অন্নদা
অন্নদা।
ব্যাপারখানা তো কিছুই বুঝতে পারলেম না। ঘটকের কথা শুনে এলেম কন্যা দেখতে। যিনি দেখা দিলেন, তাঁকে তো বয়স দেখে কোনোমতেই কন্যার মা বলে মনে হয় না, চেহারা দেখে বোধ হল অপ্সরী-- যদিচ অপ্সরীর চেহারা কিরকম পূর্বে কখনো দেখি নি। শেক্হ্যাণ্ড করতে যেমনি হাত বাড়িয়ে দিয়েছি অমনি ফস্ করে আমার হাতে কড়ি-বাঁধা একগাছি লাল সুতো বেঁধে দিলে। আর-কেউ হলে গোলমাল করতেম; কিন্তু যে সুন্দর চেহারা,গোলমাল করবার জো কী! কিন্তু, এ-সমস্ত কোন্দেশী দস্তুর তা তো বুঝতে পারছি নে।
মাতাজির প্রবেশ
মাতাজির প্রবেশ
মাতাজি।
(স্বগত) অনেক সন্ধান করে তবে পেয়েছি। আগে আমার গুরুদত্ত বশীকরণ-মন্ত্রটা খাটাই, তার পরে পরিচয় দেব। (অন্নদার কপালে নরকপাল ঠেকাইয়া)
বলো, হুর্লিং।
অন্নদা।
হুর্লিং।
মাতাজি।
(অন্নদার গলায় জবার মালা পরাইয়া) বলো, কুড়বং কড়বং ক্ড়াং।
অন্নদা।
(স্বগত) ছি ছি! ভারি হাস্যকর হয়ে উঠছে। একে আমার কোটের উপর জবার মালা, তার উপরে আবার এই অদ্ভূত শব্দগুলো উচ্চারণ!
মাতাজি।
চুপ করে রইলে যে?
অন্নদা।
বলছি। কী বলছিলেন বলুন।
মাতাজি।
কুড়বং কড়বং ক্ড়াং।
অন্নদা।
কুড়বং কড়বং ক্ড়াং। (স্বগত) রিডিক্লাস!
মাতাজি।
মাথাটা নিচু করো। কপালে সিঁদুর দিতে হবে।
অন্নদা।
সিঁদুর! সিঁদুর কি এই বেশে আমাকে ঠিক মানাবে?
মাতাজি।
তা জানি নে, কিন্তু ওটা দিতে হবে। (অন্নদার কপালে সিঁদুর-লেপন
অন্নদা।
ইস! সমস্ত কপালে যে একেবারে লেপে দিলেন!
মাতাজি।
বলো বজ্রযোগিন্যৈ নমঃ। (অন্নদার অনুরূপ আবৃত্তি) প্রণাম করো।
(অন্নদাকর্তৃক তথাকৃত) বলো কুড়বে কড়বে নমঃ। প্রণাম করো। বলো হুর্লিঙে ঘুর্লিঙে নমঃ। প্রণাম করো।
অন্নদা।
(স্বগত) প্রহসনটা ক্রমেই জমে উঠছে।
মাতাজি।
এইবার মাতা বজ্রযোগিনীর এই প্রসাদী বস্ত্রখণ্ডও মাথায় বাঁধো।
অন্নদা।
(স্বগত) এই শালুর টুকরোটা মাথায় বাঁধতে হবে! ক্রমেই যে বাড়াবাড়ি হতে চলল। (প্রকাশ্যে) দেখুন, এর চেয়ে বরঞ্চ আমি পাগড়ি পরতেও রাজি আছি, এমন-কি, বাঙলিবাবুরা যে টুপি পরে তাও পরতে পারি--
মাতাজি।
সে-সমস্ত পরে হবে, আপাতত এইটে জড়িয়ে দিই।
অন্নদা।
দিন।
মাতাজি।
এইবারে এই পিঁড়িটাতে বসুন।
অন্নদা।
(স্বগত) মুশকিলে ফেললে। আমি আবার ট্রাউজার পরে এসেছি!
যাই হোক, কোনোমতে বসতেই হবে। (উপবেশন
মাতাজি।
চোখ বোজো। বলো, খটকারিণী হঠবারিণী ঘটসারিণী নটতারিণী ক্রং। প্রণাম করো। (অন্নদার তথাকরণ) কিছু দেখতে পাচ্ছ?
অন্নদা।
কিচ্ছু না।
মাতাজি।
আচ্ছা, তা হলে পুবমুখো হয়ে বোসো, ডান কানে হাত দাও। বলো, খটকারিণী হঠবারিণী ঘটসারিণী নটতারিণী ক্রং। প্রণাম করো। এবার কিছু দেখতে পাচ্ছ?
অন্নদা।
কিছু না।
মাতাজি।
আচ্ছা, তা হলে পিছন ফিরে বোসো। দুই কানে দুই হাত দাও। বলো, খটকারিণী হঠবারিণী ঘটসারিণী নটতারিণী ক্রং। কিছু দেখতে পাচ্ছ?
