কাশ্মীর

কাশ্মীর

১।

সর্বনাশ! বল কী!

২।

চলো, আর দেরি নয়।

১।

ঠিক জান তো?

২।

তরাইয়ে গিয়েছিলুম ভালুকের চামড়া বেচতে-- স্বচক্ষে দেখে এলুম জালন্ধরের সৈন্য। আর দেখলুম ধনদত্তকে, চন্দ্রসেনের দূত। দুই পক্ষে বোঝাপড়া চলছে।

১।

ওদের পথ আগলানো হবে না?

২।

কে আগলাবে। খুড়োমহারাজ নিজের পথ খোলসা করছেন। এবার আমরা প্রজারা মিলে যেদিন যুবরাজকে রাজা করতে দাঁড়িয়েছি, এমনি অদৃষ্ট, ঠিক সেইদিনেই এসে পড়ল বিদেশী দস্যু। খুড়োরাজা এবার কাশ্মীরের রাজছত্রের উপর জালন্ধরের ছত্র চড়িয়ে সিংহাসনে নিজের অধিকার পাকা করে নিতে চেষ্টা করছেন।

১।

কিন্তু দেখো বলভদ্র, এ সংবাদ এখন প্রচার করে অভিষেক ভেঙে দিয়ো না। এখানকার অনুষ্ঠান চলতে থাক্‌, আজকের মধ্যেই সমাধা হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে আমরা যা করতে পারি করি গে। রণজিৎকে পাঠাও পত্তনে। আর জঠিয়াতে খবর দাও কাঠুরিয়াপাড়ায়-- আমি চললেম রঙ্গীপুরে। ঘোড়া যার যতগুলো পাওয়া যায় ধরে আনা চাই। পাঁচমুড়ির মহাজনদের গমের গোলা আটক করতে হবে-- অন্তত দু মাসের যুদ্ধের খোরাক দরকার।

২।

এবার আমরা মরি আর বাঁচি, ঐ পিশাচের অভিপ্রায় কিছুতেই সিদ্ধ হতে দেব না। কুমারের অভিষেক আজ সম্পন্ন হওয়াই চাই। তার পর থেকেই চন্দ্রসেনকে রাজবিদ্রোহী বলে গণ্য করব। ওরে, তোরা তোরণে দেবদারুশাখায় মালাগুলো শীঘ্র খাটিয়ে দে। ভেরীওয়ালাকে বল্‌-না বাজিয়ে দিতে ভেরী।

১।

সবাই এসে জড়ো হোক। এই-যে মহীপাল-- তোমাকে অত্যন্ত দরকার।

মহীপাল।

কেন, কী হয়েছে।

২।

সে-কথা এখানে বলা চলবে না। চলো ঐ দিকে। দেরি কোরো না।

১।

এইমাত্র একটা খবর পেয়েছি, চন্দ্রসেন এই দিকে আসছেন। বোধ করি অভিষেক ভেঙে দিতে।

২।

না, আমার বিশ্বাস, কৌশলে যুবরাজকে সতর্ক করে দিতে। চন্দ্রসেন আর সব করতে পারে কিন্তু কুমারকে ওরা বন্দী করে নিয়ে যাবে এ তিনি কখনোই সইবেন না। কিন্তু চল্‌, আর দেরি না।

[ সকলের প্রস্থান

[ সকলের প্রস্থান

আর একদল

আর একদল

১।

ব্যাপারখানা কী ভাই।

২।

আকাশ থেকে পড়লে নাকি।

১।

সেই রকমই তো বটে। দুঃখের কথাটা বলি। জান তো পেটের দায়ে একদিন ঢুকেছিলুম খুড়োরাজার প্রহরীর দলে। খুব মোটা মাইনে নইলে ওঁর কাজে লোক আসতে চায় না। স্ত্রীর গায়ে গহনা চড়ল-- কিন্তু লজ্জায় সে ইঁদারায় জল আনতে যাওয়া বন্ধ করলে। আমাদের পাড়ায় থাকে কুন্দন; সকলের নামে সে ছড়া কাটে। সে আমার নাম দিলে খুড়ো-গণেশের খুড়তুতো ইঁদুর। শুনে দেশসুদ্ধ লোক খুব হাসলে, আমি ছাড়া।

৩।

বাহবা, ঠিক নামটা বের করেছে তোদের কুন্দন। দেশে খুড়তুতো ইঁদুরের বাড়াবাড়ি হতে চলল। ঘরের ভিত পর্যন্ত ফুটো করে দিলে রে, দাঁত বসাচ্ছে সব-তাতেই, এইবার ওদের গর্তে লাগাব আগুন। তার পরে বুদ্ধু, পিঠে গণেশঠাকুরের শুঁড়-বুলোনি সইল না বুঝি।

১।

অনেকদিন অনেক সহ্য করলুম। শেষকালে সেদিন খুড়োরাজা খুশি হয়ে আমাকে প্রহরীশালার সর্দার করে দিলে-- সেইদিন পথের মধ্যে দেখা আমার ছোটোশালীর সঙ্গে। জান তাকে--

২।

জানি বইকি। ঐ তোদের রূপমতী, খাসা মেয়ে রে! তোদের ছড়া-কাটিয়ে তাকেই তো বলে মৃত্যুশেল।

১।

সে আমাকে দেখে বাঁ পা দিয়ে মাটিতে এক লাথি মারলে, ধুলো উড়িয়ে দিলে, পায়ের মল ঝম ঝম করে উঠল-- মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল। আর সইল না।

৩।

হা হা হা হা! রাঙা পায়ের এক ঘায়ে খুড়তুতো ইঁদুরের লেজ গেল কাটা!

