অমর ও শান্তা
অমর।
আমার নিখিল ভুবন হারালেম আমি যে।
বিশ্ববীণার রাগিনী যায় থামি যে।
গৃহহারা হৃদয় যায় আলোহারা পথে হায়—
গহন তিমির গুহাতলে যাই নামি যে।
তোমারি নয়নে সন্ধ্যাতারার আলো,
আমার পথের অন্ধকারে জ্বালো জ্বালো।
মরীচিকার পিছে পিছে তৃষ্ণাতপ্ত প্রহর কেটেছে মিছে।
দিন-অবসানে তোমারই হৃদয়ে
শ্রান্ত পান্থ অমৃততীর্থগামী যে॥
শান্তা।
ভুল কোরো না গো, ভুল কোরো না,ভুল
কোরো না ভালবাসায়।
ভুলায়ো না, ভুলায়ো না, ভুলায়ো না নিষ্ফল আশায়।
বিচ্ছেদদুঃখ নিয়ে আমি থাকি,দেয় না সে ফাঁকি—
পরিচিত আমি তার ভাষায়।
দয়ার ছলে তুমি হোয়ো না নিদয়।
হৃদয় দিতে চেয়ে ভেঙো না হৃদয়।
রেখো না লুব্ধ করে— মরণের বাঁশিতে মুগ্ধ করে
টেনে নিয়ে যেয়ো না সর্বনাশায়॥
অমর।
ভুল করেছিনু ভুল ভেঙেছে।
এবার জেগেছি, জেনেছি,
এবার আর ভুল নয় ভুল নয়।
ফিরেছি মায়ার পিছে পিছে,
জেনেছি স্বপন সব মিছে।
বিঁধেছে বাসনা-কাঁটা প্রাণে,
এ তো ফুল নয় ফুল নয়।
পাই যদি ভালোবাসা হেলা করিব না,
খেলা করিব না লয়ে মন।
ওই প্রেমময় প্রাণে, লইব আশ্রয় সখী,
অতল সাগর এ সংসার,
এ তো কূল নয় কূল নয়॥
প্রমদার সখীগণের প্রবেশ
দূর হইতে
প্রমদার সখীগণের প্রবেশ
দূর হইতে
সখীগণ।
অলি বার বার ফিরে যায়, অলি বার বার ফিরে আসে-
তবে তো ফুল বিকাশে।
প্রথমা।
কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না- মরে লাজে মরে ত্রাসে।
ভুলি মান অপমান, দাও মন প্রাণ, নিশি দিন রহ পাশে।
দ্বিতীয়া।
ওগো আশা ছেড়ে তবু আশা রেখে দাও,
হৃদয়-রতন আশে॥
সকলে।
ফিরে এস ফিরে এস- বন মোদিত ফুলবাসে।
আজি বিরহরজনী ফুল্ল কুসুম শিশিরসলিলে ভাসে॥
অমর।
ডেকো না আমারে ডেকো না—ডেকো না
চলে যে এসেছে মনে তারে রেখো না।
আমার বেদনা আমি নিয়ে এসেছি,
মূল্য নাহি চাই যে ভালো বেসেছি।
কৃপাকনা দিয়ে আঁখিকোনে ফিরে দেখো না।
আমার দুঃখ-জোয়ারের জলস্রোতে।
নিয়ে যাবে মোরে সব লাঞ্ছনা হতে।
দূরে যাব যবে সরে তখন চিনিবে মোরে—
অবহেলা তব ছলনা দিয়ে ঢেকো না॥
অমরের প্রতি
অমরের প্রতি
শান্তা।
না বুঝে কারে তুমি ভাসালে আঁখিজলে।
ওগো, কে আছে চাহিয়া শূন্য পথপানে-
কাহার জীবনে নাহি সুখ, কাহার পরান জ্বলে।
পড় নি কাহার নয়নের ভাষা,
বোঝ নি কাহার মরমের আশা, দেখ নি ফিরে-
কার ব্যাকুল প্রাণের সাধ এসেছ দ'লে॥
অমর।
যে ছিল আমার স্বপনচারিণী
তারে বুঝিতে পারি নি—
দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে।
শুভক্ষনে কাছে ডাকিলে, লজ্জা আমার ঢাকিলে গো—
তোমারে সহজে পেরেছি বুঝিতে।
কে মোরে ফিরাবে অনাদরে কে মোরে ডাকিবে কাছে,
কাহার প্রেমের বেদনায় আমার মূল্য আছে—
এ নিরন্তর সংশয়ে আর পারি নে যুঝিতে।
তোমারেই শুধু পেরেছি বুঝিতে॥
প্রস্থান
প্রস্থান
সখীগণ।
প্রভাত হইল নিশি কানন ঘুরে,
বিরহ-বিধুর হিয়া মরিল ঝুরে।
ম্লান শশী অস্ত গেল ম্লান হাসি মিলাইল
কাঁদি উঠিল প্রাণ কাতর সুরে।
প্রমদার প্রবেশ
প্রমদার প্রবেশ
প্রমদা।
চল্ সখী চল্ তবে ঘরেতে ফিরে
যাক ভেসে ম্লান আঁখি নয়ন-নীরে।
যাক ফেটে শূন্য প্রাণ, হোক্ আশা অবসান,
হৃদয় যাহারে ডাকে থাক্ সে দূরে।
শান্তা।
হায় হতভাগিনী,
স্রোতে বৃথা গেল ভেসে, কূলে তরী লাগে নি, লাগে নি।
কাটালি বেলা বীণাতে সুর বেঁধে—
কঠিন টানে উঠল কেঁদে,
ছিন্ন তারে থেমে গেল-যে রাগিণী।
এই পথের ধারে এসে ডেকে গেছে তোরে সে।
ফিরিয়ে দিলি তারে রুদ্ধদ্বারে।—
বুক জ্বলে গেল গো, ক্ষমা তবুও কেন মাগি নি।