্রীশ ও বিপিনের প্রবেশ
শ্রীশ ও বিপিনের প্রবেশ
শ্রীশ।
বিপিন, তুমি তো আজকাল সংগীতবিদ্যার উপর চীৎকারশব্দে ডাকাতি আরম্ভ করেছ-- কিছু আদায় করতে পারলে?
বিপিন।
কিছু না। সংগীতবিদ্যার দ্বারে সপ্তসুর অনবরত পাহারা দিচ্ছে, সেখানে কি আমার ঢোকবার জো আছে। কিন্তু এ প্রশ্ন কেন তোমার মনে উদয় হল।
শ্রীশ।
আজকাল মাঝে মাঝে কবিতায় সুর বসাতে ইচ্ছে করে। সেদিন বইয়ে পড়ছিলুম--
কেন সারা দিন ধীরে ধীরে
বালু নিয়ে শুধু খেল তীরে।
চলে যায় বেলা, রেখে মিছে খেলা
ঝাঁপ দিয়ে পড়ো কালো নীরে।
অকূল ছানিয়ে যা পাস তা নিয়ে
হেসে কেঁদে চলো ঘরে ফিরে।
--মনে হচ্ছিল এর সুরটা যেন জানি কিন্তু গাবার জো নেই।
বিপিন।
জিনিসটা মন্দ নয় হে-- তোমার কবি লেখে ভালো। ওহে, ওর পরে আর-কিছু নেই? যদি শুরু করলে তবে শেষ করো।
শ্রীশ।
নাহি জানি মনে কী বাসিয়া
পথে বসে আছে কে আসিয়া।
যে ফুলের বাসে অলস বাতাসে
হৃদয় দিতেছে উদাসিয়া
যেতে হয় যদি চলো নিরবধি
সেই ফুলবন তলাশিয়া।
বিপিন।
বাঃ, বেশ! কিন্তু শ্রীশ, শেল্ফের কাছে তুমি কী খুঁজে বেড়াচ্ছ।
শ্রীশ।
সেই-যে সেদিন যে বইটাতে নাম লেখা দেখেছিলাম সেইটে--
বিপিন।
না ভাই, আজ ও-সব নয়।
শ্রীশ।
কী-সব নয়।
বিপিন।
তাঁদের কথা নিয়ে কোনো রকম--
শ্রীশ।
কী আশ্চর্য বিপিন। তাঁদের কথা নিয়ে আমি কি এমন কোনো আলোচনা করতে পারি যাতে--
বিপিন।
রাগ কোরো না ভাই-- আমি নিজের সম্বন্ধেই বলছি, এই ঘরেই আমি অনেক সময় রসিকবাবুর সঙ্গে তাঁদের বিষয়ে যে ভাবে আলাপ করেছি, আজ সে ভাবে কোনো কথা উচ্চারণ করতেও সংকোচ বোধ হচ্ছে-- বুঝছ না--
শ্রীশ।
কেন বুঝব না। আমি কেবল একখানি বই খুলে দেখবার ইচ্ছে করেছিলুম মাত্র-- একটি কথাও উচ্চারণ করতুম না--
বিপিন।
না, আজ তাও না। আজ তাঁরা আমাদের সম্মুখে বেরোবেন, আজ আমরা যেন তার যোগ্য থাকতে পারি।
শ্রীশ।
বিপিন, তোমার সঙ্গে--
বিপিন।
না ভাই, আমার সঙ্গে তর্ক কোরো না, আমি হারলুম-- কিন্তু বইটা রাখো।
রসিকের প্রবেশ
রসিকের প্রবেশ
রসিক।
এই-যে আপনারা এসে একলা বসে আছেন-- কিছু মনে করবেন না--
শ্রীশ।
কিছু না। এই ঘরটি আমাদের সাদর সম্ভাষণ করে নিয়েছিল।
রসিক।
আপনাদের কত কষ্ট দেওয়া গেল।
শ্রীশ।
কষ্ট আর দিতে পারলেন কই। একটা কষ্টের মতো কষ্ট স্বীকার করবার সুযোগ পেলে কৃতার্থ হতুম।
রসিক।
