বাঁশরিদের বাড়ি। সতীশ ডেস্কে বসে লিখছে
সুষমার ছোটো বোন সুষীমার প্রবেশ
সুষমার ছোটো বোন সুষীমার প্রবেশ
সতীশ।
আমার সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ পাকা করতে এসেছিস? বরের মুখ-দেখা বুঝি আজ?
সুষীমা।
যাও!
সতীশ।
যাও কী। বেশিদিনের কথা নয়, তোর বয়স যখন পাঁচ, মাকে জিজ্ঞাসা করিস, আমাকে বিয়ে করতে তোর কী জেদ ছিল। আমি তোকে সোনার বালা গড়িয়ে দিয়েছিলুম, সেটা ভেঙে ব্রোচ তৈরি হয়েছে।
সুষীমা।
সতীশদা, কী বকছ তুমি।
সতীশ।
আচ্ছা, থাক্ তবে, কী জন্যে এসেছিস।
সুষীমা।
দিদির বিয়েতে প্রেজেণ্ট্ দেব।
সতীশ।
সে তো ভালো কথা। কী দিতে চাস।
সুষীমা।
এই চামড়ার থলিটা।
সতীশ।
ভালো জিনিস, আমারই লোভ হচ্ছে।
সুষীমা।
আমি এসেছি বাঁশিদিদির কাছে।
সতীশ।
ওখান থেকে কেউ তোকে পাঠিয়ে দিয়েছে?
সুষীমা।
না, লুকিয়ে এসেছি, কেউ জানে না। আমার এই থলির উপরে বাঁশিদিদিকে দিয়ে আঁকিয়ে নেব।
সতীশ।
বাঁশিদিদি আঁকতে পারে কে বললে তোকে।
সুষীমা।
শংকরদাদা। তাঁর কাছে একটা সিগারেট-কেস আছে সেটা বাঁশিদিদির দেওয়া। তার উপরে একজোড়া পায়রা এঁকেছেন নিজের হাতে। চমৎকার!
সতীশ।
আচ্ছা, তোর বাঁশিদিদিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
[ প্রস্থান
[ প্রস্থান
বাঁশরির প্রবেশ
বাঁশরির প্রবেশ
বাঁশরি।
কী সুষী!
সুষীমা।
তোমাকে সতীশদাদা সব বলেছেন?
বাঁশরি।
হাঁ বলেছেন। ছবি এঁকে দেব তোর থলির উপর? কী ছবি আঁকব।
সুষীমা।
একজোড়া পায়রা, ঠিক যেমন এঁকেছ শংকরদাদার সিগারেট কেসের উপরে।
বাঁশরি।
ঠিক তেমনি করেই দেব। কিন্তু কাউকে বলিস নে যে আমি এঁকে দিয়েছি।
সুষীমা।
কাউকে না।
বাঁশরি।
তোকেও একটা কাজ করতে হবে, নইলে আমি আঁকব না।
সুষীমা।
বলো কী করতে হবে।
বাঁশরি।
সেই সিগারেট-কেসটা আমাকে এনে দিতে হবে।
সুষীমা।
তাঁর বুকের পকেটে থাকে। কক্খনো আমাকে দেবেন না।
বাঁশরি।
আমার নাম করে বলিস দিতেই হবে।
সুষীমা।
তুমি তাঁকে দিয়েছ আবার ফিরিয়ে নেবে কী করে।
বাঁশরি।
তোমার শংকরদাদাও দেওয়া জিনিস ফিরিয়ে নেন।
সুষীমা।
কক্খনো না।
বাঁশরি।
আচ্ছা, তাঁকে জিজ্ঞাসা করিস আমার নাম ক’রে।
সুষীমা।
আচ্ছা করব। আমি যাই, কিন্তু ভুলো না আমার কথা।
বাঁশরি।
তুইও ভুলিস না আমার কথা, আর নিয়ে যা এক বাক্স চকোলেট,কাউকে বলিস নে আমি দিয়েছি।
