মন্ত্রী ও প্রতাপাদিত্য
মন্ত্রী।
যুবরাজ কারাদণ্ড তো এতদিন ভোগ করলেন, এখন ছেড়ে দিন।
প্রতাপ।
কারাদণ্ড দেবার কারণ ঘটেছিল,ছেড়ে দেবার তো কারণ ঘটে নি।
মন্ত্রী।
কেবল সন্দেহমাত্রে ওঁকে শাস্তি দিয়েছেন। প্রমাণ তো পান নি।
প্রতাপ।
মাধবপুরের প্রজারা দরখাস্ত নিয়ে দিল্লিতে চলেছিল, হাতে হাতে ধরা পড়েছিল, সেও কি তুমি অবিশ্বাস কর।
মন্ত্রী।
আজ্ঞে না মহারাজ,অবিশ্বাস করছি নে।
প্রতাপ।
ওরা তাতে লিখেছে অমি দিল্লীশ্বরের শত্রু, ওদের ইচ্ছা আমাকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে উদয়কে সিংহাসন দেওয়া হয়-এ কথাগুলো তো ঠিক?
মন্ত্রী।
আজ্ঞে হাঁ, সে দরখাস্ত তো আমি দেখেছি।
প্রতাপ।
এর চেয়ে তুমি আর কী প্রমাণ চাও।
মন্ত্রী।
কিন্তু এর মধ্যে আমাদের যুবরাজ আছেন, এ কথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি নে।
প্রতাপ।
তোমার বিশ্বাস কিম্বা তোমার আন্দাজের উপর নির্ভর করে তো আমি রাজকার্য চালাতে পারি নে। যদি বিপদ ঘটে তবে "ওই যা, মন্ত্রী আমার ভুল বিশ্বাস করেছিল' বলে তো নিষ্কৃতি পাব না।
মন্ত্রী।
কিন্তু ন্যায়বিচার করা রাজত্বের অঙ্গ মহারাজ। যুবরাজকে যে সন্দেহে কারাদণ্ড দিয়েছেন তার যদি কোনো মূল না থাকে তা হলেও রাজকার্যের মঙ্গল হবে না।
প্রতাপ।
রাজ্যরক্ষা সহজ ব্যাপার নয় মন্ত্রী। অপরাধ নিশ্চয় প্রমাণ হলে তার পরে দণ্ড দেওয়াই যে রাজার কর্তব্য তা আমি মনে করি নে। যেখানে সন্দেহ করা যায় কিম্বা যেখানে ভবিষ্যতেও অপরাধের সম্ভাবনা আছে, সেখানেও রাজা দণ্ড দিতে বাধ্য।
মন্ত্রী।
আপনি রাগ করবেন, কিন্তু আমি এ ক্ষেত্রে সন্দেহ কিম্বা ভবিষ্যৎ অপরাধের সম্ভাবনা পর্যন্ত কল্পনা করতে পারি নে।
প্রতাপ।
মাধবপুরের প্রজারা এখানে এসেছিল কি না?
মন্ত্রী।
হাঁ।
প্রতাপ।
তারা ওকেই রাজা করতে চেয়েছিল কি না?
মন্ত্রী।
হাঁ চেয়েছিল।
প্রতাপ।
তুমি বলতে চাও এ-সকলের মধ্যে উদয়ের কোনো হাত ছিল না?
