বাগানের এক দিক। খাবার-টেবিল ঘিরে বসে আছে তারক, শচীন, সুধাংশু, সতীশ ইত্যাদি।

বাগানের এক দিক। খাবার-টেবিল ঘিরে বসে আছে তারক, শচীন, সুধাংশু, সতীশ ইত্যাদি।

তারক।

বাড়াবাড়ি হচ্ছে সন্ন্যাসীকে নিয়ে। নাম পুরন্দর নয়, সবাই জানে। আসল নাম ধরা পড়লেই বোকার ভিড় পাতলা হয়ে যেত। দেশী কি বিদেশী তা নিয়েও মতভেদ। ধর্ম কী জিজ্ঞাসা করলে হেসে বলে, ধর্মটা এখনো মরে নি তাই তাকে নামের কোঠায় ঠেসে দেওয়া চলে না। সেদিন দেখি, আমাদের হিমুকে গল্‌ফ শেখাচ্ছে। হিমুর জীবাত্মাটা কোনোমতে গল্‌‍ফের গুলির পিছনেই ছুটতে পারে, তার বেশি ওর দৌড় নেই, তাই সে ভক্তিতে গদ্‌গদ। মিস্টিরিয়স সাজের নানা মালমশলা জুটিয়েছে। আজ ওকে আমি একস্‌‍পোজ করব সবার সামনে, দেখে নিয়ো।

সুধাংশু।

প্রমাণ করবে, তোমার চেয়ে যে বড়ো সে তোমার চেয়ে ছোটো!

সতীশ।

আঃ সুধাংশু, মজাটা মাটি করিস কেন। পকেট বাজিয়ে ও বলছে ডক্যুমেণ্ট্‌ আছে। বের করুকনো, দেখি কী রকম চীজ সেটা। ঐ যে সন্ন্যাসী, সঙ্গে আসছেন এঁরা সবাই।

পুরন্দরের প্রবেশ

ললাট উন্নত, জ্বলছে দুই চোখ, ঠোঁটে রয়েছে অনুচ্চারিত অনুশাসন, মুখের স্বচ্ছ রঙ পাণ্ডুর শ্যাম, অন্তর থেকে বিচ্ছুরিত দীপ্তিতে ধৌত। দাড়ি-গোঁফ কামানো, সুডৌল মাথায় ছোটো করে ছাঁটা চুল, পায়ে নেই জুতো, তসরের ধুতি পরা, গায়ে খয়েরি রঙের ঢিলে জামা। সঙ্গে সুষমা, সোমশংকর, বিভাসিনী।

শচীন।

সন্ন্যাসীঠাকুর, বলতে ভয় করি, কিন্তু চা খেতে দোষ কী।

পুরন্দর।

কিছুমাত্র না। যদি ভালো চা হয়। আজ থাক্‌, এইমাত্র নেমন্তন্ন খেয়ে আসছি।

শচীন।

নেমন্তন্ন আপনাকেও? লাঞ্চে নাকি। গ্রেট্‌ইস্টার‍্‌নে বোষ্টমের মোচ্ছব!

পুরন্দর।

গ্রেট্‌ইস্টার‍্‌নেই যেতে হয়েছিল। ডাক্তার উইল্‌কক্সের ওখানে।

শচীন।

ডাক্তার উইল্‌কক্স! কী উপলক্ষ্যে।

পুরন্দর।

যোগবাশিষ্ঠ পড়ছেন।

শচীন।

বাস্‌ রে! ওহে তারক, এগিয়ে এসো-না।–কী-যে বলছিলে।

তারক।

এই ফোটোগ্রাফটা তো আপনার?

পুরন্দর।

সন্দেহ মাত্র নেই।

তারক।

মোগলাই সাজ, সামনে গুড়্‌গুড়ি, পাশে দাড়িওয়ালাটা কে। সুস্পষ্ট যাবনিক।

পুরন্দর।

রোশেনাবাদের নবাব। ইরানী বংশীয়। তোমার চেয়ে এঁর আর্যরক্ত বিশুদ্ধ।

তারক।

আপনাকে কেমন দেখাচ্ছে যে!

