কুঞ্জ-বাতায়ন
সুরঙ্গমা।
সুরঙ্গমার গান
বাহিরে ভুল হানবে যখন
অন্তরে ভুল ভাঙবে কি?
বিষাদ-বিষে জ্বলে শেষে
তোমার প্রসাদ মাঙবে কি?
রৌদ্রদাহ হলে সারা
নামবে কি ওর বর্ষাধারা?
লাজের রাঙা মিটলে, হৃদয়
প্রেমের রঙে রাঙবে কি?
যতই যাবে দূরের পানে
বাঁধন ততই কঠিন হয়ে
টানবে না কি ব্যথার টানে?
অভিমানের কালো মেঘে
বাদল হাওয়া লাগবে বেগে,
নয়নজলের আবেগ তখন
কোনোই বাধা মানবে কি?
সুদর্শনার প্রবেশ
সুদর্শনার প্রবেশ
সুদর্শনা।
সুরঙ্গমা, ভুল তোরা করতে পারিস, কিন্তু আমার কখনোই ভুল হতে পারে না। আমি হব রানী। ওই তো আমার রাজাই বটে।
সুরঙ্গমা।
কাকে তুমি রাজা বলছ?
সুদর্শনা।
ওই যার মাথায় ফুলের ছাতা ধরে আছে।
সুরঙ্গমা।
ওই যাঁর পতাকায় কিংশুক আঁকা?
সুদর্শনা।
আমি তো দেখবামাত্রই চিনেছি, তোর মনে কেন সন্দেহ আসছে।
সুরঙ্গমা।
ও তোমার রাজা নয়। আমি যে ওকে চিনি।
সুদর্শনা।
ও কে?
সুরঙ্গমা।
ও সুবর্ণ। ও জুয়ো খেলে বেড়ায়।
সুদর্শনা।
মিথ্যে কথা বলিস নে। সবাই ওকে রাজা বলছে। তুই বুঝি সকলের চেয়ে বেশি জানিস।
সুরঙ্গমা।
ও যে সবাইকে মিথ্যে লোভ দেখাচ্ছে, সেইজন্যে সবাই ওর বশ হয়েছে। যখন ভুল ভাঙবে তখন হায় হয়ে করে মরবে।
সুদর্শনা।
তোর বড়ো অহংকার হয়েছে। তুই আমার চেয়ে চিনিস?
সুরঙ্গমা।
যদি আমার অহংকার থাকত, তাহলে আমি চিনতে পারতুম না।
সদর্শনা।
আমি ওকেই মালা পাঠিয়ে দিয়েছি।
সুরঙ্গমা।
সে মালা সাপ হয়ে তোমাকে এসে দংশন করবে।
সুদর্শনা।
আমাকে অভিসম্পাত? তোর তো আস্পর্ধা কম নয়। যা এখান থেকে চলে, আমি তোর মুখ দেখব না
[সুরঙ্গমার প্রস্থান
আমার মন আজ এমনই চঞ্চল হয়েছে। এমন তো কোনোদিন হয় না। সুরঙ্গমা।
সুরঙ্গমার প্রবেশ
সুরঙ্গমার প্রবেশ
সুদর্শনা।
আমার মালা কি ভুল পথেই গেছে?
