নৃত্যসভা

রামচন্দ্র। নটনটীর দল

নৃত্যসভা

রামচন্দ্র। নটনটীর দল

রামমোহনের প্রবেশ

রামমোহনের প্রবেশ

রামমোহন।

একবার উঠে আসুন।

রামচন্দ্র।

এখন না, যাঃ, বিরক্ত করিস নে। গান ছেড়ো না।

রামমোহন।

শুনতেই হবে।

রামচন্দ্র।

কাল সকালে শুনব। দেখ্‌, বিরক্ত করিস নে।

রামমোহন।

যুবরাজ ডাকছেন, জরুরি কাজ আছে।

রামচন্দ্র।

বুঝেছি, শালা বুঝি ঠাট্টার জবাব দিতে চায়! পারবে না আমার সঙ্গে।

রামমোহন।

ঠাট্টা শেষ হয়ে গেছে,এখন বিপদের পালা। শীঘ্র এসো।

রামচন্দ্র।

আর ভয় দেখাতে হবে না, এখন আর সময় নেই।

রামমোহন।

এ দিকেও সময় একটুও নেই। আচ্ছা, এই দিকে আসুন, বলছি। (রামচন্দ্রকে জনান্তিকে) প্রতাপাদিত্য মহারাজ সব কথা শুনেছেন।

রামচন্দ্র।

না শুনলে মজাটা কী।

রামমোহন।

কী বলেন মহারাজ, মজা! তিনি আপনার শ্বশুর, আপনার ঠাট্টার সম্পর্ক তো নন।

রামচন্দ্র।

আমার ঠাট্টা চলছে শালাদের নিয়ে। তিনি সেটা যদি গায়ে মাখেন সেটা কি আমার দোষ?

রামমোহন।

সে বিচার এখন নয়। আপাতত প্রাণদণ্ডের হুকুম হয়েছে, কাল সকালেই-

রামচন্দ্র।

তুমি শুনলে কোথা থেকে?

রামমোহন।

যুবরাজের নিজের মুখ থেকে।

রামচন্দ্র।

তোর মতো বোকা দুনিয়ায় নেই রে। যুবরাজ ঠাট্টা করেছে বুঝতে পারিস নে! প্রাণদণ্ড!

রামমোহন।

দোহাই তোমার, একটুও ঠাট্টা নয়।

রামচন্দ্র।

আমাকে ঠাট্টায় ওরা হারাতে পারবে না। তুই এখন যা।

রামমোহন।

আচ্ছা,আমি যুবরাজকে ডেকে আনছি।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

রামচন্দ্র।

(নটীদের প্রতি) ধরো গান।-

নটীদের নাচ ও গান

আমার নয়ন তোমার নয়নতলে

মনের কথা খোঁজে।

সেথায় কালো ছায়ার মায়ার ঘোরে

পথ হারালো ও যে।

নীরব দিঠে শুধায় যত

পায় না সাড়া মনের মতো,

অবুঝ হয়ে রয় সে চেয়ে

অশ্রুধারায় মজে।

তুমি আমার কথার আভাখানি

পেয়েছ কি মনে।

এই-যে আমি মালা আনি

তার বাণী কেউ শোনে?

পথ দিয়ে যাই, যেতে যেতে

হাওয়ায় ব্যথা দিই যে পেতে;

বাঁশি বিছায় বিষাদ-ছায়া

তার ভাষা কেউ বোঝে?

রামচন্দ্র।

বেটা রামমোহন আমার মনটা মিছিমিছি খারাপ করে দিয়ে গেল। এ কেমন গোঁয়ার-গোছের ঠাট্টা এ বাড়ির? শ্যালাদের রসের জ্ঞান একটুও নেই। থেমো না, আর-একটা গান ধরো। একটু দ্রুততালে।

