দেবদত্ত ও একদল উপাসক
ভৈরবমন্দিরের প্রাঙ্গণ
দেবদত্ত ও একদল উপাসক
গান
গান
সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ,
হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্তপানে চাহ।
দূর করো মহারুদ্র,
যাহা মুগ্ধ, যাহা ক্ষুদ্র,
মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উৎসাহ।
দুঃখের মন্থনবেগে উঠিবে অমৃত
শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত।
তব দীপ্ত রৌদ্র তেজে
নির্ঝরিয়া গলিবে যে,
প্রস্তর-শৃঙ্খলোন্মুক্ত ত্যাগের প্রবাহ॥
[দেবদত্ত ব্যতীত অন্য সকলের প্রস্থান
[দেবদত্ত ব্যতীত অন্য সকলের প্রস্থান
বিক্রমের প্রবেশ
বিক্রমের প্রবেশ
বিক্রম।
এর কী অর্থ? আজ মীনকেতুর পূজার আয়োজন করেছি। ভৈরবের স্তব দিয়ে তোমরা তার ভূমিকা করলে কেন।
দেবদত্ত।
রাজার এই পূজা এখনো জনসাধারণে স্বীকার করতেই পারছে না। এমন কি, তারা ভীত হয়েছে।
বিক্রম।
কেন, তাদের ভয় কিসের।
দেবদত্ত।
তোমার সাহস দেখে তারা স্তম্ভিত। পঞ্চশর দগ্ধ হয়েছেন যাঁর তপোবনে, তাঁরই পূজার বনে কন্দর্পের পূজা? এর পরিণামে বিপদ ঘটবে না কি?
বিক্রম।
কন্দর্প সেবার এসেছিলেন অপরাধীর মতো লুকিয়ে -- এবার তাঁকে ডাকব প্রকাশ্যে, আসবেন দেবতার যোগ্য নিঃসংকোচে -- মাথা তুলে ধ্বজা উড়িয়ে। বিপদের ভয় বিপদ ডেকে আনে।
দেবদত্ত।
মহারাজ, আদিকাল থেকেই ঐ দুই দেবতার মধ্যে বিরোধ।
বিক্রম।
ক্ষতি তাতে মানুষেরই। এক দেবতা আরেক দেবতার প্রসাদ থেকে মানুষকে বঞ্চিত করেন। ব্রাহ্মণ, শাস্ত্র মিলিয়ে চিরদিন তোমরা দেবপূজার ব্যাবসা করে এসেছ তাই দেবতার তোমরা কিছুই জান না।
দেবদত্ত।
সে-কথা ঠিক, দেবতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় পুঁথির থেকে। শ্লোকের ভিড় ঠেলে মরি; দক্ষিণা পাই, কিন্তু ওঁদের কাছে ঘেঁষবার সময় পাইনে।
বিক্রম।
আমার মীনকেতু অশাস্ত্রীয়; অনুষ্টুভ-ক্রিষ্টভের বন্ধন মানেন না। তিনি প্রলয়েরই দেবতা। রুদ্রভৈরবের সঙ্গেই তাঁর অন্তরের মিল -- পিনাক ছদ্মবেশ ধরেছে তাঁর পুষ্পধনুতে।
দেবদত্ত।
মহারাজ, ঐ দেবতাটিকে যথাসাধ্য পাশ কাটিয়ে চলবারই চেষ্টা করেছি। আভাসে যেটুকু জানাশোনা ঘটেছে তাতে ভৈরবের সঙ্গে অন্তত বেশভূষায় ওঁর যথেষ্ট মিল দেখতে পাই নি।
বিক্রম।
তার কারণ, এ পর্যন্ত রতি নিজেরই বেশের অংশ দিয়ে কন্দর্পকে সাজিয়েছে। তাঁকে রাঙিয়েছে নিজেরই কজ্জলের কালিমায়, কুঙ্কুমের রক্তিমায়, নীল কঞ্চুলিকার নীলিমায়, -- উনি রমণীর লালনে লালিত্যে আচ্ছন্ন আবিষ্ট, তাই তো বজ্রপাণি ইন্দ্রের সভায় উনি লজ্জিতভাবে চরের বৃত্তি করেন। রুদ্রের পৌরুষের আগুনে তাই তো ওঁকে দগ্ধ করেছিল।
দেবদত্ত।
সে-ইতিহাস তো চুকে গেছে। আবার সেই পোড়া দেবতাকে নিয়ে কেন এই উপসর্গ। পুনর্বার ওঁকে পোড়াতে হবে নাকি।
বিক্রম।
না, তাঁকে মৃত্যুর ভিতর দিয়েই বাঁচাতে হবে -- সেজন্যে বীরের শক্তি চাই। তোমাদের ভৈরবের স্তব সম্পূর্ণ হবে না আমাদের মীনকেতুর স্তব যদি তার সঙ্গে না যোগ করি।
ভস্ম-অপমানশয্যা ছাড়ো, পুষ্পধনু,
রুদ্রবহ্নি হতে লহ জ্বলদর্চি তনু।
যাহা মরণীয় যাক মরে,
জাগো অবিস্মরণীয় ধ্যানমূর্তি ধরে।
যাহা রূঢ়, যাহা মূঢ় তব,
যাহা স্থূল দগ্ধ হোক, হও নিত্য নব।
মৃত্যু হতে জাগো পুষ্পধনু,
হে অতনু, বীরের তনুতে লহ তনু।
তোমরা জান না, মহেশ্বর মদনকে অগ্নিবর দিয়েছিলেন, মৃত্যু দিয়েই তিনি তাকে অমর করেছেন। অনঙ্গই অমৃত দেবার অধিকারী হয়েছেন।
মৃত্যুঞ্জয় যে-মৃত্যুরে দিয়েছেন হানি
অমৃত সে-মৃত্যু হতে দাও তুমি আনি।
সেই দিব্য দীপ্যমান দাহ
উন্মুক্ত করুক অগ্নি-উৎসের প্রবাহ।
মিলনেরে করুক প্রখর,
বিচ্ছেদেরে করে দিক দুঃসহ সুন্দর।
মৃত্যু হতে ওঠো পুষ্পধনু,
হে অতনু, বীরের তনুতে লহ তনু॥
মীনকেতুর পথ সহজ পথ নয়, সে নয় পুষ্পবিকীর্ণ ভোগের পথ, সে দেয় না আরামের তৃপ্তি।
দেবদত্ত।
শুনে ভয় হয়। কিন্তু যা নিয়ে বিপদ ঘটে তার কারণ হচ্চে অনঙ্গদেব যে-ঘরকে তাঁর পায়ের ধূলিলেপনে চিহ্নিত করে নেন, সে-ঘরে অন্য কোনো দেবতাকে প্রবেশ করতে দেন না। তাতেই পূজনীয়দের মনে ঈর্ষা জন্মায়।
বিক্রম।
মনে হচ্ছে কথাটা আমাকেই লক্ষ্য ক'রে। সাহস বাড়ছে।
দেবদত্ত।
রাজার সঙ্গে বন্ধুত্ব দুঃসাহসের চরম। ভাগ্যদোষেই রাজার বন্ধু দুর্মুখ। ইচ্ছাক্রমে নয়।
বিক্রম।
তবে মুখ খোলো। স্পষ্ট করেই বলো, প্রজারা আমার নামে কী বলছে।
দেবদত্ত।
তারা বলছে, অন্তঃপুরের অবগুণ্ঠনতলে সমস্ত রাজ্যে আজ প্রদোষান্ধকার। রাজলক্ষ্মী রাজ্ঞীর ছায়ায় ম্লান।
বিক্রম।
দুর্মুখ, প্রজারঞ্জনে আরেকবার সীতার নির্বাসন চাই নাকি?
দেবদত্ত।
নির্বাসন তো তুমিই দিতে চাও তাঁকে অন্তঃপুরে, প্রজারা তাঁকে চায় সর্বজনের রাজসিংহাসনে। তাঁর হৃদয়ের সম্পূর্ণ অংশ তো তোমার নয়, এক অংশ প্রজাদের। শুধু কি তিনি রাজবধূ। তিনি যে লোকমাতা।
বিক্রম।
দেবদত্ত, অংশ নিয়েই যত বিরোধ। ঐ নিয়েই কুরুক্ষেত্র। ঐ তিনি আসছেন, রাজবধূর অংশ নিয়ে, না লোকমাতার?
দেবদত্ত।
আমি তবে বিদায় হই, মহারাজ।
[প্রস্থান
[প্রস্থান
মহিষী সুমিত্রার প্রবেশ
মহিষী সুমিত্রার প্রবেশ
বিক্রম।
দেবী, কোথায় চলেছ। শুনে যাও!