যা হোক, অল্পক্ষণের মধ্যে চুকে যাবে এই এক সুবিধে। তার পরেই আপনারা স্বাধীন। ভেবে দেখুন দেখি, যদি এটা সত্যকার ব্যাপার হত তা হলেই "পরিণামে বন্ধনভয়ম্'। বিবাহ জিনিসটা মিষ্টান্ন দিয়েই শুরু হয়, কিন্তু সকল সময় মধুরেণ সমাপ্ত হয় না। আচ্ছা, আজ আপনারা দুঃখিতভাবে এরকম চুপচাপ করে বসে আছেন কেন বলুন দেখি। আমি বলছি, আপনাদের কোনো ভয় নেই। আপনারা বনের বিহঙ্গ, দুটিখানি সন্দেশ খেয়েই আবার বনে উড়ে যাবেন-- কেউ আপনাদের বাঁধবে না। নাত্র ব্যাধশরাঃ পতন্তি পরিতো নৈবাত্র দাবানলঃ। দাবানলের পরিবর্তে ডাবের জল পাবেন।
শ্রীশ।
আমাদের সে দুঃখ নয় রসিকবাবু, আমরা ভাবছি-- আমাদের দ্বারা কতটুকু উপকারই বা হচ্ছে। ভবিষ্যতের সমস্ত আশঙ্কা তো দূর করতে পারছি নে।
রসিক।
বিলক্ষণ! যা করছেন তাতে আপনারা দুটি অবলাকে চিরকৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ করছেন-- অথচ নিজেরা কোনোপ্রকার পাশেই বদ্ধ হচ্ছেন না।
জগত্তারিণী।
(নেপথ্যে মৃদুস্বরে) আঃ, নেপো কী ছেলেমানুষি করছিস। শিগ্গির চোখের জল মুছে ঘরের মধ্যে যা, লক্ষ্মী মা আমার-- কেঁদে চোখ লাল করলে কী রকম ছিরি হবে ভেবে দেখ্ দেখি।-- নীরো, যা না। তোদের সঙ্গে আর পারি নে বাপু। ভদ্রলোকদের কতক্ষণ বসিয়ে রাখবি। কী মনে করবেন।
শ্রীশ।
ঐ শুনেছেন রসিকবাবু? এ অসহ্য। এর চেয়ে রাজপুতদের কন্যাহত্যা ভালো।
বিপিন।
রসিকবাবু, এঁদের এই সংকট থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা করবার জন্যে আপনি আমাদের যা বলবেন আমরা তাতেই প্রস্তুত আছি।
রসিক।
কিছু না, আপনাদের আর অধিক কষ্ট দেব না। কেবল আজকের দিনটা উত্তীর্ণ করে দিয়ে যান, তার পরে আপনাদের আর-কিছুই ভাবতে হবে না।
শ্রীশ।
ভাবতে হবে না? কী বলেন রসিকবাবু। আমরা কি পাষাণ। আজ থেকেই আমরা বিশেষরূপে এঁদের জন্যে ভাববার অধিকার পাব।
বিপিন।
এমন ঘটনার পর আমরা যদি এঁদের সম্বন্ধে উদাসীন হই তবে আমরা কাপুরুষ।
শ্রীশ।
এখন থেকে এঁদের জন্যে ভাবা আমাদের পক্ষে গর্বের বিষয়-- গৌরবের বিষয়।
রসিক।
তা বেশ, ভাববেন, কিন্তু বোধ হয় ভাবা ছাড়া আর-কোনো কষ্ট করতে হবে না।
শ্রীশ।
আচ্ছা রসিকবাবু, আমাদের কষ্ট স্বীকার করতে দিতে আপনার এত আপত্তি হচ্ছে কেন।
বিপিন।
এঁদের জন্যে যদিই আমাদের কোনো কষ্ট করতে হয় সেটা যে আমরা সম্মান বলে জ্ঞান করব।
শ্রীশ।
দু দিন ধরে, রসিকবাবু, বেশি কষ্ট পেতে হবে না ব'লে আপনি ক্রমাগতই আমাদের আশ্বাস দিচ্ছেন-- এতে আমরা বাস্তবিক দুঃখিত হয়েছি।
রসিক।
আমাকে মাপ করবেন-- আমি আর কখনো এমন অবিবেচনার কাজ করব না। আপনারা কষ্ট স্বীকার করবেন।
শ্রীশ।
আপনি কি এখনো আমাদের চিনলেন না।
রসিক।
চিনেছি বৈকি, সেজন্যে আপনারা কিছুমাত্র চিন্তিত হবেন না।
কুণ্ঠিত নৃপবালা ও নীরবালার প্রবেশ
কুণ্ঠিত নৃপবালা ও নীরবালার প্রবেশ
শ্রীশ।
(নমস্কার করিয়া) রসিকবাবু, আপনি এঁদের বলুন আমাদের যেন মার্জনা করেন।
