চাঁদ কবি ও অমিয়ায
অরণ্য
চাঁদ কবি ও অমিয়ায
চাঁদ কবি ।
কেন লো অমিয়া, তোর কচি মুখখানি
অমন বিষণ্ন হেরি, অমন গম্ভীর?
আয়, কাছে আয়, বোন, শোন্ তোরে বলি,
গান শিখাইব ব'লে দুটি গান আমি
আপনি রচনা ক'রে এনেছি অমিয়া!
বনের পাখীটি তুই, গান গেয়ে গেয়ে
বেড়াইবি বনে বনে এই তোরে সাজে--
অমিয়া ।
চূপ কর, ওই বুঝি পদশব্দ শুনি!
বুঝি আসিছেন পিতা! না না, কেন নয়!
শোন ভাই, এ বনে এস না তুমি আর!
আসিবে না? তা তা' হলে কি অমিয়ার সাথে
আর দেখা হবে নাক? হবে না কি আর?
চাঁদ কবি ।
কি কথা বলিতেছিস, অমিয়া, বালিকা!
অমিয়া ।
পিতা যে কি বলেছেন, শোন নাই তাহা--
বড় ভয় হয় শুনে, প্রাণ কেঁপে ওঠে!
কাজ নাই ভাই, তুমি যাও হেথা হতে!
যেমন করিয়া হোক, কাটিবেক দিন--
অমিয়ার তরে, কবি, ভেবোনাক তুমি।
চাঁদ কবি ।
আমি গেলে বল্ দেখি, বোনটি আমার,
কার কাছে ছুটে যাবি মনে ব্যথা পেলে?
আমি গেলে এ অরণ্যে কে রহিবে তোর!
অমিয়া ।
কেহ না, কেহ না চাঁদ! আমি বলি ভাই,
পিতারে বুঝায়ে তুমি বোলো একবার!
বোলো তুমি অমিয়ারে ভালবাস বড়,
মাঝে মাঝে তারে তুমি আস দেখিবারে!
আর কিছু নয়, শুধু এই কথা বোলো!
তুমি যদি ভাল করে বলো বুঝাইয়া,
নিশ্চয় তোমার কথা রাখিবেন পিতা!
বলিবে?
চাঁদ কবি ।
বলিব বোন! ও কথা থাকুক্!--
সে দিন যে গান তোরে দেছিনু শিখায়ে,
সে গানটি ধীরে ধীরে গা' দেখি অমিয়া!
গান
রাগিণী--মিশ্র ললিত
গান
রাগিণী--মিশ্র ললিত
অমিয়া ।
বসন্তপ্রভাতে এক মালতীর ফুল
প্রথম মেলিল আঁখি তার,
চাহিয়া দেখিল চারি ধার।
সৌন্দর্য্যের বিন্দু সেই মালতীর চোখে
সহসা জগৎ প্রকাশিল,
প্রভাত সহসা বিভাসিল
বসন্তলাবণ্যে সাজি গো--
একি হর্ষ -- হর্ষ আজি গো!
উষারাণী দাঁড়াইয়া শিয়রে তাহার
দেখিছে ফুলের ঘুম-ভাঙা,
হরষে কপোল তাঁর রাঙা!
কুসুমভগিনীগণ চারি দিক হ'তে
আগ্রহে রয়েছে তারা চেয়ে,
কখন ফুটিবে চোখ ছোট বোনটির
জাগিবে সে কাননের মেয়ে।
আকাশ সুনীল আজি কিবা,
অরুণনয়নে হাস্যবিভা,
বিমল শিশিরধৌত তনু
হাসিছে কুসুমরাজি গো--
একি হর্ষ-- হর্ষ আজি গো!
মধুকর গান গেয়ে বলে,
"মধু কই, মধু দাও দাও!'
হরষে হৃদয় ফেটে গিয়ে
ফুল বলে, "এই লও লও!'
বায়ু আসি কহে কানে কানে,
"ফুলবালা,পরিমল দাও!'
আনন্দে কাঁদিয়া কহে ফুল,
"যাহা আছে সব লয়ে যাও!'
হরষ ধরে না তার চিতে,
আপনারে চায় বিলাইতে,
বালিকা আনন্দে কুটিকুটি,
পাতায় পাতায় পড়ে লুটি--
নূতন জগত দেখি রে
আজিকে হরষ একি রে!
অমিয়া ।
সত্য সত্য ফুল যবে মেলে আঁখি তার,
না জানি সে মনে মনে কি ভাবে তখন!
চাঁদ কবি ।
অমিয়া, তুই তা, বল্, বুঝিবি কেমনে!
তুই সুকুমার ফুল যখনি ফুটিলি,
যখনি মেলিলি আঁখি, দেখিলি চাহিয়া--
শুষ্ক জীর্ণ পত্রহীন অতি সুকঠোর
বজ্রাহত শাখা- 'পরে তোর বৃন্ত বাঁধা
একটিও নাই তোর কুসুমভগিনী,
আঁধার চৌদিক হতে আছে গ্রাস করি--
যেমনি মেলিলি আঁখি অমনি সভয়ে
মুদিতে চাহিলি বুঝি নয়নটি তোর।
না দেখিলি রবিকর, জোছনার আলো,
না শুনিলি পাখীদের প্রভাতের গান!
আহা বোন, তোরে দেখে বড় হয় মায়া!
মাঝে মাঝে ভাবি ব'সে কাজ-কর্ম ভুলি,
"এতক্ষণে অমিয়া একেলা বসে আছে,
বিশাল আঁধার বনে কেহ তার নাই!'
