দৃশ্য--অরণ্য। রুদ্রচণ্ড ও অমিয়া
রুদ্রচণ্ড।।
বার বার ক'রে আমি ব'লেছি, অমিয়া, তোরে
কবিতা আলাপ-তরে নহে এ কুটীর,
তবু তোরা বার বার মিছা কি প্রলাপ গাহি
বনের আঁধার চিন্তা দিস্ ভাঙ্গাইয়া!
পাতালের গূঢ়তম অন্ধতম অন্ধকার!
অধিকার কর' এর বালিকা-হৃদয়,
ও হৃদের সুখ আশা ও হৃদের উষালোক
মৃদুহাসি মৃদুভাব ফেল গো গ্রাসিয়া!
হিমাদ্রিপাষাণ চেয়ে গুরুভার মন মোর,
তেমনি উহার মন হোক গুরুভার!
হিমাদ্রিতুষার চেয়ে রক্তহীন প্রাণ মোর,
তেমনি কঠিন প্রাণ হউক উহার!
কুটীরের চারি দিকে ঘনঘোর গাছপালা
আঁধারে কুটীর মোর রেখেছে ডুবায়ে--
এই গাছে, কতবার দেখেছি, অমিয়া তুই,
লতিকা জড়ায়েছিস আপনার মনে--
ফুলন্ত লতিকা যত ছিঁড়িয়া ফেলেছি রোষে,
এ সকল ছেলেখেলা পারি নে দেখিতে!
আবার কহি রে তোরে, বসি চাঁদ কবি-সনে
এ অরণ্যে করিস নে কবিতা-আলাপ!
অমিয়া ।
যাহা যাহা বলিয়াছ সব শুনিয়াছি পিতা--
আর আমি আনমনে গাহি না ত গান,
আর আমি তরুদেহে জড়ায়ে দিই না লতা,
আর আমি ফুল তুলে গাঁথি না ত মালা!
কিন্তু পিতা, চাঁদ কবি, এত তারে ভালবাসি,
সে আমার আপনার ভায়ের মতন--
বল মোরে বল পিতা, কেন দেখিব না তারে!
কেন তার সাথে আমি কহিব না কথা!
সেকি পিতা? তারে তুমি দেখেছে ত কত বার,
তবু কি তাহারে তুমি ভালবাস নাই!
এমন মুরতি আহা, সে যেন দেবতা-সম,
এমন কে আছে তারে ভাল যে না বাসে!
এই যে আঁধার বন তার পদার্পণ হ'লে
এও যেন হেসে ওঠে মনের হরষে!
এই যে কুটীর, এও কোল বাড়াইয়া দেয়,
অভ্যর্থনা করে নি যে কোন অতিথিরে!
ভ্রূকুটি কোরো না পিতা, ওই ভ্রূকুটির ভয়ে
সমস্ত তোমার আজ্ঞা করেছি পালন।
পায়ে পড়ি ক্ষমা কর-- এই ভিক্ষা দাও পিতা,
এ ভালবাসায় মোর করিও না রোষ!
রুদ্রচণ্ড ।
মাতৃস্তন্য কেন তোর হয় নাই বিষ!
অথবা ভূমিষ্ঠশয্যা চিতাশয্যা তোর!
অমিয়া।
তাই যদি হ'ত, পিতা, বড় ভাল হ'ত!
কে জানে মনের মধ্যে কি হয়েছে মোর,
বরষার মেঘ যদি হইতাম আমি
বর্ষিয়া সহশ্রুধারে অশ্রুজলরাশি
বজ্রনাদে করিতাম আকুল বিলাপ!
আগে ত লাগিত ভালো জোছনার আলো,
ফুটন্ত ফুলের গুচ্ছ, বকুলতলাটি--
ভ্রূকুটির ভয়ে তব ডরিয়া ডরিয়া
তাহাদেরো 'পরে মোর জন্মেছে বিরাগ!
শুধু একজন আছে যার মুখ চেয়ে
বড়ই হরষে পিতা সব যাই ভুলে,
দূর হ'তে দেখি তারে আকুল হৃদয়
দেহ ছাড়ি তাড়াতাড়ি বাহিরিতে চায়!
সে আইলে তার কাছে যেতে দিও মোরে!
সে যে পিতা অমিয়ার আপনার ভাই!
