প্রাসাদ-কুঞ্জ
সুরঙ্গমা।
প্রভু একটা কথা আছে।
নেপথ্যে।
কী বলো।
সুরঙ্গমা।
রাজকন্যা সুদর্শনা যে তোমাকেই বরণ করতে চায়, তাকে কি দয়া করবে না?
নেপথ্যে।
সে কি আমাকে চেনে?
সুরঙ্গমা।
না প্রভু, সে তোমাকে চিনতে চায়। তুমি তাকে নিজেই চিনিয়ে দেবে, নইলে তার সাধ্য কী।
নেপথ্যে।
অনেক বাধা আছে।
সুরঙ্গমা।
তাই তো তাকে কৃপা করতে হবে।
নেপথ্যে।
বহু দুঃখে যে আবরণ দূর হয়।
সুরঙ্গমা।
সেই দুঃখই তাকে দিয়ো, তাকে দিয়ো।
নেপথ্যে।
আমার নাম নিয়ে সকলের চেয়ে বড়ো হবে, এই অহংকারে সে আমাকে চায়।
সুরঙ্গমা।
এই সুযোগে তার অহংকার দাও ভেঙে। সকলের নিচে নামিয়ে তোমার পায়ের কাছে নিয়ে এস তাকে।
নেপথ্যে।
সুদর্শনাকে ব'লো, আমি তাকে গ্রহণ করব অন্ধকারে।
সুরঙ্গমা।
বাঁশি বাজবে না, আলো জ্বলবে না, সমারোহ হবে না?
নেপথ্যে।
না।
সুরঙ্গমা।
বরণডালায় সে কি ফুলের মালা তোমাকে দেবে না?
নেপথ্যে।
সে ফুল এখনও ফোটে নি।
সুরঙ্গমা।
সে-ই ভালো মহারাজ। অন্ধকারেই বীজ থাকে, অঙ্কুরিত হলে আপনিই আসে আলোয়
বাহির হতে আহ্বান।
সুরঙ্গমা।
সুরঙ্গমা।
ওই আসছেন রাজকুমারী সুদর্শনা।
সুদর্শনার প্রবেশ
সুদর্শনার প্রবেশ
সুদর্শনা।
তোমার এখানে আকাশে যেন অর্ঘ্য সাজানো, যেন শিশির-ধোওয়া সকালবেলার স্পর্শ। তুমি এখানকার বাতাসে কী ছিটিয়ে দিয়েছ বলো দেখি।
সুরঙ্গমা।
সুর ছিটিয়েছি।
সুদর্শনা।
আমাকে সেই রাজাধিরাজের কথা বলো সুরঙ্গমা, আমি শুনি।
সুরঙ্গমা।
মুখের কথায় বলে উঠতে পারি নে।
সুদর্শনা।
বলো, তিনি কি খুব সুন্দর?
সুরঙ্গমা।
সুন্দর? একদিন সুন্দরকে নিয়ে খেলতে গিয়েছিলুম, খেলা ভাঙল যেদিন, বুক ফেটে গেল, সেইদিন বুঝলুম সুন্দর কাকে বলে। একদিন তাকে ভয়ংকর ব'লে ভয় পেয়েছি, আজ তাকে ভয়ংকর ব'লে আনন্দ করি -- তাকে বলি তুমি ঝড়, তাকে বলি তুমি দুঃখ, তাকে বলি তুমি মরণ, সব শেষে বলি -- তুমি আনন্দ।
গান
আমি যখন ছিলেম অন্ধ,
সুখের খেলায় বেলা গেছে পাই নি তো আনন্দ।
খেলা ঘরের দেয়াল গেঁথে
খেয়াল নিয়ে ছিলেম মেতে,
ভিত ভেঙে যেই আসলে ঘরে
ঘুচল আমার বন্ধ,
সুখের খেলা আর রোচে না
পেয়েছি আনন্দ॥
ভীষণ আমার, রুদ্র আমার,
নিদ্রা গেল ক্ষুদ্র আমার,
উগ্র ব্যথায় নূতন ক'রে
বাঁধলে আমার ছন্দ।
যেদিন তুমি অগ্নিবেশে
সব-কিছু মোর নিলে এসে,
সেদিন আমি পূর্ণ হলেম ঘুচল আমার দ্বন্দ্ব,
দুঃখ সুখের পারে তোমায় পেয়েছি আনন্দ॥
সুদর্শনা।
প্রথমটা তুমি তাঁকে চিনতে পার নি?