সুষীমা।
কেন।
বাঁশরি।
মা জানতে পারলে রাগ করবেন।
সুষীমা।
কেন।
বাঁশরি।
যদি তোর অসুখ করে।
সুষীমা।
বলব না, কিন্তু খেতে দেব শংকরদাদাকেও।
[ সুষীমার প্রস্থান
[ সুষীমার প্রস্থান
একখানা খাতা হাতে নিয়ে বাঁশরি সোফায় হেলান দিয়ে বসল
একখানা খাতা হাতে নিয়ে বাঁশরি সোফায় হেলান দিয়ে বসল
লীলার প্রবেশ
লীলার প্রবেশ
বাঁশরি।
দেখ্ লীলা, মুখ গম্ভীর করে আসিস নে ভাই, তা হলে ঝগড়া হয়ে যাবে। মনে হচ্ছে সান্ত্বনা দেবার কুমতলব আছে, বাদল নামল বলে। দুঃখ আমার সয়, সান্ত্বনা আমার সয় না, সে তোদের জানা। বসেছিলাম গ্রামোফোনে কমিক গান বাজাতে কিন্তু তার চেয়ে কমিক জিনিস নিয়ে পড়েছি।
লীলা।
কী বলো তো বাঁশি।
বাঁশরি।
ক্ষিতীশের এই গল্পখানা।
লীলা।
(খাতাটা তুলে নিয়ে) ‘ভালোবাসার নিলাম’–নামটা চলবে বাজারে।
বাঁশরি।
বস্তুটাও। এ জিনিসের কাটতি আছে। পড়তে চাস?
লীলা।
না ভাই, সময় নেই, বিয়েবাড়ি সাজাবার জন্যে ডাক পড়েছে।
বাঁশরি।
আমি কি সাজাতে পারতুম না!
লীলা।
আমার চেয়ে অনেক ভালো পারতিস।
বাঁশরি।
ডাকতে সাহস হল না! ভীরু ওরা।
লীলা।
তা নয়, লজ্জা হল, কী বলে তোকে ডাকবে।
বাঁশরি।
না ডেকেই লজ্জা দিলে আমাকে। ভাবছে আমি অন্নজল ছেড়ে ঘরে দরজা দিয়ে কেঁদে মরছি। ওদের সঙ্গে যখন তোর দেখা হবে কথাপ্রসঙ্গে বলিস, ‘বাঁশি বিছানায় শুয়ে কমিক গল্প পড়ছিল, পেট ফেটে যাচ্ছিল হেসে হেসে।’ নিশ্চয় বলিস।
লীলা।
নিশ্চয় বলব, গল্পের বিষয়টা কী বল্ দেখি।
বাঁশরি।
হিরোর নাম স্যার চন্দ্রশেখর। নায়িকা পঙ্কজা, ধনকুবেরের মন ভোলাতে লেগেছেন উঠে পড়ে। ওঠার চেয়ে পড়ার অংশটাই বেশি। সেণ্ট্-অ্যাণ্টনির টেম্টেশন ছবি দেখেছিস তো? দিনের পর দিন নূতন বেহায়াগিরি–তোর খুব-যে শুচিবাই তা নয়, তবু ক্ষণে ক্ষণে গঙ্গার ঘাটে দৌড় মারতে চাইতিস। দ্বিতীয় নম্বরের নায়িকা গলা ভেঙে মরছে পঙ্ককুণ্ডের ধারে দাঁড়িয়ে। অবশেষে একদিন পৌষ মাসের অর্ধরাতে খিড়কির ঘাটে–তুই ভাবছিস হতভাগিনী আত্মহত্যা করে বাঁচল–ক্ষিতিশের কল্পনাকে অবিচার করিস নে–নায়িকা জলের মধ্যে এক পৈঁঠে পর্যন্ত নেবেছিল। ঠাণ্ডা জলে ছ্যাঁক করে উঠল গা-টা। ছুটল গরম বিছানা লক্ষ্য করে। এইখানটাতে সাইকলজির তর্ক এই, শীত করল বলেই মরা মুলতুবি কিংবা শীত করাতে আগুনের কথাটা মাথায় এল, অমনি ভাবল ওদের জ্বালিয়ে মারবে বেঁচে থেকে।
