রাজপথ
নাগরিকদলের প্রবেশ
নাগরিকদলের প্রবেশ
প্রথম।
এটি ঘটালেন আমাদের রাজকন্যা সুদর্শনা।
দ্বিতীয়।
সকল সর্বনাশের মূলেই স্ত্রীলোক আছে। বেদেই তো আছে,-- কী আছে বলো না হে বটুকেশ্বর। তুমি বামুনের ছেলে।
তৃতীয়।
আছে আছে বই কি। বেদে যা খুঁজবে তাই পাওয়া যাবে -- অষ্টাবক্র বলেছেন, নারীণাঞ্চনখিনাঞ্চশৃঙ্গিণাং শস্ত্রপাণিনাং--অর্থাৎ কিনা --
দ্বিতীয়।
আরে বুঝেছি বুঝেছি -- আমি থাকি তর্করত্নপাড়ায়,-- অনুস্বার -বিসর্গের একটা ফোঁটা আমার কাছে এড়াবার জো নেই
প্রথম।
আমাদের এ হল যেন কলির রামায়ণ। কোথা থেকে ঘরে ঢুকে পড়ল দশমুণ্ড রাবণ, আচমকা লঙ্কা কাণ্ড বাধিয়ে দিল।
তৃতীয়।
যুদ্ধের হাওয়া তো চলছে, এদিকে রাজকন্যা যে কোথায় অদর্শন হয়েছেন কেউ খোঁজ পায় না। মহারাজ তো বন্দী, এদিকে কে যে লড়াই চালাচ্ছে তারও কোনো ঠিকানা নেই।
দ্বিতীয়।
কিন্তু আমি ভাবছি, এখন আমাদের উপায় কী? আমাদের ছিল এক রাজা এখন সাতটা হতে চলল, বেদে পুরাণে কোথাও তো এর তুলনা মেলে না।
প্রথম।
মেলে বই কি -- পঞ্চপাণ্ডবের কথা ভেবে দেখো।
তৃতীয়।
আরে সে হল পঞ্চপতি --
প্রথম।
একই কথা। তারা হল পতি, এরা হল নৃপতি। কোনোটারই বাড়াবাড়ি সুবিধে নয়।
তৃতীয়।
আমাদের পাঁচকড়ি একেবারে বেদব্যাস হয়ে উঠল হে -- রামায়ণ মহাভারত ছাড়া কথাই কয় না।
দ্বিতীয়।
তোরা তো রামায়ণ মহাভারত নিয়ে পথের মধ্যে আসর জমিয়েছিস, এদিকে আমাদের নিজের কুরুক্ষেত্রে কী ঘটছে খবর কেউ রাখিস নে।
প্রথম।
ওরে বাবা -- সেখানে যাবে কে? খবর যখন আসবে তখন ঘাড়ের উপর এসে আপনি পড়বে -- জানতে বাকি থাকবে না।
দ্বিতীয়।
ভয় কিসের রে?
প্রথম।
তা তো সত্যি। তুমি যাও না।
তৃতীয়।
আচ্ছা, চলো না ধনঞ্জয়ের ওখানে। সে সব খবর জানে।
দ্বিতীয়।
না জানলেও বানিয়ে দিতে জানে
[সকলের প্রস্থান
[সকলের প্রস্থান
সুদর্শনা ও সুরঙ্গমার প্রবেশ
সুদর্শনা ও সুরঙ্গমার প্রবেশ
সুদর্শনা।
একদিন আমাকে সকলে সৌভাগ্যবতী বলত, আমি যেখানে যেতুম সেখানেই ঐশ্বর্যের আলো জ্বলে উঠত। আজ আমি এ কী অকল্যাণ সঙ্গে করে এনেছি। তাই আমি ঘর ছেড়ে পথে এলুম।
সুরঙ্গমা।
মা, যতক্ষণ না সেই রাজার ঘরে পৌঁছোবে ততক্ষণ তো পথই বন্ধু।
সুদর্শনা।
চুপ কর, চুপ কর, তার কথা আর বলিস নে।
সুরঙ্গমা।
তুমি যে তাঁর কাছেই ফিরে যাচ্ছ।
সুদর্শনা।
কখনোই না
সুরঙ্গমা।
কার উপরে রাগ করছ মা!
সুদর্শনা।
আমি তার নাম করতেও চাই নে।
সুরঙ্গমা।
আচ্ছা, নাম ক'রো না, তাঁর সবুর সইবে।
সুদর্শনা।
আমি পথে বেরোলুম, সঙ্গে সে এল না?
সুরঙ্গমা।
সমস্ত পথ জুড়ে আছেন তিনি।
সুদর্শনা।
একবার বারণও করলে না? চুপ করে রইলি যে? বল না, তোর রাজার এ কী রকম ব্যবহার?
সুরঙ্গমা।
সে তো সবাই জানে, আমার রাজা নিষ্ঠুর। তাঁকে কি কেউ কোনোদিন টলাতে পারে?
সুদর্শনা।
তবে তুই এমন দিনরাত ডাকিস কেন?
