বাইশ নম্বরে কন্যার বিধবা মাতা শ্যামাসুন্দরী

বাইশ নম্বরে কন্যার বিধবা মাতা শ্যামাসুন্দরী

শ্যামা।

পেলেগ শুনে ভয়ে বাঁচি নে। তাড়াতাড়ি করে পালিয়ে তো এলুম। কিন্তু অন্নদা বলে ছেলেটির আজ যে সেই উনপঞ্চাশ নম্বরে আসবার কথা আছে, সে কি সেখান থেকে চিনে ঠিক এখানে আসতে পারবে! এত ক'রে খাওয়াদাওয়ার জোগাড় করলেম, সব মাটি হবে না তো! যে তাড়াটা লাগালে, একবার খবর দেবার সময় দিলে না। ঘটক বলেছে, ছেলেটি আমার নিরুপমাকে ভালো করে দেখে-শুনে নিতে চায়, ওর পড়াশুনো গান-বাজনা সব পরীক্ষা করবে-- তা করুক। কর্তা তো নিরুপমাকে সেইরকম করেই শিখিয়েছেন। বরাবর পশ্চিমে ছিলেন, আমাদের কখনো তো বন্ধ করে রাখেন নি। তবু কলকাতার ছেলে কী রকম জানি নে। ভয় হয়, আমাদের ধরন-ধারণ দেখে হয়তো অভদ্র মনে করবে। তারা মেয়ের সঙ্গে শেক্‌হ্যাণ্ড করে না কি, কে জানে! হয়তো ইংরেজিতে গুড্‌মর্নিং বলে! শুনেছি তাদের নিজের হাতে চুরুট জ্বালিয়ে দিতে হয়-- এ-সব তো পারব না। ঘটক বললে,ছেলেটি হ্যাট-কোট পরে। আমার মেয়ে আবার ফিরিঙ্গির সাজ দু চক্ষে দেখতে পারে না। কী রকম যে হবে, বুঝতে পারছি নে। মন্ত্র পড়ে বিয়ে করতে রাজি হবে তো?

ভৃত্যের প্রবেশ

ভৃত্যের প্রবেশ

ভৃত্য।

মাঠাকরুন, একটি বাবু এসেছেন। আমি তাঁকে বললেম বাড়িতে পুরুষ-মানুষ কেউ নেই। তিনি বললেন, তিনি মার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছেন।

শ্যামা।

তবে ঠিক হয়েছে। সেই ছেলেটি এসেছে। ডেকে নিয়ে আয়। (ভৃত্যের প্রস্থান) ভয় হচ্ছে-- কলকাতার ছেলে, তার সঙ্গে কিরকম করে চলতে হবে! কী জানোয়ারই মনে করবে!

আশুর প্রবেশ

আশুর প্রবেশ

[ শ্যামাসুন্দরীর পায়ের কাছে একটি গিনি রাখিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম

[ শ্যামাসুন্দরীর পায়ের কাছে একটি গিনি রাখিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম

শ্যামা।

(স্বগত) এ যে প্রণামী দিয়ে প্রণাম করলে গো! এ তো শেক্‌হ্যাণ্ড করে না। বাঁচালে! লক্ষ্মী ছেলে! কেমন ধুতিচাদর পরে এসেছে!

আশু।

মাতাজি, আমাকে যে আপনি দর্শন দেবেন, এ আমি আশা করি নি। বড়ো অনুগ্রহ করেছেন।

শ্যামা।

(সস্নেহে সপুলকে) কেন বাবা, তুমি আমার ছেলের মতো, তোমাকে দেখা দিতে দোষ কী!