সুমিত্রা।
কী মহারাজ।
বিক্রম।
একটা সুসংবাদ আছে।
সুমিত্রা।
কী, শুনি।
বিক্রম।
লোকনিন্দার পরম গৌরবে আমি ধন্য হয়েছি।
সুমিত্রা।
নিন্দা কিসের।
বিক্রম।
লোকে বলছে, তোমার প্রেমে কর্তব্যকেও তুচ্ছ করতে পেরেছি। এতবড়ো কথা।
সুমিত্রা।
যারা বলে তাদের কথা মিথ্যা হোক।
বিক্রম।
অক্ষয় হোক এই সত্য, ইতিহাসে বিখ্যাত হোক, কবিকণ্ঠে আখ্যাত হোক, রসতত্ত্বে ব্যাখ্যাত হোক, ইতরলোকের নিন্দাপ্রশংসার অতীত হোক।
সুমিত্রা।
মহারাজ, যে-প্রেম রাজকর্তব্যেরও উপরে, সে গ্রহণ করুন দেবতা, সে কি আমি নিতে পারি।
বিক্রম।
দেবতার যা প্রাপ্য তিনি তা নেবেন তোমার মধ্যে দিয়েই। তোমার মুখে পরমাশ্চর্যকে দেখেছি। লজ্জা কোরো না, শোনো আমার কথা। যশের লোভে যারা দেশ জয় করে বেড়ায় লক্ষ্মীর তারা বিদূষক। তাদের আয়ু যায় বৃথায়, কীর্তিও চিরকাল থাকে না, লক্ষ্মী বসে বসে হাসেন। আমি তাদের দলে নই। কাশ্মীরে গিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম তোমারই সাধনায়।
সুমিত্রা।
তোমার যুদ্ধযাত্রা সফল হয়েছে। এখন আর কী চাও।
বিক্রম।
পেয়েছি বীণাটিকে। সংগীত দিয়ে অধিকার হবে কোন্ শুভক্ষণে? সুর মেলাতে পারছি নে, পেয়েও হার হচ্ছে পদে পদে। ভাগ্যের কাছে যে-দান পেয়েছি, সেই দানই আমাকে লজ্জা দিচ্ছে।
সুমিত্রা।
মুঠোর মধ্যে চেপে রেখেছ আর কল্পনা করছ, পাইনি। কিন্তু তোমার কাছে আমারও কিছু চাবার নেই কি।
বিক্রম।
সবই চাইতে পার, কিছু চাও না বলেই আমার রাজসম্পদ ব্যর্থ।
সুমিত্রা।
আমি চাই আমার রাজাকে।
বিক্রম।
পাও নি?
সুমিত্রা।
না, পাই নি। সিংহাসন থেকে তুমি নেমে এসেছ এই নারীর কাছে। আমাকে কেন তুলে নিয়ে যাও না তোমার সিংহাসনের পাশে?
বিক্রম।
হৃদয়ের সর্বোচ্চ শিখরে তোমার আসন দিয়েছি -- তাতেও গৌরব নেই?
সুমিত্রা।
মহারাজ, আমাকে নিয়ে অমন করে কথা সাজিয়ো না -- এ তোমাকে শোভা পায় না। এতে আমাকেও ছোটো করে। কী হবে আমার স্তুতিবাক্য। আমার অনুরোধ রাখো। আমি এসেছি প্রজাদের হয়ে প্রার্থনা জানাতে।
বিক্রম।
এই উদ্যানে? এখানে আজ ঋতুরাজের অধিকার। অন্তত আজ একদিনের জন্যেও সম্পূর্ণ ক'রে তাকে স্বীকার করো।
সুমিত্রা।
আমি তো তোমার আদেশ পালনে ত্রুটি করি নি -- উৎসব যাতে সুন্দর হয় আমি তো সেই আয়োজন করেছি। কিন্তু তোমারও কিছু করবার নেই কি? উৎসব যাতে মহৎ হয়ে ওঠে তুমি তাই করো, তোমার রাজমহিমা দিয়ে।
বিক্রম।
বলো, আমার কী করবার আছে।
সুমিত্রা।
কাশ্মীর থেকে যে-সব লুব্ধের দল তোমার সঙ্গে জালন্ধরে এসেছে, আজই সেই পরোপজীবীদের আদেশ করো কাশ্মীরে ফিরে যাক।
বিক্রম।
আমার এই বিদেশী অমাত্যদের 'পরে তোমার মনে ক্রোধ আছে।
সুমিত্রা।
আছে।
বিক্রম।
কাশ্মীরবিজয়ে ওরা আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল এই তার কারণ।
সুমিত্রা।
হাঁ মহারাজ, আমি জানি, বিশ্বাসঘাতকের শত্রুতা ভালো, তাদের মৈত্রী অস্পৃশ্য।
বিক্রম।
ওদের ধর্ম ওরা বুঝবে কিন্তু আমি কৃতঘ্ন হব কী করে।
সুমিত্রা।
তোমার সপক্ষে ওরা পাপ করেছে,ক্ষমা করতে হয় কোরো, কিন্তু তোমার বিপক্ষে অন্যায় করছে তাও কি ক্ষমা করতে হবে। তোমার ক্ষমার আশ্রয়ে প্রজাদের প্রতি পীড়ন হচ্ছে, তাতেও বাধা দেবে না?
বিক্রম।
মিথ্যা অপবাদ সৃষ্টি করছে প্রজারা, তাদের ঈর্ষা ওরা বিদেশী ব'লে।
সুমিত্রা।
তারও তো বিচার চাই।
বিক্রম।
এ-সব ব্যাপারে তুমি যখন হস্তক্ষেপ কর, মহারানী, তখন সুবিচার কঠিন হয়। তুমি স্বয়ং আন অভিযোগ, কোনো প্রমাণকে আমি কি তার উপরে আসন দিতে পারি। তুমি অনুরোধ করাতে যুধাজিৎকে বিনা বিচারেই পদচ্যুত করতে হল। আরও অমাত্য-বলি চাই তোমার?
সুমিত্রা।
তবে সেই ভালো। বিচার কোরো না। আমারই প্রার্থনা রাখো। কাশ্মীরের পঙ্গপালগুলো যদি কোনো অপরাধ না করেও থাকে তবু ওরা আমার রাত্রিদিনের লজ্জা। আমাকে তার থেকে বাঁচাও।
বিক্রম।
ওরা কলঙ্ক স্বীকার ক'রে বিপদ সামনে রেখে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। তোমার কথাতেও ওদের ত্যাগ করতে পারব না। দেখো প্রিয়ে, রাজার হৃদয়েই তোমার অধিকার,রাজার কর্তব্যে নয় এই কথা মনে রেখো।
সুমিত্রা।
মহারাজ, তোমার বিলাসে আমি সঙ্গিনী, তোমার রাজধর্মে আমি কেউ নই এ-কথা মনে রেখে আমার সুখ নেই।
[প্রস্থান
[প্রস্থান
বিক্রম।
শুনে যাও মহিষী।
সুমিত্রা।
(ফিরে এসে) কী, বলো।
বিক্রম।
তুমি জাগছ না কেন। কিসের এই সূক্ষ্ম আবরণ। সমস্ত আমার রাজার শক্তি নিয়ে একে সরাতে পারলেম না। আপনাকে প্রকাশ করো-- দেখা দাও, ধরা দাও। আমাকে এই অত্যন্ত অদৃশ্য বঞ্চনায় বিড়ম্বিত কোরো না।
সুমিত্রা।
আমিও তোমাকে ঐ কথাই বলছি। তুমি রাজা, আমি তোমার সম্পূর্ণ প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি নে-- তোমার শক্তিকে অন্ধকারে ঢেকে রাখলে। তুমি জাগ নি। তুমি আমাকে কেড়ে নিয়ে এসেছ কাশ্মীর থেকে -- সেই অপমান আমার ঘুচিয়ে দাও -- আমাকে রানীর পদ দিতে হবে।
বিক্রম।
আচ্ছা আচ্ছা, আমার রাজকোষ তোমার পায়ের তলায় সম্পূর্ণ ফেলে দিচ্ছি -- তুমি প্রজাদের দান করতে চাও, করো দান যত খুশি। তোমার দাক্ষিণ্যের প্লাবন বয়ে যাক এ রাজ্যে।
সুমিত্রা।
ক্ষমা করো মহারাজ, তোমার কোষ তোমারই থাক্। আমার দেহের অলংকার থাক্ আমার প্রজার জন্যে। অন্যায়ের হাত থেকে প্রজারক্ষায় যদি মহিষীর অধিকার আমার না থাকে তবে এ-সব তো বন্দিনীর বেশভূষা -- এ বইতে পারব না। মহিষীকে যদি গ্রহণ কর সেবিকাকেও পাবে, নইলে শুধু দাসী! সে আমি নই।
[ প্রস্থান
[ প্রস্থান
মন্ত্রীর প্রবেশ
মন্ত্রীর প্রবেশ
বিক্রম।
যুধাজিতের নামে রানীর কাছে কে অভিযোগ করেছিল? তুমি?