নটীদের গান

না ব'লে যেয়ো না চলে মিনতি করি

গোপনে জীবন মন লইয়া হরি।

সারা নিশি জেগে থাকি

ঘুমে ঢ'লে পড়ে আঁখি,

ঘুমালে হারাই পাছে সে ভয়ে মরি।

চকিত চমকি বঁধু তোমারে খুঁজি,

থেকে থেকে মনে হয় স্বপন বুঝি।

নিশিদিন চাহে হিয়া

পরান পসারি দিয়া

অধীর চরণ তব বাঁধিয়া ধরি।

(রামচন্দ্র মাঝে মাঝে বাহবা দিতেছেন, মাঝে মাঝে উৎকণ্ঠিতভাবে দ্বারের দিকে চাহিতেছেন।)

উদয়াদিত্যের প্রবেশ

উদয়।

উঠে এস শীঘ্র।

রামচন্দ্র।

একেবারে জোর তলব যে।

উদয়।

দেরি কোরো না, এসো শিগগির।

রামচন্দ্র।

বোনের পেয়াদা হয়ে এসেছ বুঝি, তলব দিতে?

উদয়।

আমার কর্তব্য আমি করলুম। যদি না শোন তো থাকো। বিধাতা যাকে মারেন, তাকে কেউ বাঁচাতে পারে না।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

রামচন্দ্র।

আওয়াজটা ঠাট্টার মতো শোনাচ্ছে না। একবার দেখেই আসি গে। (নটীদের প্রতি) তোমরা গান থামিয়ো না- এখনও রাত আছে বাকি। আমি এখনই আসছি।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

নটীদের গান

নটীদের গান

ফুল তুলিতে ভুল করেছি

প্রেমের সাধনে।

বঁধু তোমায় বাঁধব কিসে

মধুর বাঁধনে।

ভোলাব না মায়ার ছলে,

রইব তোমার চরণতলে,

মোহের ছায়া ফেলব না মোর

হাসি-কাঁদনে।

রইল শুধু বেদন-ভরা আশা,

রইল শুধু প্রাণের নীরব ভাষা।

নিরাভরণ যদি থাকি

চোখের কোণে চাইবে না কি,

যদি আঁখি নাই বা ভোলাই

রঙের ধাঁদনে।

প্রথমা নটী।

কই, এখনও তো ফিরলেন না।

দ্বিতীয়া নটী।

আর তো ভাই পারি নে। ঘুম পেয়ে আসছে।

তৃতীয়া নটী।

ফের কি সভা জমবে নাকি!

প্রথমা নটী।

কেউ যে জেগে আছে তা তো বোধ হচ্ছে না। এতবড়ো রাজবাড়ি সমস্ত যেন হাঁ হাঁ করছে।

দ্বিতীয়া নটী।

চাকররাও সব হঠাৎ কে কোথায় যেন চলে গেল।

তৃতীয়া নটী।

বাতিগুলো নিবে আসছে, কেউ জ্বালিয়ে দেবে না?

প্রথমা নটী।

আমার কেমন ভয় করছে ভাই।

দ্বিতীয়া নটী।

(বাদকদিগকে দেখাইয়া দিয়া) ওরাও যে সব ঘুমোতে লাগল-- কী মুশকিলেই পড়া গেল। ওদের তুলে দে-না। কেমন গা ছম্‌ ছম্‌ করছে।

তৃতীয়া নটী।

মিছে না ভাই। একটা গান ধরো। ওগো, তোমরা ওঠো, ওঠো।

বাদকগণ।

(ধড়্‌ফড়্‌ করিয়া উঠিয়া) অ্যাঁ অ্যাঁ, এসেছেন নাকি?

প্রথমা নটী।

তোমরা একবার বেরিয়ে গিয়ে দেখো না গো। কেউ কোথাও নেই। আমাদের আজকে বিদায় দেবে না নাকি?

একজন বাদক।

(বাহিরে গিয়া ফিরিয়া আসিয়া) ও দিকে যে সব বন্ধ।

প্রথমা নটী।

অ্যাঁ! বন্ধ! আমাদের কি কয়েদ করলে নাকি?

দ্বিতীয়া নটী।

দূর। কয়েদ করতে যাবে কেন?