লীলা।
কিছুতে বুঝতে পারি নে, এত লোক থাকতে ক্ষিতীশের উপর এত ভরসা রেখেছিস কী করে।
বাঁশরি।
অবিচার করিস নে। ওর লেখবার শক্তি আছে। ও আমাদের ময়মনসিংহের বাগানের আম, জাত ভালো, কিন্তু যতই চেষ্টা করা গেল ভিতরে পোকা হতেই আছে। ঐ পোকা বাদ দিয়ে কাজে লাগানো হয়তো চলবে। ঐ বুঝি আসছে।
লীলা।
আমি তবে চললুম।
বাঁশরি।
একেবারে যাস নে। সন্ধেবেলাটা কোনোমতে কাটাতে হবে। কমিক গল্পটা তো শেষ হল।
লীলা।
কমিক গল্পের এক্টিনি করতে হবে বুঝি আমাকেই? আচ্ছা, রইলুম পাশের ঘরে।
ক্ষিতীশের প্রবেশ
ক্ষিতীশের প্রবেশ
ক্ষিতিশ।
কেমন লাগল। মেলোড্রামার খাদ মেশাই নি সিকি তোলাও। সেণ্টিমেণ্টালিটির তরল রস চায় যে-সব খুকিরা, তাদের পক্ষে নির্জলা একাদশী। একেবারে নিষ্ঠুর সত্য।
বাঁশরি।
কেমন লাগল বুঝিয়ে দিচ্ছি (পাতাগুলি ছিঁড়ে ফেলল)।
ক্ষিতিশ।
করলে কী। সর্বনাশ! এটা আমার সব লেখার সেরা, নষ্ট করে ফেললে?
বাঁশরি।
দলিলটা নষ্ট করে ফেললেই সেরা জিনিসের বালাই থাকে না। কৃতজ্ঞ হোয়ো আমার ’পরে।
ক্ষিতিশ।
সাহিত্যে নিজে কিছু দেবার শক্তি নেই, অথচ সংকোচ নেই তাকে বঞ্চিত করতে। এর দাম দিতে হবে, কিছুতে ছাড়ব না।
বাঁশরি।
কী দাম চাই।
ক্ষিতিশ।
তোমাকে।
বাঁশরি।
ক্ষতিপূরণ এত সস্তায়, সাহস আছে নিতে?
ক্ষিতিশ।
আছে।
বাঁশরি।
সেণ্টিমেণ্ট্ এক ফোঁটাও মিলবে না।
ক্ষিতিশ।
আশাও করি নে।
বাঁশরি।
নির্জলা একাদশী, নিষ্ঠুর সত্য।
ক্ষিতিশ।
রাজি আছি।
বাঁশরি।
আছ রাজি? বুঝেসুঝে বলছ? এ কমিক নভেল নয়, ভুল করলে প্রুফ-দেখা চলবে না, এডিশনও ফুরবে না মরার দিন পর্যন্ত।
ক্ষিতিশ।
শিশু নই, এ কথা বুঝি।
বাঁশরি।
না মশায়, কিচ্ছু বোঝ না, বুঝতে হবে দিনে দিনে পলে পলে, বুঝতে হবে হাড়ে হাড়ে মজ্জায় মজ্জায়।
ক্ষিতিশ।
সেই হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো অভিজ্ঞতা।
বাঁশরি।
তবে বলি শোনো। অবোধের ‘পরে মেয়েদের স্বাভাবিক স্নেহ। তোমার উপর কৃপা আছে আমার। তাই অবুঝের মতো নিজের সর্বনাশের যে-প্রস্তাবটা করলে তাতে সম্মতি দিতে দয়া হচ্ছে।
ক্ষিতিশ।
সম্মতি না দিলে সাংঘাতিক নির্দয়তা হবে। সামলে উঠতে পারব না।
বাঁশরি।
মেলোড্রামা?
ক্ষিতিশ।
না মেলোড্রামা নয়।
বাঁশরি।
ক্রমে মেলোড্রামা হয়ে উঠবে না?