মন্ত্রী।
মন্ত্রগৃহের বাইরে আমি মন্ত্রণা করি নে, মহারাজ!
বিক্রম।
তবে এ-সব কথা কে তার কানে তুললে?
মন্ত্রী।
যারা দুঃখ পেয়েছে তারা স্বয়ং।
বিক্রম।
রানীর সাক্ষাৎ তারা পায় কী করে।
মন্ত্রী।
করুণার যোগ্য যারা করুণাময়ী স্বয়ং তাদের সন্ধান রাখেন।
বিক্রম।
আমাকে অতিক্রম করে যারা রানীর কাছে আবেদন নিয়ে আসে তারা দণ্ডের যোগ্য এ-কথা যেন মনে থাকে।
মন্ত্রী।
দণ্ড তারা পেয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা তাদের পাকা ফসলের খেত জ্বালিয়ে দিয়েছে, এ-কথা সবাই জানে।
বিক্রম।
মন্ত্রী, নানা কৌশলে তুমি এই অমাত্যদের নামে নিন্দা করবার সুযোগ খোঁজ, এটা আমি লক্ষ্য করেছি।
মন্ত্রী।
নিন্দনীয়দের নিন্দা করে থাকি কিন্তু কৌশল করে নয়।
বিক্রম।
এই বিদেশীরা আমার আশ্রিত, তোমাদের ঈর্ষা থেকে তাদের বিশেষভাবে রক্ষা করা আমার রাজকর্তব্য।
মন্ত্রী।
ওদের সম্বন্ধে নীরব থাকব। কিন্তু গুরুতর মন্ত্রণার বিষয় আছে। মহারাজ, ক্ষণকালের জন্যে --
বিক্রম।
এখন সময় নয়। যাও, বিপাশাকে সংবাদ দাও আজ বকুলবীথিকায় মধ্যরাত্রে তার নৃত্য। ত্রিবেদীকে বোলো মীনকেতুর পূজায় মন্ত্রোচ্চারণে তার কোনো স্খলন সহ্য করব না।
মন্ত্রী।
কাশ্মীরদেশী অমাত্য সবাই উৎসবে আসবেন সংবাদ পাঠিয়েছেন।
বিক্রম।
মহারানীর সঙ্গে কোনোমতে তাদের সাক্ষাৎ না হয়, সতর্ক থেকো।
[উভয়ের প্রস্থান
[উভয়ের প্রস্থান
রাজভ্রাতা নরেশ ও সুমিত্রার সহচরী বিপাশার প্রবেশ
রাজভ্রাতা নরেশ ও সুমিত্রার সহচরী বিপাশার প্রবেশ
বিপাশা।
মানব না ও-কথা। কাশ্মীর জয় করেছ তোমরা! মানব না।
নরেশ।
সুন্দরী, অরসিক ইতিহাস মধুর কণ্ঠের সম্মতির অপেক্ষা রাখে না।
বিপাশা।
রাজকুমার, দাম্ভিক কণ্ঠের আস্ফালনের ভাষাও তার ভাষা নয়।
নরেশ।
কিন্তু তলোয়ারের সাক্ষ্য তো মানতে হবে। যমরাজকে সামনে রেখে সে কথা কয়। আমাদের মহারাজ কাশ্মীর জয় করেছেন।
বিপাশা।
করেন নি। আমাদের যুবরাজ ছিলেন অনুপস্থিত। মানসসরোবর থেকে অভিষেকের জল আনতে গিয়েছিলেন। তাই যুদ্ধ হয় নি, দস্যুবৃত্তি হয়েছিল।
নরেশ।
তাঁর পিতৃব্য চন্দ্রসেন ছিলেন প্রতিনিধি। যুদ্ধ করেছিলেন।
বিপাশা।
যুদ্ধের ভান করেছিলেন। লুঠ-করা সিংহাসন হার-মানার ছদ্মমূল্যে নিজে কিনে নেবার জন্যে। তোমাদের সভাকবি এই নিয়ে সাত সর্গ কবিতা লিখেছেন। তোমাদের যুদ্ধ ফাঁকি, তোমাদের ইতিহাস ফাঁকি। চুপ করে হাসছ যে! লজ্জা নেই!
নরেশ।
মহারানী সুমিত্রা তো ফাঁকি নন। তিনি তো পর্বত থেকে নেমে এসেছেন আমাদের জয়লক্ষ্মীর অনুবর্তিনী হয়ে।
বিপাশা।
চুপ করো, চুপ করো। দুঃখের কথা মনে করিয়ে দিয়ো না। রাজকন্যা তখন বালিকা, বয়েস ষোলো। খুড়োমহারাজ এসে বললেন, বিজয়ীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে, নইলে সন্ধি অসম্ভব। রাজকুমারী আগুন জ্বালিয়ে ঝাঁপ দিয়ে মরতে গিয়েছিলেন। পুরবৃদ্ধরা এসে বললে, মা, রক্ষা করো, যে-পাণি মৃত্যুবর্ষণ করছে তোমার পাণি দিয়ে তাকে অধিকার করো -- শান্তি হোক।
নরেশ।
কিন্তু সেদিনকার কোনো গ্লানি তো মহারানীর মনে নেই। প্রসন্ন মহিমায় সিংহাসনে তাঁর আপন স্থান নিয়েছেন।
বিপাশা।
মহাদুঃখ ভোলবার মতোই মহাশক্তি তাঁর, তিনি যে সতীলক্ষ্মী। মৃত্যুর জন্যে যে-আগুন জ্বলেছিল তাকে সাক্ষী করে তাঁর বিবাহ। তিনদিন কৈলাসনাথের মন্দিরে ধ্যানে বসে উপবাস করে নিজেকে শুদ্ধ করে নিয়েছেন। অসহ্য অপমানকে নিঃশেষে নিজের মধ্যে দগ্ধ করে নিয়ে তবে এলেন তোমাদের ঘরে। বীরাঙ্গনার ক্ষমা যদি না থাকত তবে আগুন ধরত তোমাদের সিংহাসনে।
নরেশ।
জান বিপাশা, ঐ বীরাঙ্গনা আপন মহিমাচ্ছটায় কাশ্মীরের দিকে আমাদের হৃদয়ের একটি দীপ্যমান ছায়াপথ এঁকে দিয়েছেন। জালন্ধরের যুবকদের মন তিনি উদাস করেছেন ঐ কাশ্মীরের মুখে। তিনি তাদের ধ্যানের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছেন একটি অপরূপ জ্যোতিমূর্তি। তুমি জান না জালন্ধর থেকে কত পাগল গেছে ঐ কাশ্মীরে, খুঁজতে তাদের সাধনার ধনকে।
বিপাশা।
হায় রে, এ তো যুদ্ধ করা নয়। ওখানে তোমাদের অস্ত্র চলবার রাস্তা থাকতেও পারে কিন্তু হৃদয়জয়ের পথ ওদিকে বন্ধ করে দিয়েছ তোমাদের বর্বরতা দিয়ে।
নরেশ।
সাধনা করতে হবে -- তাতেও তো আনন্দ আছে।
বিপাশা।
তা করো, কিন্তু সিদ্ধির আশা ছেড়ে দাও।
নরেশ।
সিদ্ধি হবেই, আমি একলাই তা প্রমাণ করব -- কাশ্মীর পর্যন্ত না গিয়ে!
বিপাশা।
তোমার যত বড়ো অহংকার তত বড়োই দুরাশা।
নরেশ।
দুরাশাই আমার, সেই আমার অহংকার। আমার আকাঙ্খা পর্বতের দুর্গম শিখর। সেখানে প্রভাতের দুর্লভ তারাকে দেখি, ভোরের স্বপ্নে।
বিপাশা।
তোমাদের কবির কাছে পাঠ মুখস্থ করে এলে বুঝি?