১।

দিলেম ফেলে আমার পাগড়ি প্রহরীশালার দ্বারে, চলে গেলেম উত্তরে মালখণ্ডে। গ্রীষ্মভোর ছাগল চরাই, শীতকালে রাজধানীতে নিয়ে আসি, কম্বল বিক্রি করি। পণ করেছি যখন হাতে কিছু টাকা হবে, পাগড়িতে লাগাব সোনার পাড়-- যাব আমার শ্যালীর বাড়িতে, সেই বাঁ পায়ের লাথিটা সে ফিরিয়ে নেবে, তবে অন্য কথা। এই কথাই ভাবতে ভাবতে আসছিলেম ছাগলের পাল নিয়ে, যাচ্ছিলেম রাজধানীর দিকে। পথের মধ্যে একদল লোক ছাগলসুদ্ধ আমাকে হৈঃ হৈঃ শব্দে খেদিয়ে নিয়ে এল এইখানে, বললে এই আমাদের রাজধানী এইখানে-- এই উদয়পুরে।

২।

মুর্খু, মনে রাখিস, আজ থেকে এর নাম উদয়পুর নয়, কুমারপুর।

১।

মনে রাখা শক্ত হবে ভাই|, এখানে আমার দাদাশ্বশুরের বাড়ি, চিরদিন জানি--

৩।

ভাবনা কী, নতুন রাজত্বে তোর দাদাশ্বশুরের নাম নতুন করে দেব।

১।

তা যেন দিলে, কিন্তু আমার ছাগলের মহাজন থাকে সেইখানটাতে যাকে রাজধানী বলে জানতুম। সে লোকটার কাছে দেনাও আছে পাওনাও আছে। নইলে তারও নাম বদল করে নিলে খুশি হতুম।

২।

আচ্ছা বেশ, খুড়োরাজের রাজত্বকালের দেনাটা কুমাররাজের রাজত্বকালে মাপ করে দেওয়া গেল।

১।

আর পাওনাটা?

২।

সেটা পরে দেখা যাবে-- সময়মতো।

১।

পেটের তাগিদ সময় মানবে না, দাদা। তা যাই হোক, তোদের মুখের কথায় রাজধানী তৈরি হয় না তো ভাই, সেরকম চেহারা দেখছি নে।

৩।

সবই কি চোখে দেখতে হয়। মনে-মনে দেখ্‌।

১।

কিন্তু ছাগলের দামটা মনে-মনে পেলে আমার চলবে না। কথাটা একটু বুঝিয়ে বলো, দাদা।

৩।

তবে শোন্‌, কুমার এলেন তীর্থ থেকে, তবু খুড়োমহারাজ সিংহাসন আঁকড়েই রইলেন। দেখলুম, টানাটানি করতে গেলে রক্তারক্তি হবে। ঠিক করেছি এখানেই যুবরাজের রাজধানী বসিয়ে তাঁকে রাজা করব। আজই অভিষেক।

১।

এই আখরোটের বনে?

২।

কোথাকার গোঁয়ার এটা? রাজা যেখানেই বসবেন সিংহাসন সেইখানেই। আর তোকে যদি ইন্দ্রের আসনেও বসাই তার তলা থেকে ছাগল ডাকতে থাকবে রে।

১।

না ডাকলেও সুখ হবে না ভাই,মন কেমন করবে। কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি নে। ছিলেন এক রাজা, হলেন দুই রাজা, ভার সইবে? এক ঘোড়ার দুই সওয়ার, লেজের দিকে লাগাম টানবে একজন, মুখের দিকে আর একজন, জন্তুটা চলবে কোন্‌ রাস্তায়।

২।

ওরে, জন্তুটার চেয়ে মুস্কিল হবে সওয়ারের-- যিনি থাকবেন লেজের দিকে তাঁকে আপনিই খসে পড়তে হবে। বুঝতে পেরেছিস?

১।

অনেকখানি বোঝা বাকি আছে। লেজের মানুষটা খসে পড়বার আগে খাজনা দেব কাকে।

৩।

খাজনা দিতে হবে মহারাজ কুমারসেনকে।

১।

তার পরে?

৩।

তার পরে আর কিছুই নেই।

১।

খুড়োমহারাজ তো সিংহাসনে বসে উপোস করবার ব্রত নেন নি। যখন খিদে চড়ে যাবে তখন?

২।

সে-কথা খুড়োমহারাজ চিন্তা করবেন, আমরা সবাই পণ করেছি খাজনা দেব মহারাজ কুমারসেনকে, আর কাউকে নয়।

১।

ঠিক বলছ দাদা, সবাই পণ করেছ?

২।

হাঁ, সবাই।

১।

বরাবর দেখে আসছি তোমরা মোড়লরা পিছন থেকে চেঁচিয়ে বল, বাহবা, আর সামনে থেকে মাথায় বাড়ি পরে আমাদেরই। ঠিক বলছ, সবাই খাজনা দেবে কুমার মহারাজকে, কেউ পিছবে না?

৩।

কেউ না, কেউ না। আজ মহারাজের পা ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করব।

১।

এ-কথা ভালো। মার তো কপালে লেখাই আছে। একলা খাই সেইটেই দুঃখ। দেশ জুড়ে মারের ভোজ বসে যায় যদি, পাত পাড়তে ভয় করি নে।

২।

এই রইল কথা?

১।

হাঁ, রইল।

৩।

পিছোবি নে?

১।

পিছোবার রাস্তাটা তোমরাই খোলসা রাখ, সে রাস্তা আমরা খুঁজেই পাই নে।

৩।

ওরে বোকা, মরতে পারি নে, তা নয়, কিন্তু আমরা ম'লে তোদের দশা কী হবে।

১।

আমাদের অন্ত্যেষ্টিসৎকারটা বন্ধ থাকবে।

একদল স্ত্রীলোকের প্রবেশ

একদল স্ত্রীলোকের প্রবেশ

প্রথমা।

রাজার অভিষেকের সময় হল?

২।

না, এখনো দেরি আছে। তোমরা প্রস্তুত আছ তো?