অমনি ছুটিয়া আসি দেখিবারে তোরে!
আরেকটি গান তোরে শিখাইব আজি,
মন দিয়ে শোন্ দেখি অমিয়া আমার!
গান
রাগিণী-- মিশ্র গৌড়-সারঙ্গ
তরুতলে ছিন্নবৃন্ত মালতীর ফুল
মুদিয়া আসিছে আঁখি তার,
চাহিয়া দেখিল চারি ধার।
শুষ্ক তৃণরাশি-মাঝে একেলা পড়িয়া,
চারি দিকে কেহ নাই আর।
নিরদয় অসীম সংসার।
কে আছে গো দিবে তার তৃষিত অধরে
এক বিন্দু শিশিরের কণা?
কেহ না-- কেহ না!
মধুকর কাছে এসে বলে,
"মধু কই, মধু চাই চাই।'
ধীরে ধীরে নিশ্বাস ফেলিয়া
ফুল বলে, "কিছু নাই নাই।'
"ফুলবালা, পরিমল দাও'
বায়ু আসি কহিতেছে কাছে।
মলিন বদন ফিরাইয়া
ফুল বলে, "আর কিবা আছে!'
মধ্যাহ্নকিরণ চারি দিকে
খর দৃষ্টে চেয়ে অনিমিখে,
ফুলটির মৃদু প্রাণ হায়
ধীরে ধীরে শুকাইয়া যায়।
অমিয়া ।
ওই আসিছেন পিতা, লুকাও লুকাও,
পায়ে পড়ি-- লুকাও লুকাও এই বেলা,
একটি আমার কথা রাখ চাঁদ কবি!
সময় নাইক আর-- ওই আসিছেন,
কি হবে? কি হবে ভাই? কোথা লুকাইবে?
[ রুদ্রচণ্ডের প্রবেশ ]
পিতা, পিতা, ক্ষমা কর, ক্ষমা কর মোরে;
আপনি এসেছি আমি চাঁদ কবি-কাছে,
চাঁদের কি দোষ তাহে বল পিতা, বল!
এসেছিনু, কিছুতেই পারি নি থাকিতে--
নিজে এসেছিনু আমি, চাঁদের কি দোষ?
রুদ্রচণ্ড ।
অভাগিনী!
চাঁদ কবি ।
রুদ্রচণ্ড, শোন মোর কথা।
অমিয়া ।
থাম চাঁদ, কোন কথা বোলো না পিতারে,
থাম থাম।
চাঁদ কবি ।
রুদ্রচণ্ড, শোন মোর কথা!
অমিয়া ।
পিতা, পিতা, এই পায়ে পড়িলাম আমি,
যাহা ইচ্ছা কর তাই এখনি-- এখনি।
চেয়ো না চাঁদের পানে অমন করিয়া।
চাঁদ কবি ।
দাঁড়ানু কৃপাণ এই পরশ করিয়া--
সূর্য্যদেব, সাক্ষী রহ, আমি চাঁদ কবি
আজ হতে অমিয়ার হনু পিতা মাতা।
তোর সাথে অমিয়ার সমস্ত বন্ধন
এ মুহূর্ত্ত হতে আজ ছিন্ন হয়ে গেল।
মোর অমিয়ার কেশ স্পর্শ কর যদি
রুদ্রচণ্ড, তোর দিন ফুরাইবে ভবে!
[অমিয়ার মূর্চ্ছিত হইয়া পতন
উভয়ের দ্বন্দ্বযুদ্ধ ও রুদ্রচণ্ডের পতন]
[অমিয়ার মূর্চ্ছিত হইয়া পতন
উভয়ের দ্বন্দ্বযুদ্ধ ও রুদ্রচণ্ডের পতন]
রুদ্রচণ্ড।
সম্বর সম্বর অসি, থাম চাঁদ, থাম!
কি! হাসিছ বুঝি! বুঝি ভাবিতেছ মনে,
মরণেরে ভর করি আমি রুদ্রচণ্ড!
জানিস নে মরণের ব্যবসায়ী আমি!
জীবন মাগিতে হ'ল তোর কাছে আজ
শত বার মৃত্যু এই হইল আমার!
রুদ্রচণ্ড যে মুহূর্ত্তে ভিক্ষা মাগিয়াছে
রুদ্রচণ্ড সে মুহূর্ত্তে গিয়াছে মরিয়া!
আজ আমি মৃত সে রুদ্রের নাম লয়ে
কেবল শরীর তার, কহিতেছি তোরে--
এখনো জীবনে মোর আছে প্রয়োজন!
এখনো-- এখনো আছে! এখনো আমার
সঙ্কল্প রয়েছে হ'য়ে দারুণ তৃষিত!
রুদ্রচণ্ড তোর কাছে ভিক্ষা মাগিতেছে
আর কি চাহিস চাঁদ? দিবি মোরে প্রাণ?
[অশ্বারোহী দূতের প্রবেশ
চাঁদ কবির প্রতি]
[অশ্বারোহী দূতের প্রবেশ
চাঁদ কবির প্রতি]
দূত ।
মহাশয়, আসিতেছি রাজসভা হতে!
নিমেষ ফেলিতে আর নাই অবসর!
প্রতি মুহূর্ত্তের 'পরে অতি ক্ষীণ সূত্রে
রাজত্বের শুভাশুভ করিছে নির্ভর!
প্রশ্নোত্তর করিবার নাইক সময়!
[সত্বর উভয়ের প্রস্থান
[সত্বর উভয়ের প্রস্থান