নরেশ।
প্রয়োজন হয় না। বাইরে যার কাছ থেকে পাই কঠোর কথা, অন্তরে সেই দেয় বাণীর বর, গোপনে। যদি সাহস দাও তার নামটি তোমাকে বলি।
বিপাশা।
কাজ নেই অত সাহসে।
নরেশ।
তবে থাক্। কিন্তু এই পদ্মের কুঁড়ি, একে নিতে দোষ কী। এও তো মুখ ফুটে কিছু বলে না।
বিপাশা।
না, নেব না।
নরেশ।
কাশ্মীরের সরোবর থেকে এর মূল এনেছিলুম। অনেকদিন অনেক দ্বিধার পরে দেখা দিয়েছে তার এই কুঁড়িটি। মনে হচ্ছে আমার সৌভাগ্য তার প্রথম নিদর্শনপত্রটি পাঠিয়েছে -- এর মধ্যে একজনের অদৃশ্য স্বাক্ষর আছে। নেবে না? এই রেখে গেলুম তোমার পায়ের কাছে।
[ প্রস্থানোদ্যম
[ প্রস্থানোদ্যম
বিপাশা।
শোনো, শোনো, আবার বলছি তোমরা কাশ্মীর জয় কর নি।
নরেশ।
নিশ্চয় করেছি। সেজন্যে রাগ করতে পার, অবজ্ঞা করতে পারবে না। জয় করেছি।
বিপাশা।
ছল করে।
নরেশ।
না, যুদ্ধ করে।
বিপাশা।
তাকে যুদ্ধ বলে না।
নরেশ।
হাঁ, যুদ্ধই বলে।
বিপাশা।
সে জয় নয়।
নরেশ।
সে জয়ই।
বিপাশা।
তবে ফিরিয়ে নিয়ে যাও তোমার পদ্মের কুঁড়ি।
নরেশ।
ফিরিয়ে নেবার সাধ্য আমার নেই।
বিপাশা।
এ আমি কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলব।
নরেশ।
পার তো ছিঁড়ে ফেলো -- কিন্তু আমি দিয়েছি আর তুমি নিয়েছ, এ-কথা রইল বিধাতার মনে--চিরদিনের মতো।
[ প্রস্থান
[ প্রস্থান
সুমিত্রার প্রবেশ
সুমিত্রার প্রবেশ
সুমিত্রা।
পদ্মের কুঁড়ি-হাতে একলা দাঁড়িয়ে কী ভাবছিস, বিপাশা।
বিপাশা।
মনে-মনে ফুলের সঙ্গে করছি ঝগড়া।
সুমিত্রা।
সংসারে তোর ঝগড়া আর কিছুতেই মিটতে চায় না। কিসের ঝগড়া। ফুলের সঙ্গে আবার ঝগড়া কিসের।
বিপাশা।
ওকে বলছি, তুমি কাশ্মীরের ফুল, এখানেও তোমার মুখ প্রসন্ন কেন। অপমান এত সহজেই ভুলেছ?
সুমিত্রা।
দেবতার ফুল মানুষের অপরাধ যদি মনে রাখত তাহলে মরু হত এই পৃথিবী।
বিপাশা।
তুমিই সেই দেবতার ফুল, মহারানী, কিন্তু কাঁটাও দেবতারই সৃষ্টি। সত্যি করে বলো, কাশ্মীরের 'পরে যে-অন্যায় হয়েছে সে কখনো তোমার মনে পড়ে না? চুপ করে রইলে যে? উত্তর দেবে না? তোমার মাতৃভূমির দোহাই, এর একটা উত্তর দাও।
সুমিত্রা।
সেই আমার মাতৃভূমিরই দোহাই, আমাকে কেবল এই একটিমাত্র কথাই মনে রাখতে দে যে, আমি জালন্ধরের রানী।
বিপাশা।
আর যা ভুলতে পার ভুলো, কখনো ভুলতে দেব না যে, তুমি কাশ্মীরের কন্যা।
সুমিত্রা।
ভুলি নে। তাই কাশ্মীরের গৌরব রক্ষার জন্যেই কর্তব্যের গৌরব রাখতে হবে। নইলে এখানে কি দেহে মনে দাসীর কলঙ্ক মাখব।
বিপাশা।
সে-কথা প্রতিদিন বুঝতে পারছি, মহারানী। কাশ্মীরকে জয় করেছ এদের হৃদয়ে। আমি তো কেউ না, তবু তোমার মহিমার আলোতেই এরা আমাকে সুদ্ধ যে-চোখে দেখছে কাশ্মীরের কারো চোখে তো সে-মোহ লাগে নি।
সুমিত্রা।
বিনয় করছিস বুঝি?
বিপাশা।
বিনয় না, মহারানী। আমি আপনাতে আপনি বিস্মিত। হেসো না তুমি, এরা আমাকে উদ্দেশ ক'রে যে-সব কথা আজকাল বলে থাকে কাশ্মীরের ভাষাতে সে-সব কথা আছে বলে অন্তত আমার জানা নেই।
সুমিত্রা।
যে-ভোরবেলায় এখানে চলে এলি তখনো তোর কানে কাশ্মীরের ভাষা সম্পূর্ণ জাগবার সময় হয় নি। তবু কাকলি একটু আধটু আরম্ভ হয়েছিল, সে-কথা আজ বুঝি স্মরণ নেই? যাই হোক এখনো যে উৎসবের সাজ করিস নি।
বিপাশা।
সাজ শুরু করেছিলেম এমন সময় কে একজন এসে বললে ওরা কাশ্মীর জয় করেছে। কবরী থেকে ফেলে দিয়েছি মালা, আমার রক্তাংশুক লুটচ্ছে শিরীষবনের পথে। হাসছ কেন রানী।
সুমিত্রা।
সে-জায়গাটাকে তুই বনের পথ বলিস? এখানে আসবার সময় তোর রক্তাংশুক যে একজনের মাথায় দেখলুম।
বিপাশা।
ঐ দেখো, মহারানী, লজ্জা নেই, এখানকার যুবকদের অভ্যাস খারাপ, ওটা চুরি!
সুমিত্রা।
আমার সন্দেহ হচ্চে চুরিবিদ্যা শেখাবার জন্যই চোরের রাস্তায় তোর রক্তাংশুক পড়ে থাকে। শুনেছি তার বিদ্যা সম্পূর্ণ হয়েছে, এবার তার চুরির শেষ পরীক্ষা হবে, তোর উপর দিয়ে।
বিপাশা।
রাজার আজ্ঞা নাকি।
সুমিত্রা।
যাঁর আজ্ঞা তাঁর বেদী সাজাবি চল্। ঐ পদ্মের কুঁড়িটিই তোর প্রথম অর্ঘ্য হোক।
বিপাশা।
যেয়ো না তুমি, তবে একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, সত্য করে বলো। মকরকেতনের পূজায় আজ রাত্রে যে-উৎসব হবে তাতে তোমার উৎসাহ আছে?
সুমিত্রা।
মহারাজের আদেশ।
বিপাশা।
সে তো জানি কিন্তু তোমার নিজের মন কী বলে। -- চুপ করে থাকবে?
সুমিত্রা।
হাঁ, চুপ করেই থাকব।
বিপাশা।
আচ্ছা বেশ। কিন্তু একটা প্রশ্ন এতদিন তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে সাহস করি নি -- আজ জিজ্ঞাসা করবই -- চুপ করে থাকলে চলবে না।
সুমিত্রা।
কী প্রশ্ন তোর।
বিপাশা।
সত্যই কি তুমি মহারাজকে ভালোবাস। বলতেই হবে আমাকে।
সুমিত্রা।
হাঁ ভালোবাসি। উত্তর শুনে চুপ করে রইলি যে!
বিপাশা।
তবে সত্য কথা বলি তোমাকে। আর কিছুদিন আগে এ প্রশ্নও আমার মনে আসত না, উত্তর শুনলেও মেনে নিতুম।
সুমিত্রা।
আজ নিজের মনের সঙ্গে মনে মনে মিলিয়ে দেখছিস বুঝি।
বিপাশা।
তা তোমাকে লুকোব না, সবই তুমি জানো -- মিলিয়ে দেখছি বই কি, কিন্তু ঠিক মেলাতে পারছি নে।
সুমিত্রা।
কী করে মিলবে। প্রজারক্ষার করুণায় কাশ্মীরের অসম্মান স্বীকার ক'রে যেদিন আমি মহারাজের কাছে আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়েছিলুম তখন তিন দিন ধরে কৈলাসনাথের মন্দিরে কিসের জন্যে তপস্যা করেছি?
বিপাশা।
আমি হলে জালন্ধরের বিনিপাতের জন্যে তপস্যা করতুম।
সুমিত্রা।
এই শক্তি চেয়েছিলুম, রুদ্রের প্রসাদে আমার বিবাহ যেন ভোগের না হয়। জালন্ধরের রাজগৃহে আমি কোনোদিন কিছুর জন্যেই যেন লোভ না করি; তবে আমাকে অপমান স্পর্শ করতে পারবে না।
বিপাশা।
কোনোদিন তোমার মন বিচলিত হয় নি, মহারানী?