মন্ত্রী।
যদি হাত থাকত তা হলে এত প্রকাশ্যে এ কথার আলোচনা হত না।
প্রতাপ।
আচ্ছা, আচ্ছা, তোমার নিঃসংশয় নিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত হয়েই বসে থাকো-বিপদটা একেবারে ঘাড়ে এসে পড়ার জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকব না। রাজার দায়িত্ব মন্ত্রীর দায়িত্বের চেয়ে ঢের বেশি। অন্যায়ের দ্বারা অবিচারের দ্বারাও রাজাকে রাজধর্ম পালন করতে হয়।
মন্ত্রী।
অন্তত বৈরাগী ঠাকুরকে ছেড়ে দিন মহারাজ। প্রজাদের মনে একসঙ্গে এতগুলো বেদনা চাপাবেন না।
প্রতাপ।
আচ্ছা, সে আমি বিবেচনা করে দেখব।
মন্ত্রী।
চলুন-না মহারাজ, একবার স্বয়ং ভিতরে গিয়ে যুবরাজকে দেখে আসুন-না। ওঁর মুখ দেখলে, ওঁর দুটো কথা শুনলেই বুঝতে পারবেন, গোপনে অপরাধ ওঁর দ্বারা কখনো ঘটতেই পারে না।
প্রতাপ।
যারা মুখের ভাব দেখে আর হায়-হায় আহা-উহু করতে করতে রাজ্যশাসন করে তারা রাজা হবার যোগ্য নয়।
বসন্তরায়ের প্রবেশ
বসন্তরায়ের প্রবেশ
বসন্ত।
বাবা প্রতাপ, উদয়কে আর কেন কষ্ট দাও। পদে পদেই যদি সে তোমাদের কাছে অপরাধ করে তবে তাকে এই বুড়োর কাছে দাও-না।
[ প্রতাপ নিরুত্তর
তুমি যা মনে করে উদয়কে শাস্তি দিচ্ছ, সেই অপরাধ যে যথার্থ আমার। আমিই যে রামচন্দ্ররায়কে রক্ষা করবার জন্যে চক্রান্ত করেছিলুম।
প্রতাপ।
খুড়োমশায়,বৃথা কথা বলে আমার কাছে কোনোদিন কেউ কোনো ফল পায় নি।
বসন্ত।
ভালো, আমার আর-একটা ক্ষুদ্র প্রার্থনা আছে। আমি একবার কেবলউদয়কে দেখে যেতে চাই-আমাকে সেই কারাগৃহে প্রবেশ করতে কেউ যেন বাধা না দেয় এই অনুমতি দাও!
প্রতাপ।
সে হতে পারবে না।
বসন্ত।
তা হলে আমাকে তার সঙ্গে বন্দী করে রাখো। আমাদের দুজনেরই অপরাধ এক-দণ্ডও এক হোক-যতদিন সে কারাগারে থাকবে আমিও থাকব।
[ নীরবে প্রতাপের প্রস্থান
[ নীরবে প্রতাপের প্রস্থান
রামমোহনের প্রবেশ
রামমোহনের প্রবেশ
বসন্ত।
কী মোহন। কী খবর।
রামমোহন।
মাকে আমাদের চন্দ্রদ্বীপে আসবার কথা বলতে এসেছিলুম।
বসন্ত।
প্রতাপকে জানিয়েছিস নাকি।
রামমোহন।
তাঁকে জানাবার আগে একবার স্বয়ং মাকে নিবেদন করতে গিয়েছিলুম।
বসন্ত।
তা,বিভা কী বললে।
রামমোহন।
তিনি বললেন,তিনি যেতে পারবেন না।
বসন্ত।
কেন, কেন। অভিমান করেছে বুঝি? সেটা মিছে অভিমান, রামমোহন, সে বেশিক্ষণ থাকবে না,একটু তুমি সবুর করো।
রামমোহন।
তিনি বললেন,"দাদাকে ছেড়ে আজ আমি যেতে পারব না।'
বসন্ত।
আহা, সে কথা বলতে পারে বটে।
রামমোহন।
বড়ো বুক ফুলিয়ে এসেছিলেম। মহারাজ নিষেধ করেছিলেন।-
বলেছিলেন, মালক্ষ্মী আমাকে বড়ো দয়া করেন, আমার কথা ঠেলতে পারবেন না! আমাদের রাজা বললেন, প্রতাপাদিত্যের ঘরের মেয়েকে নিতে পারব না। আমি বললেম, তিনি কি কেবল প্রতাপাদিত্যের ঘরের মেয়ে? আপনার ঘরের রানী নন? শ্বশুরের উপর রাগ করে নিজের সিংহাসনকে অপমান করবেন? এই বলে চলে এসেছি, আজ আমি ফিরব কোন্ মুখে?
বসন্ত।
বিভাকে দোষ দিয়ো না রামমোহন।
রামমোহন।
না খুড়োমহারাজ, আমাদের মহারাজার ভাগ্যকেই দোষ দিই--এমন লক্ষ্মীকে পেয়েও হেলায় হারাতে বসেছেন।
বসন্ত।
হারাবে কেন রামমোহন। শুভদিন আসবে, আবার মিলন হবে।
রামমোহন।
কুপরামর্শ দেবার লোক যে ঢের আছে। ওরা বলছে যাদবপুরের ঘরের মেয়ে এনে তাকে ওঁর পাটরানী করবে।
বসন্ত।
এও কি কখনো সম্ভব? আমাদের বিভাকে ত্যাগ করবে?