আশু।

স্নেহ রাখবেন। আশীর্বাদ করবেন, এই অনুগ্রহ থেকে কখনো বঞ্চিত না হই।

শ্যামা।

বাবা, তোমার কথা শুনে আমার কান জুড়োল, আমি নিশ্চয়ই অনেক তপস্যা করেছিলেম, তাই--

আশু।

মাতাজি, আপনি তপস্যার দ্বারা যে নিরুপমা-সম্পদ লাভ করেছেন, আমাকে তার--

শ্যামা।

তোমাকে দেবার জন্যেই তো প্রস্তুত হয়ে এসেছি। অনেক সন্ধান করে যোগ্যপাত্র পেয়েছি, এখন দিতে পারলেই তো নিশ্চিন্ত হই।

আশু।

(শ্যামার পদধূলি লইয়া) মাতাজি, আমাকে কৃতার্থ করলেন; এত সহজেই যে ফললাভ করব, এ আমি স্বপ্নেও জানতুম না।

শ্যামা।

বল কী বাবা, তোমার আগ্রহ যত আমার আগ্রহ তার চেয়ে বেশি।

আশু।

তা হলে যে কামনা করে এসেছিলেম, আজ কি তার কিছু পরিচয়--

শ্যামা।

পরিচয় হবে বৈকি বাবা, আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই।

আশু।

আপত্তি নেই মাতাজি? শুনে বড়ো আরাম পেলেম--

শ্যামা।

দেখাশুনা সমস্তই হবে বাবা, আগে কিছু খেয়ে নাও।

আশু।

আবার খাওয়া! আপনি আমাকে যথার্থ জননীর মতোই স্নেহ দেখালেন।

শ্যামা।

তুমিও আমাকে মার মতোই দেখবে, এই আমার প্রাণের ইচ্ছা। আমার তো ছেলে নেই, তুমিই আমার ছেলের মতো থাকবে।

আহার্য লইয়া ভৃত্যের প্রবেশ

আহার্য লইয়া ভৃত্যের প্রবেশ

আশু।

করেছেন কী! এত আয়োজন!

শ্যামা।

আয়োজন আর কি করলেম? আজই ঠিক আসতে পারবে কি না মনে একটু সন্দেহ ছিল-- তাই--

আশু।

সন্দেহ ছিল? আপনি কি জানতেন আমি আসব?

শ্যামা।

তা জানতেম বৈকি।

আশু।

(আত্মগত) কী আশ্চর্য! আমাকে না জেনেই আমার জন্যে পূর্ব হতেই অপেক্ষা করছিলেন? তবু অন্নদা যোগবলে বিশ্বাস করে না! তাকে বললে বোধ হয় ঠাট্টা করেই উড়িয়ে দেবে।

[ আহারে প্রবৃত্ত

[ আহারে প্রবৃত্ত

শ্যামা।

(আত্মগত) ছেলেটি সোনার টুকরো। যেমন কার্তিকের মতো দেখতে তেমনি মধু-ঢালা কথা। আমাকে প্রথম থেকেই মাতাজি বলে ডাকছে। পশ্চিম থেকে এসেছি কিনা,তাই বোধ হয় মা না বলে মাতাজি বলছে। (প্রকাশ্যে) কিছুই খেলে না যে বাবা!

আশু।

আমার যা সাধ্য, তার চেয়ে বরঞ্চ বেশিই খেয়েছি মাতাজি।

শ্যামা।

তা হলে একটু বোসো আমি ডেকে নিয়ে আসি।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

আশু।

রাধে বলেছিল বটে, মাতাজি কুমারী কন্যার দ্বারা মন্ত্রের ফল দেখিয়ে থাকেন। বশীকরণ-বিদ্যায় আমার একটু বিশ্বাস জন্মাচ্ছে। এরই মধ্যে মাতাজির মাতৃস্নেহে আমার চিত্ত কেমন যেন আর্দ্র হয়ে এসেছে। আমার মা নেই, মনে হচ্ছে যেন মাকে পেলেম। এ কোন্‌ মন্ত্রবলে কে জানে! মাতাজি স্নিগ্ধ দৃষ্টিদ্বারা আমার সমস্ত শরীর যেন অভিষিক্ত করে দিয়েছেন। প্রথম দেখাতেই উনি যে আমাকে তাঁর পুত্রস্থানীয় করে নিয়েছেন, এ যেন পূর্বজন্মের একটা সম্বন্ধের স্মৃতি।

নিরুপমাকে লইয়া শ্যামার প্রবেশ

নিরুপমাকে লইয়া শ্যামার প্রবেশ

আশু।

(স্বগত) আহা, কী সুন্দর! মাতাজির বশীকরণ-বিদ্যা যেন মূর্তিমতী! এঁর মুখে কোনো মন্ত্রই বিফল হতে পারে না।