সুমিত্রা।
প্রতিদিন হয়েছে -- হাজারবার হয়েছে।
বিপাশা।
মাপ করো মহারানী, আমার সন্দেহ হয় তুমি তাঁকে অবজ্ঞা কর।
সুমিত্রা।
অবজ্ঞা! এমন কথা বলিস নে, বিপাশা। ওঁর মধ্যে তুচ্ছ কিছুই নেই। প্রচণ্ড ওঁর শক্তি -- সে-শক্তিতে বিলাসের আবিলতা নেই, আছে উল্লাসের উদ্দামতা। আমি যদি সেই কূল-ভাঙা বন্যার ধারে এসে দাঁড়াতুম, তাহলে আমার সমস্ত কোথায় ভেসে যেত, ধর্মকর্ম, শিক্ষাদীক্ষা। ঐ শক্তির দুর্জয়তাকে অহরহ ঠেকাতে গিয়েই আমার মন এমন পাষাণ হয়ে উঠল। এত অজস্র দান কোনো নারী পায় না -- এই দুর্লভ সৌভাগ্যকে প্রত্যাখ্যান করবার জন্যে নিজের সঙ্গে আমার এমন দুর্বিষহ দ্বন্দ্ব। মহারাজকে যদি অবজ্ঞা করতে পারতুম তাহলে তো সমস্তই সহজ হত। অন্তরে বাহিরে আমার দুঃখ ষে কত দুঃসহ তা তিনিই জানেন যাঁর কাছে ব্রত নিয়েছিলুম।
বিপাশা।
ব্রত যেন রাখলে, মহারানী, কিন্তু ভালোবাসা!
সুমিত্রা।
কী বলিস, বিপাশা। এই ব্রতই তো আমার ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, নইলে ধিক্কারের মধ্যে তলিয়ে যেত সে। প্রেম যদি লজ্জার বিষয় হয় তবে তার চেয়ে তার বিনাশ কী হতে পারে। আমার প্রেমকে বাঁচিয়েছেন তপস্বী মৃত্যুঞ্জয়। বিবাহের হোমাগ্নি থেকে আমার এ প্রেম গ্রহণ করেছি -- আহুতির আর অন্ত নেই।
বিপাশা।
নিষ্ঠুর তোমার দেবতা, আমি কিন্তু তাঁকে মানতে পারতুম না।
সুমিত্রা।
কী করে জানলি। তিনি ডাক দিলেই তোকেও মানতে হত। কিন্তু বিপাশা, ব্রতের কথা প্রকাশ করা অপরাধ, আজ অন্যায় করলুম, ক্ষমা করুন আমার ব্রতপতি।
বিপাশা।
আমাকে ক্ষমা করো, মহারানী। কিন্তু কোথায় চলেছ।
সুমিত্রা।
দেবদত্ত ঠাকুরের কাছে শুনলুম উৎসব উপলক্ষ্যে দূরের থেকে প্রজারা এসেছে। আজ মন্দিরের বাগানে তারা দর্শন পাবে। রাজা সেই সংবাদ পেয়ে শুনছি দ্বার রুদ্ধ করবার আদেশ করেছেন।
বিপাশা।
তুমি কি সে-দ্বার খোলাতে পারবে?
সুমিত্রা।
হয়তো পারব না। তবুও দেখতে যাব যদি কোনোখানে তার কোনো ফাঁক থাকে।
বিপাশা।
দ্বার রোধ করবার বিদ্যায় এরা এত নিপুণ যে, তার মধ্যে কোনো ত্রুটিই তুমি পাবে না-- এ আমি বলে দিচ্ছি।
[ উভয়ের প্রস্থান
[ উভয়ের প্রস্থান
দেবদত্তের প্রবেশ
রত্নেশ্বরের দ্রুত প্রবেশ
দেবদত্তের প্রবেশ
রত্নেশ্বরের দ্রুত প্রবেশ
রত্নেশ্বর।
ঠাকুর, দেবদত্ত ঠাকুর।
দেবদত্ত।
আমাকে ডাক পেড়ে আমাকে সুদ্ধ বিপদে ফেলবে দেখছি। কেন, কী হয়েছে।
রত্নেশ্বর।
রাজার কাছে অপরাধী। তার প্রহরীকে প্রহার করে এখানে এসেছি।
দেবদত্ত।
প্রহার করেছ? শুনে শরীর পুলকিত হল। এমন উগ্র পরিহাসের ইচ্ছা হঠাৎ কেন তোমার মনে উদয় হল।
রত্নেশ্বর।
উৎসবে রাজার দর্শন মিলবে আশা করেই বহু কষ্টে রাজধানীতে এসেছি। দ্বারী বললে উৎসবের দ্বার বন্ধ। তাই তাকে মারতে হল। অভিযোগ করতে এলে যদি সাক্ষাৎ না মেলে অপরাধ করলে অন্তত সেই উপলক্ষ্যে তো রাজার সামনে পৌঁছব।
দেবদত্ত।
কোথাকার মূর্খ তুমি। তুমি কি মনে কর, বুধকোটের গোঁয়ারের হাতে রাজার প্রহরী মার খেয়েছে এ-কথা সে মরে গেলেও স্বীকার করবে। তার স্ত্রী শুনলে যে ঘরে ঢুকতে দেবে না।
রত্নেশ্বর।
ঠাকুর, অনেক দূর থেকে এসেছি।
দেবদত্ত।
এখনো অনেক দূরেই আছ। রাজার দর্শন কি সহজে মেলে। যোজন গণনা করেই কি দূরত্ব।
রত্নেশ্বর।
গ্রামের মানুষ, রাজদর্শনের রীতিনীতি বুঝি নে সেই জেনেই মহারাজ দয়া করবেন।
দেবদত্ত।
নিজের বুদ্ধি থেকে বাহুবলে রাজদর্শনের যে-রীতি তুমি উদ্ভাবন করেছ সেটা রাজধানীতে বা রাজসভায় প্রচলিত নেই। পারিষদবর্গের জন্যে দর্শনী কিছু এনেছ কি।
রত্নেশ্বর।
আর কিছুই আনি নি আমার অভিযোগ ছাড়া, কিছু নেইও।
দেবদত্ত।
গ্রামের মানুষ তা বুঝতে পারছি।
রত্নেশ্বর।
কিসে বুঝলে, ঠাকুর।
দেবদত্ত।
এখনো এ-শিক্ষা হয় নি যে, রাজা তোমাদের মুখ থেকে শুনতে চান রাজ্যে সমস্তই ভালো চলছে, সত্যযুগ, রামরাজত্ব।
রত্নেশ্বর।
সমস্তই যদি ভালো না চলে?
দেবদত্ত।
তাহলে সেটা গোপন না করলে আরো মন্দ চলবে। রাজাকে অপ্রিয় কথা শোনানো রাজদ্রোহিতা।
রত্নেশ্বর।
আমাদের প্রতি যদি উৎপাত হয়?
দেবদত্ত।
হয় যদি তো সে তোমাদের প্রতিই হল। রাজাকে জানাতে গেলে উৎপাত হবে রাজার প্রতি।
রত্নেশ্বর।
ঠাকুর, সন্দেহ হচ্ছে পরিহাস করছ।
দেবদত্ত।
পরিহাস করেন ভাগ্য। বর্তমান অবস্থাটা বুঝিয়ে বলি। আজ ফাল্গুনের শুক্লাচতুর্দশী। এখানে চন্দ্রোদয়ের মুহূর্তে কেশরকুঞ্জে ভগবান মকরকেতনের পূজা, রাজার আদেশ। নাচগান বাজনা অনেক হবে, তার সঙ্গে তোমার কণ্ঠস্বর একটুও মিলবে না।
রত্নেশ্বর।
না মিলুক, কিন্তু রাজার চরণ মিলবে।
দেবদত্ত।
রাজাকে রাজসভায় পাওয়াই হচ্ছে পাওয়া, অস্থানে তাঁর অরাজকত্ব। অপেক্ষা করো, কাল নিজে তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব।
রত্নেশ্বর।
ঠাকুর, তোমাদের সবুর সয়। আমার যে সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে, প্রত্যেক মুহূর্ত অসহ্য। আমাদের সব চেয়ে দুর্ভাগ্য এই যে, যমযন্ত্রণাও যখন পাই, অপমানের শূলের উপর যখন চড়ে থাকি তখন অপেক্ষা করে থাকতে হয় রাজশাসনের জন্যে, নিজের হাত পঙ্গু। ধিক বিধাতাকে।
দেবদত্ত।
এখন একটু থামো, ঐ মহারানী আসছেন। ওঁর কাছে আর্তনাদ করে ধৃষ্টতা কোরো না।
রত্নেশ্বর।
আমার সৌভাগ্য, আপনি এসেছেন মহারানী, সমস্ত রাস্তা ওঁরই তো দর্শন কামনা করে এসেছি।
দেবদত্ত।
যিনি দুঃখ পান তাঁকেই দুঃখ দিতে চাও তোমরা? জান না, বিচারের ভার ওঁর 'পরে নেই, রাজ্যশাসন করেন রাজা।
রত্নেশ্বর।
মহারানী মা!