ক্ষিতিশ।
যদি হয় তবে সেই দিনগুলোকে ঐ খাতার পাতার মতো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলো।
বাঁশরি।
(উঠে দাঁড়িয়ে) আচ্ছা সম্মতি দিলেম। (ক্ষিতিশ ছুটে এল বাঁশরির দিকে) ঐ রে, শুরু হল! ভালো করে ভেবে দেখো, এখনো পিছোবার সময় আছে।
ক্ষিতিশ।
(করজোড়ে) মাপ করো, ভয় হচ্ছে পাছে মত বদলায়।
বাঁশরি।
যখন বদলাবে তখন ভয় কোরো। অমন মুখের দিকে তাকিয়ে থেকো না। দেখতে খারাপ লাগে। যাও রেজেস্ট্রি আফিসে। তিন-চার দিনের মধ্যে বিয়ে হওয়া চাই।
ক্ষিতিশ।
নোটিশের মেয়াদ কমাতে আইনে যদি বাধে।
বাঁশরি।
তা হলে বিয়েতেও বাধবে। দেরি করতে সাহস নেই।
ক্ষিতিশ।
অনুষ্ঠান?
বাঁশরি।
হবে না অনুষ্ঠান, তোমার দেখছি কমিকের দিকে ঝোঁক আছে। এখনো বুঝলে না জিনিসটা সীরিয়াস।
ক্ষিতিশ।
কাউকে নিমন্ত্রণ?
বাঁশরি।
কাউকে না।
ক্ষিতিশ।
কাউকেই না?
বাঁশরি।
আচ্ছা, সোমশংকরকে।
ক্ষিতিশ।
কিরকম চিঠিটা লিখতে হবে তার একটা খসড়া—
বাঁশরি।
খসড়া কেন, লিখে দিচ্ছি।
ক্ষিতিশ।
স্বহস্তে?
বাঁশরি।
হাঁ, স্বহস্তে।
ক্ষিতিশ।
আজই?
বাঁশরি।
হাঁ, এখনই। (চিঠি লিখে) এই নাও, পড়ো।
ক্ষিতীশের পাঠ।
এতদ্বারা সংবাদ দেওয়া যাইতেছে, শ্রীমতী বাঁশরি সরকারের সহিত শ্রীযুক্ত ক্ষিতিশচন্দ্র ভৌমিকের অবিলম্বে বিবাহ স্থির হইয়াছে। তারিখ জানানো অনাবশ্যক–আপনার অভিনন্দন প্রার্থনীয়। পত্রদ্বারা বিজ্ঞাপন হইল, ত্রুটি মার্জনা করিবেন। ইতি—
বাঁশরি।
এ চিঠি এখনি রাজার দারোয়ানের হাতে দিয়ে আসবে। দেরি কোরো না।
[ ক্ষিতীশের প্রস্থান
লীলা, শুনে যা খবরটা।
লীলার প্রবেশ
লীলার প্রবেশ
লীলা।
কী খবর।
বাঁশরি।
বাঁশরি সরকারের সঙ্গে ক্ষিতিশ ভৌমিকের বিবাহ পাকা হয়ে গেল।
লীলা।
আঃ, কী বলিস তার ঠিকানা নেই।
বাঁশরি।
এতদিন পরে একটা ঠিকানা হল।
লীলা।
এটা যে আত্মহত্যা।
বাঁশরি।
তার পরে পুনর্জন্মের প্রথম অধ্যায়।
লীলা।
সবচেয়ে দুঃখ এই যে, যেটা ট্র্যাজেডি সেটাকে দেখাবে প্রহসন।
বাঁশরি।
ট্র্যাজেডির লজ্জা ঘুচবে ঠাট্টার হাসিতে। অশ্রুপাতের চেয়ে অগৌরব নেই।
লীলা।
আমাদের রাশিচক্র থেকে খসে পড়ল সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটি। যদি তার জ্বালা নিভত শোক করতুম না। জ্বালা সে সঙ্গে করে নিয়েই চলল অন্ধকারের তলায়।
বাঁশরি।
তা হোক, ডার্ক্ হীট, কালো আগুন, কারও চোখে পড়বে না। আমার জন্য শোক করিস নে, যে আমার সাথি হতে চলল শোচনীয় সে-ই। এ কী! শংকর আসছে। তুই যা ভাই একটু আড়ালে।
[ লীলার প্রস্থান
[ লীলার প্রস্থান
সোমশংকরের প্রবেশ
সোমশংকরের প্রবেশ
সোমশংকর।
বাঁশি।
বাঁশরি।
তুমি যে!