সুরঙ্গমা।
সে যেন এমনি পর্বতের মতোই চিরদিন কঠিন থাকে। আমার দুঃখ আমার থাক, সেই কঠিনেরই জয় হ'ক
[সুদর্শনার প্রস্থান
[সুদর্শনার প্রস্থান
।
সুরঙ্গমার গান
ওগো আমার প্রাণের ঠাকুর,
তোমার প্রেম তোমারে এমন করে
করেছে নিষ্ঠুর।
তুমি বসে থাকতে দেবে না যে,
দিবানিশি তাই তো বাজে
পরান মাঝে এমন কঠিন সুর॥
ওগো আমার প্রাণের ঠাকুর,
তোমার লাগি' দুঃখ আমার
হয় যেন মধুর।
তোমার খোঁজা খোঁজায় মোরে,
তোমার বেদন কাঁদায় ওরে,
আরাম যত করে কোথায় দূর।
[সুরঙ্গমার প্রস্থান
[সুরঙ্গমার প্রস্থান
রাজা বিক্রম ও সুবর্ণের প্রবেশ
রাজা বিক্রম ও সুবর্ণের প্রবেশ
বিক্রম।
কে যে বললে সুদর্শনা এই পথ দিয়ে পালিয়েছে। যুদ্ধে তার বাপকে বন্দী করা মিথ্যে হবে যদি সে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়।
সুবর্ণ।
পালিয়ে যদি গিয়ে থাকে, তাহলে তো বিপদ কেটে গেছে। এখন ক্ষান্ত হ'ন।
বিক্রম।
কেন বলো তো?
সুবর্ণ।
দুঃসাহসিকতা হচ্ছে।
বিক্রম।
তাই যদি না হবে, তবে কাজে প্রবৃত্ত হয়ে সুখ কী?
সুবর্ণ।
কান্তিকরাজকে ভয় না করলেও চলে কিন্তু --
বিক্রম।
ওই কিন্তুটাকে ভয় করতে শুরু করলে জগতে টেকা দায় হয়।
সুবর্ণ।
মহারাজ, ওই কিন্তুটাকে না হয় মন থেকে উড়িয়ে দিলেন, কিন্তু ও যে বাইরে থেকেই হঠাৎ উড়ে এসে দেখা দেয়। ভেবে দেখুন না, বাগানে কী কাণ্ডটা হল। খুব করেই আটঘাট বেঁধেছিলেন, তার মধ্যে কোথা থেকে অগ্নিমূর্তি ধরে ঢুকে পড়ল একটা কিন্তু।
বসুসেন ও বিজয়বর্মার প্রবেশ
বসুসেন ও বিজয়বর্মার প্রবেশ
বসুসেন।
অন্তঃপুরে ঘুরে এলুম কোথাও তো তাকে পাওয়া গেল না। দৈবজ্ঞ যে বলেছিল, আমাদের যাত্রা শুভ, সেটা বুঝি মিথ্যা হল।
বিজয়।
পাওয়ার চেয়ে না পাওয়াতেই হয়তো শুভ, কে বলতে পারে?
বিক্রম।
এ কী উদাসীনের মতো কথা বলছ।
বসুসেন।
এ কী। ভূমিকম্প না কি।
বিক্রম।
ভূমিই কাঁপছে বটে, কিন্তু তাই বলে পা কাঁপতে দেওয়া হবে না।
বসুসেন।
এটা দুর্লক্ষণ।
বিক্রম।
কোনো লক্ষণই দুর্লক্ষণ নয়, যদি সঙ্গে ভয় না থাকে।
বসুসেন।
দৃষ্ট কিছুকে ভয় করি নে কিন্তু অদৃষ্ট পুরুষের সঙ্গে লড়াই চলে না।
বিক্রম।
অদৃষ্ট দৃষ্ট হয়েই আসেন, তখন তাঁর সঙ্গে খুবই লড়াই চলে।
দূতের প্রবেশ
দূতের প্রবেশ
দূত।
মহারাজ। সৈন্যরা প্রায় সকলে পালিয়েছে।
বিক্রম।
কেন?
দূত।
তাদের মধ্যে অকারণে কেমন একটা আতঙ্ক ঢুকে গেল -- কাউকে আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
বিক্রম।
আচ্ছা, তাদের ফিরিয়ে আনছি। যুদ্ধের পর হারা চলে কিন্তু যুদ্ধের আগে হার মানতে পারব না
[বিক্রমবাহু ও দূতের প্রস্থান
[বিক্রমবাহু ও দূতের প্রস্থান
বিজয়।
যার জন্য যুদ্ধ সেও পালায়, যাদের নিয়ে যুদ্ধ তারাও পালায়, এখন আমাদেরই কি পালানো দোষের?
বসুসেন।
মনে ধাঁধাঁ লেগেছে, কিন্তু স্থির করতে পারছি নে।
[উভয়ের প্রস্থান
[উভয়ের প্রস্থান
সুরঙ্গমার প্রবেশ
সুরঙ্গমার প্রবেশ
।
গান
বসন্ত, তোর শেষ করে দে রঙ্গ,
ফুল ফোটাবার খ্যাপামি, তার
উদ্দাম তরঙ্গ॥
উড়িয়ে দেবার, ছড়িয়ে দেবার
মাতন তোমার থামুক এবার,
নীড়ে ফিরে আসুক তোমার
পথহারা বিহঙ্গ॥
সাধের মুকুল কতই পড়ল ঝরে
তারা ধুলা হল, ধুলা দিল ভরে।
প্রখর তাপে জরো-জরো
ফল ফলাবার শাসন ধরো,
হেলাফেলার পালা তোমার
এই বেলা হ'ক ভঙ্গ॥
সুদর্শনার প্রবেশ
সুদর্শনার প্রবেশ
সুদর্শনা।
এ কী হল? ঘুরেফিরে সেই একই জায়গায় এসে পড়ছি। ওই যে গোলমাল শোনা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে আমার চারিদিকেই যুদ্ধ চলছে। ওই যে আকাশ ধুলোয় অন্ধকার। আমি কি এই ঘূর্ণি ধুলোর সঙ্গে সঙ্গেই অনন্তকাল ঘুরে বেড়াব? এর থেকে বেরোই কেমন করে?