পুরন্দর।

দেখাচ্ছে তুর্কির বাদশার মতো। নবাবসাহেব ভালোবাসেন আমাকে, আদর করে ডাকেন মুক্তিয়ার মিঞা, খাওয়ান এক থালায়। মেয়ের বিয়ে ছিল, আমাকে সাজিয়েছিলেন আপন বেশে।

তারক।

মেয়ের বিয়েতে ভাগবতপাঠ ছিল বুঝি?

পুরন্দর।

ছিল পোলোখেলার টুর্নামেণ্ট্‌। আমি ছিলুম নবাবসাহেবের আপন দলে।

তারক।

কেমন সন্ন্যাসী আপনি।

পুরন্দর।

ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত। কোনো উপাধিই নেই, তাই সব উপাধিই সমান খাটে। জন্মেছি দিগম্বর বেশে, মরব বিশ্বাম্বর হয়ে। তোমার বাবা ছিলেন কাশীতে হরিহর তত্ত্বরত্ন, তিনি আমাকে যে-নামে জানতেন সে নাম গেছে ঘুচে। তোমার দাদা রামসেবক বেদান্তভূষণ কিছুদিন পড়েছেন আমার কাছে বৈশেষিক। তুমি তারক লাহিড়ি, তোমার নাম ছিল বুকু, আজ শ্বশুরের সুপারিসে কক্‌স্‌‍হিল সাহেবের অ্যাটর্নি-অফিসে শিক্ষানবিশ। সাজ বদলেছে, তোমার, তারক নামের আদ্যক্ষরটা তবর্গ থেকে টবর্গে চড়েছে। শুনেছি যাবে বিলেতে। বিশ্বনাথের বাহনের প্রতি দয়া রেখো।

তারক।

ডাক্তার উইল্‌কক্সের কাছ থেকে কি ইণ্ট্রোডাক্‌শন চিঠি পাওয়া যেতে পারবে?

পুরন্দর।

পাওয়া অসম্ভব নয়।

তারক।

মাপ করবেন।

পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম

পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম

বাঁশরি।

সুষমার মাষ্টারিতে আজ ইস্তফা দিতে এসেছেন?

পুরন্দর।

কেন দেব। আরো-একটি ছাত্র বাড়ল।

বাঁশরি।

শুরু করাবেন মুগ্ধবোধের পাঠ? মুগ্ধতার তলায় ডুবছে যে মানুষটা হঠাৎ তার বোধোদয় হলে নাড়ি ছাড়বে।

পুরন্দর।

(কিছুক্ষণ বাঁশরির মুখের দিকে তাকিয়ে) বৎসে, একেই বলে ধৃষ্টতা।

বাঁশরি মুখ ফিরিয়ে সরে গেল

বাঁশরি মুখ ফিরিয়ে সরে গেল

বিভাসিনী।

সময় হয়েছে। ঘরের মধ্যে সভা প্রস্তুত, চলুন সকলে।

সকলের ঘরে প্রবেশ

সকলের ঘরে প্রবেশ

দরজা পর্যন্ত গিয়ে বাঁশরি থমকে দাঁড়াল

দরজা পর্যন্ত গিয়ে বাঁশরি থমকে দাঁড়াল

ক্ষিতিশ।

তুমি যাবে না ঘরে?

বাঁশরি।

সস্তাদরের সদুপদেশ শোনবার শখ আমার নেই।

ক্ষিতিশ।

সদুপদেশ!

বাঁশরি।

এই তো সুযোগ। পালাবার রাস্তা বন্ধ। জালিয়ানওয়ালাবাগের মার।

ক্ষিতিশ।

আমি একবার দেখে আসিগে।

বাঁশরি।

না। শোনো, প্রশ্ন আছে। সাহিত্যসম্রাট, গল্পটার মর্ম যেখানে সেখানে পৌঁচেছে তোমার দৃষ্টি?