সুরঙ্গমা।
না।
সুদর্শনা।
কিন্তু দেখো, তাঁকে চিনতে আমার একটুও দেরি হবে না। আমার কাছে তিনি সুন্দর হয়ে দেখা দেবেন।
সুরঙ্গমা।
তার আগে একটা কথা তোমাকে মেনে নিতে হবে।
সুদর্শনা।
নেব, আমার কিছুতে দ্বিধা নেই।
সুরঙ্গমা।
তিনি বলেছেন, অন্ধকারেই তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে।
সুদর্শনা।
চিরদিন?
সুরঙ্গমা।
সে-কথা বলতে পারি নে।
সুদর্শনা।
আচ্ছা, আমি সবই মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আমার কাছে তিনি লুকিয়ে থাকতে পারবেন না। দিন যদি স্থির হয়ে থাকে সবাইকে তো জানাতে হবে।
সুরঙ্গমা।
জানিয়ে কী করবে। সে অন্ধকারে সকলের তো স্থান নেই।
সুদর্শনা।
আমি রাজাধিরাজকে লাভ করেছি সে-কথা কাউকে জানাতে পারব না?
সুরঙ্গমা।
জানাতে পার কিন্তু কেউ বিশ্বাস করবে না।
সুদর্শনা।
এতবড়ো কথাটা বিশ্বাস করবে না, সে কি হয়?
সুরঙ্গমা।
লোক ডেকে প্রমাণ দিতে পারবে না যে।
সুদর্শনা।
পারবই; নিশ্চয় পারব।
সুরঙ্গমা।
আচ্ছা চেষ্টা দেখো।
সুদর্শনা।
সুরঙ্গমা, তোমার মতো আমি অত বেশি নম্র নই, আমি শক্ত আছি। সকলের কাছে তিনি আমাকে স্বীকার করে নেবেন -- এ তিনি এড়াতে পারবেন না।
সুরঙ্গমা।
সে-কথা আজকে ভাববার দরকার নেই রাজকুমারী, তুমি নিজে তাঁকে সম্পূর্ণ স্বীকার করে নিয়ো, তাহলেই সব সহজ হবে?
সুদর্শনা।
ও-কথা কেন বলছ? আমি তো সেইজন্যেই প্রস্তুত হয়ে রয়েছি। আর কিন্তু বিলম্ব করো না।
সুরঙ্গমা।
তাঁর দিকে সমস্তই প্রস্তুত হয়েই আছে। আজ আমরা তবে বিদায় হই।
সুদর্শনা।
কোথায় যাচ্ছ?
সুরঙ্গমা।
বসন্ত-উৎসব কাছে এল, তার আয়োজন করতে হবে।
সুদর্শনা।
কী রকমের আয়োজনটা হওয়া চাই?
সুরঙ্গমা।
মাধবীকুঞ্জকে তো তাড়া দিতে হয় না। আমের বনেও মুকুল আপনি ধরে। আমাদের মানুষের শক্তিতে যার যেটা দেবার সেটা সহজে প্রকাশ হতে চায় না। কিন্তু সেদিন সেটা আবৃত থাকলে চলবে না। কেউ দেবে গান, কেউ দেবে নাচ।
সুদর্শনা।
আমি সেদিন কী দেব সুরঙ্গমা?
সুরঙ্গমা।
সে-কথা তুমিই বলতে পার।
সুদর্শনা।
আমি নিজ হাতে মালা গেঁথে সুন্দরকে অর্ঘ্য পাঠাব।
সুরঙ্গমা।
সে-ই ভালো।
সুদর্শনা।
তাঁকে দেখব কী করে?
সুরঙ্গমা।
সে তিনিই জানেন।
সুদর্শনা।
আমাকে কোথায় যেতে হবে?
সুরঙ্গমা।
কোথাও না, এইখানেই।
সুদর্শনা।
কী বল সুরঙ্গমা, অন্ধকারের সভা এইখানেই? যেখানে চিরদিন আছি এইখানেই? সাজতে হবে না?
সুরঙ্গমা।
নাই বা সাজলে। একদিন তিনিই সাজাবেন যে-সাজে তোমাকে মানায়।
গান
গান
সুদর্শনা।
আমার তো আর একটুও দেরি করতে ইচ্ছে করছে না।
সুরঙ্গমা।
ক'রো না দেরি -- তাঁকে ডাকো, এইখানেই দয়া করবেন।
সুদর্শনা।
সুরঙ্গমা, আমি তো মনে করি যে ডাকছি, সাড়া পাই নে। বোধ হয় ডাকতে জানি নে। তুমি আমার হয়ে ডাকো না -- তোমার কণ্ঠ তিনি চেনেন।
সুরঙ্গমার গান
সুরঙ্গমার গান
ধীরে ধীরে আলো নিবে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল
ধীরে ধীরে আলো নিবে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল
সুদর্শনা।
অন্ধকারে আমি যে কিছুই দেখতে পাচ্ছি নে। তুমি কি এর মধ্যে আছ?