শ্যামা।

যাও, লজ্জা কোরো না মা! উনি যা জিজ্ঞাসা করেন উত্তর দিয়ো।

আশু।

লজ্জা করবেন না। মাতাজি আমার প্রতি যেরকম অনুগ্রহ প্রকাশ করেছেন, আপনিও আমাকে আপনার লোকের মতোই দেখবেন। (আত্মগত) মেয়েটি কী লাজুক! আমার কথা শুনে আরো যেন লাল হয়ে উঠল।

শ্যামা।

বাবা, তোমার ইচ্ছামত ওকে জিজ্ঞাসাপত্র করো।

আশু।

আপনার কোন্‌ কোন্‌ বিদ্যায় অধিকার আছে, জানতে উৎসুক হয়ে আছি।

শ্যামা।

বয়স অল্প, বিদ্যা কতই বা বেশি হবে-- তবে--

আশু।

যত অল্পই হোক মাতাজি, আমাদের মতো লোকের পক্ষে যথেষ্ট হবে।

শ্যামা।

(আত্মগত) বিদ্যার কোনো পরিচয় না পেয়েই যখন এত সন্তুষ্ট তখন মেয়েকে পছন্দ করেছে বলেই বোধ হচ্ছে। বাঁচা গেল, আমার বড়ো ভাবনা ছিল। (প্রকাশ্যে) নিরু, একটি গান শুনিয়ে দাও তো মা!

আশু।

গান! এ আমার আশার অতীত। আপনি বোধ হয় পূর্বে থেকেই জানেন, গানের চেয়ে আমি কিছুই ভালোবাসি নে। (স্বগত) অন্নদার মতো এতবড়ো সন্দেহী, সে থাকলে আজ যোগের বল প্রত্যক্ষ করতে পারত। (প্রকাশ্যে নিরুপমার প্রতি) আপনারা আমাকে এক দিনেই চিরঋণী করেছেন, যদি গান করেন তবে বিক্রীত হয়ে থাকব।

নিরুপমার গান

নিরুপমার গান

আশু।

(স্বগত) আর মন্ত্রের দরকার নেই। বশীকরণের আর কী বাকি রইল! কন্যাটি দেবকন্যা। (প্রকাশ্যে) মাতাজি!

শ্যামা।

কী বাবা?

আশু।

আমাকে আপনার পুত্র করেই রাখবেন, এমন সুধাসংগীত শোনবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন না। যা পাওয়া গেল এই আমি পরম লাভ মনে করছি। মন্ত্রতন্ত্রের কথা ভুলেই গেছি। এখন বুঝতে পারছি, মন্ত্রের কোনো দরকার নেই।

শ্যামা।

অমন কথা বোলো না বাবা! মন্ত্রের দরকার আছে বৈকি। নইলে শাস্ত্রে--

আশু।

সে তো ঠিক কথা। মন্ত্র আমি অগ্রাহ্য করি নে। আমি বলছিলেম মন্ত্র পড়লেই যে মন বশ হয় তা নয়, গানের মোহিনী শক্তির কাছে কিছুই লাগে না। (স্বগত) মেয়েটি আবার লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। ভারি লাজুক!

শ্যামা।

(আত্মগত) ছেলেটি খুব ভালো। কিন্তু একটু যেন লজ্জা কম বলে বোধ হয়। মন বশ করার কথাগুলো শাশুড়ির সামনে না বললেই ভালো হত।

আশু।

কিন্তু আপনি বিরক্ত হবেন না, আমার যা মনে উদয় হচ্ছে আমি বলি, তার পরে--

শ্যামা।

তা বাবা, সে-সব কথা এখন থাক্‌। আগে--

আশু।

আমি বলছিলেম, গানে যে মন বশ হয় সেও তো শব্দমাত্র; মনের সঙ্গে তার যদি যোগ থাকে তা হলে মন্ত্রের শব্দশক্তিকেই বা না মানি কী বলে?