ক্ষিতিশ।

আমার হয়েছে অন্ধ-গোলাঙ্গুল ন্যায়। লেজটা ধরেছি চেপে, বাকিটা টান মেরেচে আমাকে কিন্তু চেহারা রয়েছে অস্পষ্ট। মোট কথাটা এই বুঝেছি যে, সুষমা বিয়ে করবে রাজাবাহাদুরকে, পাবে রাজৈশ্বর্য, তার বদলে হাতটা দিতে প্রস্তুত, হৃদয়টা নয়।

বাঁশরি।

তবে শোনো বলি। সোমশংকর নয় প্রধান নায়ক, এ কথা মনে রেখো।

ক্ষিতিশ।

তাই নাকি। তা হলে অন্তত গল্পটার ঘাট পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও। তার পরে সাঁতরিয়ে হোক,খেয়া ধরে হোক, পারে পৌঁছব।

বাঁশরি।

হয়তো জান পুরন্দর তরুণসমাজে বিনা মাইনেয় মাস্টারি করেন। পরীক্ষায় উৎরিয়ে দিতে অদ্বিতীয়। কড়া বাছাই করে নেন ছাত্র। ছাত্রী পেতে পারতেন অসংখ্য, কিন্তু বাছাইরীতি এত অসম্ভব কঠিন যে, এতদিনে একটিমাত্র পেয়েছেন, তার নাম শ্রীমতী সুষমা সেন।

ক্ষিতিশ।

ছাত্রী যাদের ত্যাগ করেছেন তাদের কী দশা।

বাঁশরি।

আত্মহত্যার সংখ্যা কত, খবর পাই নি। এটা জানি, তাদের অনেকেই চঞ্চু মেলে চেয়ে আছে ঊর্ধ্বে।

ক্ষিতিশ।

সেই চকোরীর দলে নাম লেখাও নি?

বাঁশরি।

তোমার কী মনে হয়।

ক্ষিতিশ।

আমার মনে হয় চকোরীর জাত তোমার নয়, তুমি মিসেস্‌ রাহুর পদের উমেদার। যাকে নেবে তাকে দেবে লোপ করে, শুধু চঞ্চু মেলে তাকিয়ে থাকা নয়।

বাঁশরি।

ধন্য! নরনারীর ধাত বুঝতে পয়লা নম্বর, গোল্ড্‌ মেডালিস্ট্‌। লোকে বলে নারীস্বভাবের রহস্যভেদ করতে হার মানেন স্বয়ং নারীর সৃষ্টিকর্তা পর্যন্ত, কিন্তু তুমি নারীচরিত্রচারণচক্রবর্তী, নমস্কার তোমাকে।

ক্ষিতিশ।

(করজোড়ে) বন্দনা সারা হল, এবার বর্ণনার পালা শুরু হোক।

বাঁশরি।

এটা আন্দাজ করতে পার নি যে, সুষমা ঐ সন্ন্যাসীর ভালোবাসায় একেবারে শেষ-পর্যন্ত তলিয়ে গেছে?

ক্ষিতিশ।

ভালোবাসা না ভক্তি?

বাঁশরি।

চরিত্রবিশারদ, লিখে রাখো, মেয়েদের যে ভালোবাসা পৌঁছয় ভক্তিতে সেটা তাদের মহাপ্রয়াণ -সেখান থেকে ফেরবার রাস্তা নেই। অভিভূত যে পুরুষ ওদের সমান প্ল্যাটফর‍্‌মে নামে সেই গরিবের জন্য থার্ডক্লাস, বড়োজোর ইণ্টার মীডিয়েট। সেলুনগাড়ি তো নয়ই। যে উদাসীন মেয়েদের মোহে হার মানল না, ওদের ভুজপাশের দিগ্‌বলয় এড়িয়ে যে উঠল মধ্যগগনে, দুই হাত ঊর্ধ্বে তুলে

মেয়েরা তারই উদ্দেশে দিল শ্রেষ্ঠ নৈবেদ্য। দেখ নি তুমি, সন্ন্যাসী যেখানে মেয়েদের সেখানে কী ঠেলাঠেলি ভিড়!

ক্ষিতিশ।

তা হবে। কিন্তু তার উলটোটাও দেখেছি। মেয়েদের বিষম টান একেবারে তাজা বর্বরের প্রতি। পুলকিত হয়ে ওঠে তাদের অপমানের কঠোরতায়, পিছন পিছন রসাতল পর্যন্ত যেতে রাজি।

বাঁশরি।

তার কারণ মেয়েরা অভিসারিকার জাত। এগিয়ে গিয়ে যাকে চাইতে হয় তার দিকেই ওদের পুরো ভালোবাসা। ওদের উপেক্ষা তারই ‘পরে দুর্বৃত্ত হবার মতো জোর নেই যার কিম্বা দুর্লভ হবার মতো তপস্যা।

ক্ষিতিশ।

আচ্ছা, বোঝা গেল, সন্ন্যাসীকে ভালোবাসে ঐ সুষমা। তার পরে?