সোমশংকর।
নিমন্ত্রণ করতে এসেছি। জানি অন্যপক্ষ থেকে ডাকে নি তোমাকে। আমার পক্ষ থেকে কোনো সংকোচ নেই।
বাঁশরি।
কেন সংকোচ ঔদাসীন্য?
সোমশংকর।
তোমার কাছ থেকে যা পেয়েছি আর আমি যা দিয়েছি তোমাকে, এ বিবাহে তাকে স্পর্শমাত্র করতে পারবে না, এ তুমি নিশ্চয় জান।
বাঁশরি।
তবে বিবাহ করতে যাচ্ছ কেন।
সোমশংকর।
সে কথা বুঝতে যদি নাও পার, তবু দয়া কোরো আমাকে।
বাঁশরি।
তবু বলো। বুঝতে চেষ্টা করি।
সোমশংকর।
কঠিন ব্রত নিয়েছি, একদিন প্রকাশ হবে, আজ থাক্, দুঃসাধ্য আমার সংকল্প, ক্ষত্রিয়ের যোগ্য। কোনো-এক সংকটের দিনে বুঝবে সে ব্রত ভালোবাসার চেয়েও বড়ো। তাকে সম্পন্ন করতেই হবে প্রাণ দিয়েও।
বাঁশরি।
আমাকে সঙ্গে নিয়ে সম্পন্ন করতে পারতে না?
সোমশংকর।
নিজেকে কখনো তুমি ভুল বোঝাও না বাঁশি। তুমি নিশ্চিত জান তোমার কাছে আমি দুর্বল। হয়তো একদিন তোমার ভালোবাসা আমাকে টলিয়ে দিত আমার ব্রত থেকে। যে-দুর্গমপথে সুষমার সঙ্গে সন্ন্যাসী আমাকে যাত্রায় প্রবৃত্ত করেছেন সেখানে ভালোবাসার গতিবিধি বন্ধ।
বাঁশরি।
সন্ন্যাসী হয়তো ঠিকই বুঝেছেন। তোমার চেয়েও তোমার ব্রতকে আমি বড়ো করে দেখতে পারতুম না। হয়তো সেইখানেই বাধত সংঘাত। আজ পর্যন্ত তোমার ব্রতের সঙ্গেই আমার শত্রুতা। তবে এই শত্রুর দুর্গে কোন্ সাহসে তুমি এলে। একদিন যে-শক্তি আমার মধ্যে দেখেছিলে আজ কিছু কি তার অবশিষ্ট নেই। ভয় করবে না?
সোমশংকর।
শক্তি একটুও কমে নি, তবু ভয় করব না।
বাঁশরি।
যদি তেমন করে পিছু ডাকি এড়িয়ে যেতে পারবে?
সোমশংকর।
কী জানি, না পারতেও পারি।
বাঁশরি।
তবে?
সোমশংকর।
তোমাকে বিশ্বাস করি। আমার সত্য কখনোই ভাঙা পড়বে না তোমার হাতে। সংকটের মুখে যাবার পথে আমাকে হেয় করতে পারবে না তুমি। নিশ্চিত জান সত্যভঙ্গ হলে আমি প্রাণ রাখব না। মরব তুষানলে পুড়ে।
বাঁশরি।
শংকর, তুমি ক্ষত্রিয়ের মতোই ভালোবাসতে পার। শুধু ভাব দিয়ে নয় বীর্য দিয়ে। সত্যি করে বলো, আজও কি আমাকে সেদিনের মতোই ততখানি ভালোবাস।
সোমশংকর।
ততখানিই।
বাঁশরি।
আর কিছুই চাই নে আমি। সুষমাকে নিয়ে পূর্ণ হোক তোমার ব্রত, তাকে ঈর্ষা করব না।
সোমশংকর।
একটা কথা বাকি আছে।
বাঁশরি।
কী, বলো।
সোমশংকর।
আমার ভালোবাসার কিছু চিহ্ন রেখে যাচ্ছি তোমার কাছে, ফিরিয়ে দিতে পারবে না। (অলংকারের সেই থলি বের করলে)
বাঁশরি।
ও কী, ও-সব যে তলিয়ে ছিল জলে।
সোমশংকর।
ডুব দিয়ে আবার তুলে এনেছি।
বাঁশরি।
মনে করেছিলুম আমার সব হারিয়েছে। ফিরে পেয়ে অনেকখানি বেশি করে পেলুম। নিজের হাতে পরিয়ে দাও আমাকে। (সোমশংকর গয়না পরিয়ে দিলে) শক্ত আমার প্রাণ। তোমার কাছেও কোনোদিন কেঁদেছি বলে মনে পড়ে না, আজ যদি কাঁদি কিছু মনে কোরো না। (হাতে মাথা রেখে কান্না)
ভৃত্যের প্রবেশ
ভৃত্যের প্রবেশ
ভৃত্য।
রাজবাহাদুরের চিঠি।
বাঁশরি।
(দাঁড়িয়ে উঠে) শংকর, ও চিঠি আমাকে দাও।
সোমশংকর।
না পড়েই?