সুরঙ্গমা।
হাঁ।
সুদর্শনা।
আবার সেই একই কথা? আচ্ছা বেশ, ভুল করেছি, বেশ করেছি। তিনি কেন নিজে দেখা দিয়ে ভুল ভাঙিয়ে দেন না? কিন্তু তোর কথা মানব না। যা আমার কাছ থেকে -- মিছিমিছি আমার মনে ধাঁধাঁ লাগিয়ে দিস নে।
[সুরঙ্গমার প্রস্থান
ভগবান চন্দ্রমা, আজ আমার চঞ্চলতার উপরে তুমি কেবলই কটাক্ষপাত করছ। স্মিত কৌতুকে সমস্ত আকাশ ভরে গেল যে। প্রতিহারী।
প্রতিহারীর প্রবেশ
প্রতিহারীর প্রবেশ
প্রতিহারী।
কী রাজকুমারী।
সুদর্শনা।
ওই যে আম্রবনবীথিকায় উৎসববালকেরা গান গেয়ে যাচ্ছে, ডাক ডাক ওদের ডেকে নিয়ে আয়। একটু গান শুনি
[প্রতিহারীর প্রস্থান
বালকগণের প্রবেশ
এস এস সব মূর্তিমান কিশোর বসন্ত, ধরো তোমাদের গান। আমার সমস্ত দেহমন গান গাইছে, কণ্ঠে আসছে না। আমার হয়ে তোমরা গাও।
বালকগণের গান
কার হাতে এই মালা তোমার পাঠালে
আজ ফাগুনদিনের সকালে।
তার বর্ণে তোমার নামের রেখা,
গন্ধে তোমার ছন্দ লেখা,
সেই মালাটি বেঁধেছি মোর কপালে
আজ ফাগুনদিনের সকালে॥
গানটি তোমার চলে এল আকাশে
আজ ফাগুন দিনের বাতাসে।
ওগো আমার নামটি তোমার সুরে
কেমন করে দিলে জুড়ে,
লুকিয়ে তুমি ঐ গানেরি আড়ালে,
আজ ফাগুনদিনের সকালে॥
সুদর্শনা।
হয়েছে হয়েছে, আর না। তোমাদের এই গান শুনে চোখে জল ভরে আসছে -- আমার মনে হচ্ছে যা পাবার জিনিস তাকে হাতে পাবার জো নেই -- তাকে হাতে পাবার দরকার নেই।
[প্রণাম করিয়া বালকগণের প্রস্থান
[প্রণাম করিয়া বালকগণের প্রস্থান
কুঞ্জদ্বার
কুঞ্জদ্বার
ঠাকুরদা ও দেশী পথিকদের প্রবেশ
ঠাকুরদা ও দেশী পথিকদের প্রবেশ
ঠাকুরদা।
কী ভাই, হল তোমাদের?
কৌণ্ডিল্য।
খুব হল ঠাকুরদা। এই দেখো না একেবারে লালে লাল করে দিয়েছে। কেউ বাকি নেই।
ঠাকুরদা।
বলিস কী? রাজাগুলোকে সুদ্ধ রাঙিয়েছে না কি?
জনার্দন।
ওরে বাস রে! কাছে ঘেঁষে কে! তারা সব বেড়ার মধ্যে খাড়া হয়ে রইল।
ঠাকুরদা।
হায় হয়ে বড়ো ফাঁকিতে পড়েছে। একটুও রং ধরাতে পারলি নে? জোর করে ঢুকে পড়তে হয়।
কুম্ভ।
ও দাদা, তাদের রাঙা সে আর-এক রঙের। তাদের চক্ষু রাঙা, তাদের পাইকগুলোর পাগড়ি রাঙা, তার উপরে খোলা তলোয়ারের যে রকম ভঙ্গি দেখলুম একটু কাছে ঘেঁষলেই একেবারে চরম রাঙা রাঙিয়ে দিত।
ঠাকুরদা।
বেশ করেছিস ঘেঁষিস নি। পৃথিবীতে ওদের নির্বাসনদণ্ড -- ওদের তফাতে রেখেই চলতে হবে।
বাউলের প্রবেশ ও গান
যা ছিল কালো ধলো
তোমার রঙে রঙে রাঙা হল।
যেমন রাঙাবরন তোমার চরণ
তার সনে আর ভেদ না র'ল॥
রাঙা হল বসন ভূষণ,
রাঙা হল শয়ন স্বপন,
মন হল কেমন দেখ রে যেমন
রাঙা কমল টলমল!
ঠাকুরদা।
বেশ ভাই বেশ -- খুব খেলা জমেছিল?
বাউল।
খুব খুব। সব লালে লাল। কেবল আকাশের চাঁদটাই ফাঁকি দিয়েছে -- সাদাই রয়ে গেল।
ঠাকুরদা।
বাইরে থেকে দেখাচ্ছে যেন বড়ো ভালোমানুষ। ওর সাদা চাদরটা খুলে দেখতিস যদি তাহলে ওর বিদ্যে ধরা পড়ত। চুপি চুপি ও যে আজ কত রং ছড়িয়েছে এখানে দাঁড়িয়ে সব দেখেছি। অথচ ও নিজে কি এমনি সাদাই থেকে যাবে?
গান
গান
[সকলের প্রস্থান।
[সকলের প্রস্থান।
সুবর্ণ ও রাজা বিক্রমবাহুর প্রবেশ
সুবর্ণ ও রাজা বিক্রমবাহুর প্রবেশ
সুবর্ণ।
এ কী কাণ্ড করেছ রাজা বিক্রমবাহু?
