প্রাসাদ

বিক্রমদেব, মন্ত্রী ও দেবদত্ত

প্রাসাদ

বিক্রমদেব, মন্ত্রী ও দেবদত্ত

বিক্রমদেব।

পলায়ন! রাজ্য ছেড়ে পলায়ন! এ রাজ্যেতে

যত সৈন্য, যত দুর্গ, যত কারাগার,

যত লোহার শৃঙ্খল আছে, সব দিয়ে

পারে না কি বাঁধিয়া রাখিতে দৃঢ়বলে

ক্ষুদ্র এক নারীর হৃদয়। এই রাজা

এই কি মহিমা তার। বৃহৎ প্রতাপ,

লোকবল অর্থবল নিয়ে, পড়ে থাকে

শূন্য স্বর্ণ পিঞ্জরের মতো, ক্ষুদ্র পাখি

উড়ে চলে যায়।

মন্ত্রী।

হায় হায়, মহারাজ,

লোকনিন্দা, ভগ্নবাঁধ জলস্রোত সম,

ছুটে চারিদিক হতে।

বিক্রমদেব।

চুপ করো মন্ত্রী।

লোকনিন্দা, লোকনিন্দা সদা! নিন্দাভারে

রসনা খসিয়া যাক অলস লোকের।

দিবা যদি গেল, উঠুক না চুপি চুপি

ক্ষুদ্র পঙ্ককুণ্ড হতে দুষ্ট বাষ্পরাশি,

অমার আঁধার তাহে বাড়িবে না কিছু।

লোকনিন্দা!

দেবদত্ত।

মন্ত্রী, পরিপূর্ণ সূর্যপানে

কে পারে তাকাতে। তাই গ্রহণের বেলা

ছুটে আসে যত মর্তলোক, দীননেত্রে

চেয়ে দেখে দুর্দিনের দিনপতি পানে,

আপনার কালিমাখা কাচখণ্ড দিয়ে

কালো দেখে গগনের আলো। মহারানী

মা জননী, এই ছিল অদৃষ্টে তোমার?

তব নাম ধুলায় লুটায়? তব নাম

ফিরে মুখে মুখে? এ কী এ দুর্দিন আজি।

তবু তুমি তেজস্বিনী সতী, এরা সব

পথের কাঙাল।

বিক্রমদেব।

ত্রিবেদী কোথায় গেল?

মন্ত্রী, ডেকে আনো তারে। শোনা হয় নাই

তার সব কথা, ছিনু অন্যমনে।

মন্ত্রী।

যাই

ডেকে আনি তারে।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

বিক্রমদেব।

এখনো সময় আছে,

এখনো ফিরাতে পারি পাইলে সন্ধান।

আবার সন্ধান? এমনি কি চিরদিন

কাটিবে জীবন। সে দিবে না ধরা, আমি

ফিরিব পশ্চাতে? প্রেমের শৃঙ্খল হাতে

রাজ্য রাজকর্ম ফেলে শুধু রমণীর

পলাতক হৃদয়ের সন্ধানে ফিরিব?

পলাও, পলাও নারী, চির দিনরাত

করো পলায়ন; গৃহহীন প্রেমহীন

বিশ্রামবিহীন অনাবৃত প্রিথ্বীমাঝে

কেবল পশ্চাতে লয়ে আপনার ছায়া।

ত্রিবেদীর প্রবেশ

চলে যাও, দূর হও, কে ডাকে তোমারে?

বার বার তার কথা কে চাহে শুনিতে

প্রগল্‌ভ ব্রাহ্মণ, মূর্খ।

ত্রিবেদী।

হে মধুসূদন।

বিক্রমদেব।

শোনো, শোনো, দুটো কথা শুধাবার আছে।

চোখে অশ্রু ছিল?

ত্রিবেদী।

চিন্তা নেই বাপু। অশ্রু

দেখি নাই।

বিক্রমদেব।

মিথ্যা করে বলো। অতি ক্ষুদ্র

সকরুণ দুটি মিথ্যে কথা। হে ব্রাহ্মণ,

বৃদ্ধ তুমি ক্ষীণদৃষ্টি কী করে জানিলে

চোখে তার অশ্রু ছিল কি না? বেশি নয়,

এক বিন্দু জল! নহে তো নয়ন-প্রান্তে

ছল ছল ভাব, কম্পিত কাতর কণ্ঠে

অশ্রুবদ্ধ বাণী? তাও নয়? সত্য বলো,

মিথ্যা বলো। ব'লো না, ব'লো না, চলে যাও।

ত্রিবেদী।

হরি হে তুমিই সত্য।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

বিক্রমদেব।

অন্তর্যামী দেব,

তুমি জান, জীবনের সব অপরাধ

তারে ভালোবাসা; পুণ্য গেল, স্বর্গ গেল,

রাজ্য যায়, অবশেষে সেও চলে গেল।

তবে দাও, ফিরে দাও ক্ষাত্রধর্ম মোর;

রাজধর্ম ফিরে দাও, পুরুষ-হৃদয়

মুক্ত করে দাও এই বিশ্বরঙ্গমাঝে।

কোথা কর্মক্ষেত্র। কোথা জনস্রোত। কোথা

জীবন-মরণ। কোথা সেই মানবের

অবিশ্রাম সুখদুঃখ, বিপদ-সম্পদ,

তরঙ্গ-উচ্ছ্বাস।

মন্ত্রী।

মহারাজ, অশ্বারোহী

পাঠায়েছি চারিদিকে রাজ্ঞীর সন্ধানে।

বিক্রমদেব।

ফিরাও ফিরাও মন্ত্রী। স্বপ্ন ছুটে গেছে,

অশ্বারোহী কোথা তারে পাইবে খুঁজিয়া।

সৈন্যদল করহ প্রস্তুত, যুদ্ধে যাব,

নাশিব বিদ্রোহ।

মন্ত্রী।

যে আদেশ মহারাজ।

[ প্রস্থান

বিক্রমদেব।

দেবদত্ত, কেন নত মুখ, ম্লান দৃষ্টি?

ক্ষুদ্র সান্ত্বনার কথা ব'লো না ব্রাহ্মণ।

আমারে পশ্চাতে ফেলে চলে গেছে চোর,

আপনারে পেয়েছি কুড়ায়ে। আজি সখা,

আনন্দের দিন। এস আলিঙ্গনপাশে।

(আলিঙ্গন করিয়া)

বন্ধু, বন্ধু, মিথ্যা কথা, মিথ্যা এই ভান।

থেকে থেকে বজ্রশেল ছুটিছে বিঁধিছে

মর্মে। এস এস, একবার অশ্রুজল

ফেলি বন্ধুর হৃদয়ে। মেঘ যাক কেটে।

২৮। ১। ৪০ শান্তিনিকেতন
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6