বাঁশরি।
হাঁ, না পড়েই।
সোমশংকর।
তবে নাও। (বাঁশরি চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলল) এখনো একটা কাজ বাকি আছে। এই সিগারেট কেস চেয়ে পাঠিয়েছিলে। কেন,বুঝতে পারি নি।
বাঁশরি।
আর-একবার তোমার ঐ পকেটে রাখব বলে, এ আমার দ্বিতীয়বারকার দান।
সোমশংকর।
সন্ন্যাসীবাবা আমাদের বাড়িতে আসবেন এখনই–বিদায় দাও, যাই তাঁর কাছে।
বাঁশরি।
যাও, জয় হোক সন্ন্যাসীর।
[ সোমশংকরের প্রস্থান
[ সোমশংকরের প্রস্থান
লীলার প্রবেশ
লীলার প্রবেশ
লীলা।
কী ভাই—
বাঁশরি।
একটু বোসো। আর-একখানা চিঠি লেখা বাকি আছে, সেটা তাকে দিতে হবে তোরই হাত দিয়ে। (চিঠি লিখে লীলাকে দিলে) পড়ে দেখ্।
চিঠি
চিঠি
শ্রীমান ক্ষিতিশচন্দ্র ভৌমিক কল্যাণবরেষু-
তোমার ভাগ্য ভালো, ফাঁড়া কেটে গেল, আমারও বিবাহের আসন্ন আশঙ্কাটা সম্পূর্ণ লোপ করে দিলুম। ‘ভালোবাসার নিলামে’ সর্বোচ্চ দরই পেয়েছি, তোমার ডাক সে-পর্যন্ত পৌঁছত না। অন্যত্র অন্য-কোনো সান্ত্বনার সুযোগ উপস্থিতমতো যদি না জোটে তবে বই লেখো। আশা করি এবার সত্যের সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে। তোমার এই লেখায় বাঁশরির প্রতি দয়া করবার দরকার হবে না। আত্মহত্যায় এক পৈঁঠে পা বাড়িয়েই সে ফিরে এসেছে।
শ্রীমান ক্ষিতিশচন্দ্র ভৌমিক কল্যাণবরেষু-
তোমার ভাগ্য ভালো, ফাঁড়া কেটে গেল, আমারও বিবাহের আসন্ন আশঙ্কাটা সম্পূর্ণ লোপ করে দিলুম। ‘ভালোবাসার নিলামে’ সর্বোচ্চ দরই পেয়েছি, তোমার ডাক সে-পর্যন্ত পৌঁছত না। অন্যত্র অন্য-কোনো সান্ত্বনার সুযোগ উপস্থিতমতো যদি না জোটে তবে বই লেখো। আশা করি এবার সত্যের সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে। তোমার এই লেখায় বাঁশরির প্রতি দয়া করবার দরকার হবে না। আত্মহত্যায় এক পৈঁঠে পা বাড়িয়েই সে ফিরে এসেছে।
লীলা।
(বাঁশরিকে জড়িয়ে ধরে) আঃ, বাঁচালি ভাই, আমাদের সবাইকে। সুষমার উপর এখন আর তোর রাগ নেই?