সুরঙ্গমা।
তুমি যে কেবল চলে যেতেই চাচ্ছ, ফিরতে চাচ্ছ না,সেই জন্য কোথাও পৌঁছোতে পাচ্ছ না।
সুদর্শনা।
কোথায় ফেরবার কথা তুই বলছিস?
সুরঙ্গমা।
আমাদের রাজার কাছে। আমি বলে রাখছি, যে-পথ তাঁর কাছে না নিয়ে যাবে সে-পথের অন্ত পাবে না কোথাও
সৈনিকের প্রবেশ
সৈনিকের প্রবেশ
সুদর্শনা।
কে তুমি?
সৈনিক।
আমি নগরের রাজপ্রাসাদের দ্বারী।
সুদর্শনা।
শীঘ্র বলো সেখানকার খবর কী।
সৈনিক।
মহারাজ বন্দী হয়েছেন।
সুদর্শনা।
কে বন্দী হয়েছেন?
সৈনিক।
আপনার পিতা।
সুদর্শনা।
আমার পিতা! কার বন্দী হয়েছেন?
সৈনিক।
রাজা বিক্রমবাহুর
[সৈনিকের প্রস্থান
[সৈনিকের প্রস্থান
সুদর্শনা।
রাজা, রাজা, দুঃখ তো আমি সইতে প্রস্তুত হয়েই বেরিয়েছিলেম, কিন্তু আমার দুঃখ চারদিকে ছড়িয়ে দিলে কেন? যে আগুন আমার বাগানে লেগেছিল সেই আগুন কি আমি সঙ্গে করে নিয়ে চলেছি? আমার পিতা তোমার কাছে কী দোষ করেছেন?
সুরঙ্গমা।
আমরা যে কেউ একলা নই। ভালোমন্দ সবাইকেই ভাগ করে নিতে হয়। সেইজন্যেই তো ভয়, একলার জন্যে ভয় কিসের?
সুদর্শনা।
সুরঙ্গমা।
সুরঙ্গমা।
কী রাজকুমারী।
সুদর্শনা।
তোর রাজার যদি রক্ষা করবার শক্তি থাকত, তাহলে আজ তিনি কি নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারতেন?
সুরঙ্গমা।
আমাকে কেন বলছ? আমার রাজার হয়ে উত্তর দেবার শক্তি কি আমার আছে? উত্তর যদি দেন তো নিজেই এমনি করে দেবেন যে কারও কিছু বুঝতে বাকি থাকবে না।
সুদর্শনা।
রাজা, আমার পিতাকে রক্ষা করবার জন্যে যদি তুমি আসতে, তাহলে তোমার যশ বাড়ত বই কমত না
[প্রস্থানোদ্যম
[প্রস্থানোদ্যম
সুরঙ্গমা।
কোথায় যাচ্ছ?
সুদর্শনা।
রাজা বিক্রমের শিবিরে। আমাকে বন্দী করুন তিনি, আমার পিতাকে ছেড়ে দিন। আমি নিজেকে যতদূর নত করতে পারি করব, দেখি কোথায় এসে ঠেকলে তোর রাজার সিংহাসন নড়ে।
[উভয়ের প্রস্থান
[উভয়ের প্রস্থান
বসুসেন ও বিজয়বর্মার প্রবেশ
বসুসেন ও বিজয়বর্মার প্রবেশ
বসুসেন।
যুদ্ধের আরম্ভেই যুদ্ধ শেষ হয়ে আছে, ভাঙা সৈন্য কুড়িয়ে এনে কখনো লড়াই চলে?
বিজয়।
বিক্রমবাহুকে কিছুতেই ফেরাতে পারলুম না।
বসুসেন।
সে আত্মবিনাশের নেশায় উন্মত্ত।
বিজয়।
কিন্তু কে আমাকে বললে, রণক্ষেত্রে সে যেমনি গিয়ে পৌঁছেছে অমনি তার বুকে লেগেছে ঘা। এতক্ষণে তার কী হল কিছুই বলা যায় না।
বসুসেন।
আমার কাছে এইটেই সব চেয়ে অদ্ভুত ঠেকছে যে, আমরা আয়োজন করলুম কতদিন থেকে, সমারোহ হল ঢের, কিন্তু শেষ হবার বেলায় এক পলকেই কী যে হয়ে গেল ভালো বুঝতে পারা গেল না।
বিজয়।
রাত্রির সমস্ত তারা যেমন প্রভাতসূর্যের এক কটাক্ষেই নিবে যায়।
বসুসেন।
এখন চলো।
বিজয়।
কোথায়?
