মন্দির
জয়সিংহ
রঘুপতির প্রবেশ
জয়সিংহ
রঘুপতির প্রবেশ
পা ধুইবার জল প্রভৃতি অগ্রসর করিয়া
পা ধুইবার জল প্রভৃতি অগ্রসর করিয়া
জয়সিংহ।
গুরুদেব!
রঘুপতি।
যাও, যাও!
জয়সিংহ।
আনিয়াছি জল।
রঘুপতি।
থাক্, রেখে দাও জল।
জয়সিংহ।
বসন।
রঘুপতি।
কে চাহে
বসন!
জয়সিংহ।
অপরাধ করেছি কি?
রঘুপতি।
আবার?
কে নিয়েছে অপরাধ তব?--
ঘোর কলি
এসেছে ঘনায়ে। বাহুবল রাহুসম
ব্রহ্মতেজ গ্রাসিবারে চায়-- সিংহাসন
তোলে শির যজ্ঞবেদী-'পরে। হায় হায়,
কলির দেবতা তোমরাও চাটুকার
সভাসদ্সম, নতশিরে রাজ-আজ্ঞা
বহিতেছ? চতুর্ভুজা, চারি হস্ত আছ
জোড় করি! বৈকুণ্ঠ কি আবার নিয়েছে
কেড়ে দৈত্যগণ? গিয়েছে দেবতা যত
রসাতলে? শুধু, দানবে মানবে মিলে
বিশ্বের রাজত্ব দর্পে করিতেছে ভোগ?
দেবতা না যদি থাকে, ব্রাহ্মণ রয়েছে।
ব্রাহ্মণের রোষযজ্ঞে দণ্ড সিংহাসন
হবিকাষ্ঠ হবে।
জয়সিংহের নিকট গিয়া সস্নেহে
বৎস, আজ করিয়াছি
রুক্ষ আচরণ তোমা'-পরে-- চিত্ত বড়ো
ক্ষুব্ধ মোর।
জয়সিংহ।
কী হয়েছে প্রভু!
রঘুপতি।
কী হয়েছে!
শুধাও অপমানিত ত্রিপুরেশ্বরীরে।
এই মুখে কেমনে বলিব কী হয়েছে!
জয়সিংহ।
কে করেছে অপমান?
রঘুপতি।
গোবিন্দমাণিক্য।
জয়সিংহ।
গোবিন্দমাণিক্য! প্রভু, কারে অপমান?
রঘুপতি।
কারে! তুমি, আমি,সর্বশাস্ত্র, সর্বদেশ,
সর্বকাল, সর্বদেশকাল-অধিষ্ঠাত্রী
মহাকালী, সকলেরে করে অপমান
ক্ষুদ্র সিংহাসনে বসি। মা'র পূজা-বলি
নিষেধিল স্পর্ধাভারে।
জয়সিংহ।
গোবিন্দমাণিক্য!
রঘুপতি।
হাঁ গো, হাঁ, তোমার রাজা গোবিন্দমাণিক্য!
তোমার সকল-শ্রেষ্ঠ-- তোমার প্রাণের
অধীশ্বর! অকৃতজ্ঞ! পালন করিনু
এত যত্নে স্নেহে তোরে শিশুকাল হতে,
আমা-চেয়ে প্রিয়তর আজ তোর কাছে
গোবিন্দমাণিক্য?
জয়সিংহ।
প্রভু, পিতৃকোলে বসি
আকাশে বাড়ায় হাত ক্ষুদ্র মুগ্ধ শিশু
পূর্ণচন্দ্র-পানে-- দেব, তুমি পিতা মোর,
পূর্ণশশী মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য।
কিন্তু এ কী বকিতেছি! কী কথা শুনিনু!
মায়ের পূজার বলি নিষেধ করেছে
রাজা? এ আদেশ কে মানিবে?
রঘুপতি।
না মানিলে
নির্বাসন।
জয়সিংহ।
মাতৃপূজাহীন রাজ্য হতে
নির্বাসন দণ্ড নহে। এ প্রাণ থাকিতে
অসম্পূর্ণ নাহি রবে জননীর পূজা।
যার 'পরে রয়েছে যে ভার, বল তার
আছে সে কাজের। করিবই মা'র পূজা
যদি সত্য মায়ের সেবক হই মোরা।
চলো প্রভু, বাজাই মায়ের ডঙ্কা, ডেকে
আনি পুরবাসীগণে, মন্দিরের দ্বার
খুলে দিই।-- ওরে, আয় তোরা, আয়, আয়,
অভয়ার পূজা হবে-- নির্ভয়ে আয় রে
তোরা মায়ের সন্তান! আয় পুরবাসী!
[জয়সিংহ ও রঘুপতির প্রস্থান
পুরবাসীগণের প্রবেশ
অক্রুর।
ওরে, আয় রে আয়!
সকলে।
জয় মা!
হারু।
আয় রে,মায়ের সামনে বাহু তুলে নৃত্য করি।
রঘুপতি ও জয়সিংহের প্রবেশ
রঘুপতি।
শুনলুম সৈন্য আসছে। জয়সিংহ, অস্ত্র নিয়ে তুমি এইখানে দাঁড়াও। তোরা আয়, তোরা এইখানে দাঁড়া। মন্দিরের দ্বার আগলাতে হবে। আমি তোদের অস্ত্র এনে দিচ্ছি।
গণেশ।
অস্ত্র কেন ঠাকুর?