রুদ্রচণ্ড ।
বটে বটে, সে তোমার আপনার ভাই!
শত তীক্ষণ বজ্র তার পড়ুক মস্তকে,
চিরজীবী হউক সে অগ্নিকুণ্ডমাঝে!
মুখ ঢাকিস নে তুই, শোন্ তোরে বলি,
পুনরায় যদি তোর আপনার ভাই--
চাঁদ কবি এ কাননে করে পদার্পণ
এই যে ছুরিকা আছে কলঙ্ক ইহার
তাহার উত্তপ্ত রক্তে করিব ক্ষালন!
অমিয়া ।
ও কথা বোল' না পিতা--
রুদ্রচণ্ড ।
চুপ্, শোন্ বলি;
জীবন্তে ছুরিকা দিয়া বিঁধিয়া বিঁধিয়া
শত খণ্ড করি তার ফেলিব শরীর,
পাণ্ডুবর্ণ আঁখি-মুদা ছিন্ন মুণ্ড তার
এই বৃক্ষশাখা-'পরে দিব টাঙ্গাইয়া,
ভিজিবে বর্ষার জলে, পুড়িবে তপনে
যতদিনে বাহিরিয়া না পড়ে কঙ্কাল!
শুনিয়া কাঁপিতেছিস, দেখিবি যখন
মস্তকের কেশ তোর উঠিবে শিহরি!
আপনার ভাই তোর! কে সে চাঁদ কবি!
হতভাগ্য পৃথ্বীরাজ, তারি সভাসদ!
সে পৃথ্বীরাজের হীন জীবন মরণ
এই ছুরিকার 'পরে রয়েছে ঝুলান'!
অমিয়া ।
থাম পিতা, থাম থাম, ও কথা বোলা না!
শত শত অভাগার শোণিতের ধারা
তোমার ছুরিকা ওই করিয়াছে পান,
তবুও-- তবুও ওর মিটে নি পিপাসা?
কত বিধবার আহা কত অনাথার
নিদারুণ মর্ম্মভেদী হাহাকারধ্বনি
তোমার নিষ্ঠুর কর্ণ করিয়াছে পান,
তবুও তবুও ওর মিটে নি কি তৃষা?
রুদ্রচণ্ড ।
[আপনার মনে]--
মিটে নাই! মিটে নাই! মোর নির্ব্বাসন!
রাজ্য ছিল, ধন ছিল, সব ছিল মোর,
আর কত শত আশা ছিল এই হৃদে--
রাজ্য গেল, ধন গেল, সব গেল মোর,
কূলে এসে ডুবে গেল যত আশা ছিল!
শুধু এই ছুরি আছে, আর এই হৃদি
আগ্নেয় গিরির চেয়ে জ্বলন্ত গহ্বর!
মোরে নির্ব্বাসন! হায়, কি বলিব প্রিথ্বী,--
এ নির্ব্বাসনের ধার শুধিতাম আমি
প্রিথ্বীতে থাকিত যদি এমন নরক
যন্ত্রণা জীবন যেথা এক নাম ধরে,
জীবননিদাঘে যেথা নাই মৃত্যুছায়া!
মোরে নির্ব্বাসন! কেন, কোন্ অপরাধে?
অপরাধ! শতবার লক্ষবার আমি
অপরাধ করি যদি কে সে পৃথ্বীরাজ!
বিচার করিতে তার কোন্ অধিকার!
নাহয় দুরাশা মোর করিতে সাধন
শত শত মানুষের লয়েছি মস্তক--
তুমি কর নাই? তোমার দুরাশাযজ্ঞে
লক্ষ মানবের রক্ত দাও নি আহুতি?
লক্ষ লক্ষ গ্রাম দেশ কর নি উচ্ছিন্ন?
লক্ষ লক্ষ রমণীরে কর নি বিধবা?
শুধু অভিমান তব তৃপ্ত করিবারে--
ভ্রাতা তব জয়চাঁদ, তার রাজ্য দেশ
ভূমিসাৎ করিতে কর নি আয়োজন?
প্রিথ্বীতেই তোমার কি হবে না বিচার?
নরকের অধিষ্ঠাতৃদেব, শুন তুমি,
এই বাহু যদি নাহি হয় গো অসাড়,
রক্তহীন যদি নাহি হয় এ ধমনী,
তবে এই ছুরিকাটি এই হস্তে ধরি
উরসে খোদিব তার মরণের পথ!