বসুসেন।
ধরা দিতে।
বিজয়।
ধরা দিতে, না পালাতে?
বসুসেন।
পালানোর চেয়ে ধরা দেওয়া সহজ হবে।
[উভয়ের প্রস্থান
[উভয়ের প্রস্থান
সুরঙ্গমার প্রবেশ
সুরঙ্গমার প্রবেশ
।
গান
এখনো গেল না আঁধার,
এখনো রহিল বাধা।
এখনো মরণ-ব্রত
জীবনে হল না সাধা।
কবে যে দুঃখজ্বালা
হবে রে বিজয়মালা,
ঝলিবে অরুণরাগে
নিশীথরাতের কাঁদা।
এখনো নিজেরি ছায়া
রচিছে কত যে মায়া।
এখনো কেন যে মিছে
চাহিছে কেবলি পিছে,
চকিতে বিজলি আলো
চোখেতে লাগাল ধাঁধাঁ॥
সুদর্শনার প্রবেশ
সুদর্শনার প্রবেশ
সুরঙ্গমা।
এ লজ্জা কাটবে।
সুদর্শনা।
কাটবে বই কি সুরঙ্গমা -- সমস্ত পৃথিবীর কাছে আমার নিচু হবার দিন এসেছে। কিন্তু কই রাজা এখনও কেন আমাকে নিতে আসছেন না? আরও কিসের জন্যে তিনি অপেক্ষা করছেন?
সুরঙ্গমা।
আমি তো বলেছি, আমার রাজা নিষ্ঠুর -- বড়ো নিষ্ঠুর।
সুদর্শনা।
সুরঙ্গমা, তাই যা একবার তাঁর খবর নিয়ে আয় গে।
সুরঙ্গমা।
কোথায় তাঁর খবর নেব তা তো কিছুই জানি নে। ঠাকুরদাকে ডাকতে পাঠিয়েছি -- তিনি এলে হয়তো তাঁর কাছ থেকে সংবাদ পাওয়া যাবে।
সুদর্শনা।
হায় কপাল, লোককে ডেকে ডেকে তাঁর খবর নিতে হবে আমার এমন দশা হয়েছে! -- না না, দুঃখ করব না -- যা হওয়া উচিত ছিল তাই হয়েছে -- ভালোই হয়েছে -- কিছু অন্যায় হয় নি।
ঠাকুরদার প্রবেশ
ঠাকুরদার প্রবেশ
সুদর্শনা।
শুনেছি তুমি আমার রাজার বন্ধু -- আমার প্রণাম গ্রহণ করো, আমাকে আশীর্বাদ করো।
ঠাকুরদা।
কর কী, কর কী। আমি কারও প্রণাম গ্রহণ করি নে। আমার সঙ্গে সকলের হাসির সম্বন্ধ।
সুদর্শনা।
তোমার সেই হাসি দেখিয়ে দাও -- আমাকে সুসংবাদ দিয়ে যাও। বলো আমার রাজা কখন আমাকে নিতে আসবেন?
ঠাকুরদা।
ওই তো বড়ো শক্ত কথা জিজ্ঞাসা করলে। আমার বন্ধুর ভাব-গতিক কিছুই বুঝি নে, তার আর বলব কী। যুদ্ধ তো শেষ হয়ে গেল, তিনি যে কোথায় তার কোনো সন্ধান নেই।
সুদর্শনা।
চলে গিয়েছেন?
ঠাকুরদা।
সাড়াশব্দ তো কিছুই পাই নে।
সুদর্শনা।
চলে গিয়েছেন? তোমার বন্ধু এমনি বন্ধু।
ঠাকুরদা।
সেইজন্যে লোকে তাকে নিন্দেও করে সন্দেহও করে। কিন্তু আমার রাজা তাতে খেয়ালও করে না।
সুদর্শনা।
চলে গেলেন? ওরে, ওরে, কী কঠিন, কী কঠিন। একেবারে পাথর, একেবারে বজ্র। সমস্ত বুক দিয়ে ঠেলেছি -- বুক ফেটে গেল -- কিন্তু নড়ল না। ঠাকুরদা, এমন বন্ধুকে নিয়ে তোমার চলে কী করে?
ঠাকুরদা।
চিনে নিয়েছি যে -- সুখে দুঃখে তাকে চিনে নিয়েছি -- এখন আর সে কাঁদাতে পারে না।
সুদর্শনা।
আমাকেও কি সে চিনতে দেবে না?
ঠাকুরদা।
দেবে বই কি। নইলে এত দুঃখ দিচ্ছে কেন? ভালো করে চিনিয়ে তবে ছাড়বে, সে তো সহজ লোক নয়।
সুদর্শনা।
আচ্ছা আচ্ছা, দেখব তার কতবড়ো নিষ্ঠুরতা। পথের ধারে আমি চুপ করে পড়ে থাকব -- এক পা-ও নড়ব না -- দেখি সে কেমন না আসে।
ঠাকুরদা।
দিদি তোমার বয়স অল্প -- জেদ করে অনেকদিন পড়ে থাকতে পার -- কিন্তু আমার যে এক মুহূর্ত গেলেও লোকসান হয়। পাই না পাই একবার খুঁজতে বেরোব
[ প্রস্থান
[ প্রস্থান
সুদর্শনা।
চাই নে, তাকে চাই নে। সুরঙ্গমা, তোর রাজাকে আমি চাই নে। কিসের জন্যে সে যুদ্ধ করতে এল? আমার জন্যে একেবারেই না? কেবল বীরত্ব দেখাবার জন্যে?