বিপিন।
আমরা যদি ভ্রমেও ওঁদের লজ্জা বা ভয়ের কারণ হই তবে তার চেয়ে দুঃখের বিষয় আমাদের পক্ষে আর কিছুই হতে পারে না, সেজন্যে যদি ক্ষমা না করেন তবে--
রসিক।
বিলক্ষণ! ক্ষমা চেয়ে অপরাধিনীদের অপরাধ আরো বাড়াবেন না। এঁদের অল্প বয়স, মান্য অতিথিদের কিরকম সম্ভাষণ করা উচিত তা যদি এঁরা হঠাৎ ভুলে গিয়ে নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকেন তা হলে আপনাদের প্রতি অসদ্ভাব কল্পনা করে এঁদের আরো লজ্জিত করবেন না। নৃপদিদি, নীরদিদি, কী বল ভাই। যদিও এখনো তোমাদের চোখের পাতা শুকোয় নি তবু এঁদের প্রতি তোমাদের মন যে বিমুখ নয় সে কথা কি জানাতে পারি।
নৃপ ও নীরু লজ্জিত নিরুত্তর
না, একটু আড়ালে জিজ্ঞাসা করা দরকার। (জনান্তিকে) ভদ্রলোকদের এখন কী বলি বলো তো ভাই। বলব কি, তোমরা যত শীঘ্র পার বিদায় হও।
নীরবালা।
(মৃদুস্বরে) রসিকদাদা, কী বক তার ঠিক নেই, আমরা কি তাই বলেছি-- আমরা কি জানতুম এঁরা এসেছেন।
রসিক।
(শ্রীশ ও বিপিনের প্রতি) এঁরা বলছেন--
সখা, কী মোর কলমে লেখি--
তাপন বলিয়া তপনে ডরিনু,
চাঁদের কিরণ দেখি।
--এর উপরে আপনাদের আর কিছু বলবার আছে?
নীরবালা।
(জনান্তিকে) আঃ রসিকদাদা, কী বলছ তার ঠিক নেই। ও কথা আমরা কখন বললুম।
রসিক।
(শ্রীশ ও বিপিনের প্রতি) এঁদের মনের ভাবটা আমি সম্পূর্ণ ব্যক্ত করতে পারি নি বলে এঁরা আমাকে ভর্ৎসনা করছেন। এঁরা বলতে চান চাঁদের কিরণ বললেও যথেষ্ট বলা হয় না-- তার চেয়ে আরো যদি--
নীরবালা।
(জনান্তিকে) তুমি অমন কর যদি তা হলে আমরা চলে যাব।
রসিক।
সখি, ন্ যুক্তম্ অকৃতসৎকারম্ অতিথিবিশেষম্ উজ্ঝিত্বা স্বচ্ছন্দতো গমনম্। (শ্রীশ ও বিপিনের প্রতি) এঁরা বলছেন এঁদের যথার্থ মনের ভাবটি যদি আপনাদের কাছে ব্যক্ত করে বলি, তা হলে এঁরা লজ্জায় এ ঘর থেকে চলে যাবেন।
[ নীরবালা ও নৃপবালার প্রস্থানোদ্যম
[ নীরবালা ও নৃপবালার প্রস্থানোদ্যম
শ্রীশ।
রসিকবাবুর অপরাধে আপনারা নির্দোষদের সাজা দেবেন কেন। আমরা তো কোনোপ্রকার প্রগল্ভতা করি নি।
নৃপবালা ও নীরবালার "ন যযৌ ন তস্থৌ' ভাব
নৃপবালা ও নীরবালার "ন যযৌ ন তস্থৌ' ভাব
বিপিন।
(নীরকে লক্ষ্য করিয়া) পূর্বকৃত কোনো অপরাধ যদি থাকে তো ক্ষমা-প্রার্থনার অবকাশ কি দেবেন না।
রসিক।
(জনান্তিকে) এই ক্ষমাটুকুর জন্যে বেচারা অনেক দিন থেকে সুযোগ প্রত্যাশা করছে।
নীরবালা।
(জনান্তিকে) অপরাধ কী হয়েছে যে ক্ষমা করতে যাব।
রসিক।
(বিপিনের প্রতি) ইনি বলছেন আপনার অপরাধ এমন মনোহর যে তাকে ইনি অপরাধ বলে লক্ষ্যই করেন নি। কিন্তু, আমি যদি সেই খাতাটি হরণ করতে সাহসী হতেম তবে সেটা অপরাধ হত-- আইনের বিশেষ ধারায় এইরকম লিখছে।
