মন্দির

রঘুপতি জয়সিংহ ও নক্ষত্ররায়

মন্দির

রঘুপতি জয়সিংহ ও নক্ষত্ররায়

নক্ষত্ররায়।

কী জন্য ডেকেছ গুরুদেব?

রঘুপতি।

কাল রাত্রে

স্বপন দিয়েছে দেবী, তুমি হবে রাজা।

নক্ষত্ররায়।

আমি হব রাজা! হা হা! বল কী ঠাকুর!

রাজা হব? এ কথা নূতন শোনা গেল!

রঘুপতি।

তুমি রাজা হবে।

নক্ষত্ররায়।

বিশ্বাস না হয় মোর।

রঘুপতি।

দেবীর স্বপন সত্য। রাজটিকা পারে

তুমি, নাহিকো সন্দেহ।

নক্ষত্ররায়।

নাহিকো সন্দেহ!---

কিন্তু, যদি নাই পাই?

রঘুপতি।

আমার কথায়

অবিশ্বাস!

নক্ষত্ররায়।

অবিশ্বাস কিছুমাত্র নেই,

কিন্তু দৈবাতের কথা-- যদি নাই হয়!

রঘুপতি।

অন্যথা হবে না কভু।

নক্ষত্ররায়।

অন্যথা হবে না?

দেখো প্রভু, কথা যেন ঠিক থাকে শেষে।

রাজা হয়ে মন্ত্রীটারে দেব দূর করে,

সর্বদাই দৃষ্টি তার রয়েছে পড়িয়া

আমা-'পরে, যেন সে বাপের পিতামহ।

বড়ো ভয় করি তারে-- বুঝেছ ঠাকুর?

তোমারে করিব মন্ত্রী।

রঘুপতি।

মন্ত্রিত্বের পদে

পদাঘাত করি আমি।

নক্ষত্ররায়।

আচ্ছা, জয়সিংহ

মন্ত্রী হবে। কিন্তু, হে ঠাকুর, সবই যদি

জানো তুমি, বলো দেখি কবে রাজা হব।

রঘুপতি।

রাজরক্ত চান দেবী।

নক্ষত্ররায়।

রাজরক্ত চান!

রঘুপতি।

রাজরক্ত আগে আনো, পরে রাজা হবে।

নক্ষত্ররায়।

পাব কোথা!

রঘুপতি।

ঘরে আছে গোবিন্দমাণিক্য।

তাঁরি রক্ত চাই।

নক্ষত্ররায়।

তাঁরি রক্ত চাই!

রঘুপতি।

স্থির

হয়ে থাকো জয়সিংহ, হোয়ো না চঞ্চল।--

বুঝেছ কি? শোনো তবে-- গোপনে তাঁহারে

বধ ক'রে, আনিবে সে তপ্ত রাজরক্ত

দেবীর চরণে।--

জয়সিংহ, স্থির যদি

না থাকিতে পারো, চলে যাও অন্য ঠাঁই--

বুঝেছ নক্ষত্ররায়? দেবীর আদেশ,

রাজরক্ত চাই-- শ্রাবণের শেষ রাত্রে।

তোমরা রয়েছ দুই রাজভ্রাতা-- জ্যেষ্ঠ

যদি অব্যাহতি পায়, তোমার শোণিত

আছে। তৃষিত হয়েছে যবে মহাকালী,

তখন সময় আর নাই বিচারের।

নক্ষত্ররায়।

সর্বনাশ! হে ঠাকুর, কাজ কী রাজত্বে!

রাজরক্ত থাক্‌ রাজদেহে, আমি যাহা

আছি সেই ভালো।

রঘুপতি।

মুক্তি নাই, মুক্তি নাই

কিছুতেই! রাজরক্ত আনিতেই হবে!

নক্ষত্ররায়।

বলে দাও, হে ঠাকুর কী করিতে হবে।

রঘুপতি।

প্রস্তুত হইয়া থাকো। যখন যা বলি

অবিলম্বে করিবে সাধন; কার্যসিদ্ধি

যতদিন নাহি হয়, বন্ধ রেখো মুখ।

এখন বিদায় হও।

নক্ষত্ররায়।

হে মা কাত্যায়নী!

[প্রস্থান

[প্রস্থান

জয়সিংহ।

একি শুনিলাম! দয়াময়ী মাতঃ, একি

কথা! তোর আজ্ঞা! ভাই দিয়ে ভ্রাতৃহত্যা!

বিশ্বের জননী!-- গুরুদেব! হেন আজ্ঞা

মাতৃ-আজ্ঞা ব'লে করিলে প্রচার!...

