আশু ও অন্নদা
অন্নদা।
তোমার ঐ টাটকা লঙ্কার ধোঁয়ায় নাকের জলে চোখের জলে করলে যে হে! তোমার ঘরে আসা ছাড়তে হল।
আশু।
টাটকা লঙ্কার ধোঁয়া তুমি কোথায় পেলে?
অন্নদা।
ঐ যে তোমার তর্কালংকারের বকুনি। লোকটা তো বিস্তর টিকি নাড়লে, মাথামুণ্ডু কিছু পেলে কি?
আশু।
মাথামুণ্ডু নইলে শুধু টিকি নড়বে কোথায়? কথাগুলো যদি শ্রদ্ধা করে শুনতে, তবে বুঝতে।
অন্নদা।
যদি বুঝতেম, তবে শ্রদ্ধা করেতম। তুমি আশু, ফিজিকাল সায়ান্সে এম| এ| দিয়ে এলে-- তুমি যে এত ঘন ঘন টিকি-নাড়া বরদাস্ত করছ এ যদি দেখতে পায় তবে প্রেসিডেন্সি কলেজের চূনকাম-করা দেওয়ালগুলো বিনি-খরচে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। আজ কথাটা কী হল বুঝিয়ে বলো দেখি।
আশু।
পণ্ডিতমশায় পরিণয়তত্ত্ব ব্যাখ্যা করছিলেন।
অন্নদা।
তত্ত্বট আমার জানা খুব দরকার হয়ে পড়েছে। তর্কালংকারমশায় বলছিলেন, বিবাহের পূর্বে কন্যার সঙ্গে জানাশুনার চেষ্টা না করাই কর্তব্য। যুক্তিটা কী দিচ্ছিলেন, ভালো বোঝা গেল না।
আশু।
তিনি বলছিলেন, সকল জিনিসের আরম্ভের মধ্যে একটা গোপনতা আছে। বীজ মাটির নীচে অন্ধকারের মধ্যে থাকে, তার পরে অঙ্কুরিত হলে তখন সূর্য-চন্দ্র-জল-বাতাসের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করবার সময় আসে। বিবাহের পূর্বে কন্যার হৃদয়কে বিলাতি অনুকরণে বাইরে টানাটানি না করে তাকে আচ্ছন্ন আবৃত রাখাই কর্তব্য। তখন তার উপরে তাড়াতাড়ি দৃষ্টিক্ষেপ করতে যেয়ো না। সে যখন স্বভাবতই নিজে অঙ্কুরিত হয়ে তার অর্ধমুকুলিত সলজ্জ দৃষ্টিটুকু গোপনে তোমার দিকে অগ্রসর করতে থাকবে, তখনই তোমার অবসর।
অন্নদা।
আমার অদৃষ্টে সে পরীক্ষা তো হয়ে গেছে। বিলাতি প্রথা মতে বিবাহের পূর্বে কন্যার হৃদয় নিয়ে টানা-হেঁচড়া করি নি; হৃদয়টা এত অন্ধকারের মধ্যে ছিল যে আমি তার কোনো খোঁজ পাই নি, তার পরে অঙ্কুরিত হল কি না হল তারও তো কোনো ঠিকানা পেলেম না। এবারে উলটোরকম পরীক্ষা করতে চলেছি, এবার আগে হৃদয়, তার পরে অন্য কথা।
আশু।
পরীক্ষার দিন কবে?
অন্নদা।
কাল।
আশু।
স্থান?
অন্নদা।
উনপঞ্চাশ নম্বর রাম বৈরাগীর গলি।
আশু।
নম্বরটা তো ভালো শোনাচ্ছে না।
অন্নদা।
কেন? উনপঞ্চাশ বায়ুর কথা ভাবছ? সে আমাকে টলাতে পারবে না-- তুমি হলে বিপদ ঘটত।
আশু।
পাত্র?