বিপিন।
ঈর্ষা করবেন না রসিকবাবু। আপনারা সর্বদাই অপরাধ করবার সুযোগ পান এবং সেজন্যে দণ্ডভোগ করে কৃতার্থ হন। আমি দৈবক্রমে একটা অপরাধ করবার সুযোগ পেয়েছিলুম, কিন্তু এতই অধম যে দণ্ডনীয় বলেও গণ্য হলেম না, ক্ষমা পাবার যোগ্যতাও লাভ করলেম না।
রসিক।
বিপিনবাবু, একেবারে হতাশ হবেন না। শাস্তি অনেক সময় বিলম্বে আসে, কিন্তু নিশ্চিত আসে। ফস্ করে মুক্তি না পেতেও পারেন।
ভৃত্যের প্রবেশ
ভৃত্যের প্রবেশ
ভৃত্য।
জলখাবার তৈরি।
[ নৃপবালা ও নীরবালার প্রস্থান
[ নৃপবালা ও নীরবালার প্রস্থান
শ্রীশ।
আমরা কি দুর্ভিক্ষের দেশ থেকে আসছি রসিকবাবু। জলখাবারের জন্যে এত তাড়া কেন।
রসিক।
মধুরেণ সমাপয়েৎ।
শ্রীশ।
(নিশ্বাস ফেলিয়া) কিন্তু সমাপনটা তো মধুর নয়। (জনান্তিকে বিপিনের প্রতি) কিন্তু বিপিন, এঁদের তো প্রতারণা করে যেতে পারব না।
বিপিন।
(জনান্তিকে) তা যদি করি তবে আমরা পাষণ্ড।
শ্রীশ।
(জনান্তিকে) এখন আমাদের কর্তব্য কী।
বিপিন।
(জনান্তিকে) সে কি আর জিজ্ঞাসা করতে হবে।
রসিক।
আপনারা দেখছি ভয় পেয়ে গেছেন। কোনো আশঙ্কা নেই, শেষকালে যেমন করেই হোক আমি আপনাদের উদ্ধার করবই।
শ্রীশ ও বিপিন আহারে প্রবৃত্ত হইল
শ্রীশ ও বিপিন আহারে প্রবৃত্ত হইল
ঘরের অন্য দিকে অক্ষয় ও জগত্তারিণীর প্রবেশ
ঘরের অন্য দিকে অক্ষয় ও জগত্তারিণীর প্রবেশ
জগত্তারিণী।
দেখলে তো বাবা, কেমন ছেলে দুটি?
অক্ষয়।
মা, তোমার পছন্দ ভালো, এ কথা তো আমি অস্বীকার করতে পারি নে।
জগত্তারিণী।
মেয়েদের রকম দেখলে তো বাবা? এখন কান্নাকাটি কোথায় গেছে তার ঠিক নেই।
অক্ষয়।
ঐ তো ওদের দোষ। কিন্তু মা, তোমাকে নিজে গিয়ে আশীর্বাদ ক'রে ছেলেদুটিকে দেখতে হচ্ছে।
জগত্তারিণী।
সে কি ভালো হবে অক্ষয়। ওরা কি পছন্দ জানিয়েছে।
অক্ষয়।
খুব জানিয়েছে। এখন তুমি নিজে এসে আশীর্বাদ করে গেলেই চট্পট্ স্থির হয়ে যায়।
জগত্তারিণী।
তা বেশ, তোমরা যদি বল, তা যাব, আমি ওদের মার বয়সী-- আমার লজ্জা কিসের।
পুরবালার প্রবেশ
পুরবালার প্রবেশ
জগত্তারিণী।
কী আর বলব পুরো, এমন সোনার চাঁদ ছেলে।
পুরবালা।
তা জানতুম। নীর-নৃপর অদৃষ্টে কি খারাপ ছেলে হতে পারে।
অক্ষয়।
তাদের বড়দিদির অদৃষ্টের আঁচ লেগেছে আর-কি।
পুরবালা।
আচ্ছা, থামো। যাও দেখি, তাদের সঙ্গে একটু আলাপ করো গে; কিন্তু শৈল গেল কোথায়।
অক্ষয়।
সে খুশি হয়ে দরজা বন্ধ করে পুজোয় বসেছে।
শ্রীশ ও বিপিনের নিকট আসিয়া
ব্যাপারটা কী। রসিকদা, আজকাল তো খুব খাওয়াচ্ছ দেখছি। প্রত্যহ যাকে দু বেলা দেখছ তাকে হঠাৎ ভুলে গেলে?