সুরঙ্গমা।
দেখাবার ইচ্ছে তাঁর যদি থাকত তাহলে এমন করে দেখাতেন কারও আর সন্দেহ থাকত না। দেখান আর কই?
সুদর্শনা।
যা যা চলে যা -- তোর কথা অসহ্য বোধ হচ্ছে। এত নত করলে তবু সাধ মিটল না? বিশ্বসুদ্ধ লোকের সামনে এইখানে ফেলে রেখে দিয়ে চলে গেল?
[উভয়ের প্রস্থান
[উভয়ের প্রস্থান
নাগরিক দলের প্রবেশ
নাগরিক দলের প্রবেশ
প্রথম।
ওহে এতগুলো রাজা একত্র হয়ে লড়াই বাধিয়ে দিলে, ভাবলুম খুব তামাশা হবে -- কিন্তু দেখতে দেখতে কী যে হয়ে গেল, বোঝাই গেল না।
দ্বিতীয়।
দেখলে না, ওদের নিজেদের মধ্যে গোলমাল লেগে গেল, কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না।
তৃতীয়।
পরামর্শ ঠিক রইল না যে। কেউ এগোতে চায় কেউ পিছোতে চায় -- কেউ এদিকে যায় কেউ ওদিকে যায়, একে কি আর যুদ্ধ বলে? কিন্তু লড়েছিল রাজা বিক্রমবাহু, সে-কথা বলতেই হবে।
প্রথম।
সে যে হেরেও হারতে চায় না।
দ্বিতীয়।
শেষকালে অস্ত্রটা তার বুকে এসে লাগল।
তৃতীয়।
সে যে পদে পদেই হারছিল, তা যেন টেরও পাচ্ছিল না।
প্রথম।
অন্য রাজারা তো তাকে ফেলে কে কোথায় পালাল, তার ঠিক নেই
[সকলের প্রস্থান
[সকলের প্রস্থান
অন্য দলের প্রবেশ
অন্য দলের প্রবেশ
প্রথম।
শুনেছি বিক্রমবাহু মরে নি।
তৃতীয়।
না, কিন্তু বিক্রমবাহুর বিচারটা কী রকম হল?
দ্বিতীয়।
শুনেছি বিচারকর্তা স্বহস্তে রাজমুকুট পরিয়ে দিয়েছে।
তৃতীয়।
এটা কিন্তু একেবারেই বোঝা গেল না।
দ্বিতীয়।
বিচারটা যেন কেমন বেখাপ রকম শোনাচ্ছে।
প্রথম।
তা তো বটেই। অপরাধ যা কিছু করেছে, সে তো ওই বিক্রমবাহুই।
দ্বিতীয়।
আমি যদি বিচারক হতুম, তাহলে কি আর আস্ত রাখতুম? ওর আর চিহ্ন দেখাই যেত না।
তৃতীয়।
কী জানি,বিচারকর্তাকে দেখি নে, তার বুদ্ধিটাও দেখা যায় না।
প্রথম।
ওদের বুদ্ধি ব'লে কিছু আছে কি! এর মধ্যে সবই মর্জি। কেউ তো বলবার লোক নেই।
দ্বিতীয়।
যা বলিস ভাই, আমাদের হাতে শাসনের ভার যদি পড়ত, তাহলে এর চেয়ে ঢের ভালো করে চালাতে পারতুম।
তৃতীয়।
সে কি একবার করে বলতে
[সকলের প্রস্থান
[সকলের প্রস্থান
ঠাকুরদা ও বিক্রমবাহুর প্রবেশ
ঠাকুরদা ও বিক্রমবাহুর প্রবেশ
ঠাকুরদা।
একী বিক্রমরাজ, তুমি পথে যে।
বিক্রম।
তোমার রাজা আমাকে পথেই বের করেছে।
ঠাকুরদা।
ওই তো তার স্বভাব।
বিক্রম।
তার পরে আর নিজের দেখা নেই।
ঠাকুরদা।
সেও তার এক কৌতুক।
বিক্রম।
কিন্তু আমাকে এমন করে আর কতদিন এড়াবে? যখন কিছুতেই তাকে রাজা বলে মানতেই চাই নি তখন কোথা থেকে কালবৈশাখীর মতো এসে এক মুহূর্তে আমার ধ্বজা পতাকা ভেঙে উড়িয়ে ছারখার করে দিলে আর আজ তার কাছে হার মানবার জন্যে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তার আর দেখাই নেই।
ঠাকুরদা।
তা হ'ক, সে যতবড়ো রাজাই হ'ক হার-মানার কাছে তাকে হার মানতেই হবে। কিন্তু রাজন, রাত্রে বেরিয়েছ যে।
বিক্রম।
ওই লজ্জাটুকু এখনও ছাড়তে পারি নি। রাজা বিক্রম থালায় মুকুট সাজিয়ে তোমার রাজার মন্দির খুঁজে বেড়াচ্ছে, এই যদি দিনের আলোয় লোকে দেখে তাহলে যে তারা হাসবে
ঠাকুরদা।
লোকের ওই দশা বটে। যা দেখে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে যায় তাই দেখেই বাঁদররা হাসে।
বিক্রম।
কিন্তু ঠাকুরদা, তুমিও পথে যে।
ঠাকুরদা।
আমিও সর্বনাশের পথ চেয়ে আছি।
গান
আমার সকল নিয়ে বসে আছি
সর্বনাশের আশায়।
আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি
পথে যে জন ভাসায়॥
বিক্রম।
কিন্তু ঠাকুরদা, যে ধরা দেবে না তার কাছে ধরা দিয়ে লাভ কী বলো।
ঠাকুরদা।
তার কাছে ধরা দিলে এক সঙ্গেই ধরাও দেওয়া হয় ছাড়াও পাওয়া যায়।
যে জন দেয় না দেখা যায় যে দেখে
