মন্দির

রঘুপতি

মন্দির

রঘুপতি

রঘুপতি।

দেখো, দেখো, কী করে দাঁড়ায়ে আছে, জড়

পাষাণের স্তূপ, মূঢ় নির্বোধের মতো।

মূক, পঙ্গু, অন্ধ ও বধির! তোরি কাছে

সমস্ত ব্যথিত বিশ্ব কাঁদিয়া মরিছে!

পাষাণ চরণে তোর, মহৎ হৃদয়

আপনারে ভাঙিছে আছাড়ি। হা হা হা হা!

কোন্‌ দানবের এই ক্রূর পরিহাস

জগতের মাঝখানে রয়েছে বসিয়া।

মা বলিয়া ডাকে যত জীব, হাসে তত

ঘোরতর অট্টহাস্যে নির্দয় বিদ্রূপ।

দে ফিরায়ে জয়সিংহে মোর! দে ফিরায়ে!

দে ফিরায়ে রাক্ষসী পিশাচী!

নাড়া দিয়া

শুনিতে কি

পাস? আছে কর্ণ? জানিস কী করেছিস?

কার রক্ত করেছিস পান? কোন্‌ পুণ্য

জীবনের? কোন্‌ স্নেহদয়াপ্রীতি-ভরা

মহা হৃদয়ের?

থাক্‌ তুই চিরকাল

এইমতো--এই মন্দিরের সিংহাসনে,

সরল ভক্তির প্রতি গুপ্ত উপহাস!

দিব তোর পূজা প্রতিদিন, পদতলে

করিব প্রণাম, দয়াময়ী মা বলিয়া

ডাকিব তোমারে। তোর পরিচয় কারো

কাছে নাহি প্রকাশিব, শুধু ফিরায়ে দে

মোর জয়সিংহে! কার কাছে কাঁদিতেছি!

তবে দূর, দূর, দূর, দূর করে দাও

হৃদয়দলনী পাষাণীরে। লঘু হোক

জগতের বক্ষ।

দূরে গোমতীর জলে প্রতিমা-নিক্ষেপ

মশাল লইয়া বাদ্য বাজাইয়া

গুণবতীর প্রবেশ

দূরে গোমতীর জলে প্রতিমা-নিক্ষেপ

মশাল লইয়া বাদ্য বাজাইয়া

গুণবতীর প্রবেশ

গুণবতী।

জয় জয় মহাদেবী।

দেবী কই?

রঘুপতি।

দেবী নাই।

গুণবতী।

ফিরাও দেবীরে

গুরুদেব, এনে দাও তাঁরে, রোষ শান্তি

করিব তাঁহার। আনিয়াছি মার পূজা।

রাজ্য পতি সব ছেড়ে পালিয়াছি শুধু

প্রতিজ্ঞা আমার। দয়া করো, দয়া করে

দেবীরে ফিরায়ে আনো শুধু, আজি এই

এক রাত্রি তরে। কোথা দেবী?

রঘুপতি।

কোথাও সে

নাই। ঊর্ধ্বে নাই, নিম্নে নাই, কোথাও সে

নাই, কোথাও সে ছিল না কখনো।

গুণবতী।

প্রভু,

এইখানে ছিল না কি দেবী?

রঘুপতি।

দেবী বল

তারে? এ সংসারে কোথাও থাকিত দেবী,

তবে সেই পিশাচীরে দেবী বলা কভু

সহ্য কি করিত দেবী? মহত্ত্ব কি তবে

ফেলিত নিষ্ফল রক্ত হৃদয় বিদারি

মূঢ় পাষাণের পদে? দেবী বল তারে?

পুণ্যরক্ত পান ক'রে সে মহারাক্ষসী

ফেটে মরে গেছে।

গুণবতী।

গুরুদেব, বধিয়ো না

মোরে। সত্য করে বলো আরবার। দেবী

নাই?

রঘুপতি।

নাই।

গুণবতী।

দেবী নাই?

রঘুপতি।

নাই।

গুণবতী।

দেবী নাই?

তবে কে রয়েছে?

রঘুপতি।

কেহ নাই। কিছু নাই।

গুণবতী।

নিয়ে যা, নিয়ে যা পূজা! ফিরে যা, ফিরে যা!

বল্‌ শীঘ্র কোন্‌ পথে গেছে মহারাজ।

অপর্ণার প্রবেশ

অপর্ণার প্রবেশ

অপর্ণা।

পিতা!

রঘুপতি।

জননী, জননী, জননী আমার!

পিতা! এ তো নহে ভৎর্সনার নাম। পিতা!

মা জননী, এ পুত্রঘাতীরে পিতা ব'লে

যে জন ডাকিত, সেই রেখে গেছে ওই

সুধামাখা নাম তোর কণ্ঠে, এইটুকু

দয়া করে গেছে। আহা, ডাক আরবার!

অপর্ণা।

পিতা, এস এ মন্দির ছেড়ে যাই মোরা।

পুষ্প-অর্ঘ্য লইয়া

গোবিন্দমাণিক্যের প্রবেশ

পুষ্প-অর্ঘ্য লইয়া

গোবিন্দমাণিক্যের প্রবেশ

গোবিন্দমাণিক্য।

দেবী কই?

রঘুপতি।

দেবী নাই।

গোবিন্দমাণিক্য।

একি রক্তধারা!

রঘুপতি।

এই শেষ পুণ্যরক্ত এ পাপ-মন্দিরে।

জয়সিংহ নিবায়েছে নিজ রক্ত দিয়ে

হিংসারক্তশিখা।

গোবিন্দমাণিক্য।

ধন্য ধন্য জয়সিংহ,

এ পূজার পুষ্পাঞ্জলি সঁপিনু তোমারে।

গুণবতী।

মহারাজ!

গোবিন্দমাণিক্য।

প্রিয়তমে!

গুণবতী।

আজ দেবী নাই--

তুমি মোর একমাত্র রয়েছ দেবতা।

[ প্রণাম

[ প্রণাম

গোবিন্দমাণিক্য।

গেছে পাপ। দেবী আজ এসেছে ফিরিয়া

আমার দেবীর মাঝে।

অপর্ণা।

পিতা চলে এস!

রঘুপতি।

পাষাণ ভাঙিয়া গেল--জননী আমার

এবারে দিয়েছে দেখা প্রত্যক্ষ প্রতিমা!

জননী অমৃতময়ী!

অপর্ণা।

পিতা, চলে এস!
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7