রসিক।
এঁদের নূতন আদর, পাতে যা পড়ছে তাতেই খুশি হচ্ছেন। তোমার আদর পুরোনো হয়ে এল, তোমাকে নূতন করে খুশি করি এমন সাধ্য নেই ভাই।
অক্ষয়।
কিন্তু শুনেছিলেম, আজকের সমস্ত মিষ্টান্ন এবং এ পরিবারের সমস্ত অনাস্বাদিত মধু উজাড় করে নেবার জন্যে দুটি অখ্যাতনামা যুবকের অভ্যুদয় হবে-- এঁরা তাঁদেরই অংশে ভাগ বসাচ্ছেন নাকি। ওহে রসিকদা, ভুল কর নি তো?
রসিক।
ভুলের জন্যেই তো আমি বিখ্যাত। বড়োমা জানেন তাঁর বুড়ো রসিক-কাকা যাতে হাত দেবেন তাতেই গলদ হবে।
অক্ষয়।
বল কী রসিকদাদা। করেছ কী। সে দুটি ছেলেকে কোথায় পাঠালে?
রসিক।
ভ্রমক্রমে তাঁদের ভুল ঠিকানা দিয়েছি।
অক্ষয়।
সে বেচারাদের কী গতি হবে।
রসিক।
বিশেষ অনিষ্ট হবে না। তাঁরা কুমারটুলিতে নীলমাধব চৌধুরির বাড়িতে এতক্ষণে জলযোগ সমাধা করেছেন। বনমালী ভট্টাচার্য তাঁদের তত্ত্বাবধানের ভার নিয়েছেন।
অক্ষয়।
তা যেন বুঝলুম, মিষ্টান্ন সকলেরই পাতে পড়ল, কিন্তু তোমারই জলযোগটি কিছু কটু রকম হবে। এইবেলা ভ্রম সংশোধন করে নাও। শ্রীশবাবু, বিপিনবাবু, কিছু মনে কোরো না-- এর মধ্যে একটু পারিবারিক রহস্য আছে।
শ্রীশ।
সরলপ্রকৃতি রসিকবাবু সে রহস্য আমাদের নিকট ভেদ করেই দিয়েছেন। আমাদের ফাঁকি দিয়ে আনেন নি।
বিপিন।
মিষ্টান্নের থালায় আমরা অনধিকার আক্রমণ করি নি, শেষ পর্যন্ত তার প্রমাণ দিতে প্রস্তুত আছি।
অক্ষয়।
বল কী বিপিনবাবু। তা হলে চিরকুমার-সভাকে চিরজন্মের মতো কাঁদিয়ে এসেছ? জেনেশুনে, ইচ্ছাপূর্বক?
রসিক।
না না, তুমি ভুল করছ অক্ষয়।
অক্ষয়।
আবার ভুল? আজ কি সকলেরই ভুল করবার দিন হল নাকি।--
গান
ভুলে ভুলে আজ ভুলময়।
ভুলের লতায় বাতাসের ভুলে
ফুলে ফুলে হোক ফুলময়।
আনন্দ-ঢেউ ভুলের সাগরে উছলিয়া হোক কূলময়।
রসিক।
এ কী, বড়োমা আসছেন যে!
অক্ষয়।
আসবারই তো কথা। উনি তো কুমারটুলির ঠিকানায় যাবেন না।
জগত্তারিণীর প্রবেশ
জগত্তারিণীর প্রবেশ
শ্রীশ ও বিপিনের ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম
দুইজনকে দুই মোহর দিয়া জগত্তারিণীর আশীর্বাদ। জনান্তিকে অক্ষয়ের সহিত জগত্তারিণীর আলাপ
শ্রীশ ও বিপিনের ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম
দুইজনকে দুই মোহর দিয়া জগত্তারিণীর আশীর্বাদ। জনান্তিকে অক্ষয়ের সহিত জগত্তারিণীর আলাপ
অক্ষয়।
মা বলছেন, তোমাদের আজ ভালো করে খাওয়া হল না, সমস্তই পাতে পড়ে রইল।
শ্রীশ।
আমরা দুবার চেয়ে নিয়ে খেয়েছি।
বিপিন।
যেটা পাতে পড়ে আছে ওটা তৃতীয় কিস্তি।
শ্রীশ।
ওটা না পড়ে থাকলে আমাদেরই পড়ে থাকতে হত।
জগত্তারিণী।
(জনান্তিকে) তা হলে তোমরা ওঁদের বসিয়ে কথাবার্তা কও বাছা, আমি আসি।
[ প্রস্থান
[ প্রস্থান
রসিক।
না, এ ভারি অন্যায় হল।
অক্ষয়।
অন্যায়টা কী হল।
রসিক।
আমি ওঁদের বার বার করে বলে এসেছি যে, ওঁরা কেবল আজ আহারটি করেই ছুটি পাবেন, কোনোরকম বধবন্ধনের আশঙ্কা নেই। কিন্তু--
শ্রীশ।