ভালোবাসে আড়াল থেকে,
আমার মন মজেছে সেই গভীরের
গোপন ভালোবাসায়॥
[উভয়ের প্রস্থান
[উভয়ের প্রস্থান
সুরঙ্গমার প্রবেশ
সুরঙ্গমার প্রবেশ
।
গান
পথের সাথি, নমি বারম্বার।
পথিকজনের লহ নমস্কার॥
ওগো বিদায়, ওগো ক্ষতি
ওগো দিনশেষের পতি,
ভাঙা-বাসার লহ নমস্কার॥
ওগো নব প্রভাতজ্যোতি,
ওগো চিরদিনের গতি,
নব আশার লহ নমস্কার।
জীবনরথের হে সারথি,
আমি নিত্য পথের পথী,
পথে চলার লহ নমস্কার॥
সুদর্শনার প্রবেশ
সুদর্শনার প্রবেশ
সুদর্শনা।
বেঁচেছি, বেঁচেছি সুরঙ্গমা। হার মেনে তবে বেঁচেছি। ওরে বাস রে। কী কঠিন অভিমান। কিছুতেই গলতে চায় না। আমার রাজা কেন আমার কাছে আসতে যাবে -- আমিই তার কাছে যাব, এই কথাটা কোনোমতেই মনকে বলাতে পারছিলুম না। সমস্ত রাতটা পথে পড়ে ধুলোয় লুটিয়ে কেঁদেছি -- দক্ষিনে হাওয়া বুকের বেদনার মতো হু হু করে বয়েছে, আর কৃষ্ণচতুর্দশীর অন্ধকারে বউ-কথা-কও চার পহর রাত কেবলই ডেকেছে -- সে যেন অন্ধকারের কান্না।
সুরঙ্গমা।
আহা কালকের রাতটা মনে হয়েছিল যেন কিছুতেই আর পোহাতে চায় না।
সুদর্শনা।
কিন্তু বললে বিশ্বাস করবি নে, তারই মধ্যে বার বার আমার মনে হচ্ছিল কোথায় যেন তার বীণা বাজছে। যে নিষ্ঠুর, তার কঠিন হাতে কি অমন মিনতির সুর বাজে? বাইরের লোক আমার অসম্মানটাই দেখে গেল -- কিন্তু গোপন রাত্রের সেই সুরটা কেবল আমার হৃদয় ছাড়া আর তো কেউ শুনল না। সে বীণা তুই কি শুনেছিলি সুরঙ্গমা? না, সে আমার স্বপ্ন?
সুরঙ্গমা।
সেই বীণা শুনব বলেই তো তোমার কাছে কাছে আছি। অভিমান-গলানো সুর বাজবে জেনেই কান পেতে পড়েছিলুম।
[উভয়ের প্রস্থান
[উভয়ের প্রস্থান
গানের দলের প্রবেশ
গানের দলের প্রবেশ
।
গান
আমার অভিমানের বদলে আজ
নেব তোমার মালা।
আজ নিশিশেষে শেষ করে দিই
চোখের জলের পালা॥
আমার কঠিন হৃদয়টারে
ফেলে দিলেম পথের ধারে,
তোমার চরণ দেবে তারে মধুর
পরশ পাষাণ-গালা॥
ছিল আমার আঁধারখানি,
তারে তুমিই নিলে টানি,
তোমার প্রেম এল যে আগুন হয়ে
করল তারে আলা।
সেই যে আমার কাছে আমি
ছিল সবার চেয়ে দামি
তারে উজাড় করে সাজিয়ে দিলেম
তোমার বরণডালা॥
[প্রস্থান
[প্রস্থান
সুদর্শনা ও সুরঙ্গমার পুনঃপ্রবেশ
সুদর্শনা ও সুরঙ্গমার পুনঃপ্রবেশ
সুদর্শনা।
তার পণটাই রইল -- পথে বের করলে তবে ছাড়লে। মিলন হলে এই কথাটাই তাকে বলব যে, আমিই এসেছি, তোমার আসার অপেক্ষা করি নি। বলব চোখের জল ফেলতে ফেলতে এসেছি -- কঠিন পথ ভাঙতে ভাঙতে এসেছি। এ গর্ব আমি ছাড়ব না।
সুরঙ্গমা।
কিন্তু সে গর্বও তোমার টিঁকবে না। সে যে তোমারও আগে এসেছিল নইলে তোমাকে বার করে কার সাধ্য।
সুদর্শনা।
তা হয়তো এসেছিল -- আভাস পেয়েছিলুম কিন্তু বিশ্বাস করতে পারি নি। যতক্ষণ অভিমান করে বসে ছিলুম ততক্ষণ মনে হয়েছিল সেও আমাকে ছেড়ে গিয়েছে -- অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে যখনই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম তখনই মনে হল সেও বেরিয়ে এসেছে, রাস্তা থেকেই তাকে পাওয়া শুরু করেছি। এখন আমার মনে আর কোনো ভাবনা নেই। তার জন্যে এত যে দুঃখ এই দুঃখই আমাকে তার সঙ্গ দিচ্ছে -- এত কষ্টের রাস্তা আমার পায়ের তলায় যেন সুরে সুরে বেজে উঠছে -- এ যেন আমার বীণা, আমার দুঃখের বীণা -- এরই বেদনার গানে তিনি এই কঠিন পাথরে এই শুকনো ধুলোয় আপনি বেরিয়ে এসেছেন -- আমার হাত ধরেছেন -- সেই আমার অন্ধকারের মধ্যে যেমন করে হাত ধরতেন -- হঠাৎ চমকে উঠে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত -- এও সেইরকম। কে বললে, তিনি নেই -- সুরঙ্গমা, তুই কি বুঝতে পারছিস নে তিনি লুকিয়ে এসেছেন?