শ্যামা।

ঠিক কথা। মন্ত্রটা মানাই ভালো।

আশু।

(সোৎসাহে) আপনার কাছে এ-সব কথা বলা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা, কিন্তু শাব্দী শক্তির সঙ্গে আত্মার যে একটি নিগূঢ় যোগ আছে তার স্বরূপ নিরূপণ করা কঠিন, তর্কালঙ্কারমশায় বলেন সে অনির্বচনীয়। শাস্ত্রে যে বলে শব্দ ব্রহ্ম, তার কারণ কী? ব্রহ্মই যে শব্দ বা শব্দই সে ব্রহ্ম তা নয়; কিন্তু ব্রহ্মের ব্যবহারিক সত্তার মধ্যে শব্দস্বরূপেই ব্রহ্মের প্রকাশ যেন নিকটতম। (নিরুপমার প্রতি) আপনি তো এ সকল বিষয়ে অনেক আলোচনা করেছেন, আপনার কি মনে হয় না রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শের চেয়ে শব্দই যেন আমাদের আত্মার অব্যবহিত প্রত্যক্ষের বিষয়? সেইজন্যই এক আত্মার সঙ্গে আর-এক আত্মার মিলনসাধনের প্রধান উপায় শব্দ। আপনি কী বলেন? (স্বগত) মেয়েটি ভারি লাজুক!

শ্যামা।

বলো-না মা,যা জিজ্ঞাসা করছেন বলো। এত বিদ্যে শিখলে, এই কথাটার উত্তর দিতে পারছ না?-- বাবা, প্রথম দিন কিনা, তাই লজ্জা করছে। ও যে কিছু শেখে নি তা মনে কোরো না।

আশু।

ওঁর বিদ্যার উজ্জ্বলতা মুখশ্রীতেই প্রকাশ পাচ্ছে। আমি কিছুমাত্র সন্দেহ করছি নে।

শ্যামা ।

নিরু, মা, একবার ও ঘরে যাও তো।

[নিরুপমার প্রস্থান

দেখো বাবা, মেয়েটির বাপ নেই, সকল কথা আমাকেই কইতে হচ্ছে, তুমি কিছু মনে কোরো না।

আশু।

মনে করব! বলেন কী! আপনার কথা শুনতেই তো এসেছিলেম-- বাচালের মতো কেবল নিজেই কতকগুলো বকে গেলেম। আমাকে মাপ করবেন।

শ্যামা।

তোমার যদি মত থাকে তা হলে একটা দিনস্থির করতে হচ্ছে তো?

আশু।

(স্বগত) আমি ভেবেছিলেম, আজই সমস্ত হয়ে যাবে। কিন্তু আজ বৃহস্পতি বার, তাই বোধ হয় হল না। (প্রকাশ্যে) তা, আসছে রবিবারেই যদি স্থির করেন?

শ্যামা।

বল কী বাবা? আজ বৃহস্পতিবার, মাঝে তো কেবল দুটো দিন আছে।

আশু।

এর জন্যে কি অনেক আয়োজনের দরকার হবে?

শ্যামা।

তা হবে বৈকি বাবা; যথাসাধ্য করতে হবে। তা ছাড়া, পাঁজি দেখে একটা শুভদিন স্থির করতে হবে তো।

আশু।

তা বটে, শুভদিন দেখতে হবে বৈকি। আসল কথা, যথা শীঘ্র হয়। আমার যেরকম আগ্রহ, ইচ্ছে হচ্ছে, এই মুহূর্তেই--

শ্যামা।

তা, আমি অনর্থক দেরি করব না বাবা! আসছে অঘ্রান মাসেই হয়ে যাবে। মেয়েটিরও বিবাহযোগ্য বয়স হয়ে এসেছে, ওকেও তো আর রাখা যাবে না।

আশু।

ওঁর বিবাহ হয়ে গেলেই বুঝি--

শ্যামা।

তা হলে আবার আমি কাশীতে ফিরে যেতে পারি।

আশু।

তাহলে তার আগেই আমাদের--

শ্যামা।

সব ঠিক করে নিতে হবে।

আশু।

তবে দিনক্ষণ দেখুন।

শ্যামা।

তুমি তো রাজি আছ বাবা?