ওর মধ্যে কিন্তুটা কোথায় রসিকবাবু। আপনি অত চিন্তিত হচ্ছেন কেন।
রসিক।
বলেন কী শ্রীশবাবু, আপনাদের আমি কথা দিয়েছি যখন--
বিপিন।
তা বেশ তো, এমনিই কী মহাবিপদে ফেলেছেন।
শ্রীশ।
মা আমাদের যে আশীর্বাদ করে গেলেন আমার যেন তার যোগ্য হই।
রসিক।
না না, শ্রীশবাবু, সে কোনো কাজের কথা নয়। আপনারা যে দায়ে পড়ে ভদ্রতার খাতিরে--
বিপিন।
রসিকবাবু, আমাদের প্রতি অবিচার করবেন না-- দায়ে পড়ে--
রসিক।
দায় নয় তো কী মশায়। সে কিছুতেই হবে না। আমি বরঞ্চ সেই ছেলেদুটোকে বনমালীর হাত ছাড়িয়ে কুমারটুলি থেকে এখনো ফিরিয়ে আনব, তবু--
শ্রীশ।
আপনার কাছে কী অপরাধ করেছি রসিকবাবু।
রসিক।
না না, এ তো অপরাধের কথা হচ্ছে না। আপনারা ভদ্রলোক, কৌমার্যব্রত অবলম্বন করেছেন-- আমার অনুরোধে পড়ে পরের উপকার করতে এসে শেষকালে--
বিপিন।
শেষকালে নিজের উপকার করে ফেলব এটুকু আপনি সহ্য করতে পারবেন না-- এমনি হিতৈষী বন্ধু!
শ্রীশ।
আমরা যেটাকে সৌভাগ্য বলে স্বীকার করছি-- আপনি তার থেকে আমাদের বঞ্চিত করতে চেষ্টা করছেন কেন।
রসিক।
শেষকালে আমাকে দোষ দেবেন না।
বিপিন।
নিশ্চয় দেব, যদি না আপনি স্থির হয়ে শুভকর্মে সহায়তা করেন।
রসিক।
আমি এখনো সাবধান করছি--
গতং তদ্গাম্ভীর্যং তটমপি চিতং জালিকশতৈঃ
সখে হংসোত্তিষ্ঠ ত্বরিতমমুতো গচ্ছ সরসঃ।
সে গাম্ভীর্য গেল কোথা, নদীতট হেরো হোথা
জালিকেরা জালে ফেলে ঘিরে--
সখে হংস, ওঠো ওঠো, সময় থাকিতে ছোটো
হেথা হতে মানসের তীরে।
শ্রীশ।
কিছুতেই না। তা, আপনার সংস্কৃত শ্লোক ছুঁড়ে মারলেও সখা হংসরা কিছুতেই এখান থেকে নড়ছেন না।
রসিক।
স্থান খারাপ বটে, নড়বার জো নেই। আমি তো অচল হয়ে বসে আছি-- হায় হায়--
অয়িকুরঙ্গ তপোবনবিভ্রমাৎ
উপগতাসি কিরাতপুরীমিমাম্।
ভৃত্যের প্রবেশ
ভৃত্যের প্রবেশ
ভৃত্য।
চন্দ্রবাবু এসেছেন।
অক্ষয়।
এইখানেই ডেকে নিয়ে আয়।
[ ভৃত্যের প্রস্থান
[ ভৃত্যের প্রস্থান
রসিক।
একেবারে দারোগার হাতে চোর-দুটিকে সমর্পণ করে দেওয়া হোক।
চন্দ্রবাবুর প্রবেশ
চন্দ্রবাবুর প্রবেশ
চন্দ্রবাবু।
এই-যে, আপনারা এসেছেন। পূর্ণবাবুকেও দেখছি।
অক্ষয়।
আজ্ঞে না, আমি পূর্ণ নই, তবু অক্ষয় বটে।
চন্দ্রবাবু।
অক্ষয়বাবু। তা, বেশ হয়েছে, আপনাকেও দরকার ছিল।
অক্ষয়।
আমার মতো অদরকারি লোককে যে- দরকারে লাগাবেন তাতেই লাগতে পারি-- বলুন কী করতে হবে।
চন্দ্রবাবু।
আমি ভেবে দেখেছি আমাদের সভা থেকে কুমারব্রতের নিয়ম না ওঠালে সভাকে অত্যন্ত সংকীর্ণ করে রাখা হচ্ছে। শ্রীশবাবু বিপিনবাবুকে এই কথাটা একটু ভালো করে বোঝাতে হবে।
অক্ষয়।
ভারি কঠিন কাজ, আমার দ্বারা হবে কিনা সন্দেহ।
চন্দ্রবাবু।
একবার একটা মতকে ভালো ব'লে গ্রহণ করেছি ব'লেই সেটাকে পরিত্যাগ করবার ক্ষমতা দূর করা উচিত নয়। মতের চেয়ে বিবেচনাশক্তি বড়ো। শ্রীশবাবু, বিপিনবাবু--
শ্রীশ।
আমাদের অধিক বলা বাহুল্য--
চন্দ্রবাবু।
কেন বাহুল্য। আপনারা যুক্তিতেও কর্ণপাত করবেন না?