সুরঙ্গমার গান
সুরঙ্গমার গান
সুদর্শনা।
ও কে ও, চেয়ে দেখ্ সুরঙ্গমা, এত রাত্রে এই আঁধারে পথে আরও একজন পথিক বেরিয়েছে যে।
সুরঙ্গমা।
মা, এ যে বিক্রম রাজা দেখছি।
সুদর্শনা।
বিক্রম রাজা?
সুরঙ্গমা।
ভয় ক'রো না।
সুদর্শনা।
ভয়! ভয় কেন করব। ভয়ের দিন আমার আর নেই।
রাজা বিক্রমবাহুর প্রবেশ
রাজা বিক্রমবাহুর প্রবেশ
বিক্রম।
তুমিও চলেছ বুঝি। আমিও এই এক পথেরই পথিক। আমাকে কিছুমাত্র ভয় ক'রো না।
সুদর্শনা।
ভালোই হয়েছে বিক্রমরাজ -- আমরা দুজনে তাঁর কাছে পাশাপাশি চলেছি এ ঠিক হয়েছে। ঘর ছেড়ে বেরোবার মুখেই তোমার সঙ্গে আমার যোগ হয়েছিল -- আজ ঘরে ফেরবার পথে সেই যোগই যে এমন শুভযোগ হয়ে উঠবে তা আগে কে মনে করতে পারত।
বিক্রম।
কিন্তু তুমি যে হেঁটে চলেছ এ তো তোমাকে শোভা পায় না। যদি অনুমতি কর তাহলে এখনই রথ আনিয়ে দিতে পারি।
সুদর্শনা।
না না, অমন কথা ব'লো না -- যে-পথ দিয়ে তাঁর কাছ থেকে দূরে এসেছি, সেই পথের সমস্ত ধুলোটা পা দিয়ে মাড়িয়ে মাড়িয়ে ফিরব তবেই আমার বেরিয়ে আসা সার্থক হবে। রথে করে নিয়ে গেলে আমাকে ফাঁকি দেওয়া হবে।
সুরঙ্গমা।
মহারাজ, তুমিও তো আজ ধুলোয়। এ পথে তো হাতি ঘোড়া রথ কারও দেখি নি।
সুদর্শনা।
যখন প্রাসাদে ছিলুম তখন কেবল সোনারুপোর মধ্যেই পা ফেলেছি -- আজ তাঁর ধুলোর মধ্যে চলে আমার সেই ভাগ্যদোষ খণ্ডিয়ে নেব। আজ আমার সেই ধুলোমাটির রাজার সঙ্গে পদে পদে এই ধুলোমাটিতে মিলন হচ্ছে, এ সুখের খবর কে জানত।
সুরঙ্গমা।
ওই দেখো, পূর্বদিকে চেয়ে দেখো ভোর হয়ে আসছে। আর দেরি নেই -- তাঁর প্রাসাদের সোনার চূড়ার শিখর দেখা যাচ্ছে।
ঠাকুরদার প্রবেশ
ঠাকুরদার প্রবেশ
ঠাকুরদা।
ভোর হল, দিদি, ভোর হল।
সুদর্শনা।
তোমাদের আশীর্বাদে পৌঁছেছি।
ঠাকুরদা।
কিন্তু আমাদের রাজার রকম দেখেছ? রথ নেই, বাদ্য নেই, সমারোহ নেই।
সুদর্শনা।
বল কী, সমারোহ নেই? ওই যে আকাশ একেবারে রাঙা, ফুলগন্ধের অভ্যর্থনায় বাতাস একেবারে পরিপূর্ণ।
ঠাকুরদা।
তা হ'ক, আমাদের রাজা যত নিষ্ঠুর হ'ক আমরা তো তেমন কঠিন হতে পারি নে -- আমাদের যে ব্যথা লাগে। এই দীনবেশে তুমি রাজভবনে যাচ্ছ, এ কি আমরা সহ্য করতে পারি? একটু দাঁড়াও, আমি ছুটে গিয়ে তোমার জন্যে রানীর বেশ নিয়ে আসি।
সুদর্শনা।
না না না। সে বেশ তিনি আমাকে চিরদিনের মতো ছাড়িয়েছেন -- সবার সামনে আমাকে দাসীর বেশ পরিয়েছেন -- বেঁচেছি বেঁচেছি -- আমি আজ তাঁর দাসী -- যে-কেউ তাঁর আছে, আমি আজ সকলের নিচে।
ঠাকুরদা।
শত্রুপক্ষ তোমার এ-দশা দেখে পরিহাস করবে, সেইটে আমাদের অসহ্য হয়।
সুদর্শনা।