বাঁশরি।
কেন থাকবে। সে কি আমার চেয়ে জিতেছে। লীলা, দে ভাই সব দরজা খুলে সব আলোগুলো জ্বালিয়ে–বাগান থেকে যতগুলো ফুল পাস নিয়ে আয় সংগ্রহ করে।
[ লীলার প্রস্থান
[ লীলার প্রস্থান
পুরন্দরের প্রবেশ
পুরন্দরের প্রবেশ
বাঁশরি।
এ কী সন্ন্যাসী, তুমি যে আমার ঘরে?
পুরন্দর।
চলে যাচ্ছি দূরে, হয়তো আর দেখা হবে না।
বাঁশরি।
যাবার বেলায় আমার কথা মনে পড়ল?
পুরন্দর।
তোমার কথা কখনোই ভুলি নি। ভোলবার মতো মেয়ে নও তুমি। নিত্যই এ কথা মনে রেখেছি, তোমাকে চাই আমাদের কাজে–দুর্লভ দুঃসাধ্য তুমি, তাই দুঃখ দিয়েছি।
বাঁশরি।
পার নি দুঃখ দিতে। মরা কঠিন নয়, পেয়েছি তার প্রথম শিক্ষা। কিন্তু তোমাকে একটা শেষকথা বলব সন্ন্যাসী, শোনো। সুষমাকে তুমি ভালোবাস, সুষমা জানে সেই কথা। তোমার ভালোবাসার সূত্রে গেঁথে ব্রতের হার পরেছে সে গলায়, তার আর ভাবনা কিসের। সত্য কি না বলো।
পুরন্দর।
সত্য কি মিথ্যা সে-কথা বলে কোনো ফল নেই, দুইই সমান।
বাঁশরি।
সুষমার ভাগ্য ভালো কিন্তু সোমশংকরকে কী তুমি দিলে।
পুরন্দর।
সে পুরুষ, সে ক্ষত্রিয়, সে তপস্বী।
বাঁশরি।
হোক পুরুষ, হোক ক্ষত্রিয়, তার তপস্যা অপূর্ণ থাকবে আমি না থাকলে, আবশ্যক আছে আমাকে।
পুরন্দর।
বঞ্চিত হবার দুঃখই তাকে দেবে শক্তি।
বাঁশরি।
কখনোই না, তাতেই পঙ্গু করবে তার ব্রত। যে পারে ঐ ক্ষত্রিয়কে শক্তি দিতে এমন কেবল একটি মেয়ে আছে এ-সংসারে।
পুরন্দর।
জানি।
বাঁশরি।
সে সুষমা নয়।
পুরন্দর।
তাও জানি। কিন্তু ঐ বীরের শক্তি হরণ করতে পারে, এমনও একটিমাত্র মেয়ে আছে এ-সংসারে।
বাঁশরি।
আজ অভয় দিচ্ছে সে। আপন অন্তরের মধ্যে সে আপনি পেয়েছে দীক্ষা। তার বন্ধন ঘুচেছে, সে আর বাঁধবে না।
পুরন্দর।
তবে আজ যাবার দিনে নিঃসংকোচে তারই হাতে রেখে গেলেম সোমশংকরের দুর্গম পথের পাথেয়।
বাঁশরি।
এতদিন আমার যত প্রণাম বাকি ছিল সব একত্র করে আজ এই দিলেম তোমার পায়ে।
পুরন্দর।
আর আমি দিয়ে গেলেম, তোমাকে একটি গান, তোমার কণ্ঠে সেটিকে গ্রহণ করো।
গান
পিনাকেতে লাগে টংকার -
বসুন্ধরার পঞ্জরতলে কম্পন জাগে শঙ্কার।
আকাশেতে ঘোরে ঘূর্ণী
সৃষ্টির বাঁধ চূর্ণি,
বজ্রভীষণ গর্জনরব প্রলয়ের জয়ডঙ্কার।
স্বর্গ উঠিছে ক্রন্দি,
সুরপরিষদ বন্দী,
তিমিরগহন দুঃসহ রাতে উঠে শৃঙ্খলঝংকার।
দানবদম্ভ তর্জি
রুদ্র উঠিল গর্জি,
লণ্ডভণ্ড লুটিল ধুলায় অভ্রভেদী অহংকার।।