রামমোহন।
সেই চক্রান্তই হয়েছে, তাই আমি ছুটে এলুম। অপরাধ করলে নিজে, আর যিনি সতীলক্ষ্মী তাঁকে দণ্ড দিলেন। এও কি কখনো সইবে? হোক-না কলি, ধর্ম কি একেবারে নেই। চললুম মহারাজ,আশীর্বাদ করবেন, আমাদের রাজার যেন সুমতি হয়।
বসন্ত।
এখানকার বিপদ কেটে গেলে আমি নিজে যাব তোমাদের ওখানে। এমন অন্যায় হতে দেব কেন।
[ রামমোহনের প্রণাম করিয়া প্রস্থান
সীতারামের প্রবেশ
কী সীতারাম,খবর কি?
সীতারাম।
কারাগারে আমরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছি, এখনই যুবরাজ বেরিয়ে আসবেন।
বসন্ত।
আবার আর-একটা উৎপাত ঘটবে না তো? একটা ফাঁড়া কাটাতে গিয়ে আর-একটা ফাঁকা ঘাড়ে চাপে যে। আমার ভালো ঠেকছে না।
সীতারাম।
কাছেই নৌকো তৈরি আছে খুড়োমহারাজ, তাঁকে নিয়ে এখনই আপনাকে পালাতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো গতি নেই।
বসন্ত।
তার আগে বিভার সঙ্গে একবার দেখা করে আসি গে।
সীতারাম।
না, তার সময় নেই।
বসন্ত।
দেরি করব না সীতারাম, তার সঙ্গে জীবনে আর তো দেখা হবে না।
সীতারাম।
তা হলে সমস্ত আমাদের বৃথা হয়ে যাবে। ওই দেখুন, আগুনের শিখা জ্বলে উঠেছে।
বসন্ত।
আগুন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে তো রে?
সীতারাম।
কারাগারের মধ্যেই আমাদের চর আছে, এই এলেন ব'লে, দেখুন-না।
উদয়াদিত্যের প্রবেশ
উদয়াদিত্যের প্রবেশ
উদয়।
দাদামশায় যে!
বসন্ত।
আয় ভাই,আয়।
উদয়।
সমস্তই স্বপ্ন নাকি? আমি তো বুঝতে পারছি নে।
সীতারাম।
যুবরাজ, এই দিকে নৌকো আছে, শীঘ্র আসুন।
উদয়।
কেন, নৌকো কেন?
সীতারাম।
নইলে আবার প্রহরীরা ধরে ফেলবে।
উদয়।
কেন, আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি।
বসন্ত।
হাঁ ভাই,আমি তোকে চুরি করে নিয়ে চলেছি।
সীতারাম।
কয়েদখানায় আমিই আগুন লাগিয়েছি।
উদয়।
কী সর্বনাশ! মরবি যে রে!