প্রথমা।

আমাদের জন্যে ভেবো না গো, ভেবো না। তোমাদের পুরুষের মধ্যেই দেখি কেউ বা এগোন কেউ বা পিছোন। কেউ বলছেন সময় বুঝে কাজ, কেউ বলছেন কাজ বুঝে সময়। মাঝের থেকে সময় যাচ্ছে চলে।

দ্বিতীয়া।

দেখে এলেম তোমাদের ন্যায়বাগীশ এখনো বসে তর্ক করছেন, যিনি রাজা তিনি সিংহাসনে বসেন, না, যিনি সিংহাসনে বসেন তিনিই রাজা। এই নিয়ে দুই পক্ষে মাথা-ভাঙাভাঙি চলছে আমাদের পাড়ায়। মেয়েরা কাল সমস্ত রাত ধরে সাজিয়েছে মাঙ্গল্যের ডালা।

তৃতীয়া।

ভোর থেকে যে-যার গ্রাম থেকে সব বেরিয়ে পড়ল।

১।

আর লজ্জা দিয়ো না আমাদের। এ-কথা মেনে নিচ্ছি মেয়েদের মতো পুরুষ মেলে না। তোমাদের গানের দল আছে তো?

দ্বিতীয়া।

হাঁ, তারা এল বলে।

২।

তোমাদের উমিচাঁদের মেয়ে?

তৃতীয়া।

সেই তো সব দল ডেকে আনছে।

২।

নন্দপল্লীর উপযুক্ত মেয়ে বটে। সেদিন বিতস্তার ঘাটে আমাদের করমচাঁদ গিয়েছিলেন তাকে গোটাদুয়েক মিঠে কথা বলতে। কঙ্কণের এক ঘা খেয়েই মুখ বন্ধ।

প্রথমা।

জান না বুঝি, সে বলেছে বেত্রবতী নাম নেবে-- কুমার-মহারাজের সিংহাসনের পশ্চাতে থাকবে তার পরিচারিকা হয়ে।

১।

দাদা, তা হলে আমি ছাগল-চরানোর ব্যাবসা ছেড়ে দিয়ে রাজার ছত্রধর হব।

২।

ওরে বুদ্ধু, এই খানেক আগেই তোকে দোমনা দেখেছি, একমুহূর্তে রাজভক্তি ভরপুর হয়ে উঠল কিসে।

১।

এক আগুন থেকে আর-এক আগুন জ্বলে।

৩।

তুই তো ছাগল চরাতে গিয়েছিলি, উত্তরখণ্ডের খবর কিছু এনেছিস?

১।

কাউকে যদি না বল তো বলি।

৩।

ভয় কিসের। বলে ফেল্‌ না।

১।

বললে না প্রত্যয় যাবে স্বয়ং রানী সুমিত্রাকে দেখেছি ভৈরবীবেশে চলেছেন ধ্রুবতীর্থে।

২।

পাগল রে!

প্রথমা।

না গো, উনি মিথ্যা কথা বলছেন না। আমিও শুনেছি বটে। কাউকে বলতে সাহস করি নি।

৩।

কার কাছে শুনলে।

প্রথমা।

ঐ যে আমার ভাসুরঝি মন্দাকিনী। তীর্থ করে ফিরে আসছিল। পথে দেখা। রাজকুমারী চলেছেন মার্তণ্ডদেবের উপাসিকার দীক্ষা নিতে।

২।

বিশ্বাস করি কী ক'রে। বুদ্ধু, তোর সঙ্গে কথা হল কিছু?

১।

প্রণাম করে বললুম, তুমি আমাদের রাজকুমারী সুমিত্রা। তিনি বললেন, আমার নাম তপতী। জানিস তো সেই অপরূপ রূপ। সেই লাবণ্য যেন আগুনে স্নান করে এল। বললেম, দেবী, চরণের সেবক হয়ে যাই সঙ্গে। তিনি নীরবে তর্জনী তুলে ফিরে যেতে ইঙ্গিত করলেন।

৩।

দুর্গম তীর্থে রাজকুমারী একলা চলেছেন, তুই এখানে এসে রাজবাড়িতে জানালি নে?

১।

দুই-একজনকে জানাতে গিয়েছিলেম-- আমাকে মারে আর কি। বলে, আমি নেশা করেছি!

আর-একজনের প্রবেশ

আর-একজনের প্রবেশ

৪।

কিছুতে রাজি হল না।

২।

কার কথা বলছ।

৪।

আমাদের সভাকবি দর্দুর। খুড়োমহারাজের আশ্রয় ছাড়তে সাহস করল না। আজ অভিষেকে কোনোরকমের একটা সভাকবি চাই তো।

৩।

চাই বই কি। আজকের মতো রীতরক্ষা ক'রে তারপরে সংক্ষেপে বিদায় করলেই হবে।

৪।

জোগাড় করেছি একটি। মন্নু তাকে নিয়ে আসছে। বিদেশী, যাচ্ছে ধ্রুবতীর্থে, সঙ্গে নারী আছে।

৩।

এর থেকেই ঠাওরালে সে কবি?

৪।

দেখলেম, গাছতলায় বসে মেয়েটি গান গাচ্ছে আর সে বাজাচ্ছে একতারা। মুখ দেখেই সন্দেহ হল লোকটা আর কিছুই না পারুক, গান বানাতে পারে। সিধে গিয়ে বললুম, তুমি কবি, চলো রাজার অভিষেকে। প্রথমটা কিছুতেই মানতে রাজি নয়। ভাবলে তাকে পাগল বললুম, না বোকা বললুম। সঙ্গের মেয়েটি বললে, হাঁ, ইনি কবি বইকি, নিশ্চয় কবি, অভিষেকে যেতে হবেই তো। অমনি মানুষটা জল হয়ে গেল-- আর "না' বলবার জো রইল না।

৩।

"না' বলবার মতো মেয়েটি নয় বোধ করি।

৪।

একেবারেই না। দেখলেম দিব্যি বশ মেনেছে। মেয়েটি যদি বলত, চলো, লড়াই করবে, তবে তখনি ছুটত লড়াই করতে, কবিতা লেখা তো সামান্য কথা।