নেপথ্যে।
এই তো আমি আছি।
সুদর্শনা।
আমি তোমাকে বরণ করব, সে কি না দেখেই?
নেপথ্যে।
চোখে দেখতে গেলে ভুল দেখবে -- অন্তরে দেখো মন শুদ্ধ করে।
সুদর্শনা।
ভয়ে যে আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠছে।
নেপথ্যে।
প্রেমের মধ্যে ভয় না থাকলে রস নিবিড় হয় না।
সুদর্শনা।
এই অন্ধকারে তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?
নেপথ্যে।
হাঁ পাচ্ছি।
সুদর্শনা।
কী রকম দেখছ?
নেপথ্যে।
আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার মধ্যে দেহ নিয়েছে যুগযুগান্তরের ধ্যান, লোকলোকান্তরের আলোক, বহু শত শরৎ-বসন্তের ফুল ফল। তুমি বহুপুরাতনের নূতন রূপ।
সুদর্শনা।
বলো বলো এমনি ক'রে বলো। মনে হচ্ছে যেন অনাদিকালের গান জন্মজন্মান্তর থেকে শুনে আসছি। কিন্তু প্রভু, এ যে কঠিন কালো লোহার মতো অন্ধকার, এ যে আমর উপর চেপে আছে ঘুমের মতো, মূর্ছার মতো, মৃত্যুর মতো। এ জায়গায় তোমাতে আমাতে মিল হবে কেমন ক'রে? না না, হবে না মিলন, হবে না। এখানে নয়, চোখের দেখার জগতেই তোমাকে দেখব -- সেইখানেই যে আমি আছি।
নেপথ্যে।
আচ্ছা দেখো। তোমাকে নিজে চিনে নিতে হবে।
সুদর্শনা।
চিনে নেব, লক্ষ লোকের মধ্যে চিনে নেব, ভুল হবে না।
নেপথ্যে।
বসন্ত-পূর্ণিমার উৎসবে সকল লোকের মধ্যে আমাকে দেখবার চেষ্টা ক'রো। সুরঙ্গমা।
সুরঙ্গমা।
কী প্রভু।
নেপথ্যে।
বসন্ত-পূর্ণিমার উৎসব তো এল।
সুরঙ্গমা।
আমাকে কী কাজ করতে হবে?
নেপথ্যে।
আজ তোমার কাজের দিন নয়, সাজের দিন। পুষ্পবনের আনন্দে মিলিয়ে দিয়ো প্রাণের আনন্দ।
সুরঙ্গমা।
তাই হবে প্রভু।
নেপথ্যে।
সুদর্শনা আমাকে চোখে দেখতে চান।
সুরঙ্গমা।
কোথায় দেখবেন?
নেপথ্যে।
যেখানে পঞ্চমে বাঁশি বাজবে, পুষ্পকেশরের ফাগ উড়বে, আলোয় ছায়ায় হবে গলাগলি সেই দক্ষিণের কুঞ্জবনে।
সুরঙ্গমা।
চোখে ধাঁধা লাগবে না?
নেপথ্যে।
সুদর্শনার কৌতূহল হয়েছে।
সুরঙ্গমা।
কৌতূহলের জিনিস তো পথে ঘাটে ছড়াছড়ি। তুমি যে কৌতূহলের অতীত
গান
কোথা বাইরে দূরে যায় রে উড়ে, হায় রে হায়,
তোমার চপল আঁখি বনেরপাখি বনে পালায়॥
ওগো হৃদয়ে যবে মোহন রবে বাজবে বাঁশি,
তখন আপনি সেধে ফিরবে কেঁদে পরবে ফাঁসি,
তখন ঘুচবে ত্বরা ঘুরিয়া মরা হেথা হোথায় --
আহা আজি সে আঁখি বনের পাখি বনে পালায়॥
চেয়ে দেখিস না রে হৃদয়-দ্বারে কে আসে যায়,
তোরা শুনিস কানে বারতা আনে দখিন বায়।
আজি ফুলের বাসে সুখের হাসে আকুল গানে
চির বসন্ত যে তোমারি খোঁজে এসেছে প্রাণে,
তারে বাহিরে খুঁজি' ফিরিছ বুঝি পাগল প্রায়,
আহা আজি সে আঁখি বনের পাখি বনে পালায়॥
[ উভয়ের প্রস্থান
[ উভয়ের প্রস্থান