সীতারাম।
যতদিন তুমি কয়েদে ছিলে, প্রতিদিন আমি মরেছি।
উদয়।
না, আমি পালাব না।
বসন্ত।
কেন দাদা।
উদয়।
নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে অন্যদের বিপদের জালে জড়াতে পারব না।
বসন্ত।
অন্যদের যে তাতেই আনন্দ। তোমার তাতে কোনো অপরাধ নেই।
উদয়।
সে আমি পারব না। কারাগারের বন্ধন আমার পক্ষে তার চেয়ে অনেক ভালো। যদি পালাই তবে মুক্তি আমার ফাঁস হবে। আমি কারাগারে ফিরব।
বসন্ত।
কারাগার তো গেছে ছাই হয়ে, তুমি ফিরবে কোথায়।
উদয়।
ওই দিকে একখানা ঘর বাকি আছে।
বসন্ত।
তা হলে আমিও যাই।
উদয়।
না, তুমি যেতে পারবে না। কিছুতেই না।
বসন্ত।
আচ্ছা তা হলে আমি বিভার কাছে যাই। তার প্রাণটা যে কীরকম করছে, সে আমিই জানি।
উদয়।
সীতারাম আমার জন্যে যে নৌকো তৈরি আছে সে নৌকোয় চড়ে এখনই তুই রায়গড়ে চলে যা।
সীতারাম।
(উদয়কে প্রণাম করিয়া) তা ছাড়া আমার আর গতি নিই। প্রভু, যদি কোনো পুণ্য করে থাকি আর-জন্মে যেন তোমার দাস হয়ে জন্মাই।
[ উভয়ের প্রস্থান
[ উভয়ের প্রস্থান
ধনঞ্জয়ের প্রবেশ
ধনঞ্জয়ের প্রবেশ
নৃত্য ও গীত
নৃত্য ও গীত
ওরে আগুন আমার ভাই,
আমি তোমারি জয় গাই।
তোমার শিকলভাঙা এমন রাঙা মূর্তি দেখি নাই।
তুমি দু হাত তুলে আকাশ-পানে
মেতেছ আজ কিসের গানে,
একি আনন্দময় নৃত্য অভয় বলিহারি যাই।
যেদিন ভবের মেয়াদ ফুরাবে ভাই,
আগল যাবে সরে-
সেদিন হাতের দড়ি পায়ের বেড়ি
দিবি রে ছাই করে।
সেদিন আমার অঙ্গ তোমার অঙ্গে
ঐ নাচনে নাচবে রঙ্গে,
সকল দাহ মিটবে দাহে
ঘুচবে সব বালাই।
[ প্রস্থান
[ প্রস্থান
প্রতাপাদিত্য ও মন্ত্রীর প্রবেশ
প্রতাপাদিত্য ও মন্ত্রীর প্রবেশ
প্রতাপ।
দৈবাৎ আগুন লাগার কথা আমি একবর্ণ বিশ্বাস করি নে। এর মধ্যে চক্রান্ত আছে। খুড়ো কোথায়?
মন্ত্রী।
তাঁকে দেখা যাচ্ছে না।
প্রতাপ।
হুঁ। তিনিই এই অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে ছোঁড়াটাকে নিয়ে পালিয়েছেন।
মন্ত্রী।
তিনি সরল লোক -- এ-সকল বুদ্ধি তো তাঁর আসে না।
প্রতাপ।
বাইরে থেকে যাকে সরল বলে বোধ হবে না তার কুটিল বুদ্ধি বৃথা।
মন্ত্রী।
কারাগার ভস্মসাৎ হয়ে গেছে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে যদি--
প্রতাপ।
কোনো আশঙ্কা নেই, আমি বলছি উদয়কে নিয়ে খুড়োমহারাজ পালিয়েছেন। বৈরাগীটার খবর পেয়েছ?
মন্ত্রী।
না মহারাজ।
প্রতাপ।
সে বোধ হয় পালিয়েছে। সে যদি থাকে তো আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো।
মন্ত্রী।
কেন মহারাজ, তাকে আবার কিসের প্রয়োজন।
প্রতাপ।
আর কিছু নয়-সেই ভাঁড়টাকে নিয়ে একটু আমোদ করতে পারতুম, তার কথা শুনতে মজা আছে।
ধনঞ্জয়ের প্রবেশ
ধনঞ্জয়ের প্রবেশ
ধনঞ্জয়।
জয় হোক মহারাজ। আপনি তো আমাকে ছাড়তেই চান না, কিন্তু কোথা থেকে আগুন ছুটির পরোয়ানা নিয়ে হাজির; কিন্তু না বলে যাই কী করে। তাই হুকুম নিতে এলুম।
প্রতাপ।
কদিন কাটল কেমন?
ধনঞ্জয়।
সুখে কেটেছে,কোনো ভাবনা ছিল না। এ-সব তারই লুকোচুরি খেলা- ভেবেছিলে গারদে লুকোবে, ধরতে পারবে না। কিন্তু ধরেছি, চেপে ধরেছি, তার পর খুব হাসি, খুব গান। বড়ো আনন্দে গেছে, আমরা গারদ-ভাইকে মনে থাকবে।
গান
ওরে শিকল, তোমায় অঙ্গে ধরে
দিয়েছি ঝংকার।
তুমি আনন্দে ভাই, রেখেছিলে
ভেঙে অহংকার।
তোমায় নিয়ে করে খেলা
সুখে দুঃখে কাটল বেলা-
অঙ্গ বেড়ি দিলে বেড়ি,
বিনা দামের অলংকার।
তোমার 'পরে করি নে রোষ,
দোষ থাকে তো আমারই দোষ,
ভয় যদি রয় আপন মনে
তোমায় দেখি ভয়ংকর।
অন্ধকারে সারা রাতি
ছিলে আমার সাথের সাথি,
সেই দয়াটি স্মরি তোমায়
করি নমস্কার।
প্রতাপ।
বল কী বৈরাগী, গারদে তোমার এত আনন্দ কিসের।
ধনঞ্জয়।
মহারাজ, রাজ্যে তোমার যেমন আনন্দ, তেমনি আনন্দ। অভাব কিসের। তোমাকে সুখ দিতে পারেন আর আমাকে পারেন না?