রঘুপতি।

বন্ধ হোক বলিদান

তবে

জয়সিংহ।

হোক বন্ধ।-- না না গুরুদেব, তুমি

জানো ভালোমন্দ। সরল ভক্তের বিধি

শাস্ত্রবিধি নহে। আপন আলোকে আঁখি

দেখিতে না পায়, আলোক আকাশ হতে

আসে। প্রভু, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো দাসে ;

ক্ষমা করো স্পর্ধা মূঢ়তার। ক্ষমা করো

নিতান্ত বেদনাবেশে উদ্‌ভ্রান্ত প্রলাপ।

বলো প্রভু, সত্যই কি রাজরক্ত চান

মহাদেবী?

রঘুপতি।

হায় বৎস, হায়! অবশেষে

অবিশ্বাস মোর প্রতি?

জয়সিংহ।

অবিশ্বাস! কভু

নহে। তোমারে ছাড়িলে, বিশ্বাস আমার

দাঁড়াবে কোথায়? বাসুকির শিরশ্চ্যুত

বসুধার মতো, শূন্য হতে শূন্যে পাবে

লোপ। রাজরক্ত চায় তবে মহামায়া,

সে রক্ত আনিব আমি। দিব না ঘটিতে

ভ্রাতৃহত্যা।

রঘুপতি।

দেবতার আজ্ঞা পাপ নহে।

জয়সিংহ।

পুণ্য তবে, আমিই সে করিব অর্জন।

রঘুপতি।

সত্য করে বলি, বৎস, তবে। তোরে আমি

ভালোবাসি প্রাণের অধিক-- পালিয়াছি

শিশুকাল হতে তোরে, মায়ের অধিক

স্নেহে-- তোরে আমি নারিব হারাতে।

জয়সিংহ।

মোর

স্নেহে ঘটিতে দিব না পাপ, অভিশাপ

আনিব না এ স্নেহের 'পরে।

রঘুপতি।

ভালো ভালো,

সে কথা হইবে পরে-- কল্য হবে স্থির।

[উভয়ের প্রস্থান

চাঁদপাল ও গোবিন্দমাণিক্যের প্রবেশ

চাঁদপাল ও গোবিন্দমাণিক্যের প্রবেশ

চাঁদপাল।

মহারাজ, সাবধানে থেকো। চারি দিকে

চক্ষুকর্ণ পেতে আছি, রাজ-ইষ্টানিষ্ট

কিছু না এড়ায় মোর কাছে। মহারাজ,

তব প্রাণহত্যা-তরে গুপ্ত আলোচনা

স্বকর্ণে শুনেছি।

গোবিন্দ।

প্রাণহত্যা! কে করিবে?

চাঁদপাল।

বলিতে সংকোচ মানি। ভয় হয়, পাছে

সত্যকার ছুরি চেয়ে নিষ্ঠুর সংবাদ

অধিক আঘাত করে রাজার হৃদয়ে।

গোবিন্দ।

অসংকোচে বলে যাও। রাজার হৃদয়

সতত প্রস্তুত থাকে আঘাত সহিতে।

কে করেছে হেন পরামর্শ।

চাঁদপাল।

যুবরাজ

নক্ষত্ররায়।

গোবিন্দ।

নক্ষত্র!

চাঁদপাল।

স্বকর্ণে শুনেছি

মহারাজ, রঘুপতি যুবরাজে মিলে

গোপনে মন্দিরে বসে স্থির হয়ে গেছে

সব কথা।

গোবিন্দ।

দুই দণ্ডে স্থির হয়ে গেল

আজন্মের বন্ধন টুটিতে! হায় বিধি!

চাঁদপাল।

দেবতার কাছে তব রক্ত এনে দেবে--

গোবিন্দ।

দেবতার কাছে! তবে আর নক্ষত্রের

নাই দোষ। জানিয়াছি, দেবতার নামে

মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ। ভয় নাই,

যাও তুমি কাজে। সাবধানে রব আমি।

[চাঁদপালের প্রস্থান

রক্ত নহে ফুল আনিয়াছি মহাদেবী!

ভক্তি শুধু-- হিংসা নহে, বিভীষিকা নহে।

এ জগতে দুর্বলেরা বড়ো অসহায়

মা জননী, বাহুবল বড়োই নিষ্ঠুর,

স্বার্থ বড়ো ক্রূর, লোভ বড়ো নিদারুণ,

অজ্ঞান একান্ত অন্ধ-- গর্ব চলে যায়

অকাতরে ক্ষুদ্রেরে দলিয়া পদতলে।

হেথা স্নেহ-প্রেম অতি ক্ষীণ বৃন্তে থাকে,

পলকে খসিয়া পড়ে স্বার্থের পরশে।

তুমিও জননী, যদি খড়গ উঠাইলে,

মেলিলে রসনা, তবে সব অন্ধকার!

ভাই তাই ভাই নহে আর, পতি প্রতি

সতী বাম, বন্ধু শত্রু, শোণিতে পঙ্কিল

মানবের বাসগৃহ, হিংসা পুণ্য, দয়া

নির্বাসিত। আর নহে, আর নহে, ছাড়ো

ছদ্মবেশ। এখনো কি হয় নি সময়?

এখনো কি রহিবে প্রলয়রূপ তব?