বাঁশরি।

সে কী ভালোবাসা! মরণের বাড়া! সংকোচ ছিল না, কেননা একে সে ভক্তি বলেই জানত। পুরন্দর দূরে যেত আপন কাজে, সুষমা তখন যেত শুকিয়ে, মুখ হয়ে যেত ফ্যাকাসে। চোখে প্রকাশ পেত জ্বালা, মন শূন্যে শূন্যে খুঁজে বেড়াত কার দর্শন। বিষম ভাবনা হল মায়ের মনে। একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাঁশি, কী করি।’ আমার বুদ্ধির উপর তখন তাঁর ভরসা ছিল। আমি বললেম, ‘দাও-না পুরন্দরের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে।’ তিনি তো আঁৎকে উঠলেন; বললেন, ‘এমন কথা ভাবতেও পার?’ তখন নিজেই গেলুম পুরন্দরের কাছে। সোজা বললুম, ‘নিশ্চয়ই জানেন, সুষমা আপনাকে ভালোবাসে। ওকে বিয়ে করে উদ্ধার করুন বিপদ থেকে।’ এমন করে মানুষটা তাকাল আমার মুখের দিকে, রক্ত জল হয়ে গেল। গম্ভীর সুরে বললে, ‘সুষমা আমার ছাত্রী, তার ভার আমার ’পরে, আর আমার ভার তোমার ’পরে নয়।’ পুরুষের কাছ থেকে এতবড়ো ধাক্কা জীবনে এই প্রথম। ধারণা ছিল, সব পুরুষের ‘পরেই সব মেয়ের আবদার চলে, যদি নিঃসংকোচ সাহস থাকে। দেখলুম দুর্ভেদ্য দুর্গও আছে। মেয়েদের সাংঘাতিক বিপদ সেই বন্ধ কপাটের সামনে, ডাকও আসে সেইখান থেকে কপালও ভাঙে সেইখানটায়।

ক্ষিতিশ।

আচ্ছা, বাঁশি, সত্যি করে বলো, সন্ন্যাসী তোমারও মনকে টেনেছিল কিনা।

বাঁশরি।

দেখো, সাইকলজির অতি সূক্ষ্ম তত্ত্বের মহলে কুলুপ দেওয়া ঘর। নিষিদ্ধ দরজা না খোলাই ভালো; সদরমহলেই যথেষ্ট গোলমাল, সামলাতে পারলে বাঁচি। আজ যে পর্যন্ত শুনলে তার পরের অধ্যায়ের বিবরণ পাওয়া যাবে একখানা চিঠি থেকে। পরে দেখাব।

ক্ষিতিশ।

ঘরের মধ্যে চেয়ে দেখো, বাঁশি। পুরন্দর আঙটি বদল করাচ্ছে। জানলার থেকে সুষমার মুখের উপর পড়েছে রোদের রেখা। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে, শান্ত মুখ, জল ঝরে পড়ছে দুই চোখ দিয়ে। বরফের পাহাড়ে যেন সূর্যাস্ত, গলে পড়ছে ঝরনা।

বাঁশরি।

সোমশংকরের মুখের দিকে দেখো–সুখ না দুঃখ, বাঁধন পরছে না ছিঁড়ছে? আর পুরন্দর, সে যেন ঐ সূর্যেরই আলো। তার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব রয়েছে লক্ষ যোজন দূরে, মেয়েটার মনে যে অগ্নিকাণ্ড চলছে তার সঙ্গে কোনো যোগই নেই। অথচ তাকে ঘিরে একটা জ্বলন্ত ছবি বানিয়ে দিলে।

ক্ষিতিশ।

সুষমার ’পরে সন্ন্যাসীর মন এতই যদি নির্লিপ্ত তবে ওকেই বেছে নিলে কেন।

বাঁশরি।

ও যে আইডিয়ালিস্ট্‌! বাস্‌ রে! এতবড়ো ভয়ংকর জীব জগতে নেই। আফ্রিকার অসভ্য মারে মানুষকে নিজে খাবে বলে। এরা মারে তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায়। খায় না খিদে পেলেও। বলি দেয় সারে সারে, জেঙ্গিসখাঁর চেয়ে সর্বনেশে।