হৃদয় এমন মোর হয়েছে অধীর
পারি নে থাকিতে হেথা স্থির হ'য়ে আর!
চলিনু, অমিয়া, আমি-- তুই থাক্ হেথা,
চলিনু গুহায় আমি করিগে ভ্রমণ।
শোন্, শোন্, শোন্ বলি, মনে আছে তোর--
চাঁদ কবি পুনঃ যদি আসে এ কুটীরে
জীবন লইয়া আর যাবে না সে ফিরে!
[প্রস্থান
[প্রস্থান
অমিয়া।
বড় সাধ যায় এই নক্ষত্রমালিনী
স্তব্ধ যামিনীর সাথে মিশে যাই যদি!
মৃদুল সমীর এই, চাঁদের জোছনা,
নিশার ঘুমন্ত শান্তি, এর সাথে যদি
অমিয়ার এ জীবন যায় মিলাইয়া!
আঁধার ভ্রূকুটিময় এই এ কানন,
সঙ্কীর্ণহৃদয় অতি ক্ষুদ্র এ কুটীর,
ভ্রূকুটির সমুখেতে দিনরাত্রি বাস,
শাসন-শকুনি এক দিনরাত্রি যেন
মাথার উপরে আছে পাখা বিছাইয়া--
এমন ক'দিন আর কাটিবে জীবন!
থেকে থেকে প্রাণ উঠে কাঁদিয়া কাঁদিয়া!
পাখী যদি হইতাম,দু-দণ্ডের তরে
সুনীল আকাশে গিয়া ঊষার আলোকে
একবার প্রাণ ভ'রে দিতেম সাঁতার!
আহা, কোথা চাঁদ কবি, ভাই গো আমার!
এ রুদ্ধ অরণ্য-মাঝে তোমারে হেরিলে
দু-দণ্ড যে আপনারে ভুলে থাকি আমি!
(রুদ্রচণ্ডের প্রবেশ)
না-- না পিতা, পায়ে পড়ি, পারিব না তাহা,
আর কি তাহারে কভু দেখিতে দিবে না?
কোন্ অপরাধ আমি করেছি তোমার
অভাগীরে এত কষ্ট দিতেছ যা লাগি!
কে জানে বুকের মধ্যে কি যে করিতেছে!
দাও পিতা, ওই ছুরি বিঁধিয়া বিঁধিয়া
ভেঙ্গে ফেল যাতনার এ আবাসখানা!
ওই ছুরি কত শত বীরের শোণিতে
মাথা তার ডুবায়েছে হাসিয়া হাসিয়া,
ক্ষুদ্র এই বালিকার শোণিত বর্ষিতে
ও দারুণ ছুরি তব হবে না কুণ্ঠিত!
হেসো না অমন করি, পায়ে পড়ি তব,
ওর চেয়ে রোষদীপ্ত ভ্রূকুটিকুটিল
রুদ্র মুখপানে তব পারি নেহারিতে!
রুদ্রচণ্ড ।
ঘুমাগে ঘুমাগে তুই, অমিয়া, ঘুমাগে--
একটু রহিব একা, তাও কি দিবি না?
আজ আমি ঘুমাব না, একেলা হেথায়
ভ্রমিয়া ভ্রমিয়া রাত্রি করিব যাপন।
এনে দে কুঠার মোর, কাটিয়া পাদপ
এ দীর্ঘ সময় আমি দিব কাটাইয়া।
বিশ্রাম আমার কাছে দারুণ যন্ত্রণা।
বিশ্রাম, কালের প্রতি মুহূর্ত্ত যেমন
দংশন করিতে থাকে হৃদয় আমার।
মরুভূমিপথমাঝে পথিক যখন
দূর গম্যদেশে তার করিতে গমন
যত অগ্রসর হয়, দিগন্তবিস্তৃত
নব নব মরু যদি পড়ে দৃষ্টিপথে,
তাহার হৃদয় হয় যেমন অধীর,
তেমনি আমার সেই উদ্দেশ্যের মাঝে
প্রত্যেকে আমার সেই উদ্দেশ্যে মাঝে
প্রত্যেক মুহূর্ত্তকাল, প্রত্যেক নিমেষ
অস্থির করিয়া তুলে হৃদয় আমার!