এই-যে উঠিছে খড়্গ চারি দিক হতে

মোর শির লক্ষ্য করি, মাতঃ, এ কি তোরি

চারি ভুজ হতে? তাই হবে! তবে তাই

হোক। বুঝি মোর রক্তপাতে হিংসানল

নিবে যাবে। ধরণীর সহিবে না এত

হিংসা। রাজহত্যা। ভাই দিয়ে ভ্রাতৃহত্যা!

সমস্ত প্রজার বুকে লাগিবে বেদনা,

সমস্ত ভায়ের প্রাণ উঠিবে কাঁদিয়া।

মোর রক্তে হিংসার ঘুচিবে মাতৃবেশ,

প্রকাশিবে রাক্ষসী-আকার। এই যদি

দয়ার বিধান তোর, তবে তাই হোক!

জয়সিংহের প্রবেশ

জয়সিংহের প্রবেশ

জয়সিংহ।

বল্‌ চণ্ডী, সত্যই কি রাজরক্ত চাই?

এই বেলা বল্‌, বল্‌ নিজমুখে, বল্‌

মানবভাষায় চল্‌ শীঘ্র-- সত্যই কি

রাজরক্ত চাই?

নেপথ্যে।

চাই।

জয়সিংহ।

তবে মহারাজ,

নাম লহো ইষ্টদেবতার। কাল তব

নিকটে এসেছে।

গোবিন্দ।

কী হয়েছে জয়সিংহ?

জয়সিংহ।

শুনিলে না নিজকর্ণে? দেবীরে শুধানু

সত্যই কি রাজরক্ত চাই-- দেবী নিজে

কহিলেন "চাই'।

গোবিন্দ।

দেবী নহে জয়সিংহ,

কহিলেন রঘুপতি অন্তরাল হতে,

পরিচিত স্বর।

জয়সিংহ।

কহিলেন রঘুপতি!

অন্তরাল হতে?-- নহে নহে, আর নহে!

কেবলই সংশয় হতে সংশয়ের মাঝে

নামিতে পারি নে আর! যখনি কূলের

কাছে আসি, কে মোরে ঠেলিয়া দেয় যেন

অতলের মাঝে! সে যে অবিশ্বাসদৈত্য!

আর নহে! গুরু হোক কিংবা দেবী হোক,

একই কথা।--

ছুরিকা উন্মোচন।.... ছুরি ফেলিয়া

ফুল নে মা। নে মা! ফুল নে মা!

পায়ে ধরি, শুধু ফুল নিয়ে হোক তোর

পরিতোষ! আর রক্ত না মা, আর রক্ত

নয়! এও যে রক্তের মতো রাঙা, দুটি

জবাফুল! পৃথিবীর মাতৃবক্ষ ফেটে

উঠিয়াছে ফুটে, সন্তানের রক্তপাতে

ব্যথিত ধরার স্নেহবেদনার মতো।

নিতে হবে! এই নিতে হবে! আমি

নাহি ডরি তোর রোষ। রক্ত নাহি দিব।

রাঙা তোর আঁখি ! তোল্‌ তোর খড়্গ! আন্‌

তোর শ্মশানের দল! আমি নাহি ডরি।

[গোবিন্দমাণিক্যের প্রস্থান

কী হল হায়! দেবী গুরু যাহা ছিল

এক দণ্ডে বিসর্জন দিনু-- বিশ্বমাঝে

কিছু রহিল না আর!

রঘুপতির প্রবেশ

রঘুপতির প্রবেশ

রঘুপতি।

সকল শুনেছি

আমি। সব পণ্ড হল। কী করিলি, ওরে

অকৃতজ্ঞ!

জয়সিংহ।

দণ্ড দাও প্রভু!

রঘুপতি।

সব ভেঙে

দিলি? ব্রহ্মশাপ ফিরাইলি অর্ধপথ

হতে! লঙ্ঘিলি গুরুর বাক্য! ব্যর্থ করে

দিলি দেবীর আদেশ! আপন বুদ্ধিরে

করিলি সকল হতে বড়ো! আজন্মের

স্নেহঋণ শুধিলি এমনি করে!

জয়সিংহ।

দণ্ড

দাও পিতা!

রঘুপতি।

কোন্‌ দণ্ড দিব?

জয়সিংহ।

প্রাণদণ্ড।

রঘুপতি।

নহে। তার চেয়ে গুরুদণ্ড চাই। স্পর্শ

কর্‌ দেবীর চরণ।

জয়সিংহ।

করিনু পরশ।

রঘুপতি।

বল্‌ তবে, "আমি এনে দিব রাজরক্ত

শ্রাবণের শেষ রাত্রে দেবীর চরণে।'

জয়সিংহ।

আমি এনে দিব রাজরক্ত, শ্রাবণের

শেষ রাত্রে দেবীর চরণে।

রঘুপতি।

চলে যাও।
1 | 2 | 3 | 4 | 5