বিপিন।
আমরা আপনারই মতে--
চন্দ্রবাবু।
আমার মত এক সময় ভ্রান্ত ছিল সে কথা স্বীকার করছি, আপনারা এখনো সেই মতেই--
রসিক।
এই-যে পূর্ণবাবু আসছেন। আসুন আসুন।
পূর্ণর প্রবেশ
পূর্ণর প্রবেশ
চন্দ্রবাবু।
পূর্ণবাবু, তোমার প্রস্তাবমতে আমাদের সভা থেকে কুমারব্রত তুলে দেবার জন্যেই আজ আমরা এখানে মিলিত হয়েছি। কিন্তু, শ্রীশবাবু এবং বিপিনবাবু অত্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, এখন ওঁদের বোঝাতে পারলেই--
রসিক।
ওঁদের বোঝাতে আমি ত্রুটি করি নি চন্দ্রবাবু--
চন্দ্রবাবু।
আপনার মতো বাগ্মী যদি ফল না পেয়ে থাকেন তা হলে--
রসিক।
ফল যা পেয়েছি "তা ফলেন পরিচীয়তে'।
চন্দ্রবাবু।
কি বলছেন ভালো বুঝতে পারছি নে।
অক্ষয়।
ওহে রসিকদা, চন্দ্রবাবুকে খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। আমি দুটি প্রত্যক্ষ প্রমাণ এখনই এনে উপস্থিত করছি।
শ্রীশ।
পূর্ণবাবু, ভালো আছেন তো?
পূর্ণ।
হাঁ।
বিপিন।
আপনাকে একটু শুকনো দেখাচ্ছে।
পূর্ণ।
না, কিছু না।
শ্রীশ।
আপনাদের পরীক্ষার আর তো দেরি নেই।
পূর্ণ।
না।
নৃপবালা ও নীরবালাকে লইয়া অক্ষয়ের প্রবেশ
নৃপবালা ও নীরবালাকে লইয়া অক্ষয়ের প্রবেশ
অক্ষয়।
(নৃপবালা ও নীরবালার প্রতি) ইনি চন্দ্রবাবু, ইনি তোমাদের গুরুজন,এঁকে প্রণাম করো। (নৃপ ও নীরর প্রণাম) চন্দ্রবাবু, নূতন নিয়মে আপনাদের সভায় এই দুটি সভ্য বাড়ল।
চন্দ্রবাবু।
বড়ো খুশি হলেম। এঁরা কে।
অক্ষয়।
আমার সঙ্গে এঁদের সম্বন্ধ খুব ঘনিষ্ঠ। এঁরা আমার দুটি শ্যালী। শ্রীশবাবু এবং বিপিনবাবুর সঙ্গে এঁদের সম্বন্ধ শুভলগ্নে আরো ঘনিষ্ঠতর হবে। এঁদের প্রতি দৃষ্টি করলেই বুঝবেন, রসিকবাবু এই যুবক-দুটির যে মতের পরিবর্তন করিয়েছেন সে কেবলমাত্র বাগ্মিতার দ্বারা নয়।
চন্দ্রবাবু।
বড়ো আনন্দের কথা।
পূর্ণবাবু।
শ্রীশবাবু, বড়ো খুশি হলুম। বিপিনবাবু, আপনাদের বড়ো সৌভাগ্য। আশা করি অবলাকান্তবাবুও বঞ্চিত হন নি, তাঁরও একটি--
নির্মলার প্রবেশ
নির্মলার প্রবেশ
চন্দ্রবাবু।
নির্মলা, শুনে খুশি হবে, শ্রীশবাবু এবং বিপিনবাবুর সঙ্গে এঁদের বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হয়ে গেছে। তা হলে কুমারব্রত উঠিয়ে দেওয়া সম্বন্ধে প্রস্তাব উত্থাপন করাই বাহুল্য।
নির্মলা।
কিন্তু অবলাকান্তবাবুর মত তো নেওয়া হয় নি-- তাঁকে এখানে দেখছি নে-
চন্দ্রবাবু।
ঠিক কথা, আমি সেটা ভুলেই গিয়েছিলুম-- তিনি আজ এখনো এলেন না কেন।
রসিক।
কিছু চিন্তা করবেন না, তাঁর পরিবর্তন দেখলে আপনারা আরো আশ্চর্য হবেন।