বিক্রম।
আমি কেবল এই প্রাসাদের কাছটাতেই আগুন ধরাতে চেয়েছিলুম, সে আগুন যে এত শীঘ্র এমন চারিদিকে ধরে উঠবে সে আমি মনেও করি নি। এ বাগান থেকে বেরোবার পথ কোথায় শীঘ্র বলে দাও।
সুবর্ণ।
পথ কোথায় আমি তো কিছুই জানি নে। যারা আমাদের এখানে এনেছিল তাদের একজনকেও দেখছি নে।
বিক্রম।
তুমি তো এদেশেরই লোক -- পথ নিশ্চয় জান।
সুবর্ণ।
অন্তঃপুরের বাগানে কোনোদিনই প্রবেশ করি নি।
বিক্রম।
সে আমি বুঝি নে, তোমাকে পথ বলতেই হবে, নইলে তোমাকে দু-টুকরো করে কেটে ফেলব।
সুবর্ণ।
তাতে প্রাণ বেরোবে, পথ বেরোবার কোনো উপায় হবে না।
বিক্রম।
তবে কেন বলে বেড়াচ্ছিলে তুমিই এখানকার রাজা?
সুবর্ণ।
আমি রাজা না, রাজা না। (মাটিতে পড়িয়া জোড় করে) কোথায় আমার রাজা, রক্ষা করো। আমি পাপিষ্ঠ, আমাকে রক্ষা করো। আমি বিদ্রোহী, আমাকে দণ্ড দাও, কিন্তু রক্ষা করো।
বিক্রম।
অমন শূন্যতার কাছে চীৎকরে করে লাভ কী? ততক্ষণ পথ বের করবার চেষ্টা করা যাক।
সুবর্ণ।
আমি এইখানেই পড়ে রইলুম -- আমার যা হবার তাই হবে।
বিক্রম।
সে হবে না। পুড়ে মরি তো একলা মরব না -- তোমাকে সঙ্গী নেব।
নেপথ্যে হইতে।
রক্ষা করো, রক্ষা করো। চারিদিকে আগুন।
বিক্রম।
মূঢ় ওঠো, আর দেরি না।
সুদর্শনার প্রবেশ
সুদর্শনার প্রবেশ
সুদর্শনা।
রাজা, রক্ষা করো। আগুনে ঘিরেছে।
সুবর্ণ।
কোথায় রাজা? আমি রাজা নই।
সুদর্শনা।
তুমি রাজা নও?
সুবর্ণ।
আমি ভণ্ড আমি পাষণ্ড! (মুকুট মাটিতে ফেলিয়া) আমার ছলনা ধূলিসাৎ হ'ক
[রাজা বিক্রমের সহিত প্রস্থান
[রাজা বিক্রমের সহিত প্রস্থান
সুদর্শনা।
রাজা নয়? এ রাজা নয়? তবে ভগবান হুতাশন, দগ্ধ করো আমাকে; আমি তোমারই হাতে আত্মসমর্পণ করব।
নেপথ্যে।
ওদিকে কোথায় যাও। তোমার অন্তঃপুরের চারিদিকে আগুন ধরে গেছে, ওর মধ্যে প্রবেশ ক'রো না।
সুরঙ্গমার প্রবেশ
সুরঙ্গমার প্রবেশ
সুরঙ্গমা।
এস।
সুদর্শনা।
কোথায় যাব?
সুরঙ্গমা।
ওই আগুনের ভিতর দিয়েই চলো।
সুদর্শনা।
সে কী কথা?
সুরঙ্গমা।
আগুনকে বিশ্বাস করো, যাকে বিশ্বাস করেছিলে, এ তার চেয়ে ভালো।
সুদর্শনা।
রাজা কোথায়?
সুরঙ্গমা।
রাজাই আছেন ওই আগুনের মধ্যে। তিনি সোনাকে পুড়িয়ে নেবেন।
সুদর্শনা।
সত্যি বলছিস?