প্রতাপ।
এখন তুমি যাবে কোথায়।
ধনঞ্জয়।
রাস্তায়।
প্রতাপ।
বৈরাগী, আমার এক-একবার মনে হয় তোমার ওই রাস্তাই ভালো--আমার এই রাজ্যটা কিছু না।
ধনঞ্জয়।
মহারাজ, রাজ্যটাও তো রাস্তা। চলতে পারলেই হল। ওটাকে যে পথ বলে জানে সেই তো পথিক; আমরা কোথায় লাগি। তা হলে অনুমতি যদি হয় তো এবারকার মতো বেরিয়ে পড়ি।
প্রতাপ।
আচ্ছা, কিন্তু মাধবপুরে যেয়ো না।
ধনঞ্জয়।
সে কেমন করে বলি, যখন নিয়ে যাবে তখন কার বাবার সাধ্য বলে যে যাব না।
মন্ত্রী।
মহারাজ! ওই তো দেখি যুবরাজ আসছেন।
[ প্রস্থান
[ প্রস্থান
প্রতাপ।
তাই তো, পালায় নি তবে।
উদয়াদিত্যের প্রবেশ
উদয়াদিত্যের প্রবেশ
প্রতাপ।
কী, তুমি যে মুক্ত দেখি?
উদয়।
কেমন করে বলব মহারাজ। কারাগার পুড়লেই কি কারাগার যায়।
প্রতাপ।
তুমি যে পালিয়ে গেলে না?
উদয়।
মেয়াদ না ফুরোলে পালাব কী করে। মহারাজের সঙ্গে আমার যে চিরবন্ধনের সম্বন্ধ, সেটা যখন নিজে ছিন্ন করে দেবেন সেইদিনই তো ছাড়া পাব।
প্রতাপ।
তোমাকে ত্যাগ ক'রে?
উদয়।
তা ছাড়া আর কী বলব। আমাকে গ্রহণ করে আমাদের তো কারও কোনো সুখ নেই।
প্রতাপ।
তুমি অথচ সিংহাসনের যোগ্য নও, সেই সিংহাসনে তোমার অধিকার আছে, এর থেকেই যত দুঃখ। যেখানে যার স্থান নয় সেইখানেই তার বন্ধন।
উদয়।
না মহারাজ, আমি যোগ্য নই। আপনার এই সিংহাসন হতে আমাকে অব্যাহতি দিন এই ভিক্ষা।
প্রতাপ।
তুমি যা বলছ তা যে সত্যই তোমার হৃদয়ের ভাব তা কী করে জানব।
উদয়।
আজ আমি মা-কালীর চরণ স্পর্শ করে শপথ করব, আপনার রাজ্যের সূচ্যগ্র ভূমিও আমি কখনো শাসন করব না; সমরাদিত্যই আপনার রাজ্যের উত্তরাধিকারী।
প্রতাপ।
তুমি তবে কী চাও
উদয়।
মহারাজ, আমি আর কিছুই চাই নে-কেবল আমাকে পিঞ্জরের পশুর মতো গারদে পুরে রাখবেন না। আমাকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করুন, আমি একাকী কাশী চলে যাই।
প্রতাপ।
আচ্ছা বেশ। আমি এর ব্যবস্থা করছি।
উদয়।
আমার আর-একটি প্রার্থনা আছে মহারাজ। আমি বিভাকে নিজে তার শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবার অনুমতি চাই।
প্রতাপ।
তার আবার শ্বশুরবাড়ি কোথায়।
উদয়।
তাই যদি মনে করেন তবে সেই অনাথা কন্যাকে আমার কাছে থাকবার অনুমতি দিন। এখানে তো তার সুখও নেই, কর্মও নেই।
প্রতাপ।
তার মাতার কাছে অনুমতি নিতে পার।
[ মন্ত্রীর প্রস্থান
[ মন্ত্রীর প্রস্থান
মহিষী ও বিভার প্রবেশ
মহিষী ও বিভার প্রবেশ
মহিষী।
উদয় কি বেঁচে আছে।
প্রতাপ।
ভয় নেই। বেঁচে আছে। তুমি এখানে যে?