অন্নদা।
কী দেখতে পাওয়া উচিত, আগে আমাকে বলুন।
মাতাজি।
একটা গর্দভ দেখতে পাচ্ছ তো?
অন্নদা।
পাচ্ছি বৈকি! অত্যন্ত নিকটেই দেখতে পাচ্ছি।
মাতাজি।
তবে মন্ত্র ফলেছে। তার পিঠের উপরে--
অন্নদা।
হাঁ হাঁ, তার পিঠের উপরে একজনকে দেখতে পাচ্ছি বৈকি।
মাতাজি।
গর্দভের দুই কান হাতে চেপে ধরে--
অন্নদা।
ঠিক বলেছেন, কষে চেপে ধরেছে--
মাতাজি।
একটি সুন্দরী কন্যা--
অন্নদা।
পরমা সুন্দরী--
মাতাজি।
ঈশানকোণের দিকে চলেছেন--
অন্নদা।
দিক্ভ্রম হয়ে গেছে, কোন্ কোণে যাচ্ছেন তা ঠিক বলতে পারছি নে। কিছু ছুটিয়ে চলেছেন বটে! গাধাটার হাঁফ ধরে গেল।
মাতাজি।
ছুটিয়ে যাচ্ছেন না কি? তবে তো আর-একবার--
অন্নদা।
না না, ছুটিয়ে যাবেন কেন-- কিরকম যাওয়াটা আপনি স্থির করছেন বলুন দেখি।
মাতাজি।
একবার এগিয়ে যাচ্ছেন, আবার পিছু হটে পিছিয়ে আসছেন।
অন্নদা।
ঠিক তাই। এগোচ্ছেন আর পিছোচ্ছেন। গাধাটার জিভ বেরিয়ে পড়েছে।
মাতাজি।
তা হলে ঠিক হয়েছে। এবার সময় হল। ওলো মাতঙ্গিনী, তোরা সবাই আয়।
হুলুধ্বনি-শঙ্খধ্বনি করিতে করিতে স্ত্রীদলের প্রবেশ
অন্নদার বামে মাতাজির উপবেশন ও তাহার হস্তে হস্তস্থাপন
অন্নদা।
এটা বেশ লাগছে। কিন্তু ব্যাপারটা কী ঠিক বুঝতে পারছি নে।
রমণীগণের গান
রমণীগণের গান
অন্নদা।
বুদ্ধি-বিচার একেবারেই যায় নি। অতি সামন্যই বাকি আছে। তার থেকে মনে হচ্ছে, ঐ-যে যাকে জন্তু জানোয়ার বলা হল সে সৌভাগ্যশালী আমি ছাড়া, উপস্থিত ক্ষেত্রে, আর কেউ হতেই পারে না। গানটি ভালো, সুরটিও বেশ, কন্ঠস্বরেরও নিন্দা করা যায় না, কিন্তু রূপক ভেঙে সাদা ভাষায় একটু স্পষ্ট করে সবটা খুলে বলুন দেখি-- আমার সম্বন্ধে আপনারা কী করতে চান? পালাব এমন আশঙ্কা করবেন না, আপনারা তাড়া দিলেও নয়। কিন্তু কোথায় এলুম, কেন এলুম, কোথায় যাব, এ-সকল গুরুতর প্রশ্ন মানবমনে স্বভাবতই উদয় হয়ে থাকে।
মাতাজি।
তোমার স্ত্রীকে কি মাঝে মাঝে স্মরণ কর?
অন্নদা।
করে লাভ কী, কেবল সময় নষ্ট। তাঁকে স্মরণ করে যেটুকু সুখ আপনাদের দর্শন করে তার চেয়ে ঢের বেশি আনন্দ।
মাতাজি।
তোমার স্ত্রী যদি তোমাকে স্মরণ করে সময় নষ্ট করেন?
অন্নদা।
তা হলে তাঁর প্রতি আমার উপদেশ এই যে, আর অধিক নষ্ট করা উচিত হয় না; হয় বিস্মরণ করতে আরম্ভ করুন নয় দর্শন দিন-- সময়টা মূল্যবান জিনিস।
মাতাজি।
সেই উপদেশই শিরোধার্য। আমিই তোমার সেবিকা শ্রীমতী মহীমোহিনী দেবী
অন্নদা।
বাঁচালে! মনে যেরকম ভাবোদ্রেক করেছিলে, নিজের স্ত্রী না হলে গলায় দড়ি দিতে হত। কিন্তু নিজের স্বামীর জন্য এ-সমস্ত ব্যাপার কেন?
মাতাজি।
গুরুর কাছে যে বশীকরণ-মন্ত্র শিখেছিলেম আগে সেইটে প্রয়াগ করে তবে আত্মপরিচয় দিলেম, এখন আর তোমর নিস্কৃতি নেই।
অন্নদা।
আর-কারো উপর এ মন্ত্রের পরীক্ষা করা হয়েছে?