২।

শুনে বুঝছি, লোকটি কবি। মনে তো আছে, আমাদের ধরণীদাস। গৌরীতরাইয়ের নথনি বুনত শাল, ধরণী আস্তে আস্তে দাঁড়াত তার আঙিনার কোণে। আর সে দিত তার কুণ্ডল ঝুলিয়ে ঝংকার, তারই চোটে ধরণী সাত খাতা জুড়ে ছড়া লিখেছে। খেতুলাল, তুই ধরেছিস ঠিক, লোকটা কবি।

৪।

হোক, বা না হোক, চেহারায় মানাবে। ঐ যে আসছে।

মন্নুর সঙ্গে নরেশ ও বিপাশার প্রবেশ

মন্নুর সঙ্গে নরেশ ও বিপাশার প্রবেশ

বিপাশা।

(নরেশের প্রতি) কবি নরোত্তম, এদের বঞ্চিত কোরো না। তোমাকে গান গাইতে বলতে সাহস পাই নে। কিন্তু আমি তো তোমারই শিষ্যা, যথাসময়ে আমাকে অনুমতি কোরো, আমি গাইব।

নরেশ।

তোমার ভক্তিতে আমি প্রীত। ভালো, অনুমতি করছি, গাও তুমি।

বিপাশা।

সে কি প্রভু, এখনই? এখনো তো সময় হয় নি।

নরেশ।

এতদিনেও আমার কাছে এ শিক্ষা হল না যে, গানের অসময় নেই?

১।

কবি অন্যায় বলেন নি। ঐ দেখো-না, লোক জড়ো হয়েছে। সময় হল।

বিপাশা।।

গান

দিনের পরে দিন-যে গেল আঁধার ঘরে,

তোমার আসনখানি দেখে মন-যে কেমন করে।

ওগো বঁধু, ফুলের সাজি

মঞ্জরীতে ভরল আজি,

ব্যথার হারে গাঁথব তারে রাখব চরণ'পরে।

পায়ের ধ্বনি গনি গনি রাতের তারা জাগে।

উত্তরীয়ের হাওয়া এসে ফুলের বনে লাগে।

ফাগুনবেলার বুকের মাঝে

পথ-চাওয়া সুর কেঁদে বাজে,

প্রাণের কথা ভাষা হারায় চোখের জলে ঝরে॥

১।

হায় হায়, খাঁটি কবি বটে রে। ছেড়ে দেওয়া হবে না। দাদাশ্বশুরের আটচালায় এক কোণে জায়গা করে দেব।

২।

কবি, রচনা তোমারই বটে তো? ভণিতা নেই কেন। আমাদের বংশীলাল খুব লম্বা করেই ভণিতা লাগায়।

নরেশ।

ভণিতার সম্পর্ক রাখি নে। আমি জানি গান যে গায় গান তারই। গানটা আমার কি তোমার, এই অত্যন্ত বাজে প্রশ্ন যদি না ভুলিয়ে দিলে তাহলে সে-গান গানই নয়।

৩।

কিন্তু দেখো কবি, আমার কেমন মনে হচ্ছে এ গান আমি পূর্বেই শুনেছি এই কাশ্মীরেই।

নরেশ।

বড়ো খুশি হলুম এ-কথা শুনে। তুমি রসিক লোক। ভালো গান শুনলেই মনে হয় এ গান আগেই শুনেছি।

৩।

মনে হচ্ছে আমাদের কবি শশাঙ্ক যেন ঐ রকমের একটা--

নরেশ।

কিছুই অসম্ভব নয়, কোনো কোনো কবি থাকেন যাঁর রচনা ঠিক অন্য লোকের রচনার মতোই হয়।

৩।

কবি, ইচ্ছে করছে তোমাকে একটা মালা দিই।

নরেশ।

মালা আমি নিই নে। আমার গান যাঁর কণ্ঠে, আমার মালাও তাঁরই কণ্ঠে পড়ে।

৪।

সে তো ভালো কথা। উনি মালা পরার যোগ্য বটেন। হাঁ গা, তোমাদের ডালিতে তো মালা অনেক আছে, একখানা দাও-না ওঁকে পরিয়ে দিই।

প্রথমা।

হাঁ, দিলাম ব'লে।

৪।

ভালোমানুষের ঝি, দিলে দোষ কী।

দ্বিতীয়া।

তোমরা দোষ দেখতে পাবে কেন। পথে ঘাটে মালা পরিয়ে বেড়ানো তোমাদের স্বভাব যে।

৩।

মাসি, রাগ কর কেন?

দ্বিতীয়া।

আর "মাসি মাসি' করতে হবে না।

৩।

আচ্ছা, ছাড়লেম মাসি বলা, যা বললে খুশি হও তাই বলব। আপাতত একখানা মালা দাও-না, ওঁকে পরিয়ে দিই।

তৃতীয়া।

তোমরা কি লজ্জার মাথা খেয়ে বসেছ! কোথাকার কে তার ঠিক নেই, রাজার অভিষেকের মালা দিতে হবে! এত সস্তা নয় গো।

১।

ও-কথা বোলো না দিদিশ্বাশুড়ি, রাজা থাকলে স্বয়ং ওকে মালা দিতেন।

দ্বিতীয়া।

ভরততলির লোক, তোমাদের ব্যাভারটা কী রকম গো। ওকে দিদিশাশুড়ি বল কোন্‌ সম্পর্কে। ও আমার বোনঝি।

১।

মাসি বলতে সাহস হল না। ভাবলুম দাদাশ্বশুরের গ্রামে থাকে, ঐ সম্পর্কের নামটা বেমানান হবে না।

প্রথমা।

ঐ যে রাজা আসছেন শিবির থেকে। এখনো তো সময় হয় নি। এরা সব গান গেয়ে উৎপাত ক'রে বের করে আনলে।

সকলে।

জয়, মহারাজ কুমারসেনের জয়!