সুরঙ্গমা।
আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি, আগুনের ভিতরকার রাস্তা জানি।
[উভয়ের প্রস্থান
[উভয়ের প্রস্থান
গানের দলের প্রবেশ
গানের দলের প্রবেশ
।
গান
আগুনে হল আগুনময়।
জয় আগুনের জয়।
মিথ্যা যত হৃদয় জুড়ে
এইবেলা সব যাক না পুড়ে',
মরণ-মাঝে তোর জীবনের হ'ক রে পরিচয়॥
আগুন এবার চলল রে সন্ধানে
কলঙ্ক তোর লুকিয়ে কোথায় প্রাণে।
আড়াল তোমার যাক না ঘুচে,
লজ্জা তোমার যাক রে মুছে,
চিরদিনের মতো তোমার ছাই হয়ে যাক ভয়॥
[গানের দলের প্রস্থান
[গানের দলের প্রস্থান
সুদর্শনা ও সুরঙ্গমার পুনঃপ্রবেশ
সুদর্শনা ও সুরঙ্গমার পুনঃপ্রবেশ
সুরঙ্গমা।
ভয় নেই, তোমার ভয় নেই।
সুদর্শনা।
ভয় আমার নেই -- কিন্তু লজ্জা! লজ্জা যে আগুনের মতো আমার সঙ্গে সঙ্গে এসেছে। আমার মুখ চোখ, আমার সমস্ত হৃদয়টাকে রাঙা করে রেখেছে।
সুরঙ্গমা।
এ দাহ মিটতে সময় লাগবে।
সুদর্শনা।
কোনোদিন মিটবে না, কোনোদিন মিটবে না।
সুরঙ্গমা।
হতাশ হ'য়ো না। তোমার সাধ তো মিটেছে, আগুনের মধ্যেই তো আজ দেখে নিলে।
সুদর্শনা।
আমি কি এমন সর্বনাশের মধ্যে দেখতে চেয়েছিলুম? কী দেখলুম জানি নে, কিন্তু বুকের মধ্যে এখনও কাঁপছে।
সুরঙ্গমা।
কেমন দেখলে?
সুদর্শনা।
ভয়ানক, সে ভয়ানক। সে আমার স্মরণ করতেও ভয় হয়। কালো, কালো। আমার মনে হল ধূমকেতু যে আকাশে উঠেছে সেই আকাশের মতো কালো -- ঝড়ের মেঘের মতো কালো -- কূলশূন্য সমুদ্রের মতো কালো
[প্রস্থান
[প্রস্থান
সুরঙ্গমা।
যে কালো দেখে আজ তোমার বুক কেঁপে গেছে সেই কালোতেই এক দিন তোমার হৃদয় স্নিগ্ধ হয়ে যাবে। নইলে ভালোবাসা কিসের?
গান
আমি রূপে তোমায় ভোলাব না,
ভালোবাসায় ভোলাব।
আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো
গান দিয়ে দ্বার খোলাব॥
ভরাব না ভূষণভারে,
সাজাব না ফুলের হারে,
প্রেমকে আমার মালা করে
গলায় তোমার দোলাব॥
জানবে না কেউ কোন্ তুফানে
তরঙ্গদল নাচবে প্রাণে,
চাঁদের মতো অলখ টানে
জোয়ারে ঢেউ তোলাব॥
সুদর্শনার পুনঃ প্রবেশ
সুদর্শনার পুনঃ প্রবেশ
সুদর্শনা।
কিন্তু কেন সে আমাকে জোর করে পথ আটকায় না? কেশের গুচ্ছ ধরে কেন সে আমাকে টেনে রেখে দেয় না? আমাকে কিছু সে বলছে না, সেই জন্যেই আরও অসহ্য বোধ হচ্ছে।
সুরঙ্গমা।
রাজা কিছু বলছে না, কে তোমাকে বললে?
সুদর্শনা।
অমন করে নয়, চীৎকার করে বজ্রগর্জনে -- আমার কান থেকে অন্য সকল কথা ডুবিয়ে দিয়ে। রাজা, আমাকে এত সহজে ছেড়ে দিয়ো না, যেতে দিয়ো না।
সুরঙ্গমা।
ছেড়ে দেবেন, কিন্তু যেতে দেবেন কেন?
সুদর্শনা।
যেতে দেবেন না? আমি যাবই।
সুরঙ্গমা।
আচ্ছা যাও।
সুদর্শনা।
আমার দোষ নেই। আমাকে জোর করে তিনি ধরে রাখতে পারতেন কিন্তু রাখলেন না। আমাকে বাঁধলেন না -- আমি চললুম। এইবার তাঁর প্রহরীদের হুকুম দিন, আমাকে ঠেকাক।
সুরঙ্গমা।
কেউ ঠেকাবে না। ঝড়ের মুখে ছিন্ন মেঘ যেমন অবাধে চলে তেমনি তুমি অবাধে চলে যাও।
সুদর্শনা।
ক্রমেই বেগ বেড়ে উঠছে -- এবার নোঙর ছিঁড়ল। হয়তো ডুবব কিন্তু আর ফিরব না
[দ্রুত প্রস্থান
[দ্রুত প্রস্থান