মহিষী।
পারব কেন থাকতে। শুনলুম কারাগারে আগুন লেগেছে। উদয়, বাবা আমার, এখন ঘরে চল্।
উদয়।
আমার ঘর নেই। আমি যাচ্ছি কাশী।
মহিষী।
সে কী কথা। তা হলে আমাকে মেরে ফেলে যা।
উদয়।
মা, এতদিনে তুমি কি ঠাউরেছ তোমার আশ্রয়েই ছেলে নিরাপদে থাকবে। আমার তো শিক্ষার আর কিছু বাকি নেই। আজ তোমাদেরই কল্যাণে বিশ্বনাথের আশ্রয় পেয়েছি। কারাগারের সঙ্গে সঙ্গে আমার অন্য সব আশ্রয়ই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কেঁদে কী হবে মা, আজই চোখের জল মোছাবার সময়।
বিভা।
দাদা, আমাকে ফেলে যেতে পারবে না।
উদয়।
কিছুতে না। (মাতার প্রতি) বিভার তো আর জায়গা নেই - এখন তুমি অনুমতি করো, আমার সঙ্গে ওকেও অভয়-আশ্রয়ে নিয়ে যাই।
মহিষী।
তুই যদি যাবি উদয়, তো ও যাক তোর সঙ্গে-- তোর মায়ের হয়ে ও-ই তোকে দেখতে শুনতে পারবে। ইতিমধ্যে ওর শ্বশুরবাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিই, যদি তারা--
প্রতাপ।
চুপ করো, ওর আবার শ্বশুরবাড়ি কোথায়।
মহিষী।
গর্ভে ধরে সংসারে কী দুঃখই এনেছি। রাজার বাড়িতে এরা জন্মেছিল এইজন্যেই? এখন একবার বাড়িতে চল্--তার পরে--
উদয়।
না মা,ও বাড়িতে আর নয়--রাস্তা বেয়ে সোজা চলে যাব, আমাদের পিছনে তাকাবার কিছুই নেই।
মহিষী।
তোরা রাস্তায় বেরিয়ে যাবি, আর এই রাজবাড়ির অন্ন যে আমার বিষের মতো ঠেকবে।
উদয়।
এখন আমাদের আশীর্বাদ করে বিদায় করো।
মহিষী।
বুঝতে পারছি,তোদের দুঃখের দিন ঘুচল। এবার ঈশ্বর তোদের সুখেই রাখবেন। তবু দুর্বল মন মানে না যে। আজ থেকে মায়ের যোগ্য সেবা তোদের আর তো কিছু করতে পারব না। তোদের জন্যে যশোরেশ্বরীর কাছে রোজ পুজো দেব।
বিভা।
দাদামশায় কোথায় দাদা।
উদয়।
তিনি কাছেই কোথাও আছেন-এখনই দেখা হবে।
প্রতাপ।
না, দেখা হবে না। কোনোদিন না!
উদয়।
কেন, তাঁর কী হল?
প্রতাপ।
তাঁর বিচার বাকি আছে। সে-সব কথা তোমাদের ভাববার কথা নয়।
উদয়।
না হতে পারে, কিন্তু এই বলে গেলুম মহারাজ, রাজ্য তো মাটির নয়,রাজ্য হল পুণ্যের - সে পুণ্য রাজাকে নিয়ে, প্রজাকে নিয়ে, সকলকে নিয়ে। বিভা, আর কাঁদিস নে। দাদামশায় তো মহাপুরুষ, ভয়ে তাঁর ভয় নেই, মৃত্যুতে তাঁর মৃত্যু নেই। আমাদের মতো সামান্য মানুষই ঘা খেয়ে মরে।
প্রতাপ।
এখন এস উদয়, কালীর মন্দিরে এস,মায়ের পা ছুঁয়ে শপথ করতে হবে।