কুমারসেনের প্রবেশ

কুমারসেনের প্রবেশ

কুমার।

শীঘ্র আমার অশ্ব প্রস্তুত করো।

৩।

কবি, ধরো ধরো, একটা গান শিগগির।

বিপাশা।।

গান

তোমার আসন শূন্য আজি, হে বীর পূর্ণ করো,

ঐ যে দেখি বসুন্ধরা কাঁপল থরোথরো।

বাজল তূর্য আকাশপথে

সূর্য আসেন অগ্নিরথে,

এই প্রভাতে দখিন হাতে বিজয়খড়গ ধরো।

ধর্ম তোমার সহায়, তোমার সহায় বিশ্ববাণী।

অমর বীর্য সহায় তোমার, সহায় বজ্রপাণি।

দুর্গম পথ সগৌরবে

তোমার চরণচিহ্ন লবে,

চিত্তে অভয়বর্ম তোমার, বক্ষে তাহাই পরো॥

কুমারসেন।

(বিপাশাকে ইঙ্গিতে কাছে ডেকে) হঠাৎ এখানে এলে যে।

বিপাশা।

ছুটি পেয়েছি যুবরাজ।

কুমারসেন।

সুমিত্রা?

বিপাশা।

সে-বন্দিনীও ছুটি পেয়েছে।

কুমারসেন।

মৃত্যু?

বিপাশা।

না, নূতন প্রাণ।

কুমারসেন।

অর্থ কী, বুঝিয়ে দাও।

বিপাশা।

জালন্ধর ছেড়েছেন তিনি। গেছেন ধ্রুবতীর্থে, উপাসিকার দীক্ষা নেবেন।

কুমারসেন।

তোমার কথাটাকে এখনো মনের মধ্যে ঠিক নিতে পারছি নে।

বিপাশা।

যুবরাজ, সুমিত্রাকে তো চেনো। সূর্যের তপস্যা সেই জ্যোতির্ময়ী ছাড়া কে গ্রহণ করতে পারে আজকের দিনে। আলোকের দূতী যারা, ভোগের ভাণ্ডারে তাদের বন্ধন রুদ্রদেব সহ্য করতে পারেন না।

কুমারসেন।

আর জালন্ধররাজ বুঝি শৃঙ্খল হাতে নিয়ে ছুটেছেন।

বিপাশা।

মাটির বাঁধ দিয়ে নদীকে বেঁধে তার স্রোতকে রাজভাণ্ডারে জমা করবার জন্যে; তাঁর কথা জিজ্ঞাসা করো আমার ঐ পথের সঙ্গীকে।

কুমারসেন।

তোমার পথের সঙ্গী?

বিপাশা।

হাঁ যুবরাজ, আমার পথের সঙ্গী। চুপ করে রইলে! এর থেকে বুঝছি তুমি বুঝেছ। এর উপরে কথা চলে না।

কুমারসেন।

এতদিনে বন্ধন গ্রহণ করলে, বিপাশা?

বিপাশা।

বিপাশা সিন্ধুনদীতে মিলেছে, সে মুক্তধারার মিলন।

কুমারসেন।

ওঁর নামটি বলো।

বিপাশা।

ওঁর নাম নরেশ। রাজা বিক্রমের বৈমাত্র৻ ভাই। ডেকে আনছি।

কুমারসেন।

নমস্কার, রাজকুমার।

নরেশ।

নমস্কার।

কুমারসেন।

তোমার মতো অতিথিকে পেয়ে আমার আজকের দিন সার্থক।

নরেশ।

আমি আমার মহারানীর অনুবর্তী-- তীর্থযাত্রী আমি, পথের অতিথি। তোমার দ্বারে আজ যে-অতিথি অনাহূত এসেছেন, তাঁর সংবাদ পেয়েছ? প্রস্তুত হয়েছ তো?

কুমারসেন।

এই মাত্র সংবাদ পেয়েছি। আয়োজন নেই, কিন্তু আহ্বান করতে হবে। বিশেষ করে আমারাই সঙ্গে তাঁর যুদ্ধের কারণ কী ঘটছে তা এখনো পর্যন্ত বুঝতেই পারি নি।

নরেশ।

কারণের প্রয়োজন হয় না। অন্ধ বিদ্বেষ অন্ধ ঈর্ষা বাইরে থেকে পথ খোঁজে না, স্বভাবের ভিতরেই তার আশ্রয়। তোমার মর্যাদা উনি সহ্য করতে পারেন না, তার অহৈতুক উত্তেজনা ওঁর দীনতার মধ্যে। এ যে বিধাতার অভিশাপ। তার উপরে উনি মনে-মনে সন্দেহ করেন মহারানী সুমিত্রা তোমার প্রশ্রয় পেয়েচেন বা তোমার প্রশ্রয় প্রার্থনা করতে এসেছেন।

কুমারসেন।

এতদিনেও কি জানেন না সুমিত্রার পক্ষে তা অসম্ভব।

নরেশ।

জানবার শক্তি যদি থাকত তাহলে হারাবার দুর্ভাগ্য তার ঘটত না।

ব্রাহ্মণগণের প্রবেশ

ব্রাহ্মণগণের প্রবেশ

পুরোহিত।

মহারাজ, অভিষেকের কাজ এখনই আরম্ভ করা কর্তব্য। মনে হচ্ছে বিলম্বে বিঘ্ন হতে পারে। নানাপ্রকার জনশ্রুতি শোনা যাচ্ছে।

কুমারসেন।

অভিষেকের কাজ সংক্ষিপ্ত করো। বিলম্ব সইবে না।

পুরোহিত।

চলো তবে মহারাজ, ঐ অশ্বত্থবেদিকায়। সকলে জয়ধ্বনি করো।

তুরী ভেরী শঙ্খধ্বনি

তুরী ভেরী শঙ্খধ্বনি

সকলে।

জয় মহারাজাধিরাজ কাশ্মীরাধিপতির জয়!

