খাম্বাজ

খাম্বাজ

বাল্মীকি।

ব্যাকুল হয়ে বনে বনে

ভ্রমি একেলা শূন্য মনে!

কে পুরাবে মোর শূন্য এ হিয়া,

জুড়াবে প্রাণ সুধাবরিষণে!

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

দস্যুগণের প্রবেশ

দস্যুগণের প্রবেশ

নটনারায়ণ

নটনারায়ণ

দস্যুগণ।

আর না, আর না, এখানে আর না--

আয় রে সকলে চলিয়া যাই!

ধনুক বাণ ফেলেছে রাজা,

এখানে কেমনে থাকিব ভাই!

চল চল চল এখনি যাই!

বাল্মীকির প্রবেশ

বাল্মীকির প্রবেশ

দস্যুগণ।

তোর দশা, রাজা, ভাল ত নয়,

রক্তপাতে পাস্‌ রে ভয়--

লাজে মোরা ম'রে যাই!

পাখীটি মারিলে কাঁদিয়া খুন,

না জানি কে তোরে করিল গুণ--

হেন কভু দেখি নাই!

[ দস্যুগণের প্রস্থান

[ দস্যুগণের প্রস্থান

হাম্বির

হাম্বির

বাল্মীকি।

জীবনের কিছু হল না, হায়!

হল না গো হল না হায়, হায়!

গহনে গহনে কত আর ভ্রমিব নিরাশার এ আঁধারে?

শূন্য হৃদয় আর বহিতে যে পারি না,

পারি না গো পারি না আর।

কি ল'য়ে এখন ধরিব জীবন-- দিবস রজনী চলিয়া যায়--

দিবস রজনী চলিয়া যায়--

কত কি করিব বলি কত উঠে বাসনা,

কি করিব জানি না গো!

সহচর ছিল যারা ত্যেজিয়া গেল তার-- ধনুর্ব্বাণ ত্যেজেছি--

কোন আর নাহি কাজ!

কি করি কি করি বলি হাহা করি ভ্রমি গো,

কি করিব জানি না যে!

[ ব্যাধগণের প্রবেশ ও একটি ক্রৌঞ্চমিথুনের প্রতি লক্ষ ]

[ ব্যাধগণের প্রবেশ ও একটি ক্রৌঞ্চমিথুনের প্রতি লক্ষ ]

সিন্ধু ভৈরবী

সিন্ধু ভৈরবী

বাল্মীকি।

থাম্‌ থাম্‌! কি করিবি বধি পাখীটির প্রাণ!

দুটিতে রয়েছে সুখে, মনের উলাসে গাহিতেছে গান!

প্রথম ব্যাধ।

রাখ' মিছে ওসব কথা, কাছে মোদের এস নাক হেথা,

চাই নে ওসব শাস্তর-কথা, সময় ব'হে যায় যে ।

বাল্মীকি।

শোন শোন মিছে রোষ কোরো না!

ব্যাধ।

থাম থাম ঠাকুর, এই ছাড়ি বাণ!

[ একটি ক্রৌঞ্চকে বধ ]

[ একটি ক্রৌঞ্চকে বধ ]

বাল্মীকি।

মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ

যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্‌।

বাহার

কি বলিনু আমি!-- একি সুললিত বাণী রে!

কিছু না জানি কেমনে যে আমি প্রকাশিনু দেবভাষা--

এমন কথা কেমনে শিখিনু রে!

পুলকে পূরিল মনপ্রাণ, মধু বরষিল শ্রবণে,

একি!-- হৃদয়ে একি এ দেখি!--

ঘোর অন্ধকার-মাঝে একি জ্যোতি রে!

অবাক্‌!-- করুণা এ কার?

[ সরস্বতীর আবির্ভাব ]

[ সরস্বতীর আবির্ভাব ]

ভূপালি

ভূপালি

বাল্মীকি।

একি এ, একি এ, স্থিরচপলা!

কিরণে কিরণে হল সব দিক উজলা।

কি প্রতিমা দেখি এ,

জোছনা মাখিয়ে

কে রেখেছে আঁকিয়ে

আ মরি কমলপুতলা!

[ দেবীর অন্তর্ধান ]

[ দেবীর অন্তর্ধান ]

[ ব্যাধগণের প্রস্থান

[ ব্যাধগণের প্রস্থান

টোড়ী

টোড়ী

বাল্মীকি।

কোথা লুকাইলে?

সব আশা নিভিল, দশদিশি অন্ধকার!

সব গেছে চ'লে ত্যেজিয়ে আমারে,

তুমিও কি তেয়াগিলে?

[ লক্ষ্মীর আবির্ভাব ]

[ লক্ষ্মীর আবির্ভাব ]

সিন্ধু

সিন্ধু

লক্ষ্মী।

কেন গো আপনমনে ভ্রমিছে বনে বনে, সলিল দুনয়নে

কিসের দুখে?

কমলা দিতেছে আসি রতন রাশি রাশি, ফুটুক্‌ তবে হাসি

মলিন মুখে।

কমলা যারে চায় বল সে কি না পায়, দুখের এ ধরায়

থাকে সে সুখে।

ত্যজিয়া কমলাসনে এসেছি ঘোর বনে, আমারে শুভক্ষণে

হের গো চোখে।

টোড়ী

টোড়ী

বাল্মীকি।

আমার কোথায় সে উষাময়ী প্রতিমা!