প্রথমা নটী।

ভালো লাগছে না। কী হল বুঝতে পারছি নে। চলো ভাই, আর এখানে নয়। একটা কী কাণ্ড হচ্ছে।

[প্রস্থান

[প্রস্থান

রাজমহিষীর প্রবেশ

রাজমহিষীর প্রবেশ

রাজমহিষী।

কই এদের মহলেও তো মোহনকে দেখতে পাচ্ছি নে। কী হল বুঝতে পারছি নে। বামী!

বামীর প্রবেশ

এ দিক্‌কার খাওয়াদাওয়া তো সব শেষ হল, মোহনকে খুঁজে পাচ্ছি নে কেন।

বামী।

মা, তুমি অত ভাবছ কেন। তুমি শুতে যাও, রাত যে পুইয়ে এল, তোমার শরীরে সইবে কেন।

রাজমহিষী।

সে কি হয়। আমি যে তাকে নিজে বসিয়ে খাওয়াব বলে রেখেছি।

বামী।

নিশ্চয় রাজকুমারী তাকে খাইয়েছেন। তুমি চলো, শুতে চলো।

রাজমহিষী।

আমি ওই মহলে খোঁজ করতে যাচ্ছিলুম, দেখি সব দরজা বন্ধ- এর মানে কী, কিছুই বুঝতে পারছি নে।

বামী।

বাড়ীতে গোলমাল দেখে রাজকুমারী তাঁর মহলে দরজা বন্ধ করেছেন। অনেক দিন পরে জামাই এসেছেন, আজ লোকজনের ভিড় সইবে কেন। চলো, তুমি শুতে চলো।

রাজমহিষী।

কী জানি বামী, আজ ভালো লাগছে না। প্রহরীদের ডাক্‌তে বললুম, তাদের কারো কোনো সাড়াই পাওয়া গেল না।

বামী।

যাত্রা হচ্ছে, তারা তাই আমোদ করতে গেছে।

রাজমহিষী।

মহারাজ জানতে পারলে যে তাদের আমোদ বেরিয়ে যাবে। উদয়ের মহলও যে বন্ধ, তারা ঘুমিয়েছে বুঝি!

বামী।

ঘুমোবেন না! বল কী। রাত কি কম হয়েছে।

রাজমহিষী।

গান-বাজনা ছিল, জামাইকে নিয়ে একটু আমোদ-আহ্লাদ করবে না? ওরা মনে কি ভাববে বলো তো। এ-সমস্তই ওই বউমার কাণ্ড। একটু বিবেচনা নেই। রোজই তো ঘুমোচ্ছে-একটা দিন কি আর-

বামী।

যাক্‌, সে-সব কথা কাল হবে-আজ চলো।

রাজমহিষী।

মঙ্গলার সঙ্গে তোর দেখা হয়েছে তো?

বামী।

হয়েছে বৈকি।

রাজমহিষী।

ওষুধের কথা বলেছিস?

বামী।

সে-সব ঠিক হয়ে গেছে।

[ উভয়ের প্রস্থান

[ উভয়ের প্রস্থান

প্রতাপাদিত্য প্রহরী পীতাম্বর ও অনুচরের প্রবেশ

প্রতাপাদিত্য প্রহরী পীতাম্বর ও অনুচরের প্রবেশ

প্রতাপ।

কত রাত আছে?

পীতাম্বর।

এখনও চার দণ্ড রাত আছে।

প্রতাপ।

কী যেন একটা গোলমাল শুনলুম।

পীতাম্বর।

আজ্ঞে হাঁ,তাই শুনেই আমি আসছি।

প্রতাপ।

কী হয়েছে?

পীতাম্বর।

আসবার সময় দেখলুম বাইরের প্রহরীরা দ্বারে নেই।

প্রতাপ।

অন্তঃপুরের প্রহরীরা?

পীতাম্বর।

হাত-পা-বাঁধা পড়ে আছে।

প্রতাপ।

তারা কী বললে?

পীতাম্বর।

আমার কথার কোনো জবাব দিলে না-হয়তো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।

প্রতাপ।

রামচন্দ্র রায় কোথায়? উদয়াদিত্য বসন্তরায় কোথায়?