কুমারসেন।

বাহিরে ঐ কিসের কোলাহল।

অনুচরদের প্রবেশ

অনুচরদের প্রবেশ

অনুচর।

খুড়োমহারাজ হঠাৎ উপস্থিত। প্রহরীরা বলছে প্রাণ থাকতে তাঁকে এখানে প্রবেশ করতে দেব না। তারা লড়াই করে মরতে প্রস্তুত। আদেশ করো মহারাজ।

কুমারসেন।

শান্ত করো প্রহরীদের। খুড়োমহারাজকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এসো।

[ অনুচরদের প্রস্থান

[ অনুচরদের প্রস্থান

বিপাশা।

আমরা তবে প্রচ্ছন্ন হই।

[ নরেশ ও বিপাশার প্রস্থান

[ নরেশ ও বিপাশার প্রস্থান

চন্দ্রসেনের প্রবেশ

চন্দ্রসেনের প্রবেশ

একদল।

কোথায় চলেছ চন্দ্রসেন। পাষণ্ড,কপট। কোথায় যাও বিশ্বাসঘাতক। ওকে বন্দী করো।

কুমারসেন।

থামো তোমরা। এ কেমন বুদ্ধি তোমাদের। উনি এসেছেন বিশ্বাস করে আমার কাছে।

চন্দ্রসেন।

কিছু ভয় নেই, বৎস, শুধু বিশ্বাসের উপর ভর করে আসি নি। ওদের যদি অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছা থাকে নিরাশ করব না।

কুমারসেন।

প্রণাম পিতৃব্যদেব। আমার অভিষেকমুহূর্ত তোমার সমাগমে সার্থক হল। আমাকে আশীর্বাদ করো।

চন্দ্রসেন।

সে পরে হবে। সময় একটুও নেই। কেন এসেছি শোনো। সহসা জালন্ধররাজ সসৈন্যে কাশ্মীরে উপস্থিত।

কুমারসেন।

শুনেছি সে সংবাদ। অভিষেকের কাজ সত্বর সমাধা করব।

চন্দ্রসেন।

থাক্‌ এখন অভিষেক। অবিলম্বে চলো তার কাছে আত্মসমর্পণ করবে।

কুমারসেন।

আত্মসমর্পণ! যুদ্ধ নয়?

চন্দ্রসেন।

সৈন্য কোথায় তোমার।

কুমারসেন।

কেন। রাজধানীতে সৈন্যের অভাব নেই।

চন্দ্রসেন।

সে তো এখনো তোমার নয়।

কুমারসেন।

কিন্তু কাশ্মীরের তো বটে!

চন্দ্রসেন।

বিক্রম তো কাশ্মীর চান না, তোমাকেই চান।

কুমারসেন।

আমার মান-অপমান কি কাশ্মীরের নয়।

চন্দ্রসেন।

কী বল তুমি! এ তো সামান্য আত্মীয়কলহ। দাও তাঁর কাছে ধরা, চাও তাঁর স্নেহ ও ক্ষমা, হাসিমুখে সমস্ত নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।

কুমারসেন।

খুড়োমহারাজ, তর্ক করবার সময় নেই, শেষবার জিজ্ঞাসা করি-- রাজধানী থেকে সৈন্য পাব না?

চন্দ্রসেন।

রাজধানী! বিদ্রূপ করছ? শুনেছি ঐ আখরোটবনেই কাশ্মীরের রাজধানী। তোমার আদেশ এইখান থেকেই ঘোষণা কোরো। আমাকে তো কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বিদায় হই।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

সকলে।

ধিক্‌ ধিক্‌। নিপাত যাও। কোটি জন্ম তোমার নরকবাস হোক। সিংহাসনের কীট, সিংহাসনকে জীর্ণ করে তার ধূলির মধ্যে তোমার বিলুপ্তি ঘটুক।

কুমারসেন।

স্তব্ধ হও। শোনো। জালন্ধর কাশ্মীর আক্রমণে এসেছেন, আমাকে একলা লড়তে হবে।

সকলে।

মহারাজ, ন্যায় তোমার পক্ষে, ধর্ম তোমার পক্ষে, সমস্ত কাশ্মীরের হৃদয় তোমার পক্ষে। জয় মহারাজা কুমারসেনের জয়! ধিক্‌ ধিক্‌ চন্দ্রসেনকে শত শত শত ধিক্‌।

কুমারসেন।

চুপ করো, বৃথা উত্তেজনায় বলক্ষয় কোরো না। এখনি যাও সৈন্য সংগ্রহ করো গে।

সকলে।

আর অভিষেক?

কুমারসেন।

নাইবা হল অভিষেক।

সকলে।

সে হবে না, মহারাজ, সে হবে না। চন্দ্রসেনের চক্রান্ত শেষে সফল হবে! এ কিছুতেই পারব না সইতে। আমরা অR, সৈন্যসংগ্রহের আয়োজনে এখনই চললুম। কিন্তু উৎসব চলুক, অনুষ্ঠান শেষ হোক।

কুমারসেন।

ভয় নেই, মন্দিরে দেবসাক্ষী করে তীর্থোদকে একমুহূর্তে আমার অভিষেক হয়ে যাবে। যদি ফিরে আসি উৎসব সম্পূর্ণ করব। কিন্তু তোমরা যাও। আর বিলম্বে নয়।

সকলে।

জয় মহারাজ, কুমারসেনের জয়। ধিক্‌ চন্দ্রসেন। ধিক্‌ ধিক্‌ ধিক্‌।

[ সকলের প্রস্থান

[ সকলের প্রস্থান

আর-একদলের প্রবেশ

আর-একদলের প্রবেশ

১।

মহারাজ, আর সময় নেই। পালাতে হবে।

কুমারসেন।

কেন।

১।

জালন্ধরের সৈন্য অন্ধমুনির মাঠ পর্যন্ত এসেছে, পালানো ছাড়া এখন আর উপায় নেই। চলো, শম্ভুপ্রস্থের বনে আমি পথ জানি।

[উভয়ের প্রস্থান

[উভয়ের প্রস্থান

২।

এইমাত্র-যে খুড়োমহারাজ এসেছিলেন।

১।

চাতুরী, চাতুরী। শত্রুপক্ষকে তিনি নিজে সন্ধান বাতলিয়েছেন।

২।

গ্রামে গ্রামে লোক গেছে সৈন্য জোগাড় করতে, কিন্তু সময় তো পাওয়া গেল না। এরা যুদ্ধ করতেও দিলে না রে।

৩।

এ যে বেড়া আগুন, কিছুই করতে পারব না, মরব শুধু। অসহ্য!