সুমিত্রার প্রবেশ
সুমিত্রার প্রবেশ
সুমিত্রা।
কী বৎস, তুমি কে।
দেবদত্ত।
ও কেউ না, নাম রত্নেশ্বর, এসেছে বুধকোট থেকে, এর বেশি ওর পরিচয় নেই। পায়ের ধুলো নিয়েই চলে যাবে। হল তো দর্শন -- চল্ এখন ঘরে, আমার ব্রাহ্মণীর প্রসাদ পাবি।
সুমিত্রা।
বুধকোট, সে তো শিলাদিত্যের শাসনে। বলো দেখি তার ব্যবহার কী রকম।
দেবদত্ত।
মহারানী, এ-সব প্রশ্ন এখানকার কোকিলের ডাকের মধ্যে ভালো শোনাচ্ছে না। আমি ওকে কালই নিজে রাজসভায় নিয়ে যাব।
রত্নেশ্বর।
রাজসভা! মহারানী, সেখানে কোনো আশা নেই বলেই এই উৎসবের প্রাঙ্গণে অভিযোগ এনেছি।
সুমিত্রা।
কেন আশা নেই।
রত্নেশ্বর।
শিলাদিত্য স্বয়ং রাজধানীতে উপস্থিত, আমাদের কান্না চাপা দেবার জন্যে। তিনি বসেন রাজার কানের কাছে, আমরা থাকি দূরে।
সুমিত্রা।
কোনো ভয় নেই তোমার, কী বলতে চাও আমার কাছে বলো।
রত্নেশ্বর।
সতীতীর্থ ভৃগুকূট পাহাড়ের তলে। আমাদেরই রাজকুলের মহিষী মহেশ্বরী সেখানে স্বামীর অনুমৃতা হয়েছিলেন, সে আজ পাঁচশো বছরের কথা।
সুমিত্রা।
সেই সতীকাহিনী তো ভাটের মুখে শুনেছি আমার বিবাহদিনে।
রত্নেশ্বর।
তাঁরই সিঁদুরের কৌটো সেখানে সমাধিমন্দিরে।
সুমিত্রা।
সেই কৌটোর সিঁদুর বিবাহকালে আমিও পরেছি।
রত্নেশ্বর।
আমাদের মেয়েরা তীর্থে যায়, সেই কৌটোর সিঁদুর মাথায় পরে পুণ্য কামনায়। এতকাল কোনো বাধা হয় নি।
সুমিত্রা।
এখন কি বাধা ঘটেছে।
রত্নেশ্বর।
হাঁ, মহারাণী।
সুমিত্রা।
কিসের বাধা।
রত্নেশ্বর।
শিলাদিত্য তীর্থদ্বারে কর বসিয়েছে। দরিদ্র মেয়েদের পক্ষে দুঃসাধ্য হল। হাত থেকে তাদের কঙ্কণ কেড়ে নিয়ে কর আদায় হচ্ছে।
সুমিত্রা।
কী বললে! মহারাজের সম্মতি আছে এতে?
রত্নেশ্বর।
রাজকার্যের রহস্য জানিনে, মা, কথা কইতে সাহস হয় না।
সুমিত্রা।
ঠাকুর, বলো, এতে মহারাজের সম্মতি আছে?
দেবদত্ত।
সম্মতির প্রয়োজন হয় না, এতে আয়বৃদ্ধি আছে।
সুমিত্রা।
সত্য করে বলো, এই অর্থ রাজকোষ গ্রহণ করে?
দেবদত্ত।
সেদিন সভাপণ্ডিত ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন অগ্নি যা গ্রহণ করেন তাতে মলিনতা থাকে না, রাজার কর সেই অগ্নি।
সুমিত্রা।
আমি পণ্ডিতের ব্যাখ্যা শুনতে চাই নে-- বলো এই অর্থ রাজকোষে আসে?
দেবদত্ত।
নিয়মরক্ষার জন্যে কিছু আসে বই কি, কিন্তু অনিয়মের কবলটা তার চেয়ে অনেক বড়ো, বেশির ভাগ তলিয়ে যায় সেই গহ্বরে। মহারানী, অনেক পাপীর উচ্ছিষ্ট রাজকোষে জমা হয়।
রত্নেশ্বর।
মা, এটুকু কথা নিয়ে দুঃখ কোরো না -- আমাদের অন্নসম্বল অল্প, তার কান্না কেঁদে কেঁদে আমাদের স্বর ক্লান্ত। সেই সম্বলকে যখন কেউ স্বল্পতর করে তখন তা নিয়ে অভিযোগ করা আমরা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু আমাদেরও মর্মস্থান আছে, সেখানে রাজায় প্রজায় ভেদ নেই; সেখানে যদি রাজা হাত দেন সে আমাদের সইবে না।
সুমিত্রা।
বলো সব কথা। ভয় কোরো না।
রত্নেশ্বর।
আমরা অত্যন্ত ভীরু, মহারানী, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখে আমাদেরও ভয় ভেঙে যায়। সেই জন্যেই এমন করে চলে আসতে পেরেছি। জানি বিপদ সাংঘাতিক, কিন্তু বিপদের চেয়ে যেখানে গ্লানি দুঃসহ সেখানে আমাদের মতো দুর্বলও বিপদকে গ্রাহ্য করে না। না খেয়ে মরার দুঃখ কম নয় কিন্তু এমন অবস্থা আছে যখন বেঁচে থাকার মতো দুঃখ আর নেই।
সুমিত্রা।
সে-কথা আমিও বুঝি। যা তোমার বলবার আছে সব তুমি আমার কাছে বলো।
রত্নেশ্বর।
তীর্থদ্বারে কর সংগ্রহের জন্যে রাজার অনুচর নিযুক্ত, সুন্দরী মেয়েদের বিপদ ঘটছে প্রতিদিন।
সুমিত্রা।
সর্বনাশ! সত্য বলছ?
রত্নেশ্বর।
যে-কথা নিয়ে মানুষ মরতে প্রস্তুত হয়, আমি সেই কথা শুধু মুখে বলতে এসেছি মহারানী, এই আমার লজ্জা। আমার ছোটোবোন গিয়েছিল তীর্থে, হতভাগিনী আজো ফেরে নি।
সুমিত্রা।
এও তুমি সহ্য করেছ?
রত্নেশ্বর।
সহ্য করব না, সেই পণ করেই বেরিয়েছি। নিজের হাতেই দণ্ড তুলতে হবে, কিন্তু তার আগে রাজদণ্ডের শেষ দোহাই পেড়ে যাব। তার পরে ধর্মই জানেন, আর আমিই জানি।
সুমিত্রা।
এই সমস্ত কি শিলাদিত্যের জ্ঞাতসারে?
রত্নেশ্বর।
তাঁরই ইচ্ছাক্রমে।
সুমিত্রা।
ঠাকুর, সত্য করে বলো, রাজার কানে এ-কথা কি আজো ওঠে নি।
দেবদত্ত।
তোমার কাছে কোনোদিন মিথ্যা বলি নি, আজও বলব না। রত্নেশ্বর, তোমার আবেদন হল, এখন যাও ঐ আমার কুটির দেখা যাচ্ছে।
[রত্নেশ্বরের প্রস্থান
[রত্নেশ্বরের প্রস্থান
সুমিত্রা।
ঠাকুর, রাজার কাছে এই অভিযোগ আসে নি?
দেবদত্ত।
হাঁ এসেছে। মন্ত্রী দ্বিধা করেছিলেন, আমি স্বয়ং জানিয়েছি।
সুমিত্রা।
ফল কী হল।
দেবদত্ত।
শুনে লাভ নেই। রাজারা যখন অন্যায় করেন তখন তার সমর্থনের জন্যে অতি ভীষণ হয়ে ওঠেন।
সুমিত্রা।
ঠাকুর, ভীষণতা অন্যায়ের ছদ্মবেশ; ভয় ক'রে তাকে যেন সম্মান না করি। অন্যায়কারীকে ক্ষুদ্র বলেই জানতে হবে, অতি ক্ষুদ্র, তার হাতে যত বড়ো একটা দণ্ড থাক্। তাকে যদি ভয় করি তবে তার চেয়েও ক্ষুদ্র হতে হবে। শিলাদিত্য উৎসবের নিমন্ত্রণে রাজধানীতে এসেছে?
দেবদত্ত।
হাঁ, এসেছে।
সুমিত্রা।
মন্ত্রীকে আদেশ করো তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই।
দেবদত্ত।
মহারানী!