শত্রুপক্ষের পরিহাস অক্ষয় হ'ক -- তারা আমার গায়ে ধুলো দিক। আজকের দিনের অভিসারে সেই ধুলোই আমার অঙ্গরাগ।
ঠাকুরদা।
এর উপরে আর কথা নেই। এখন আমাদের বসন্ত-উৎসবের শেষ খেলাটাই চলুক -- ফুলের রেণু এখন থাক, দক্ষিনে হাওয়ায় এবার ধুলো উড়িয়ে দিক। সকলে মিলে আজ ধূসর হয়ে প্রভুর কাছে যাব। গিয়ে দেখব তাঁর গায়েও ধুলো মাখা। তাঁকে বুঝি কেউ ছাড়ে, মনে করছ? যে পায় তাঁর গায়ে মুঠো মুঠো ধুলো দেয় যে।
বিক্রম।
ঠাকুরদা, তোমাদের এই ধুলোর খেলায় আমাকেও ভুলো না। আমার এই রাজবেশটাকে এমনি মাটি করে নিয়ে যেতে হবে যাতে একে আর চেনা না যায়
ঠাকুরদা।
সে আর দেরি হবে না ভাই। যেখানে নেবে এসেছ এখানে যত তোমার মিথ্যে মান সব ঘুচে গেছে -- এখন দেখতে দেখতে রং ফিরে যাবে। আর এই আমাদের রানীকে দেখো, ও নিজের উপর ভারি রাগ করেছিল --মনে করেছিল গয়না ফেলে দিয়ে নিজের ভুবনমোহন রূপকে লাঞ্ছনা দেবে, কিন্তু সে রূপ অপমানের আঘাতে আরও ফুটে পড়েছে -- সে যেন কোথাও আর কিছু ঢাকা নেই। আমাদের রাজাটির নিজের নাকি রূপের সম্পর্ক নেই তাই তো বিচিত্র রূপ সে এত ভালোবাসে, এই রূপই তো তার বক্ষের অলংকার। সেই রূপ আপন গর্বের আবরণ ঘুচিয়ে দিয়েছে -- আর আমার রাজার ঘরে কী সুরে যে এতক্ষণে বীণা বেজে উঠেছে, তাই শোনবার জন্যে প্রাণটা ছটফট করছে।
সুরঙ্গমা।
ওই যে সূর্য উঠল
[সকলের প্রস্থান
[সকলের প্রস্থান
গান
গান
সুদর্শনা।
প্রভু, যে আদর কেড়ে নিয়েছ সে আদর আর ফিরিয়ে দিয়ো না; আমি তোমার চরণের দাসী, আমাকে সেবার অধিকার দাও।
রাজা।
আমাকে সইতে পারবে?
সুদর্শনা।
পারব রাজা পারব। আমার প্রমোদবনে আমার রানীর ঘরে তোমাকে দেখতে চেয়েছিলুম -- সেখানে তোমার দাসের অধম দাসকেও তোমার চেয়ে চোখে সুন্দর ঠেকে। তোমাকে তেমন করে দেখবার তৃষ্ণা আমার একেবারে ঘুচে গেছে -- তুমি সুন্দর নও প্রভু সুন্দর নও, তুমি অনুপম।
রাজা।
তোমারই মধ্যে আমার উপমা আছে।
সুদর্শনা।
যদি থাকে তো সেও অনুপম।
রাজা।
আজ এই অন্ধকার ঘরের দ্বার একেবারে খুলে দিলুম -- এখানকার লীলা শেষ হল। এস, এবার আমার সঙ্গে এস, বাইরে চলে এস-- আলোয়।
সুদর্শনা।
যাবার আগে আমার অন্ধকারের প্রভুকে আমার নিষ্ঠুরকে আমার ভয়ানককে প্রণাম করে নিই।
[প্রস্থান
[প্রস্থান
।
গান
অরূপ বীণা রূপের আড়ালে লুকিয়ে বাজে,
সে বীণা আজি উঠিল বাজি' হৃদয়মাঝে॥
ভুবন আমার ভরিল সুরে,
ভেদ ঘুচে যায় নিকটে দূরে,
সেই রাগিণী লেগেছে আমার সকল কাজে॥
হাতে পাওয়ার চোখে চাওয়ার সকল বাঁধন,
গেল কেটে আজ সফল হল সকল কাঁদন।
সুরের রসে হারিয়ে যাওয়া
সেই তো দেখা সেই তো পাওয়া,
বিরহ মিলন মিলে গেল আজ সমান সাজে॥