অন্নদা।
কন্যার বিধবা মা তাকে পশ্চিম থেকে সঙ্গে করে এনেছে। আমি ঘটককে বলে রেখেছি যে ভালো করে মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করে নিয়ে তবে বিবাহের কথা হবে।
আশু।
কিন্তু অন্নদা, শেষকালে বহুবিবাহে প্রবৃত্ত হলে?
অন্নদা।
তোমাদের মতো আমি নাম দেখে ভড়কাই নে।
আশু।
তবু একটা প্রিন্সিপ্ল্ আছে তো? বহুবিবাহকে বহুবিবাহ বলতেই হবে।
অন্নদা।
আমার নামমাত্র স্ত্রী যেখানে আছে প্রিন্সিপ্ল্ও সেইখানে আছে। সে স্ত্রীও আসছে না, প্রিন্সিপ্ল্ও রইল; অতএব এখন আমি ডঙ্কা মেরে বহুবিবাহ করব, প্রিন্সিপ্ল্জুজুকে ডরাব না।
রাধাচরণের প্রবেশ
রাধাচরণের প্রবেশ
রাধাচরণ।
আশুবাবু!
আশু।
কী হে রাধে?
রাধাচরণ।
সেদিন আপনি আমার সঙ্গে মন্ত্র নিয়ে তর্ক করলেন--এক-একটা শব্দের যে এক-এক-প্রকার বিশেষ ক্ষমতা আছে, আমার বোধ হল আপনি যেন তা সম্পূর্ণ বিশ্বার করেন না।
অন্নদা।
বল কী রাধে? তা হলে আশুর অবিশ্বাস করবার ক্ষমতা এখনো সম্পূর্ণ লোপ হয় নি! এখনো দুটো-একটা জায়গায় ঠেকছে!-- শব্দের মধ্যে শক্তি আছে, এ কথা বাঙালির ছেলে বিশ্বাস কর না!
রাধাচরণ।
বলুন তো অন্নদাবাবু! তা হলে মারণ, উচাটন, বশীকরণ-- এগুলো কি বেবাক গাঁজাখুরি!
অন্নদা।
তাও কি কখনো হয়? সংসারে কি এত গাঁজার চাষ হতে পারে?
রাধাচরণ।
পশ্চিম থেকে একজন যোগসিদ্ধ মাতাজি এসেছেন। শুনেছি তিনি মন্ত্রের বল একেবারে প্রত্যক্ষ দেখিয়ে দিতে পারেন। দেখতে গিয়েছিলেম, কিন্তু সকলকে তিনি দেখা দেন না; বলেছেন, যোগ্য লোক পেলে তাকে তিনি তাঁর সমস্ত বিদ্যে দেখিয়ে দেবেন। আশুবাবু, আপনি চেষ্টা করলে নিশ্চয় বিফল হবেন না।
আশু।
তিনি থাকেন কোথায়?
রাধাচরণ।
বাইশ নম্বর ভেড়াতলায়।
অন্নদা।
বাইশ নম্বরটা উনপঞ্চাশের চেয়ে ভালো হতে পারে, কিন্তু জায়গাটা ভালো ঠেকছে না। একে বশীকরণ-বিদ্যে, তার উপরে ভেড়াতলা। মাতাজির কাছে মুণ্ডুজিটি খুইয়ে এসো না।
আশু।
আরে ছি! কী বক তার ঠিক নেই। তাঁরা হলেন সাধু স্ত্রীলোক, সেখানে মুণ্ডুর ভাবনা ভাবতে হয় না। তুমি বুঝেসুঝে উনপঞ্চাশে পা বাড়িয়ো।
অন্নদা।
তুমি ভাবছ বাইশ একেবারেই নির্বিষ। তা নয় হে। বিশেষ উপরের দুই মাত্রা চড়িয়ে তবে বাইশ। আপাদমস্তক জর্জর হয়ে ফিরবে।
অগ্রহায়ণ, ১৩০৮ শিলাইদহ