সুমিত্রা।
তুমি যা বলবে আমি তা সব জানি, সমস্ত জেনেই বলছি আজ তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হওয়া চাই।
দেবদত্ত।
আগে উৎসব সমাধা হোক।
সুমিত্রা।
এ পাপের বিচার না হলে আজ উৎসব হতেই পারবে না।
দেবদত্ত।
মহারানী, সাবধান হবার অত্যন্ত প্রয়োজন আছে।
সুমিত্রা।
আমাকে নিবৃত্ত কোরো না। একদিন আগুনে ঝাঁপ দিতে গিয়েছিলুম, সুবিজ্ঞের পরামর্শে নিবৃত্ত হয়েছি। তখনই সংকল্প রক্ষা করলে এত অমঙ্গল ঘটত না এ-জগতে। শিলাদিত্যের বিচার যদি না হয় তাহলে এ রাজত্বে রানী হবার লজ্জা আমি সইব না। ঐ যে গর্জন শুনতে পাচ্ছি দ্বারের বাইরে।
দেবদত্ত।
দয়াময়ী, কতটুকুই বা শুনলে। সবটা কানে উঠলে কান বধির হয়ে যেত। যে-নিঃসহায়দের সামনে সকল দ্বার রুদ্ধ তাদের কণ্ঠও রুদ্ধ থাকে, তাই তো আছি আমরা আরামে। বাধা আজ অল্প-একটু বুঝি সরেছে -- তাই গুমরে-ওঠা দুঃখসমুদ্রের ধ্বনি সামান্য একটু শোনা গেল।
সুমিত্রা।
ঠাকুর, বাধা আছে তো আছে-- কিন্তু তার সামনে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করছে কেন, ভীরু সব। বিধাতা যাদের অবজ্ঞা করেন তাদের দয়া করেন না তাও কি এরা জানে না? দ্বার ভেঙে ফেলুক-না। বিচার ভয়ে ভয়ে চায় বলেই তো ওরা বিচার পায় না। রাজা যত বড়ো জোরের সঙ্গে ওদের কাছে কর দাবি করে, তত বড়ো জোরের সঙ্গেই ওদের বিচার চাবার অধিকার। ধর্মের বিধান মানুষের অনুগ্রহের দান নয়। আমাকে নিয়ে চলো ঠাকুর, ওদের মাঝখানে।
দেবদত্ত।
মহারানী, তোমার নিজের জায়গায় থাকলেই ওদের বাঁচাতে পারবে; তোমার আসন যেখানে তোমার শক্তি সেইখানেই।
সুমিত্রা।
আমার আসন! আমার আসন আমি পাই নি। অহর্নিশি সেই শূন্যতা সইতে পারছি নে, মন কেবলই বলছে, রুদ্রভৈরবের পায়ের কাছেই আমার স্থান, -- দেখিয়ে দিন তিনি পথ, ভেঙে দিন তিনি বিঘ্ন, ব্যর্থতার অপমান থেকে সেবিকাকে উদ্ধার করুন।
[ উভয়ের প্রস্থান
[ উভয়ের প্রস্থান
নরেশ ও বিপাশার প্রবেশ
নরেশ ও বিপাশার প্রবেশ
নরেশ।
শোনো শোনো, বিপাশা, শুনে যাও।
বিপাশা।
শোনবার যোগ্য কথা থাকলে তবেই শুনব।
নরেশ।
আমি বলতে এসেছি জালন্ধর কাশ্মীর জয় করে নি।
বিপাশা।
কবে তোমার ভুল ভাঙল।
নরেশ।
প্রতিদিনই ভাঙছে। প্রতিদিনই প্রমাণ পাচ্ছি, কাশ্মীরই জালন্ধর জয় করেছে। হার মানলুম। এখন প্রসন্ন হও।
বিপাশা।
তার সময় আসে নি।
নরেশ।
কবে আসবে।
বিপাশা।
যখন আর একবার তোমরা সৈন্য নিয়ে কাশ্মীরে যুদ্ধ করতে যাবে।
নরেশ।
যাব যুদ্ধ করতে, চেষ্টা ক'রে হেরেও আসব।
বিপাশা।
চেষ্টা করতে হবে না, বীরপুরুষ। সেই যুদ্ধটা না দেখে আমি যেন না মরি। ছলনাকে গৌরব বলে অহংকার করছ সেইটে চূর্ণ হবে তবেই ধর্ম আছেন এ-কথা মানব।
নরেশ।
সত্য বলছি, সেই গৌরবকে ফেলে দিতে পারলে বাঁচি।
বিপাশা।
কেন বলো তো।
নরেশ।
কেননা, সেই গৌরবটার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যের জিনিস দেখেছি।
বিপাশা।
রানী সুমিত্রাকে দেখেছ।
নরেশ।
তাঁর কথা বলা বাহুল্য। আমি বলছিলুম--
বিপাশা।
আর কিছু বলতে হবে না। তাঁর চেয়ে বড়ো কথা তোমাদের রাজ্যে আর নেই। তোমাদের রাজা কি তাঁর নাগাল পায়। চুপ করে রইলে যে? লজ্জা আছে দেখছি। স্বীকার করোই-না।
নরেশ।
স্বীকার অনেকদিন করেছি। কুক্ষণে মহারাজ কাশ্মীর জয় করতে গিয়েছিলেন। জয় করে তাঁর নিজের রাজ্য হারিয়েছেন। কাশ্মীর থেকে পাপগ্রহকে অভ্যর্থনা করে এনেছেন রাজ্যের মধ্যে, পাপের নৈবেদ্যে তাকেই পুষ্ট করে তুলেছেন। বিপাশা, তোমার কাছে গোপন করব না-- বিপদের জাল চারিদিকে ঘিরে আসছে, গ্রন্থির পর গ্রন্থি, তারই মাঝখানে নিশ্চিন্ত বসে আছেন আমাদের স্বেচ্ছান্ধ মহারাজ, প্রস্তুত হতে হবে আমাদেরই, আর সময় নেই।
বিপাশা।
অতএব?
নরেশ।
অতএব এই বেলা তোমার মুখে একটা গান শুনে নিতে চাই।
বিপাশা।
আমার গান, বিপদের ভূমিকায়!
নরেশ।
বাঁশির স্বরে সাপের জড়তা ঘোচে, তোমার গানে আমার তরবারি জেগে উঠবে।
বিপাশা।
যুদ্ধের গান চাই?
নরেশ।
না, সে-গান আমার অস্থিমজ্জায় আছে, আমি ক্ষত্রিয়।
বিপাশা।
তবে?
নরেশ।
তুমি জান কোন্ গানটা আমি ভালোবাসি।
বিপাশা।
উৎসবের সময় তো গাইতেই হবে, তখন শুনো।
নরেশ।
যা সকলেই পাবে তাতে আমার কেবল একটা মাত্র ভাগ। একটি সম্পূর্ণ দান আমাকে দাও, যা কেবল আমার একলারই।
বিপাশা।।
গান
মন যে বলে, চিনি চিনি
যে-গন্ধ বয় এই সমীরে।
কে ওরে কয় বিদেশিনী
চৈত্ররাতের চামেলিরে?
রক্তে রেখে গেছে ভাষা
স্বপ্নে ছিল যাওয়া-আসা
কোন্ যুগে কোন্ হাওয়ার পথে
কোন্ বনে কোন্ সিন্ধুতীরে।
এই সুদূরে পরবাসে
ওর বাঁশি আজ প্রাণে আসে।
মোর পুরাতন দিনের পাখি
ডাক শুনে তার উঠল ডাকি,
চিত্ততলে জাগিয়ে তোলে
অশ্রুজলের ভৈরবীরে॥
নরেশ।
বিপাশা, একটা কথা শুনতে চাই।
বিপাশা।
ঐ তো তোমার লুব্ধ স্বভাব। বললে, একটি গান শুনতে চাই, যেমনি গান শেষ হল রব উঠছে একটি কথা শুনতে চাই। একটি কথা থেকে দুটি কথা হবে, তার পর আমার কাজের বেলা যাবে চলে। আমি যাই।
নরেশ।
শোনো, শোনো, একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও। ঐ-যে গাইলে ওটা কি সত্য। প্রবাসে বাঁশি কি বেজেছে।
বিপাশা।
অরসিক, কথা দিয়ে যার কাছে গান ব্যাখ্যা করতে হয় তাকে গান না শোনানোই ভালো। তুমি-যে অলঙ্কার শাস্ত্রের ছাত্রদেরও ছাড়িয়ে উঠলে।
নরেশ।
তবে থাক ব্যাখ্যা, গানই আমার যথেষ্ট।
[উভয়ের প্রস্থান
[উভয়ের প্রস্থান
রাজপুরাঙ্গনা কালিন্দীর প্রবেশ। কালিন্দীর আপনমনে কাব্য আবৃত্তি
মঞ্জরী, গৌরীর প্রবেশ
রাজপুরাঙ্গনা কালিন্দীর প্রবেশ। কালিন্দীর আপনমনে কাব্য আবৃত্তি
মঞ্জরী, গৌরীর প্রবেশ
গৌরী।
একা-একা কার সঙ্গে আলাপ চলছে? বনদেবতার সঙ্গে?
