উদয়াদিত্য ও ধনঞ্জয়
পথে
উদয়াদিত্য ও ধনঞ্জয়
ধনঞ্জয়।
আজ রাস্তায় মিলন, আজ বড়ো আনন্দ। আজ আর ভণ্ডামির কোনো দরকার নেই, আজ আর যুবরাজ নয়। আজ তো তুমি ভাই। আয় ভাই, কোলাকুলি করে নিই।
[ কোলাকুলি
দাদা, যেখানে দীন দরিদ্র সবাই এসে মেলে সেই দরাজ জায়গাটাতে এসে দাঁড়িয়েছ, আজ আর কিছু ভাবনা নেই।
গান
সকল ভয়ের ভয় যে তারে
কোন্ বিপদে কাড়বে।
প্রাণের সঙ্গে যে প্রাণ গাঁথা
কোন্ কালে সে ছাড়বে।
নাহয় গেল সবই ভেসে--
রইবে তো সেই সর্বনেশে,
যে লাভ সকল ক্ষতির শেষে
সে লাভ কেবল বাড়বে।
সুখ নিয়ে ভাই, ভয়ে থাকি--
আছে আছে দেয় সে ফাঁকি,
দুঃখে যে সুখ থাকে বাকি
কেই বা সে সুখ নাড়বে।
যে পড়েছে পড়ার শেষে
ঠাঁই পেয়েছে তলায় এসে--
ভয় মিটেছে, বেঁচেছে সে,
তারে কে আর পাড়বে।
উদয়।
বৈরাগী ঠাকুর, আমি তোমার সঙ্গ ধরলুম, আর ছাড়ছি নে কিন্তু।
ধনঞ্জয়।
তুমি ছাড়লে আমি ছাড়ি কই ভাই। মনে বেশ আনন্দ আছে তো? খুঁতমুত কিছু নেই তো?
উদয়।
কিছু না, বেশ আছি।
ধনঞ্জয়।
তবে দাও একটু পায়ের ধুলো।
উদয়।
ও কী কর, ও কী কর। অপরাধ হবে যে।
ধনঞ্জয়।
দাদা, এতবড়ো বোঝা নিজের হাতে ভগবান যার কাঁধ থেকে নামিয়ে দেন, সে যে মহাপুরুষ। তোমাকে দেখে আমার সর্ব গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। একবার দিদিকে আনো, তাকে একবার দেখি।
উদয়।
সে তোমাকে দেখবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে, তাকে ডেকে আনছি।
বিভার প্রবেশ ও বৈরাগীকে প্রণাম
বিভার প্রবেশ ও বৈরাগীকে প্রণাম
ধনঞ্জয়।
ভয় নেই দিদি, ভয় নেই, কোনো ভয় নেই। এই দেখ্-না, আমাকে দেখ্-না-- আমি তাঁর রাস্তার ছেলে-- রাস্তার কোলে-কোলেই দিন কেটে গেল-- দিনরাত্রি একেবারে ধুলোয় ধুলোময় হয়ে বেড়াই, মায়ের আদরে লাল হয়ে উঠি। আমার মায়ের ওই ধুলোঘরে আজ তোমার নতুন নিমন্ত্রণ, কিন্তু মনে কোনো ভয় রেখো না।
বিভা।
বৈরাগী ঠাকুর, তুমি কোথায় যাচ্ছ। তুমি কি আমাদের সঙ্গে যাবে।
ধনঞ্জয়।
কোথায় যাব সে কথা আমার মনেই থাকে না। ওই রাস্তাই তো আমাকে মজিয়েছে। এই মাটি দেখলে আমাকে মাটি করে দেয়।
গান
সারিগানের সুর
গ্রামছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ
আমার মন ভুলায় রে।
ওরে কার পানে মন হাত বাড়িয়ে
লুটিয়ে যায় ধুলায় রে।
ও যে আমায় ঘরের বাহির করে,
পায়ে পায়ে পায়ে ধরে--
ও যে কেড়ে আমায় নিয়ে যায় রে
যায় রে কোন্ চুলায় রে।
ও যে কোন্ বাঁকে কী ধন দেখাবে,
কোন্খানে কী দায় ঠেকাবে,
কোথায় গিয়ে শেষ মেলে যে--
ভেবেই না কুলায় রে।
উদয়।
ঠাকুর, তুমি কি ভাবছ বিভা আমার পথের সঙ্গিনী। ওকে আমি ওর শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দিতে যাচ্ছি।
ধনঞ্জয়।
বেশ, বেশ, হরি যেখানে নিয়ে যান সেইখানেই ভালো। দেখি তিনি কোন্খানে পৌঁছিয়ে দেন, আমিও সঙ্গে আছি। কোনো ভয় নেই দিদি, কোনো ভয় নেই।
[ প্রস্থান
[ প্রস্থান
বিভা।
দাদা, ওই-যে মোহন আসছে। ওর সঙ্গে আমি একটু আলাদা কথা কইতে চাই।
উদয়।
আচ্ছা, আমি একটু সরে যাচ্ছি।
[ প্রস্থান
[ প্রস্থান
রামমোহনের প্রবেশ
রামমোহনের প্রবেশ
বিভা।
মোহন!