মাতাজি।
না, তোমার জন্যই এতদিন এ মন্ত্র ধারণ করে রেখেছিলেম। আজ এর আশ্চর্য প্রত্যক্ষ ফল পেয়ে গুরুর চরণে মনে মনে শতবার প্রমাণ করছি। অব্যর্থ মন্ত্র। মন্ত্রে তোমার কি বিশ্বাস হল না?
অন্নদা।
বশীকরণের কথা অস্বীকার করতে পারি নে। এখন তোমাকে একবার এই মন্ত্রগুলো পড়িয়ে নিতে পারলে আমি নিশ্চিন্ত হই।
(দাসীকর্তৃক সম্মুখে আহার্য-স্থাপন)
এও বশীকরণের অঙ্গ। বন্যমৃগই হোক আর শহুরে গাধাই হোক পোষ মানাবার পক্ষে এটা খুব দরকারি।
আহারে প্রবৃত্ত
আহারে প্রবৃত্ত
আশুর দ্রুত প্রবেশ
আশুর দ্রুত প্রবেশ
[মাতাজি প্রভৃতির প্রস্থান
[মাতাজি প্রভৃতির প্রস্থান
আশু।
ওহে অন্নদা, ভারি গোলমাল বেধে গেছে। বাঃ, তুমি যে দিব্যি আহার করতে বসেছে! তোমার এ কী রকমের সাজ! (উচ্চহাস্য) ব্যাপারখানা কী? নর-মুণ্ড, খাঁড়া, বাতি, জবার মালা! তোমার বলিদান হবে নাকি?
অন্নদা।
হয়ে গেছে।
আশু।
হয়ে গেছে কী রকম?
অন্নদা।
সে-সকল ব্যাখ্যা পরে করব। তোমার খবরটা আগে বলো।
আশু।
তুমি বিবাহের জন্য যে কন্যাটিকে দেখবে বলে স্থির করেছিলে, তাঁরা হঠাৎ উনপঞ্চাশ নম্বর থেকে বাইশ নম্বরে উঠে গেছেন। আমি কন্যার বিধবা মাকে মাতাজি মনে করে বারবার এমন নির্বোধের মতো কথাবার্তা কয়ে গেছি যে, তাঁরা ঠিক করে নিয়েছেন, আমি মেয়েটিকে বিবাহ করতে সম্মত হয়েছি। এখন তুমি না গেলে তো আর উদ্ধার নেই।
অন্নদা।
মেয়েটি দেখতে কেমন?
আশু।
দেবকন্যার মতো।
অন্নদা।
তা হোক, বহুবিবাহ আমার মতবিরুদ্ধ।
আশু।
বল কী! সেদিন এত তর্ক করলে--
অন্নদা।
সেদিনকার চেয়ে ঢের ভালো যুক্তি আজ পাওয়া গেছে--
আশু।
একেবারে অখণ্ডনীয়?
অন্নদা।
অখণ্ডনীয়।
আশু।
যুক্তিটা কিরকম দেখা যাক।
অন্নদা।
তবে একটু বোসো। (প্রস্থান ও মাতাজিকে লইয়া প্রবেশ) ইনি আমার স্ত্রী শ্রীমতী মহীমোহিনী দেবী।
আশু।
অ্যাঁ! ইনি তোমার--আপনি আমাদের অন্নদার--কী আশ্চর্য! তা হলে তো হতে পারে না!
অন্নদা।
হতে পারে না কী বলছ? হয়েছে, আবার হতে পারে না কী? একবার হয়েছে, এই আবার দুবার হল| তুমি বলছ হতে পারে না!
আশু।
না, আমি তা বলছি নে। আমি বলছি, সেই বাইশ নম্বরের কী করা যায়!
অন্নদা।
সে আর শক্ত কী! সহজ উপায় আছে।
আশু।
কী বলো দেখি।
অন্নদা ।
বিয়ে করে ফেলো।
আশু।
সমস্ত বিসর্জন দেব-- আমার হঠযোগ, প্রাণায়াম, মন্ত্রসাধন--
অন্নদা।
ভয় কী, তুমি যেগুলো ছাড়বে আমি সেগুলো গ্রহণ করব। সে যাই হোক, তোমার বশীকরণটা কিরকম হল?
আশু।
তা, নিতান্ত কম হয় নি। তোমার এই একটা ঠাট্টা করবার বিষয় হল।
অন্নদা।
আর ঠাট্টা চলবে না।
আশু।
কেন বলো দেখি।
অন্নদা।
আমারও বশীকরণ হয়ে গেছে।
আশু।
চললেম। এক ঘন্টার মধ্যেই যাবার কথা আছে। কথাটা পাকা করে আসি গে।
অগ্রহায়ণ, ১৩০৮ শিলাইদহ