পীতাম্বর।

বোধ করি তাঁরা অন্তঃপুরেই আছেন।

প্রতাপ।

বোধ করি! তোমার বোধ-করার কথা কে জিজ্ঞাসা করছে। মন্ত্রীকে ডাকো।

[ পীতাম্বরের প্রস্থান

[ পীতাম্বরের প্রস্থান

মন্ত্রীর প্রবেশ

মন্ত্রীর প্রবেশ

মন্ত্রী।

মহারাজ, রাজজামাতা-

প্রতাপ।

রামচন্দ্ররায়-

মন্ত্রী।

হাঁ, তিনি রাজপুরী পরিত্যাগ করে গেছেন।

প্রতাপ।

পরিত্যাগ করে গেছেন, প্রহরীরা গেল কোথা?

মন্ত্রী।

বহির্‌দ্বারের প্রহরীরা পালিয়ে গেছে।

প্রতাপ।

(মুষ্টি বদ্ধ করিয়া) পালিয়ে গেছে? পালাবে কোথায়? যেখানে থাকে তাদের খুঁজে আনতে হবে। অন্তঃপুরের পাহারায় কে কে ছিল?

মন্ত্রী।

সীতারাম আর ভাগবত।

প্রতাপ।

ভাগবত ছিল? সে তো হুঁশিয়ার; সেও কি উদয়ের সঙ্গে যোগ দিলে?

মন্ত্রী।

সে হাত-পা-বাঁধা পড়ে আছে।

প্রতাপ।

হাত-পা-বাঁধা আমি বিশ্বাস করি নে। হাত-পা ইচ্ছে করে বাঁধিয়েছে।

আচ্ছা, সীতারামকে নিয়ে এস,সেই গর্দভের কাছ থেকে কথা বের করা শক্ত হবে না।

মন্ত্রীর প্রস্থান

মন্ত্রীর প্রস্থান

ও সীতারামকে লইয়া পুনঃপ্রবেশ

ও সীতারামকে লইয়া পুনঃপ্রবেশ

প্রতাপ।

অন্তঃপুরের দ্বার খোলা হল কী করে।

সীতারাম।

(করজোড়ে) দোহাই মহারাজ,আমার কোনো দোষ নেই।

প্রতাপ।

সে কথা তোকে কে জিজ্ঞাসা করছে।

সীতারাম।

আজ্ঞা না, মহারাজ--যুবরাজ--যুবরাজ আমাকে বলপূর্বক বেঁধে--

ব্যস্তভাবে বসন্তরায়ের প্রবেশ

সীতারাম।

যুবরাজকে নিষেধ করলুম, তিনি--

বসন্ত।

হাঁ হাঁ, সীতারাম কী বললি? অধর্ম করিস নে সীতারাম, উদয়াদিত্যের এতে কোনো দোষ নেই।

সীতারাম।

আজ্ঞা না, যুবরাজের কোনো দোষ নেই।

প্রতাপ।

তবে কার দোষ!

সীতারাম।

আজ্ঞে না।

প্রতাপ।

তবে কার দোষ?

সীতারাম।

আজ্ঞা যুবরাজ-

প্রতাপ।

তাঁর সঙ্গে আর কে ছিল?

সীতারাম।

আজ্ঞে,বউরানীমা-

প্রতাপ।

বউরানী? ওই সেই শ্রীপুরের- (বসন্তরায়ের দিকে চাহিয়া) উদয়াদিত্যের এ অপরাধের মার্জনা নেই।

বসন্ত।

বাবা প্রতাপ, এতে উদয়ের কোনো দোষ ছিল না।

প্রতাপ।

দোষ ছিল না! দেখো, তুমি তার পক্ষ নিয়ে যদি কথা কও তাতে তার ভালো হবে না--এই আমি বলে দিলুম।

[বসন্তরায় কিয়ৎকাল চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধারে উঠিয়া প্রস্থান

[বসন্তরায় কিয়ৎকাল চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধারে উঠিয়া প্রস্থান
1 | 2 | 3 | 4