অক্ষয়।
চন্দ্রবাবু, এবারে আমাকেও দলে নেবেন। সভাটি যেরকম লোভনীয় হয়ে উঠল এখন আমাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না।
চন্দ্রবাবু।
আপনাকে পাওয়া আমাদের সৌভাগ্য।
অক্ষয়।
আমার সঙ্গে সঙ্গে আর-একটি সভ্যও পাবেন। আজকের সভায় তাঁকে কিছুতেই উপস্থিত করতে পারলেম না। এখন তিনি নিজেকে সুলভ করবেন না-- বাসরঘরে ভূতপূর্ব কুমার-সভাটিকে সাধ্যমত পিণ্ডদান করে তার পরে যদি দেখা দেন। এইবার অবশিষ্ট সভ্যটি এলেই আমাদের চিরকুমার-সভা সম্পূর্ণ সমাপ্ত হয়।
শৈলবালার প্রবেশ
শৈলবালার প্রবেশ
শৈলবালা।
(চন্দ্রবাবুকে প্রণাম করিয়া) আমাকে ক্ষমা করবেন।
শ্রীশ।
এ কী, অবলাকান্তবাবু--
অক্ষয়।
আপনারা মত-পরিবর্তন করেছেন, ইনি বেশ-পরিবর্তন করেছেন মাত্র।
রসিক।
শৈলজা ভবানী এতদিন কিরাতবেশ ধারণ করেছিলেন, আজ ইনি আবার তপস্বিনীবেশ গ্রহণ করলেন।
চন্দ্রবাবু।
নির্মলা, আমি কিছুই বুঝতে পারছি নে।
নির্মলা।
অন্যায়! ভারি অন্যায়! অবলাকান্তবাবু--
অক্ষয়।
নির্মলা দেবী ঠিক বলেছেন-- অন্যায়। কিন্তু, সে বিধাতার অন্যায়। এঁর অবলাকান্ত হওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু ভগবান এঁকে বিধবা শৈলবালা করে কী মঙ্গল সাধন করছেন সে রহস্য আমাদের অগোচর।
শৈলবালা।
(নির্মলার প্রতি) আমি অন্যায় করেছি, সে অন্যায়ের প্রতিকার আমার দ্বারা কী হবে? আশা করি কালে সমস্ত সংশোধন হয়ে যাবে।
পূর্ণ।
(নির্মলার নিকটে আসিয়া) এই অবকাশে আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি, চন্দ্রবাবুর পত্রে আমি যে স্পর্ধা প্রকাশ করেছিলুম সে আমার পক্ষে অন্যায় হয়েছিল-- আমার মতো অযোগ্য--
চন্দ্রবাবু।
কিছু অন্যায় হয় নি পূর্ণবাবু, আপনার যোগ্যতা যদি নির্মলা না বুঝতে পারেন তো সে নির্মলারই বিবেচনার অভাব।
[ নির্মলার নতমুখে নিরুত্তরে প্রস্থান
[ নির্মলার নতমুখে নিরুত্তরে প্রস্থান
রসিক।
(পূর্ণের প্রতি জনান্তিকে) ভয় নেই পূর্ণবাবু, আপনার দরখাস্ত মঞ্জুর-- প্রজাপতির আদালতে ডিক্রি পেয়েছেন-- কাল প্রত্যুষেই জারি করতে বেরোবেন।
শ্রীশ।
(শৈলবালার প্রতি) বড়ো ফাঁকি দিয়েছেন।
বিপিন।
সম্বন্ধের পূর্বেই পরিহাসটা করে নিয়েছেন।
শৈলবালা।
পরে তাই বলে নিষ্কৃতি পাবেন না।
বিপিন।
নিষ্কৃতি চাই নে।
রসিক।
এইবারে নাটক শেষ হল। এইখানে ভরতবাক্য উচ্চারণ করে দেওয়া যাক--
সর্বস্তরতু দুর্গাণি সর্বো ভদ্রাণি পশ্যতু।
সর্বঃ কামানবাপ্নোতু সর্বঃ সর্বত্র নন্দতু॥