রামমোহন।
মা, আজ তুমি এলে?
বিভা।
হাঁ মোহন, তুই কি আমায় নিতে এলি।
রামমোহন।
না মা, অত ব্যস্ত হোয়ো না, আজ থাক্।
বিভা।
কেন মোহন, আজ কেন নয়।
রামমোহন।
আজ দিন ভালো নয় যে মা, আজ দিন ভালো নয়।
বিভা।
ভালো দিন নয়? তবে আজ এত উৎসবের আয়োজন কেন। বরাবর দেখলুম রাস্তায় আলোর মালা, বাঁশি বাজছে। আজ বুঝি শুভলগ্ন পড়েছে।
রামমোহন।
শুভলগ্ন, মিথ্যা কথা! সমস্ত ভুল!
বিভা।
মোহন, তোর কথা আমি বুঝতে পারছি নে, কী হয়েছে আমাকে সত্যি করে বল্। মহারাজ কি রাগ করেছেন?
রামমোহন।
রাগ করেছেন বৈকি।
বিভা।
তিনি তো আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
রামমোহন।
দেরি হয়ে গেছে মা, দেরি হয়ে গেছে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। সময় গেলে আর ফেরে না।
বিভা।
কে বললে ফেরে না। আমি তপস্যা করে ফেরাব, আমি জীবন মন দিয়ে ফেরাব। মোহন, এখনই তুই আমাকে নিয়ে যা। দেরি যদি হয়ে থাকে, আর এক মুহূর্ত দেরি করব না।
রামমোহন।
যুবরাজ কোথায় গেছেন?
বিভা।
তিনি এখনই আসবেন।
রামমোহন।
তিনি ফিরে আসুন-না।
বিভা।
না মোহন, আর বিলম্ব নয়। তিনি কি খবর পেয়েছেন আমি এসেছি। দাদা বললেন, তিনি নৌকার ছাত থেকে দেখেছেন ময়ূরপংখি সাজানো হচ্ছে।
রামমোহন।
হাঁ, সাজানো হচ্ছে বটে--
বিভা।
এখনও কি সাজানো শেষ হয় নি।
রামমোহন।
ওই ময়ূরপংখির সাজসজ্জায় আগুন লাগুক।
বিভা।
মোহন, তোর মুখে এ কী কথা! তুই যখন আনতে গেলি আসতে পারি নি বলে এত রাগ করেছিস? তুইও আমার দুঃখ বুঝতে পারিস নি মোহন?
[ রামমোহন নিরুত্তর
এই দেখ্, তোর দেওয়া সেই শাঁখাজোড়া পরে এসেছি-- আজকের দিনে তুই আমার উপর রাগ করিস নে।
রামমোহন।
আমাকে আর দগ্ধ কোরো না। মিথ্যে দিয়ে তোমার কাছে আর চাপা দিতে পারলুম না। মা জননি, এ রাজ্যের লক্ষ্মী তুমি, কিন্তু এ রাজ্যে তোমার আজ আর স্থান নেই। চলো মা, তুমি ফিরে চলো-- তোমার এই পাদপদ্মের দাস, এই অধম সন্তান তোমার সঙ্গে যাবে।
বিভা।
মোহন, যা তোর বলবার আছে সব তুই বল্। আমি যে কত দুঃখ সইতে পারি তা কি তুই জানিস নে?
রামমোহন।
সন্তান যখন ডাকতে গেল তখন কেন এলি নে-- তখন কেন এলি নে-- আমার পোড়া কপাল, তোকে কেন আনতে পারলুম না।
বিভা।
ওরে মোহন, জগতে এমন কোনো সুখ নেই যার লোভে আমি সেদিন দাদাকে ফেলে আসতে পারতুম-- এতে আমার কপালে যা থাকে তাই হবে।
রামমোহন।
তবে শোন্ মা, সেই ময়ূরপংখি তোর জন্যে নয়।
বিভা।
নাই হল মোহন, দুঃখ কিসের। আমি হেঁটে চলে যাব।
রামমোহন।
যাবি কোথায়। সেখানে যে আজ আর-এক রানী আসছে।
বিভা।
আর-এক রানী!
রামমোহন।
হাঁ, আর-এক রানী। আজ মহারাজের বিবাহ।
বিভা।
ওঃ-- আজ বিবাহের লগ্ন!
রামমোহন।
এক বিবাহের লগ্নে মহারাজ তোমাদের ঘরে গিয়েছিলেন-- আজ কোন্ বিবাহের লগ্নে তুমি তাঁর ঘরের সামনে এসে পৌঁছলে। আর, আমার এমন কপাল আজ আমি বেঁচে আছি। চল্ মা, ফিরে চল্, আর এক দণ্ড নয়-- ওই বাঁশি আমার কানে বিষ ঢালছে। ওরে, আর-একদিন কী বাঁশি শুনেছিলুম, সেই কথা মনে পড়ছে। চল্ চল্, ফিরে চল্। অমন চুপ করে বসে রইলে কেন মা? কেমন করে যে কাঁদতে হয় তাও কি একেবারে ভুলে গেছ।
বিভা।
মোহন, আমার একটি কথা রাখতে হবে।
রামমোহন।
কী কথা।
বিভা।
আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। যদি না যাস আমি একলা যাব।
রামমোহন।
সে আজ ময়ূরপংখিতে চড়বে, আর তুমি আজ হেঁটে যাবে?