১।

জালন্ধরের পাপিষ্ঠরা একেই বলে যুদ্ধ করা। এ তো মানুষ খুন করা!

আর-এক দল

আর-এক দল

১।

নাগপত্তন জ্বালিয়ে দিয়েছে রে, জ্বালিয়ে দিয়েছে।

২।

বলিস কী।

৩।

হাঁ, সেখানকার মানুষগুলো শেষ পর্যন্ত চেঁচিয়ে গলা ভেঙেছে-- জয় মহারাজ কুমারসেনের জয়।

২।

এর পিছনে আছে খুড়োরাজা। নাগপত্তন ওকে কিছুতেই মানে নি কিনা, এবার তারই শোধ নিলে বিদেশীকে নিয়ে।

৩।

তাহলে অনেক পত্তনেরই লীলা সাঙ্গ হবে।

দেবদত্তের প্রবেশ

দেবদত্তের প্রবেশ

দেবদত্ত।

শোনো শোনো, তোমাদের মধ্যে কুন্তীপুরের মানুষ কেউ আছে?

১।

কেন বলো তো।

দেবদত্ত।

চন্দ্রসেনের সঙ্গে বিক্রমমহারাজের পরামর্শ হয়েছে, সেখানে সৈন্য পাঠাবেন উৎপাত করবার জন্যে।

২।

আপনি কে হন মশায়। বিদেশী বলে বোধ হচ্ছে।

দেবদত্ত।

হাঁ, বিদেশী।

৩।

জালন্ধরের মানুষ?

দেবদত্ত।

ঠিক ঠাউরেছ।

১।

তোমার এতটা ধর্মবুদ্ধি হল কেমন করে।

দেবদত্ত।

বিধাতার আশ্চর্য মহিমায় কদাচিৎ এমনতরো ঘটে। তোমাদের কাশ্মীরে চন্দ্রসেন যে-বংশে জন্মেছেন সে-বংশেও ভদ্রমানুষ জন্মায় দেখেছি।

২।

বেশ বলেছেন, ঠাকুর, বেশ বলেছেন। ব্রাহ্মণ তো?

দেবদত্ত।

হাঁ, ব্রাহ্মণ।

সকলে।

প্রণাম হই।

২।

নিজের রাজার বিরুদ্ধে আপনি--

দেবদত্ত।

রাজার বিরুদ্ধে বল একে কোন্‌ বুদ্ধিতে। আমার রাজার পাপ যতটা নিবারণ করব আমার রাজভক্তি ততটাই সার্থক হবে।

৩।

কিন্তু বিপদ আছে তো ঠাকুর, রাজা যদি--

দেবদত্ত।

রাজার হয়ে আজ যারা অন্যায় করছে, বিপদের আশঙ্কা আমার চেয়ে তাদের তো কম নয়। অধর্ম যদি সাহস দিতে পারে, ধর্ম কি ভীরু হবে।

২।

খুব বড়ো কথা বললে ঠাকুর। দাও, আর একবার পায়ের ধুলো দাও।

দেবদত্ত।

যুবরাজ কুমারসেন এখান থেকে পালাতে পেরেছেন?

১।

ঠাকুর মাপ করো, ঐটে পারব না, যুবরাজের কথা তোমার সঙ্গেও চলবে না।

দেবদত্ত।

কিছু বলতে হবে না, আমি জানতে চাই, তিনি নিরাপদ তো?

১।

আপদ-বিপদের কথা কে বলতে পারে। তবে কিনা আমাদের চেষ্টার ত্রুটি হবে না।

৩।

দেখো দেখো, ঐ পশ্চিম পাহাড়ে। বোধ হচ্ছে অচলেশ্বরের কাছে ওরা আগুন লাগিয়েছে। বনটা সুদ্ধ জ্বলে উঠেছে। অকারণ সর্বনাশ করতে এল কেন এরা! খিদে পেলে বাঘে খায়, ভয় পেলে সাপে তাড়া ক'রে ক'রে আসে, এদের যে নিষ্কাম পাপ, অহৈতুকী হিংসা। এরা কোন্‌ জাতের মানুষ, ঠাকুর।

দেবদত্ত।

দৈত্য, দৈত্য। দেবতার 'পরে এদের বিশুদ্ধ বিদ্বেষ। ওরে উন্মত্ত দুর্বৃত্ত অন্ধ, তোমার মহাপাতক তোমাকে মহাপতনে নিয়ে চলল, আজ কে তোমাকে বাঁচাতে পারে। ধিক্‌ তোমার বন্ধুদের।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

বিক্রম ও চরের প্রবেশ

বিক্রম ও চরের প্রবেশ

বিক্রম।

কী বললে। সন্ধান পাওয়া গেল না?

চর।

না মহারাজ।

বিক্রম।

তবে যে চন্দ্রসেন বললেন, এইখানেই তাঁর অভিষেক হচ্ছিল। সে তো বেশিক্ষণের কথা নয়।

চর।

এইমাত্র দেখলুম তাঁর ঘোড়া ফিরিয়ে আনছে। তিনি প্রবেশ করেছেন শম্ভুপ্রস্থের বনে। সেখানে গুহার পথে অদৃশ্য হতে মুহূর্তমাত্র বিলম্ব হয় না।

বিক্রম।

যারা পথ জানে তাদের ধরে আনো।

চর।

মহারাজ, মরে গেলেও তারা বলবে না। ওখানে সন্ধান করতে যাবে এমন সাহসও কারও নেই। ও যে ভূতে পাওয়া অরণ্য।

বিক্রম।

ডেকে আনো চন্দ্রসেনকে।

চন্দ্রসেনের প্রবেশ

কোথায় কুমারসেন?