ক্ষিতিশ।

সন্ন্যাসীর ’পরে তোমার মনে মনে ভক্তি আছে বলেই তোমার ভাষা এত তীব্র।

বাঁশরি।

যাকে-তাকে ভক্তি করতে না পেলে বাঁচে না যে-সব হ্যাংলা মেয়ে আমি তাদের দলে নই গো। রাজরানী যদি হতুম মেয়েদের চুলে দড়ি পাকিয়ে ওকে দিতুম ফাঁসি। কামিনীকাঞ্চন ছোঁয় না-যে তা নয়, কিন্তু তাকে দেয় ফেলে ওর কোন্‌-এক জগন্নাথের রথের তলায়, বুকের পাঁজর যায় গুঁড়িয়ে।

ক্ষিতিশ।

ওর আইডিয়াটা কী জানা চাই তো।

বাঁশরি।

সে আছে বাওয়ান্ন বাঁও জলের নীচে। তোমার এলাকার বাইরে, সেখানে তোমার মন্দাকিনী-পদ্মাবতীর ডুবসাঁতার চলে না। আভাস পেয়েছি কোন্‌ ডাকঘর-বিবর্জিত দেশে ও এক সংঘ বানিয়েছে, তরুণতাপসসংঘ, সেখানে নানা পরীক্ষায় মানুষ তৈরি হচ্ছে।

ক্ষিতিশ।

কিন্তু, তরুণী?

বাঁশরি।

ওর মতে গৃহেই নারী, কিন্তু পথে নয়।

ক্ষিতিশ।

তা হলে সুষমাকে কিসের প্রয়োজন।

বাঁশরি।

অন্ন চাই-যে। মেয়েরা প্রহরণধারিণী না হোক বেড়িহাতা-ধারিণী তো বটে। রাজভাণ্ডারের চাবিটা থাকবে ওরই হাতে। ঐ-যে ওরা বেরিয়ে আসছে, অনুষ্ঠান শেষ হল বুঝি।

পুরন্দর ও অন্য সকলে বেরিয়ে এল ঘর থেকে

পুরন্দর ও অন্য সকলে বেরিয়ে এল ঘর থেকে

পুরন্দর।

(সোমশংকর ও সুষমাকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে) তোমাদের মিলনের শেষ কথাটা ঘরের দেয়ালের মধ্যে নয় বাইরে, বড়ো রাস্তার সামনে। সুষমা, বৎসে, যে সম্বন্ধ মুক্তির দিকে নিয়ে চলে তাকেই শ্রদ্ধা করি। যা বেঁধে রাখে পশুর মতো প্রকৃতির-গড়া প্রবৃত্তির বন্ধনে বা মানুষের-গড়া দাসত্বের শৃঙ্খলে ধিক্‌ তাকে। পুরুষ কর্ম করে, স্ত্রী শক্তি দেয়। মুক্তির রথ কর্ম, মুক্তির বাহন শক্তি। সুষমা, ধনে তোমার লোভ নেই, তাই ধনে তোমার অধিকার। তুমি সন্ন্যাসীর শিষ্যা, তাই রাজার গৃহিণীপদে তোমার পূর্ণতা। (ডান হাতে সোমশংকরের ডান হাত ধরে)

তস্মাৎ ত্বমুত্তিষ্ঠ যশোলভস্ব

জিত্বা শত্রূন্‌ ভুঙ্‌ক্ষ্ব রাজ্যং সমৃদ্ধম্‌।

ওঠো, তুমি যশোলাভ করো। শত্রুদের জয় করো–যে রাজ্য অসীম সমৃদ্ধিবান তাকে ভোগ করো। বৎস, আমার সঙ্গে আবৃত্তি করো প্রণামের মন্ত্র।

নমঃ পুরস্তাদ্‌ অথ পৃষ্ঠতস্তে

নমোস্তুতে সর্বত এব সর্ব।

অনন্তবীর্যামিতবিক্রমস্‌ত্বং

সর্বং সমাপ্নোষি ততোহসি সর্বঃ।।

তোমাকে নমস্কার সম্মুখ থেকে, তোমাকে নমস্কার পশ্চাৎ থেকে, হে সর্ব, তোমাকে নমস্কার সর্ব দিক থেকে। অনন্তবীর্য তুমি, অমিতবিক্রম তুমি, তোমাতেই সর্ব, তুমিই সর্ব!