তুমি ত নহ সে দেবী, কমলাসনা,

কোরো না আমারে ছলনা!

এনেছ কি ধন মান? তাহা যে চাহে না প্রাণ--

দেবি গো, চাহি না, চাহি না, মণিময় ধূলিরাশি চাহি না--

তাহা ল'য়ে সুখী যারা হয় হোক্‌, হয় হোক্‌--

আমি, দেবি, সে সুখ চাহি না।

যাও লক্ষ্মী অলকায়, যাও লক্ষ্মী অমরায়,

এ বনে এস না, এস না, এস না এ দীনজনকুটীরে!

যে বীণা শুনেছি কানে, মনপ্রাণ আছে ভোর--

আর কিছু চাহি না,চাহি না!

[ লক্ষ্মীর অন্তর্ধান ও সরস্বতীর পুনরাবির্ভাব ]

[ লক্ষ্মীর অন্তর্ধান ও সরস্বতীর পুনরাবির্ভাব ]

বাহার

বাহার

বাল্মীকি।

এই যে হেরি গো দেবী আমারি!

এবে কবিতাময় জগত চরাচর,

সব শোভাময় নেহারি।

ছন্দে উঠিছে চন্দ্রমা, ছন্দে কনকরবি উদিছে,

ছন্দে জগমণ্ডল চলিছে,

জ্বলন্ত কবিতা তারকা সবে--

এ কবিতার মাঝে তুমি কে গো দেবি

আলোকে আলো আঁধারি!

আজি মলয় আকুল বনে বনে একি এ গীত গাহিছে,

ফুল কহিছে প্রাণের কাহিনী,

নব রাগ রাগিনী উছাসিছে--

এ আনন্দে আজ গীত গাহে মোর হৃদয় সব অবারি!

তুমিই কি দেবী ভারতী কৃপাগুণে অন্ধ আঁখি ফুটালে,

উষা আনিলে প্রাণের আঁধারে,

প্রকৃতির রাগিনী শিখাইলে?

তুমি ধন্য গো,

রব' চিরকাল চরণ ধরি তোমারি।

গৌড় মল্লার

হৃদয়ে রাখ, গো দেবি, চরণ তোমার।

এস, মা করুণারাণী, ও বিধু-বদনখানি

হেরি হেরি আঁখি ভরি হেরিব আবার।

এস আদরিণী বাণী সমুখে আমার।

মৃদু মৃদু হাসি হাসি বিলাও অমৃতরাশি--

আলোয় করেছ আলো, স্নেহের প্রতিমা,

তুমি গো লাবণ্যলতা, মূর্ত্তি মধুরিমা।

বসন্তের বনমালা, অতুল রূপের ডালা,

মায়ার মোহিনী মেয়ে ভাবের আধার,

ঘুচাও মনের মোর সকল আঁধার।

অদর্শন হ'লে তুমি ত্যেজি লোকালয়ভূমি

অভাগা বেড়াবে কেঁদে নিবিড় গহনে--

হেরে মোরে তরুলতা বিষাদে কবে না কথা

বিষণ কুসুমকুল বনফুল-বনে।

"হা দেবী' "হা দেবী' বলি গুঞ্জরি কাঁদিবে অলি,

ঝরিবে ফুলের চোখে শিশির-আসার--

হেরিব জগত শুধু আঁধার! আধার!

সরস্বতী।

দীনহীন বালিকার সাজে,

আইনু এ ঘোর বনমাঝে,

গলাতে পাষাণ তোর মন,

কেন, বৎস, শোন্‌ তাহা, শোন্‌!

আমি বীণাপাণি, তোরে এসেছি শিখাতে গান।

তোর গানে গ'লে যাবে সহস্র পাষাণপ্রাণ।

যে রাগিণী শুনে তোর গ'লেছে কঠোর মন,

সে রাগিণী তোরি কণ্ঠে বাজিবে রে অনুক্ষণ।

অধীর হইয়া সিন্ধু কাঁদিবে চরণতলে,

চারি দিকে দিক্‌বধূ আকুল নয়নজলে।

মাথার উপরে তার কাঁদিবে সহস্র তারা,

অশনি গলিয়া গিয়া হইবে অশ্রুর ধারা।

যে করুণ রসে আজি ডুবিল রে ও হৃদয়,

শতস্রোতে তুই তাহা ঢালিবি জগতময়।

যেথায় হিমাদ্রি আছে সেথা তোর নাম র'বে,

যেথায় জাহ্নবী বহে তোর কাব্যস্রোত ব'রে!

সে জাহ্নবী বহিবেক অযুত হৃদয় দিয়া,

শ্মশান পবিত্র করি মরুভূমি উর্ব্বরিয়া।

শুনিতে শুনিতে, বৎস, তোর সে অমর গীত'

জগতের শেষ দিনে রবি হবে অস্তমিত'।

যত দিন আছে শশী, যত দিন আছে রবি,

তুই বাজাইবি বীণা তুই আদি মহাকবি!

মোর পদ্মাসনতলে রহিবে আসন তোর,

নিত্য নব নব গীতে সতত রহিবি ভোর।

বসি তোর পদতলে কবিবালকেরা যত

শুনি তোর কণ্ঠস্বর শিখিবে সঙ্গীত কত!

এই নে আমার বীণা দিনু তোরে উপহার

যে গান গাহিতে সাধ ধ্বনিবে ইহার তার!
1 | 2 | 3 | 4