চন্দ্রসেন।

প্রজারা মিলে কোথায় তাঁকে গোপন করেছে, খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

বিক্রম।

আগুন লাগাও চারিদিকে, আপনি বেরিয়ে আসবেন।

চন্দ্রসেন।

কোথায় আছেন না জেনে আগুন লাগানো হিংসার ছেলেমানুষি।

বিক্রম।

সন্ধান তুমি জান, গোপন করছ।

চন্দ্রসেন।

পাপে তো প্রবৃত্ত হয়েছি, তার উপরে মূঢ়তা যোগ করব, এতবড়ো অর্বাচীন আমি নই। গোপন ক'রে তোমার কাছে নিজের বিপদ কেন ঘটাব।

বিক্রম।

আমি তোমাকে বিশ্বাস করি নে।

চন্দ্রসেন।

সমস্ত কাশ্মীরের লোক আমাকে অভিসম্পাত করছে, অবশেষে তোমারও মুখে এমন কথা শুনব এ আমি আশা করি নি।

বিক্রম।

তুমি অল্প আগেই এখানে কুমারের কাছে এসেছিলে এ-কথা সত্য কি না।

চন্দ্রসেন।

তাঁকে তোমার কাছে আত্মসমর্পণের পরামর্শ দিতে এসেছিলুম।

বিক্রম।

সেই ছলেই তাকে জানিয়েছ আমি এসেছি। আমার পক্ষ অবলম্বনের ভান ক'রে তাকে সতর্ক করে দিয়েছ।

চন্দ্রসেন।

ভুল করে আমাকে অবিশ্বাস কোরো না, মহারাজ।

বিক্রম।

সেও ভালো, কিন্তু বিশ্বাস ক'রে ভুল করবার সময় নেই। সেনাপতিকে আদেশ করে দিচ্ছি, তুমি দৃষ্টিবন্দী হয়ে থাকবে, শেষ পর্যন্ত কুমারকে সুমিত্রাকে যদি না পাই তবে পশুর মতো পিঞ্জরে পুরে তোমাকে জালন্ধরে নিয়ে যাব, প্রাণদণ্ড দেওয়াও তোমার পক্ষে সম্মান।

দ্বিতীয় চরের প্রবেশ

দ্বিতীয় চরের প্রবেশ

চর।

মহিষীর সংবাদ পাওয়া গেছে।

বিক্রম।

বলো বলো, কোথায় তিনি।

চর।

তিনি গেছেন মার্তণ্ডদেবের মন্দিরে, ধ্রুবতীর্থে।

বিক্রম।

চলো, এখনই চলো সেখানে। এই মুহূর্তে।

চন্দ্রসেন।

মহারাজ, কাশ্মীরের দেবতার বিরুদ্ধে স্পর্ধা প্রকাশ কোরো না। দেবালয়ে গিয়ে মার্তণ্ডদেবের উপাসিকাকে হরণ করা সইবে না।

বিক্রম।

তোমাদের মার্তণ্ডদেবই তো আমার মহিষীকে হরণ করেছেন। দেবতার চৌর্য আমি স্বীকার করব না।

চন্দ্রসেন।

এ কী বলছ। ভয় নেই তোমার?

বিক্রম।

না, ভয় নেই।

চন্দ্রসেন।

তাহলে আমার প্রাণদণ্ড করো। এ-পাপের দায়িত্ব আমি বহন করতে পারব না।

বিক্রম।

প্রাণদণ্ড সব শেষে। যতক্ষণ তোমার কাছ থেকে কাজ উদ্ধারের আশা আছে, ততক্ষণ নয়। সেনাপতি--

সেনাপতির প্রবেশ

সেনাপতির প্রবেশ

সেনাপতি।

কী মহারাজ।

বিক্রম।

চলো মার্তণ্ডদেবের মন্দিরের পথে।

সেনাপতি।

ঐ মন্দিরের দুর্গম পথে সৈন্য নিয়ে যাওয়া অসম্ভব।

বিক্রম।

অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে। মন্দিরের দুর্গমতা লৌকিক হোক অলৌকিক হোক, ভৌতিক হোক দৈবিক হোক, কিছুতে মানব না। সুমিত্রার পক্ষে কাশ্মীরের আশ্রয় চূর্ণ চূর্ণ করব এই শপথ আমি নিয়েছি।

চন্দ্রসেন।

দেবমন্দির ইহলোকের সীমায় নয় মহারাজ, সে তো পার্থিব কাশ্মীরের বাহিরে।

বিক্রম।

সে-কথা দেবতা সম্বন্ধে খাটে, কিন্তু সুমিত্রা সম্বন্ধে নয়; তিনি ইহলোকের সীমায় যতক্ষণ আছেন ততক্ষণ তিনি আমার, ততক্ষণ তিনি দেবতার নন। ততক্ষণ আমার কাছে তাঁর নিষ্কৃতি নেই, তাঁর কাছে আমারও নেই নিষ্কৃতি।

চন্দ্রসেন।

মহারাজ, আমি তোমার বয়োজ্যেষ্ঠ, আমি তোমার পায়ের কাছে মাথা রাখছি, লও আমার মুণ্ডচ্ছেদন ক'রে, কাশ্মীরের দেবতার অপমান কোরো না।

বিক্রম।

তোমার মুণ্ডের কী মূল্য আছে, তার পরিবর্তে আমার অপমান লাঘব হবে। আমাকে ছলনা করে তুমি পরিত্রাণ পাবে না। সেনাপতি, উদয়পুর অবরোধ করো। এইখানে কুমার নিশ্চয় লুকিয়ে আছেন চন্দ্রসেন সে-কথা গোপন করছেন। তার পরে চলব তীর্থের পথে। কন্দর্পদেবের পরিচয় পূর্বেই পেয়েছি এবার নেব মার্তণ্ডদেবের পরিচয়। যে-উৎসব জালন্ধরের দেবমন্দিরে আরম্ভ করেছিলুম, কাশ্মীরের দেবমন্দিরে সেই উৎসবের সমাপ্তি হবে।

১৯ ভাদ্র, ১৩৩৬ শান্তিনিকেতন
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7