কালিন্দী।
না গো, মনোদেবতার সঙ্গে। মন্মথর স্তব কণ্ঠস্থ করছি। রাজার আদেশ।
গৌরী।
ওটা হৃদয়স্থ থাকলেই হয়, কণ্ঠে আনবার দরকার কী।
কালিন্দী।
হৃদয়ের পদচারণার পথ কণ্ঠে।
গৌরী।
ওগো জালন্ধরিণী, এতদিন আছি, তোমাদের ধরনধারন আজও বুঝতে পারলুম না।
কালিন্দী।
আশ্চর্য নেই গো কাশ্মীরিণী, বুঝতে বুদ্ধির দরকার করে। কোন্খানটা দুর্বোধ ঠেকছে, শুনি-না।
গৌরী।
বেদে অগ্নি সূর্য ইন্দ্র বরুণ অনেক দেবতারই স্তব আছে, কিন্তু তোমাদের এই দেবতাটির তো নামও শোনা যায় না।
কালিন্দী।
সত্যযুগের ঋষিমুনিরা এঁকে যত সাবধানে এড়িয়ে চলতেন ততই অসাবধানে পড়তেন বিপদে। মুখে তাঁর নাম করতেন না তাই মার খেয়ে মরতেন অন্তরে। পুরাণগুলো পড় নি বুঝি?
গৌরী।
মূর্খ আছি সেই ভালো, বিদূষী। সত্যযুগের কলঙ্ককাহিনী কলিযুগে টেনে আনবার মতো এত বিদ্যেয় দরকার কী ভাই। কলিযুগের পাপের ভার যথেষ্ট ভারী আছে।
কালিন্দী।
বড়ো লজ্জা দিলে। মূর্খ ব'লে অহংকার করতে পারলুম না -- ওখানে কাশ্মীরেরই জিত রইল।
মঞ্জরী।
ভাই, তোর কালিন্দীকলকল্লোল একটুখানি থামা। ত্রিবেদীঠাকুর বলেন, কালিন্দীর রসনা তার প্রতিবেশী দশনপংক্তির কাছ থেকে দংশন করবার বিদ্যেটা শিখে নিয়েছে। কেবল সেই বিদ্যেটা ফলাবার জন্যেই যে-দেবতাকে মানিস নে তাকে নিয়ে তর্ক তুলেছিস। নতুন দেবতাকে ভক্তি করবার আগে তোর ইষ্টদেবতার সাধনা সারা হোক।
কালিন্দী।
তার পরে আসছেন অনিষ্টদেবতাটি। একটু চুপ কর্, ভাই, স্তবটা আর একবার আউড়ে নিই। দেবতা ত্রুটি মার্জনা করেন, কিন্তু আমাদের সভাকবি তাঁর রচনার আবৃত্তিতে একটু ভুল পেলে কাঁদিয়ে ছাড়েন।
মঞ্জরী।
ঐ আসছেন ত্রিবেদীঠাকুর, ওঁর কাছে আজ সন্দেহ মিটিয়ে নিই।
আবৃত্তি করতে করতে ত্রিবেদীর প্রবেশ
আবৃত্তি করতে করতে ত্রিবেদীর প্রবেশ
ত্রিবেদী।
কর্পূর ইব দগ্ধোহপি শক্তিমান্যো জনে জনে --
নমোহস্তবার্যবীর্যায় তস্মৈ মকরকেতবে।
মঞ্জরী।
আপন মনে কী বকছ, ঠাকুর।
ত্রিবেদী।
গোলমাল কোরো না, মুখস্থ করছি।
মঞ্জরী।
কী মুখস্থ করছ।
ত্রিবেদী।
মকরকেতুর স্তব। রাজার আদেশ।
কালিন্দী।
তোমারও এই দশা?
ত্রিবেদী।
দেখছ না, মধুকরের গুঞ্জন আর শোনা যাচ্ছে না। সংস্কৃত শৌরসেনী মাগধী অর্ধমাগধী মহারাষ্ট্রী পারসিক যাবনিক নানা ভাষায় আজ অভ্যাস চলছে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে মকরকেতুর সকল দেশের সকল ভাষাতেই পাণ্ডিত্য।
কালিন্দী।
কিন্তু অনুচ্চারিত ভাষাই তিনি সব চেয়ে ভালো বোঝেন। দাদাঠাকুর, একটা কথার উত্তর দাও। মকরকেতুর পূজার বিধান পেয়েছ কোন্ বেদে।
ত্রিবেদী।
চুপ চুপ। কী কণ্ঠস্বরই পেয়েছ তোমরা পুরাঙ্গনারা।
কালিন্দী।
অরসিক, বয়স হয়েছে বলে কি কণ্ঠস্বরের বিচারবুদ্ধিটাও খোয়াতে হবে। তোমাদের কবি যে কোকিলের সঙ্গে এই কণ্ঠের তুলনা করেন।
ত্রিবেদী।
অন্যায় করেন না। কোনো কথা গোপনে বলবার অভ্যাস ঐ পাখিটার নেই।
কালিন্দী।
দাদাঠাকুর, তোমার সঙ্গে গোপন কথা বলবার মতো মনেরভাব আমার নয়। শাস্ত্রের বিচার চাই। এরা বলছিল, পুরাণে অতনুর নেই তনু, আবার বেদে নেই তার নামগন্ধ -- বাকি রইল কী। তাহলে পূজাটা হবে কাকে নিয়ে।
ত্রিবেদী।
আরে চুপ চুপ -- স্বরটাকে আরেক সপ্তক নামিয়ে আনো।
মঞ্জরী।
কেন, ঠাকুর, ভয় কাকে?
ত্রিবেদী।
যারা নতুন দেবতার পূজা চালাতে চায় তারা ভক্তির জোরের চেয়ে গায়ের জোরটা বেশি ব্যবহার করে। আমি ভালোমানুষ, দেবতার চেয়ে এই দেবতাভক্তদের ভয় করি অনেক বেশি।
গৌরী।
ঠাকুর, আমি বলছিলুম এই সব হঠাৎ-দেবতার আবার পূজা কিসের।
ত্রিবেদী।
মূঢ়ে, যারা বনেদি দেবতা তাদের এত উগ্রতা নেই। সংসারে হঠাৎ দেবতারাই সাংঘাতিক। তাদের পূজা করায় ব্যর্থতা, না-পূজা করায় সর্বনাশ। অতএব ছাড়ো তর্ক, পরো মঞ্জীর, আনো বীণা, গাঁথো মালা -- পঞ্চশরের শরগুলোকে শান দেও গে।
কালিন্দী।
কিন্তু তোমার মন্ত্রটি পেলে কোথা থেকে, ঠাকুর।
ত্রিবেদী।
যিনি পূজা প্রচার করছেন পূজার মন্ত্ররচনা তাঁরই। আমি সেটাকে শ্রুতির দ্বারা গ্রহণ ক'রে স্মৃতির দ্বারা ব্যক্ত করব। দেখে নিয়ো, রাজসভার শ্রুতিভূষণ বলবেন, সাধু, স্মৃতিরত্নাকর বলবেন, অহো কিমাশ্চর্যম্!
মঞ্জরী।
ও কী ও, ভাই, বাইরে যে অস্ত্রের ঝঞ্ঝনি শোনা গেল।
কালিন্দী।
হয়তো ওটা সত্যকার নয়। হয়তো উৎসবের একটা কোনো পালার অভ্যাস চলছে।
গৌরী।
ত্রিবেদীঠাকুর, এও বুঝি তোমাদের জালন্ধরের সৃষ্টিছাড়া কীর্তি? মীনকেতুর উৎসবে রক্তপাতের পালা?
ত্রিবেদী।
সুন্দরী, জগতে এ পালা বার বার অভিনয় হয়ে গেছে। ত্রেতাযুগে এই পালায় একবার রাক্ষসে বানরে মিলে অগ্নিকাণ্ড করেছিল। কলিযুগে তাদের বংশ বেড়েছে বই কমে নি। যাই হোক শব্দটা ভালো লাগছে না-- যাও তোমরা মন্দিরে আশ্রয় লও গে।
[ সকলের প্রস্থান
[ সকলের প্রস্থান
১৯ ভাদ্র, ১৩৩৬ শান্তিনিকেতন