বিভা।
হেঁটে যাওয়াই আমাকে সাজে-- আমি হেঁটেই যাব। তুই সঙ্গে যাবি নে?
রামমোহন।
আমি সঙ্গে যাব না, তো কে যাবে। কিন্তু মা, সে সভায় আজ তুমি কিসের জন্যে যাবে।
বিভা।
তা বটে, কেন যাব। মোহন, আমাকে দুঃখ সইতে হবে সে কথাটা হঠাৎ আমি ভুলে গিয়েছিলুম-- ভেবেছিলুম, যা ভোগ হবার তা বুঝি হয়ে চুকে গেছে।
রামমোহন।
কেন মা, তুমি সতীলক্ষ্মী, তুমি দুঃখ কেন পাও।
বিভা।
মোহন, সেদিন অপরাধ যে সত্যি হয়েছিল। সে অপরাধের শাস্তি না হয়ে তো মিটবে না, সে শাস্তি আমিই নিলুম-- প্রায়শ্চিত্ত আমাকে দিয়েই হবে।
রামমোহন।
মা, তোমার পিতার হাতের আঘাত সেও তুমিই মাথায় করে নিয়েছ, আবার তোমার স্বামীর হাতের আঘাত সেও তুমিই নিলে। কিন্তু আমি বলছি মা, সকলের চেয়ে বড়ো দণ্ড পেলে তোমার স্বামী। সে আজ দ্বারের কাছ থেকেও তোমাকে হারালো।
উদয়াদিত্যের প্রবেশ
উদয়াদিত্যের প্রবেশ
উদয়।
ওরে বিভা!
বিভা।
দাদা, সব জানি। কিছু ভেবো না।
উদয়।
এখন কী করবি বোন।
বিভা।
ভেবেছিলুম রাজবাড়িতে একবার যাব, কিন্তু যাব না।
রামমোহন।
মা, যেয়ো না, যেয়ো না। গেলে তোমার অপমান হত-- সেই অপমানে তোমার স্বামীর পাপ আরো বাড়ত।
বিভা।
আমার মান-অপমান সব চুকে গেছে। কিন্তু দাদার অপমান হত যে। দাদা, এবার নৌকা ফেরাও।
উদয়।
তুই কোথায় যাবি বিভা।
বিভা।
তোমার সঙ্গে কাশী যাব। আমি আজ মুক্তি পেয়েছি। এখন তোমার চরণসেবা করে আমার জীবন আনন্দে কাটবে। মোহন, তুই তোর প্রভুর কাছে ফিরে যা।
রামমোহন।
ওই দেখো মা, ফেরবার পথে আগুন লেগেছে, ওই-যে ময়ূরপংখি চলেছে। ও পথ আমার পথ নয়।
ধনঞ্জয়ের প্রবেশ
ধনঞ্জয়ের প্রবেশ
বিভা।
বৈরাগী ঠাকুর!
ধনঞ্জয়।
কেন দিদি।
বিভা।
আমাকে তোমাদের সঙ্গ দিয়ো ঠাকুর।
উদয়।
ঠাকুর, শেষকালে বিভাকেও আমাদের পথ নিতে হল!
ধনঞ্জয়।
সে তো বেশ কথা। দয়াময় হরি! কী আনন্দ, তোমার এ কী আনন্দ! ছাড় না, কিছুতেই ছাড় না। শ্বশুরবাড়ির রাস্তার ধারেও ডাকাতের মত বসে আছে। দিদি, এই মাঝরাস্তায় আমাদের পাগল প্রভুর তলব পড়েছে। একেবারে জোর তলব। চল্ চল্। চল্ চল্। পা ফেলে চল্। খুশি হয়ে চল্। হাসতে হাসতে চল্। রাস্তা এমন করে পরিষ্কার করে দিয়েছে-- আর ভয় কিসের।
গীত
আমি ফিরব না রে, ফিরব না আর ফিরব না রে--
এখন হাওয়ার মুখে ভাসল তরী,
কূলে ভিড়ব না আর ভিড়ব না রে।
ছড়িয়ে গেছে সুতো ছিঁড়ে,
তাই খুঁটে আজ মরব কি রে।
এখন ভাঙা ঘরের কুড়িয়ে খুঁটি
বেড়া ঘিরব না আর ঘিরব না রে।
ঘাটের রশি গেছে কেটে,
কাঁদব কি তাই বক্ষ ফেটে?
এখন পালের রশি ধরব কসি,
এ রশি ছিঁড়ব না আর ছিঁড়ব না রে।