ক্ষণকালের জন্য যবনিকা পড়ে তখনই উঠে গেল। তখন রাত্রি,

আকাশে তারা দেখা যায়। সুষমা ও তার বন্ধু নন্দা।

ক্ষণকালের জন্য যবনিকা পড়ে তখনই উঠে গেল। তখন রাত্রি,

আকাশে তারা দেখা যায়। সুষমা ও তার বন্ধু নন্দা।

সুষমা।

এইবার সেই গানটা গা দেখি ভাই।

গান

গান

নন্দা।

না চাহিলে যারে পাওয়া যায়,

তেয়াগিলে আসে হাতে,

দিবসে সে-ধন হারায়েছি আমি

পেয়েছি আঁধার রাতে।

না দেখিবে তারে পরশিবে না গো,

তারি পানে প্রাণ মেলে দিয়ে জাগো,

তারায় তারায় রবে তারি বাণী,

কুসুমে ফুটিবে প্রাতে।।

তারি লাগি যত ফেলেছি অশ্রুজল,

বীণাবাদিনীর শতদলদলে

করিছে সে টলমল।

মোর গানে গানে পলকে পলকে

ঝলসি উঠিছে ঝলক ঝলকে,

শান্ত হাসির করুণ আলোক

ভাতিছে নয়নপাতে।।

পুরন্দরের প্রবেশ

পুরন্দরের প্রবেশ

সুষমা।

(ভূমিষ্ঠ প্রণাম করে) প্রভু, দুর্বল আমি। মনের গোপনে যদি পাপ থাকে ধুয়ে দাও, মুছে দাও। আসক্তি দূর হোক, জয়যুক্ত হোক তোমার বাণী।

পুরন্দর।

বৎসে, নিজেকে নিন্দা কোরো না, অবিশ্বাস কোরো না, নাত্মানমবসাদয়েৎ। ভয় নেই, কোনো ভয় নেই। আজ তোমার মধ্যে সত্যের আবির্ভাব হয়েছে মাধুর্যে, কাল সেই সত্য অনাবৃত করবে আপন জগজ্জয়িনী বীরশক্তি।

সুষমা।

আজ সন্ধ্যায় এইখানে তোমার প্রসন্নদৃষ্টির সামনে আমার নূতন জীবন আরম্ভ হল। তোমারই পথ হোক আমার পথ।

পুরন্দর।

তোমাদের কাছ থেকে দূরে যাবার সময় আসন্ন হয়েছে।

সুষমা।

দয়া করো প্রভু, ত্যাগ কোরো না আমাকে। নিজের ভার আমি নিজে বহন করতে পারব না। তুমি চলে গেলে আমার সমস্ত শক্তি যাবে তোমারই সঙ্গে।

পুরন্দর।

আমি দূরে গেলেই তোমার শক্তি তোমার মধ্যে ধ্রুবপ্রতিষ্ঠিত হবে। আমি তোমার হৃদয়দ্বার খুলে দিয়েছি নিজে স্থান নেব বলে নয়। যিনি আমার ব্রতপতি তিনি সেখানে স্থান গ্রহণ করুন। আমার দেবতা হোন তোমারই দেবতা, দুঃখকে ভয় নেই, আনন্দিত হও আত্মজয়ী আপনারই মধ্যে।

একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, সোমশংকরের মহত্ত্ব তুমি আপন অন্তরের থেকে চিনতে পেরেছ?

সুষমা।

পেরেছি।

পুরন্দর।

সেই দুর্লভ মহত্ত্বকে তোমার দুর্লভ সেবার দ্বারা মূল্যদান করে গৌরবান্বিত করবে, তার বীর্যকে সর্বোচ্চ সার্থকতার দিকে আনন্দে উন্মুখ রাখবে, এই নারীর কাজ; মনে রেখো, তোমার দিকে তাকিয়ে সে যেন নিজেকে শ্রদ্ধা করতে পারে–এই কথাটি ভুলো না।

সুষমা।

কখনো ভুলব না।

পুরন্দর।

প্রাণকে নারী পূর্ণতা দেয়, এইজন্যেই নারী মৃত্যুকেও মহীয়ান করতে পারে, তোমার কাছে এই আমার শেষ কথা।
1 | 2 | 3