আশু।

বিলক্ষণ! রাজি যদি না থাকব তো এখানে এলেম কেন! আপনাকে নিয়ে কি আমি পরিহাস করছি! আমার সেরকম স্বভাব নয়। আমি এখনকার ছেলেদের মতো এ-সকল বিষয় নিয়ে তামাশা করি নে।

শ্যামা।

তোমার আর মত বদলাবে না?

আশু।

কিছুতেই না। আপনার পদস্পর্শ করে আমি বলছি, আপনার কাছ থেকে যা সংগ্রহ করতে এসেছি তা আমি গ্রহণ করে তবে নিরস্ত হব।

শ্যামা।

দেওয়া-থোওয়ার কথা কিছু হল না যে।

আশু।

আপনি কী চান বলুন।

শ্যামা।

আমি কী চাইব বাবা? তুমি কী চাও, সেইটে বলো।

আশু।

আমি কেবল বিদ্যে চাই, আর কিছু চাই নে।

শ্যামা ।

(স্বগত) ছেলেটি কিন্তু বেহায়া, তা বলতেই হবে! ছি ছি ছি, বিদ্যেসুন্দরের কথা আমার কাছে পাড়লে কী করে! আমার নিরুকে বলে কিনা বিদ্যে! (প্রকাশ্যে) তা হলে পানপাত্রটার কথা কী বল বাবা?

আশু।

(স্বগত) পানপাত্র! এঁর দেখছি সমস্তই শাক্তমতে। এ দিকে কুমারী কন্যা, তার পরে আবার পানপাত্র! এইটে আমার ভালো ঠেকছে না। (প্রকাশ্যে) তা, মাতাজি, আপনি কিছু মনে করবেন না-- অবশ্য যে কাজের যা অঙ্গ তা করতেই হয়-- কিন্তু ঐ-যে পানপাত্রের কথা বললেন, ওটা তো আমার দ্বারা হবে না।

শ্যামা।

বাবা, তোমরা একালের ছেলে, তোমরা ওটাকে অসভ্যতা মনে কর, কিন্তু আমি তো ওতে কোনো দোষ দেখি নে--

আশু।

আপনি ওতে কোনো দোষই দেখেন না! বলেন কী মাতাজি!

শ্যামা।

তা, নাহয় পানপাত্র রইল, ওর জন্যে কিছু আটকাবে না, এখন বিবাহের কথা তো পাকা?

আশু।

কার বিবাহের কথা?

শ্যামা।

তুমি আমাকে অবাক করলে বাপু! এতক্ষণ কথাবার্তার পর জিজ্ঞাসা করছ কার বিবাহের কথা! তোমারই তো বিবাহের কথা হচ্ছিল; কেবল পানপাত্রের কথা শুনেই তুমি চমকে উঠলে। তা, পানপাত্র নাহয় নাই হল।

আশু।

(হতবুদ্ধিভাবে) ও, হাঁ, তা বুঝেছি, তাই হচ্ছিল বটে! (স্বগত) মস্ত একটা কী ভুল হয়ে গেছে। না বুঝে একেবারে জড়িয়ে পড়েছি। কী করা যায়! (প্রকাশ্যে) কিন্তু, এত তাড়াতাড়ি কিসের, আর-এক দিন এ-সব কথা খোলসা করে আলোচনা করা যাবে। কী বলেন?

শ্যামা।

খোলসার আর কী বাকি রেখেছ বাবা! আর-একদিন এর চেয়ে আর কত খোলসা হবে! তাড়াতাড়ি তো তুমিই করছিলে। আসছে রবিবারেই তুমি দিন স্থির করতে চেয়েছিলে।

আশু।

তা চেয়েছিলেম বটে।

শ্যামা।

তুমি দেখাশুনা করতে চাইলে বলেই আমি মেয়েকে তোমার সাক্ষাতে বের করলুম, তার গানও শুনলে, এখন পানপাত্রের কথা শুনেই যদি বেঁকে দাঁড়াও তা হলে তো আমার আর মুখ দেখাবার জো থাকবে না। তোমাকেই বা লোকে কী বলবে বাবা! ভদ্রলোকের মেয়ের সঙ্গে এমন ব্যবহার কি ভালো! আমার নিরু তোমার কাছে কী দোষ করেছিল যে--

[ক্রন্দন

[ক্রন্দন

নিরুপমার দ্রুত প্রবেশ

নিরুপমার দ্রুত প্রবেশ

নিরুপমা।

মা, কী হয়েছে মা, অমন করে কাঁদছ কেন!