রঘুপতি।
মায়ের পুজো বন্ধ করবার জন্যে রাজা সৈন্য আসছে।
হারু।
সৈন্য আসছে! প্রভু, তবে আমরা প্রণাম হই।
সরোষে
সরোষে
রঘুপতি।
দাঁড়া তোরা!
করজোড়ে
করজোড়ে
জ|য়সিংহ।
যেতে দাও প্রভু-- প্রাণভয়ে ভীত এরা
বুদ্ধিহীন, আগে হতে রয়েছে মরিয়া।
আমি আছি মায়ের সৈনিক। এক দেহে
সহস্র সৈন্যের বল। অস্ত্র থাক্ পড়ে।
ভীরুদের যেতে দাও।
স্বগত
স্বগত
রঘুপতি।
সে কাল গিয়েছে।
অস্ত্র চাই, অস্ত্র চাই-- শুধু ভক্তি নয়।
প্রকাশ্যে
জয়সিংহ, তবে বলি আনো, করি পূজা।
বাহিরে বাদ্যেদ্যম
বাহিরে বাদ্যেদ্যম
জয়সিংহ।
সৈন্য নহে প্রভু, আসিছে রানীর পূজা।
রানীর অনুচর ও পুরবাসীগণের প্রবেশ
রানীর অনুচর ও পুরবাসীগণের প্রবেশ
সকলে।
ওরে, ভয়ে নেই-- সৈন্য কোথায়?-- মা'র পূজা আসছে।
হারু।
আমরা আছি খবর পেয়েছে, সৈন্যেরা শীঘ্র এ দিকে আসছে না।
কানু।
ঠাকুর, রানীমা পুজো পাঠিয়েছেন।
রঘুপতি।
জয়সিংহ, শীঘ্র পূজার আয়োজন করো।
[জয়সিংহের প্রস্থান
[জয়সিংহের প্রস্থান
পুরবাসীগণের নৃত্যগীত। গোবিন্দমাণিক্যের প্রবেশ
পুরবাসীগণের নৃত্যগীত। গোবিন্দমাণিক্যের প্রবেশ
গোবিন্দ।
চলে যাও হেথা হতে-- নিয়ে যাও বলি।
রঘুপতি, শোন নাই আদেশ আমার?
রঘুপতি।
শুনি নাই।
গোবিন্দ।
তবে তুমি এ রাজ্যের নহ।
রঘুপতি।
নহি আমি। আমি আছি যেথা, সেখা এলে
রাজদণ্ড খসে যায় রাজহস্ত হতে,
মুকুট ধুলায় পড়ে লুটে। কে আছিস,
আন মা'র পূজা।
বাদ্যোদ্যম
বাদ্যোদ্যম
গোবিন্দ।
চুপ কর্!
অনুচরের প্রতি
কোথা আছে
সেনাপতি, ডেকে আন্। হায় বঘুপতি,
অবশেষে সৈন্য দিয়ে ঘিরিতে হইল
ধর্ম! লজ্জা হয় ডাকিতে সৈনিকদল,
বাহুবল দুর্বলতা করায় স্মরণ।
রঘুপতি।
অবিশ্বাসী, সত্যই কি হয়েছে ধারণা
কলিযুগে ব্রহ্মতেজ গেছে-- তাই এত
দুঃসাহস? যায় নাই। যে দীপ্ত অনল
জ্বলিছে অন্তরে, সে তোমার সিংহাসনে
নিশ্চয় লাগিবে। নতুবা এ মনানলে
ছাই করে পুড়াইব সব শাস্ত্র, সব
ব্রহ্মগর্ব, সমস্ত তেত্রিশ কোটি মিথ্যা।
আজ নহে মহারাজ, রাজ-অধিরাজ,
এই দিন মনে কোরো আর-এক দিন।
জয়সিংহের প্রবেশ
জয়সিংহের প্রবেশ
জয়সিংহ।
আয়োজন
হয়েছে পূজার। প্রস্তুত রয়েছে বলি।
গোবিন্দ।
বলি কার তবে?
জয়সিংহ।
মহারাজ, তুমি হেথা!
তবে শোন নিবেদন-- একান্ত মিনতি
যুগলচরণতলে, প্রভু, ফিরে দাও
তব গর্বিত আদেশ। মানব হইয়া
দাঁড়ায়ো না দেবীরে আচ্ছন্ন করে--
রঘুপতি।
ধিক্
জয়সিংহ, ওঠো, ওঠো! চরণে পতিত
কার কাছে? আমি যার গুরু, এ সংসারে
এই পদতলে তার একমাত্র স্থান।
মূঢ়, ফিরে দেখ্-- গুরুর চরণ ধরে
ক্ষমা ভিক্ষা কর্। রাজার আদেশ নিয়ে
করিব দেবীর পূজা, করালকালিকা,
এত কি হয়েছে তো অধঃপাত! থাক্
পূজা, থাক্ বলি-- দেখিব রাজার দর্প
কতদিন থাকে। চলে এসো জয়সিংহ!
[রঘুপতি ও জয়সিংহের প্রস্থান
[রঘুপতি ও জয়সিংহের প্রস্থান
গোবিন্দ।
এ সংসারে বিনয় কোথায়? মহাদেবী,
যারা করে বিচরণ তব পদতলে
তারাও শেখে নি হায় কত ক্ষুদ্র তারা!
হরণ করিয়া লয়ে তোমার মহিমা
আপনার দেহে বহে, এত অহংকার!
[প্রস্থান
[প্রস্থান