আশু।

(স্বগত) কী সর্বনাশ! আমাকে এঁরা সবাই কী মনে করবেন না-জানি! (প্রকাশ্যে) কিছুই হয় নি, আমি সমস্তই ঠিক করে দিচ্ছি। আপনারা কান্নাকাটি করবেন না। শুভকর্মে ওতে অমঙ্গল হয়। (শ্যামার প্রতি) তা, আপনি একটা দিন স্থির করে দিন, আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই।

শ্যামা।

তা বাবা, যদি ভালো দিন হয়, তা হলে তুমি যা বলেছিলে আসছে রবিবারেই হয়ে যাক। আমার আয়োজনে কাজ নেই। এই কটা দিন তোমার মত স্থির থাকলে বাঁচি।

আশু।

অমন কথা বলবেন না, আমার মতের কখনো নড়চড় হয় না।

শ্যামা।

আমার পা ছুঁয়ে তো তাই বলেওছিলে, কিন্তু দশ মিনিট না যেতেই এক পানপাত্রের কথা শুনেই তোমার মত বদলে গেল।

আশু।

তা বটে। পানপাত্রটা আমি আদবে পছন্দ করি না--

শ্যামা।

কেন বলো তো বাবা?

আশু।

তা ঠিক বলতে পারছি নে-- ঐ আমার কেমন-- বোধ হয়, ওটা-- কী জানেন, পানপাত্রটা যেন-- কে জানে ও কথাটাই কেমন-- হঠাৎ শুনলে কী যেন-- তা, এই বাড়িটার নম্বর কী বলুন দেখি।

শ্যামা।

ওঃ, তাই বুঝি ভাবছ? আমরা তোমাকে ভাঁড়াচ্ছি নে বাবা। আমরাই উনপঞ্চাশ নম্বরে ছিলুম, কাল এই বাইশ নম্বরে উঠে এসেছি। যদি মনে কোনো সন্দেহ থাকে, উনপঞ্চাশ নম্বরে বরঞ্চ একবার খোঁজ করে আসতে পারো।

আশু।

(স্বগত) উঃ, কী ভুলই করেছি! যা হোক, এখন একটা পরিত্রাণের রাস্তা পাওয়া গেছে। অন্নদাকে এনে দিলেই সমস্ত গোল মিটে যাবে। যা হোক, অন্নদার অদৃষ্ট ভালো। এক-একবার মনে হচ্ছে, ভুলটা শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলে মন্দ হয় না।

শ্যামা।

কী বাবা? এত ভাবছ কেন? আমরা ভদ্রঘরের মেয়ে, তোমাকে ঠকাবার জন্যে পশ্চিম থেকে এখেনে আসি নি।

আশু।

ও কথা বলবেন না, আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। এখন আমি যাচ্ছি, এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসব, আজকের দিনের মধ্যেই একটা সন্তোষজনক বন্দোবস্ত করবই-- এ আমি আপনার পা ছুঁয়ে শপথ করে যাচ্ছি।

শ্যামা।

বাবা, ও শপথে কাজ নেই-- পা ছুঁয়ে আরো একবার শপথ করেছিলে--

আশু।

আচ্ছা, আমি আমার ইষ্টদেবতার শপথ করে যাচ্ছি, আজকের মধ্যেই সমস্ত পাকা করে তবে অন্য কথা।

শ্যামা।

(স্বগত) ছেলেটি কথাবার্তায় বেশ, কিন্তু ওকে কিছুই বুঝবার জো নেই। কখনো-বা তাড়া দেয়, কখনো-বা ঢিল দেয়, অথচ মুখ দেখে ওর প্রতি অবিশ্বাসও হয় না।

আশু।

তবে অনুমতি করেন তো এখন আসি।

শ্যামা।

তা, এসো বাবা।

[ প্রণাম করিয়া আশুর প্রস্থান

[ প্রণাম করিয়া আশুর প্রস্থান

অগ্রহায়ণ, ১৩০৮ শিলাইদহ
1 | 2 | 3 | 4 | 5